শুক্রবার, ৩ ফেব্রুয়ারী, ২০১২

বাংলাদেশে আইনের শাসন ভেঙে পড়েছে


বাংলাদেশে দুর্নীতি-হত্যাকাণ্ডসহ হাজার রকম অপরাধের মাত্রা দৌড় দিয়ে বাড়তে থাকার মূল কারণ এখানে এখন আইনের শাসন বলে আর কিছু নেই। বেড়া যেখানে ধান খায়, রক্ষক যেখানে ভক্ষক, সেখানে এটা হওয়াই স্বাভাবিক। বাংলাদেশে এখন শেয়ারবাজার, ব্যাংক থেকে নিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্যে যে সঙ্কট দেখা দিয়েছে, শ্রমজীবী জনগণের ওপর যে অমানুষিক শোষণ ও আর্থিক নির্যাতন চলছে; তার মূলেও এই একই কারণ। যে দেশে অপরাধীর শাস্তির ব্যবস্থা নেই এবং বিপুল অধিকাংশ অপরাধী যেখানে সরকারের লোক অথবা সরকারের সঙ্গে সম্পর্কিত তাদের পেয়ারের লোক—সেখানে যে ভয়াবহ পরিস্থিতি হওয়ার কথা সেটাই বাংলাদেশে এখন দেখা যাচ্ছে।

এই মুহূর্তে একথা বলার কারণ, নরসিংদীতে মেয়র লোকমান হত্যার চিহ্নিত আসামি আওয়ামী লীগের স্থানীয় মন্ত্রীর ভাইসহ অন্যদের বিরুদ্ধে সমন জারি করতে দেরি করা এবং তারা আত্মসমর্পণ করার পর তাদের সবাইকেই যেভাবে নির্বাচনের ঠিক আগে জামিন দেয়া হয়েছে, এটা ‘ক্রিমিনালদের পৃষ্ঠপোষকতা’ ছাড়া আর কিছুই নয়। যেভাবে এই ক্রিমিনালরা পলাতক থাকার পর আত্মসমর্পণ করে প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই জামিন পেয়ে নিরাপদে ও বুক ফুলিয়ে জনসমক্ষে ঘুরে বেড়াচ্ছে, তাতে এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই যে, সরকারের থেকে জামিনের পূর্ণ আশ্বাস পেয়েই তারা পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করেছে। মহামান্য আদালত ও পুলিশের মধ্যে এ দেশে যে অপূর্ব যোগসাজশ দেখা যায়, সেই যোগসাজশ এক্ষেত্রেও কাজ করেছে।

শুধু নরসিংদীর এই ক্রিমিনালরাই নয়, অন্য ক্রিমিনালদের ক্ষেত্রেও একই কথা। নির্বাচনে তাদের দলীয় ক্রিমিনালদের মনোনয়ন দেয়ার ব্যাপারেও আওয়ামী লীগের উত্সাহের অভাব নেই। দেখা যাচ্ছে, নিজেদের দলেই ক্রিমিনাল এবং যারা ক্রিমিনাল নয় তাদের মধ্যে ক্রিমিনালদেরই আওয়ামী নেতৃত্বের পছন্দ! এত পছন্দ যে, নির্বাচনে নিশ্চিত পরাজয় জেনেও তারা নিজেদের দলের ক্রিমিনালদের মনোনয়ন দিতে কোনো অসুবিধে বোধ করে না!! ফেনীর কুখ্যাত ক্রিমিনাল জয়নাল হাজারীর বিরুদ্ধে যেসব ক্রাইমের মামলা ছিল, তা একে একে তুলে নিয়ে কয়েক দিন আগে তার বিরুদ্ধে সর্বশেষ ক্রিমিনাল মামলাও তুলে নেয়া হয়েছে! কাজেই জয়নাল হাজারী এখন আর ক্রিমিনাল নয়, একেবারেই ধোয়া তুলসী পাতা!!

অপরাধীর শাস্তি না হওয়ার পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ যে এখন দুর্বৃত্তের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে, এটা কারও অজানা নয়। এ নিয়ে আমি নিজেও অনেক লেখালেখি করেছি। কিন্তু দুর্বৃত্তগিরি কমে না এসে বাংলাদেশে এত বিশাল আকারে এবং এত বিচিত্র রূপে ছড়িয়ে পড়েছে যাতে এই দেশ এখন আন্তর্জাতিকভাবেও বিশ্বের সব থেকে দুর্নীতিগ্রস্ত এবং অপরাধপ্রবণ দেশ হিসেবে পরিগণিত।

এ বিষয়টি বিবেচনার বিষয় এবং বারবার এ নিয়ে কোনো আলোচনার প্রয়োজনই হতো না যদি এর দ্বারা সমগ্র সমাজ, বিশেষত জনগণের দরিদ্রতম শ্রমজীবী অংশ ক্ষতিগ্রস্ত ও তাদের জীবন উত্তরোত্তর বিপর্যস্ত না হতো। কিন্তু এ সত্ত্বেও নিদারুণ ঘৃণ্য ব্যাপার হলো এই যে, এ নিয়ে ক্ষমতাসীন দল ও জোটের মধ্যেও কোনো আত্মসমালোচনা নেই। জোটের শরিকরা সুবিধাবাদী অবস্থানে থেকে জোটভুক্ত অবস্থায় নানা ধরনের সুযোগ-সুবিধা ভোগ ও ব্যবহার করলেও তারা নিজেদের গা বাঁচিয়ে সরকারের কিছু সমালোচনা কখনও সখনও করে থাকে। কিন্তু তাদের এই দ্বৈত কর্মের জন্য তাদের সমালোচনার কোনো প্রভাব জনগণের ওপর পড়ে না। উপরন্তু জনগণ তাদের সুবিধাবাদী হিসেবে ধরে নিয়েই তাদের মূল্যায়ন করে থাকেন।

সরকার ও সরকারি লোকজন এমনভাবে নিজেদের তিন বছরের শাসনামলে নানাবিধ ‘অর্জনের’ কীর্তন করে থাকেন যাতে মনে হয় দেশ এখন দুধ-মধুতে ভাসছে এবং আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সম্মানের উচ্চ শিখরে আছে। তাদের রঙ-বেরঙের কীর্তিকলাপ যে কীভাবে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে তাদের খেলো করছে, তার একটি সাম্প্রতিক দৃষ্টান্ত বাধ্য হয়েই উল্লেখ করতে হচ্ছে। আমাদের দেশে অনেক সময় সমালোচনাকে সমালোচকদের ব্যক্তিস্বার্থের সঙ্গে সম্পর্কিতভাবে দেখার একটা ঐতিহ্য আছে। কিন্তু এর সঙ্গে ব্যক্তিস্বার্থের কোনো সম্পর্ক নেই। সম্পর্ক আছে জনগণের ও দেশের স্বার্থের।

শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে সম্প্রতি জাতিসংঘের সম্মেলনে গিয়েছিলেন। সে সময় লেখক হুমায়ূন আহমেদ ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে নিউইয়র্কে ছিলেন। এখনও তিনি সেখানেই আছেন। তার আরোগ্য আমরা কামনা করি। তার সুচিকিত্সা হোক, এটা আমরা চাই। কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে, এজন্য নিষ্প্রয়োজনে সরকারকে অর্থ ব্যয় করতে হবে এবং সেটাও বৈদেশিক মুদ্রায়। শেখ হাসিনা হুমায়ূনকে তার চিকিত্সার জন্য নিউইয়র্কে দশ হাজার ডলার দিয়েছেন। তার চিকিত্সার জন্য সত্যি যদি এই অর্থের প্রয়োজন হতো তা হলে এর মধ্যে কোনো অসুবিধে ছিল না। কিন্তু কোটি কোটি টাকার মালিক হিসেবে তার অর্থের অভাব নেই। তাছাড়া তার প্রধান প্রকাশক পরম বন্ধু এবং কোটি কোটি টাকার মালিক এক ব্যক্তি সেখানে তার চিকিত্সার জন্য অর্থের জোগান দিচ্ছেন। তাছাড়া হুমায়ূন নিজেও এখান থেকে কোনো কোনো প্রকাশকের কাছ থেকে লাখ লাখ টাকা অগ্রিম নিয়ে গেছেন। কাজেই তার চিকিত্সার জন্য অর্থের এখন অভাব নেই, যাতে প্রধানমন্ত্রীর তাকে দশ হাজার ডলার দেয়ার প্রয়োজন ছিল।

এখানে অবশ্যই বলা দরকার, হাসিনা ও তার সরকার তাদের নিজেদের দলের একজন নেতৃস্থানীয় লোক আবদুর রাজ্জাককে তার চিকিত্সার জন্য লন্ডনে কোনো টাকা দেননি। আওয়ামী লীগ দলীয় রাজ্জাকের দু-একজন ঘনিষ্ঠ ব্যক্তি তার জন্য কিছু অর্থের ব্যবস্থা করেছিলেন, যা চিকিত্সার প্রয়োজনের তুলনায় কম ছিল। এ অবস্থায় আবদুর রাজ্জাক কয়েক দিন আগে লন্ডনে মৃত্যুবরণ করেন। এটা আওয়ামী লীগ দলের জন্য কোনো কৃতিত্বের পরিচয় নয়। এছাড়া অন্য প্রশ্নও আছে। হুমায়ূন আহমেদকে যে অর্থ হাসিনা মহা বদান্যতা দেখিয়ে দান করলেন, এটা কি তিনি নিজের পকেট থেকে দিলেন, না এটা দেয়া হলো জনগণের পকেট থেকে? এ প্রশ্ন কি দেশের জনগণ করতে পারেন না? কেউ প্রশ্ন না করলেও এ প্রশ্ন কি অযথার্থ? তাছাড়া হুমায়ূন আহমেদ নিজেই বা এ টাকা কীভাবে নিলেন? কোনো আত্মসম্মান জ্ঞানসম্পন্ন ব্যক্তির পক্ষে এই আচরণ কি শোভনীয়?

এবার আসা যেতে পারে এ প্রসঙ্গে দ্বিতীয় কথায়। মাত্র কয়েক দিন আগে শেখ হাসিনা হুমায়ূন আহমেদকে জাতিসংঘে বাংলাদেশের উপদেষ্টা হিসেবে নিযুক্তি দিয়েছেন!! হুমায়ূনও তা গ্রহণ করেছেন!!! যিনি ক্যান্সারের মতো গুরুতর রোগের চিকিত্সার জন্য আমেরিকায় গেছেন, তাকে এভাবে জাতিসংঘে বাংলাদেশের উপদেষ্টা করার অর্থ কী? কী উপদেশ তিনি এভাবে দেবেন? এটাও কি তার হাতে জনগণের ট্যাক্সের টাকা তুলে দেয়ার এক কৌশল নয়? নিজেদের দলের পতিত বা প্রায়-বিতাড়িত লোককে তার দুরবস্থার সময় হাসিনা চিকিত্সার জন্য সাহায্য করলে বদান্য ব্যক্তি হিসেবে তার কোনো সুখ্যাতি হতো না। কিন্তু লেখক হুমায়ূন আহমেদকে সম্পূর্ণ নিষ্প্রয়োজনেও এই অর্থ সাহায্য করলে সাহিত্য-সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষক হিসেবে নিজের জয়-জয়কার হওয়ার কথা চিন্তা করেই যে হাসিনা এ কাজ করেছেন এতে আর কার সংশয় থাকতে পারে? এক্ষেত্রে আবার বলা দরকার, আমরা এভাবে বিষয়টি উত্থাপন ও উল্লেখ করার একমাত্র উদ্দেশ্য হলো গরিব জনগণের চিকিত্সার কোনো ব্যবস্থা দেশে না থাকা।

যেসব সুবিধা আগে সরকারি হাসপাতালগুলোতে ছিল, সেগুলো তুলে দেয়া যখন হচ্ছে তখন হুমায়ূন আহমেদের মতো একজন ধনাঢ্য ব্যক্তিকে চিকিত্সার জন্য আমেরিকায় গিয়ে অর্থ সাহায্য করে আসা এবং সর্বোপরি তার মতো একজন অসুস্থ ব্যক্তিকে জাতিসংঘে বাংলাদেশের উপদেষ্টা বানিয়ে মাসে হাজার হাজার ডলার দেয়ার ব্যবস্থা কি দুর্নীতিরই নামান্তর নয়? আমরা হুমায়ূনের সুচিকিত্সা হোক এটা চাই এবং তার পরিপূর্ণ আরোগ্য কামনা করি। কিন্তু তার জন্য আমরা দেশের জনগণের স্বার্থবিরুদ্ধ কোনো কাজ সমর্থনের পক্ষপাতী নই। তাছাড়া এদেশে দুর্নীতি কত বিচিত্রভাবে করা হচ্ছে তার দৃষ্টান্ত হিসেবেও এ বিষয়ে জনগণের দৃষ্টি আকর্ষণ করা কর্তব্য বিবেচনা করে এখানে বিষয়টির উল্লেখ করা আমরা প্রয়োজন বোধ করেছি। বিষয়টি খুব নাজুক হলেও এর উল্লেখ থেকে বিরত থাকা কর্তব্য কাজে অবহেলারই শামিল।
[সূত্র : আমারে দেশ-১৯/০১/১২]