বৃহস্পতিবার, ১২ জানুয়ারী, ২০১২

ঢাকায় ভারতের সামরিক উপস্থিতির জন্য বিস্ময়কর প্রস্তাব

বদরুদ্দীন উমর


ভারত ও বাংলাদেশ প্রতিবেশী রাষ্ট্র। শুধু তাই নয়, ১৯৪৭ সালের আগে উভয়েই ভিন্ন একটি রাষ্ট্রের অন্তর্গত ছিল। সুদূর প্রাচীনকাল থেকে ব্রিটিশ শাসনের শেষ পর্যন্ত এ দুই দেশের ইতিহাস অভিন্ন। শুধু দুই দেশ নয়, পাকিস্তানকে হিসাব করলে তিন দেশের ইতিহাসই দক্ষিণ এশীয় উপমহাদেশের অভিন্ন ইতিহাস। সাম্রাজ্যবাদী চক্রান্তে ওই উপমহাদেশ বিভক্ত হওয়ার পর থেকে ১৯৪৭-পরবর্তীকালে ভারত ও পাকিস্তান স্বতন্ত্র রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে ওঠে। পরে পাকিস্তান বিভক্ত হয়ে বাংলাদেশ রাষ্ট্র সৃষ্টির পর দক্ষিণ এশিয়া এখন ত্রিধাবিভক্ত হয়েছে। কিন্তু ১৯৪৭ সাল থেকে ৬৩ বছরের স্বাতন্ত্র্য সত্ত্বেও এ অঞ্চলের জনগণ শত শত বছরের সামাজিক আদান-প্রদান, চিন্তাধারা ও শাসনসূত্রে পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্কিত। এ সম্পর্কের ঐতিহ্য কৃত্রিম বিভাজনের কারণে বিনষ্ট হওয়ার নয়। কাজেই অনেক বিভিন্নতা সত্ত্বেও ভারতীয় উপমহাদেশ বা দক্ষিণ এশিয়া নামে পরিচিত, তিন রাষ্ট্রে বিভক্ত, এ দেশের জনগণের চিন্তাচেতনা ও সংস্কৃতির মধ্যে যে ঐক্য ও বন্ধন দেখা যায়, সেটা অন্য কারো সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে দেখা যায় না। এর ফলে এমনি ঘোরতর বিশ্বাস জনগণের মধ্যে যে সৌহার্দ্য ও সুসম্পর্ক আছে রাষ্ট্রীয় দ্বন্দ্ব ও বৈরিতা সত্ত্বেও, এটা এক সুখকর বাস্তবতা। বিশেষ বিশেষ সময়ে দ্বন্দ্ব-বৈরিতার পরিবর্তে যেকোনো দুই রাষ্ট্রের মধ্যে কিছুটা সুসম্পর্ক যখন হয়, তখন জনগণের মধ্যকার ওই সৌহার্দ্য স্পষ্টভাবেই দেখা যায়। এটা ভারত-পাকিস্তান, ভারত-বাংলাদেশ, এমনকি পাকিস্তান-বাংলাদেশের জনগণের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের মধ্যে দেখা যায়। এটিই স্বাভাবিক, কারণ যেসব স্বার্থ নিয়ে এ রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে বৈরিতা ও দ্বন্দ্ব-সংঘাত থাকে, সেসব স্বার্থ জনগণের নয়। এই রাষ্ট্রগুলোর প্রতিটিতে শাসনকাজ যে শ্রেণী বা শ্রেণীদের দ্বারা পরিচালিত হয়, তারা জনস্বার্থের প্রতিনিধিত্ব করে না, এর পরও জনগণকে শোষণ ও দমন-পীড়ন করে তারা নিজেদের শাসনব্যবস্থা বলবৎ রাখে। নিজেদের শাসনস্বার্থেই এই রাষ্ট্রগুলো পরস্পরের সঙ্গে দ্বন্দ্ব-সংঘর্ষে লিপ্ত হয়, যে দ্বন্দ্ব-সংঘর্ষের সঙ্গে এই রাষ্ট্রগুলোর জনগণের কোনো সম্পর্ক থাকে না। তবে তারা সব সময়ই চেষ্টা করে আন্তরাষ্ট্রীয় বৈরিতা ও দ্বন্দ্ব-সংঘর্ষকে জনগণের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে। তাদের এ চেষ্টা তারা কত ধরনের কৌশলের মাধ্যমে করে, তার কোনো হিসাব নেই।

ভারত বাংলাদেশের ঘনিষ্ঠতম প্রতিবেশী দেশ। এই দুই দেশের জনগণের মধ্যে দীর্ঘদিনের গভীর সম্পর্ক। ১৯৪৭ সালের দেশভাগ লাখ লাখ পরিবারকে বিভক্ত করেছিল। তারা দুই দেশেই ছড়িয়ে আছে। কাজেই দুই দেশের মধ্যে যে শুধু প্রতিবেশীসুলভ সম্পর্ক আছে তাই নয়, রক্ত ও আত্দীয়তার বন্ধনও উপেক্ষার নয়। কিন্তু এসব সত্ত্বেও দেখা যাবে যে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে অসম ও বৈরী নীতির কারণে শক্তিশালী প্রতিবেশী ভারত দুই দেশের মধ্যে তিক্ততার সম্পর্ক সৃষ্টি করছে। ১৯৭১ সালে ভারতের প্রতি বাংলাদেশের জনগণের যে বন্ধুত্ব ও সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছিল, তার মধ্যে পরিবর্তন ঘটেছে। পরবর্তী পর্যায়ে শক্তিশালী রাষ্ট্র হিসেবে ভারত বাংলাদেশের ওপর তার নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা এবং বাংলাদেশকে তার শাসকশ্রেণীর স্বার্থে ব্যবহারের যে চেষ্টা করে আসছে, তার ফলে দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কের অবনতি ঘটেছে।

এখানে লক্ষ করার বিষয়, বর্তমানে ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে যে তিক্ত সম্পর্ক অনেকাংশে সৃষ্টি হয়েছে, সে তিক্ততা রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে নেই। ভারত বাংলাদেশ সরকারের মাধ্যমেই এখন এ দেশে তার নিয়ন্ত্রণ নানাভাবে কার্যকর করতে নিযুক্ত হয়েছে। ব্যবসা-বাণিজ্য, সড়কপথ ও বন্দর, নদীর পানি ইত্যাদি ক্ষেত্রে ভারত বাংলাদেশে নিজের স্বার্থ উদ্ধার করলেও বাংলাদেশ তার বিনিময়ে প্রকৃতপক্ষে উল্লেখযোগ্য কিছুই পাচ্ছে না। এর দ্বারা জনগণ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন এবং তাঁদের ওপর এই নীতি ভারত ছড়িয়ে দিচ্ছে বাংলাদেশে সরকারের মাধ্যমেই। বাংলাদেশ সরকার এভাবে ভারত সরকারের তাঁবেদার হিসেবেই কাজ করছে।

ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের ক্ষেত্রে এই লম্বা ভূমিকার কারণ, ঠিক এ মুহূর্তে ভারত এমন এক কাজের জন্য বাংলাদেশ সরকারের ওপর প্রবল চাপ সৃষ্টি করছে, যা বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বকে সরাসরি উপেক্ষা ও পদদলিত করার শামিল। ভারত বলেছে, বাংলাদেশে যাতায়াতকারী ভারতীয় বিমানের নিরাপত্তার জন্য তারা এখানে সশস্ত্র 'স্কাই মার্শাল' পাঠাবে, যারা ঢাকার শাহজালাল বিমানবন্দরে অবস্থান নেবে। এই বিশেষ সামরিক বাহিনী বিমানবন্দরে অবস্থান করতে পারবে। এ জন্য তাদের তিন সদস্যের একটি টিম ঢাকায় এসে এখানকার কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত প্রায় চূড়ান্ত করেছে। এভাবে ভারতের স্কাই মার্শাল বাংলাদেশে মোতায়েন করার কারণ বাংলাদেশে নাকি ইসলামী জঙ্গি তৎপরতা খুব বৃদ্ধি পেয়েছে এবং তার ফলে ভারতীয় বিমানের নিরাপত্তা এখানে বিঘি্নত হওয়ার আশঙ্কা। সেটা যাতে না হয়, তার প্রতি সতর্ক দৃষ্টি রাখা এবং সে রকম কোনো আশঙ্কা রোধের জন্য ভারত ঢাকা বিমানবন্দরে তাদের নিজস্ব সামরিক ও গোয়েন্দা বাহিনী নিয়োজিত রাখার উদ্যোগ নিয়েছে।

সংবাদপত্রের রিপোর্ট থেকে দেখা যায়, এভাবে বাংলাদেশে ভারতীয় স্কাই মার্শাল নামে তাদের সামরিক বাহিনীর অবস্থান গ্রহণের ব্যাপারে এখানকার গোয়েন্দা সংস্থাগুলো আপত্তি জানিয়ে বলেছে, বিমানবন্দরের নিরাপত্তা যথেষ্ট সুরক্ষিত এবং ভারতসহ কোনো দেশের বিমানের নিরাপত্তাজনিত কোনো সমস্যা এখানে দেখা যায়নি এবং তাদের কাছে এ বিষয়ে কোনো তথ্যই নেই। কাজেই হঠাৎ ভারতীয় বিমানের নিরাপত্তার জন্য এখানে তাদের সামরিক বাহিনীর সরাসরি উপস্থিতি এবং অবস্থান গ্রহণের কোনো যৌক্তিকতা নেই। এটা সম্পূর্ণ নিষ্প্রয়োজন।

বাংলাদেশে আল-কায়েদাসহ অন্যান্য জঙ্গি সংগঠনের তৎপরতা রয়েছে বলে ভারত সরকার যে কথা বলেছে, তার কোনো বাস্তব ভিত্তি নেই। এ ধরনের কোনো তৎপরতা দ্বারা বিমানবন্দরে বিমান ওঠানামা তো নয়ই, কোনো ক্ষেত্রেই কোনো বিঘ্ন ও বিপদ সৃষ্টি হয়নি। কাজেই ভারতীয় বিমানের নিরাপত্তার জন্য তাদের এই বিশেষ ব্যবস্থা অনুমোদন করার অর্থ হলো, দেশের সার্বভৌমত্ব ভারতের কাছে সমর্পণ করা। আসলে ভারত যেভাবে তাদের সামরিক বাহিনী বিমানবন্দরে মোতায়েন করার কথা বলেছে, এটা বিশ্বের কোনো দেশের কোনো বিমানবন্দরেই নেই। একটি দেশ অন্য দেশে নিজের বিমানের নিরাপত্তার জন্য যদি নিজস্ব সামরিক বাহিনী মোতায়েন করতে চায়, তাহলে অন্য দেশও সেটা চাইতে পারে এবং এখানে এ অনুমতি দিলে অন্য ক্ষেত্রে সেটা না দেওয়ার যুক্তি থাকে না। এর অর্থ দাঁড়ায়, নিজেদের দেশের বিমানবন্দরকে নানা দেশের সামরিক বাহিনীর ঘাঁটিতে পরিণত করা। এর থেকে একটি দেশের নিজস্ব অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার ক্ষেত্রে বিপজ্জনক ব্যাপার আর কী হতে পারে? কাজেই ভারত নিজেদের বিমানের নিরাপত্তার নাম করে এখানে সামরিক বাহিনী মোতায়েন করার যে প্রস্তাব করেছে, এটার উদ্দেশ্য সম্পূর্ণ অন্য কিছু এবং একে বাংলাদেশের ওপর ভারতের সাম্রাজ্যবাদী হামলা ছাড়া অন্য কোনোভাবে আখ্যায়িত করা চলে না।

কিন্তু ভারত শুধু বিমানবন্দরে তাদের বিমানের নিরাপত্তার জন্যই নয়, তাদের দূতাবাসের নিরাপত্তার জন্যও সেখানে ভারতীয় সশস্ত্র আধাসামরিক বাহিনী মোতায়েন রাখার ব্যবস্থা করছে। এটাও এক ব্যতিক্রমী ব্যাপার। বহু দেশের দূতাবাসই ঢাকায় আছে, তাদের নিরাপত্তা বাংলাদেশের দায়িত্ব এবং সে দায়িত্ব বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনী পালন করে থাকে। কিন্তু তা সত্ত্বেও ভারত নিজেদের দূতাবাসের নিরাপত্তার জন্য নিজেদের সশস্ত্র সামরিক বাহিনী রাখার প্রস্তাব কী কারণে করতে পারে এবং বাংলাদেশ সরকার কী কারণে তাদের প্রস্তাবে সম্মত হয়_এটা স্বাভাবিক অবস্থায় কোনো বোধগম্য ব্যাপার নয়।

বাংলাদেশের প্রতি ভারতের এই আচরণ এবং এখানে সামরিক উপস্থিতির জন্য সরকারের ওপর চাপ প্রয়োগের ব্যাপারটি কোনো সুপ্রতিবেশীসুলভ ব্যাপার নয়। খুব স্পষ্টভাবেই এটা একধরনের সাম্রাজ্যবাদী আচরণ। এ ধরনের সাম্রাজ্যবাদী আচরণের অর্থ যে বাংলাদেশের ওপর নিজেদের কর্তৃত্ব স্থাপন, এতে কোনো সন্দেহ নেই। বাংলাদেশ সরকার যদি ভারতের এই চাপের কাছে নতিস্বীকার করে বিমানবন্দর, ভারতীয় দূতাবাস এবং তাদের অন্যান্য স্থাপনায় ভারতীয় সামরিক বাহিনীকে অবস্থান গ্রহণের অনুমতি দেয়, তাহলে সেটা হবে বাংলাদেশের জনগণের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা এবং দেশীয় স্বার্থ সম্পূর্ণ বিসর্জন দিয়ে ভারতের কাছে আত্দসমর্পণ। বাংলাদেশ সরকার যদি ভারতের এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান না করে ঢাকায় তাদের সামরিক উপস্থিতিতে সম্মত হয়, তাহলে তার খেসারত এ সরকারকে অবশ্যই দিতে হবে। জনস্বার্থ ও দেশীয় স্বার্থের প্রতি এই বেইমানির প্রতিশোধ জনগণ অবশ্যই নেবে।
[সূত্রঃ কালের কণ্ঠ, ২৭/০৫/১০]

জনগণকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলনের চক্রান্ত

বদরুদ্দীন উমর


বর্তমান সরকারের কাছে যা প্রত্যাশিত অবশেষে তা-ই হয়েছে। জনগণের স্বার্থ, তাদের ভিটেমাটি, আবাদি জমি সবকিছুকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে তারা ঠিক করেছে বড়পুকুরিয়া ও ফুলবাড়ীতে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলন করবে। ফুলবাড়ী থেকে এশিয়া এনার্জিকে জনগণ আন্দোলনের মাধ্যমে বিতাড়িত করার পর তারা এ দেশ থেকে চলে যায়নি। তারা ঢাকায় বসেই নানা চক্রান্তে লিপ্ত ছিল। কারণ তারা বাংলাদেশের শাসকশ্রেণীর এবং তাদের ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল ও আমলাদের চরিত্র ভালোভাবেই জানে। তারা জানে কিভাবে এসব সরকারি দলের নেতা-নেত্রীকে এবং আমলাদের বশ করে নিজেদের স্বার্থ উদ্ধার করতে হয়। তাদের এই জানাশোনার ভিত্তিতে তারা এটা ধরে রেখেছিল যে তাদের বিরুদ্ধে যতই আন্দোলন হোক, সরকার তাদের পক্ষে, সে সরকার বিএনপির হোক অথবা হোক আওয়ামী লীগের। এদিক দিয়ে তাদের কোনো অসুবিধা নেই। তাদের অসুবিধা শুধু জনগণের প্রতিরোধ নিয়ে। মনে হয় এখন তারা কিছুটা নিশ্চিন্ত হয়েছে যে তারা আবার ফুলবাড়ীতে ফিরতে পারবে বিশেষ কোনো প্রতিরোধ ছাড়াই।

কিন্তু শুধু ফুলবাড়ীতেই নয়, বড়পুকুরিয়ায়ও তারা উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। এই সিদ্ধান্ত যেভাবে ঘোষিত হয়েছে সেটা আকস্মিক মনে হলেও এর জন্য এক বছর ধরে সরকার এবং সংশ্লিষ্ট মহলের মধ্যে অনেক চক্রান্তমূলক আলাপ-আলোচনা হয়েছে, অনেক লেনদেন, ভাগবাটোয়ারার হিসাব কষা হয়েছে। এসব চক্রান্তমূলক আলোচনা ও হিসাব-নিকাশ শেষে এখন সরকার ঘোষণা করেছে যে তারা বড়পুকুরিয়া ও ফুলবাড়ী উভয় জায়গায়ই উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলন করবে।

এ প্রসঙ্গে ঠিক বছরখানেক আগের এক গোলটেবিল বৈঠকের কথা বলা দরকার। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর কয়েকজন অনাবাসী জ্বালানিবিশেষজ্ঞ ও সরকারি কর্মকর্তারা যমুনা রিসোর্টে এ বৈঠক করেন। তাতে যোগদানকারীদের মধ্যে একজন হলেন মহম্মদ খলিকুজ্জামান। তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের লক হাভেন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন। The Quarry Quardary নামে তাঁর একটি প্রবন্ধ আজ (১.৬.২০১০) Daily Star পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। তাতে তিনি বলেছেন, ১৫-১৮ জুন, ২০০৯ সালে অনুষ্ঠিত সেই গোলটেবিল বৈঠকে তিনিসহ আটজন অনাবাসী বিশেষজ্ঞ উপস্থিত ছিলেন। এ ছাড়া তাতে উপস্থিত ছিলেন জ্বালানি উপদেষ্টা তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী, দুজন প্রতিমন্ত্রী শামসুল হক টুকু ও মুস্তাফিজুর রহমান, জ্বালানি সেক্রেটারি মহম্মদ মহসীন, পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান হোসেন মনসুর এবং উত্তরবঙ্গের কয়েকজন সংসদ সদস্য।
সরকার কর্তৃক আয়োজিত এই বৈঠকে প্রস্তাবিত কয়লানীতি এবং কয়লা উত্তোলন বিষয়ে আলোচনা হয়। প্রকাশিত কয়লানীতি এবং কয়লা উত্তোলন পদ্ধতি নিয়ে অনাবাসী জ্বালানিবিশেষজ্ঞদের মধ্যে মতানৈক্য হলেও কতগুলো সুপারিশের ব্যাপারে সব অংশগ্রহণকারীই একমত হন। গোলটেবিল বৈঠক শেষে যমুনা রিসোর্টে ১৮ জুন, ২০০৯ এক সংবাদ সম্মেলনে এই সুপারিশগুলোর বিবরণ প্রকাশ করা হয়। মহম্মদ খলিকুজ্জামান তাঁর উলি্লখিত প্রবন্ধে বলেন, সে সময় মনে হয়েছিল অনাবাসী বিশেষজ্ঞ গ্রুপ যেসব সুপারিশ করেছে সেগুলো সরকার কর্তৃক বিবেচিত হবে। কিন্তু পরে দেখা গেল তা হয়নি। এ বছর ২৬ মে Energy Bangla নামে পত্রিকায় খবর প্রকাশিত হয়েছে, সরকার বড়পুকুরিয়া ও ফুলবাড়ীতে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। এই পত্রিকাটি হলো এশিয়া এনার্জির কয়লা উত্তোলন সম্পর্কিত প্রস্তাবের সমর্থক। এদের কাছে সরকারের এই সিদ্ধান্তের খবর আগেভাগেই কিভাবে পেঁৗছাল সেটা এক বড় প্রশ্ন।

এখানে উল্লেখ করা দরকার যে কিছুদিন আগে কয়েকজন উচ্চপর্যায়ের সরকারি কর্মকর্তা জার্মানি সফর করেন সেখানে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলন দেখার জন্য। পত্রিকার রিপোর্ট অনুযায়ী এই সফরের ব্যবস্থা ও ব্যয় বহন করে এশিয়া এনার্জি করপোরেশন (AEC, এখন নাম পরিবর্তন করে হয়েছে GCM)। যাদের উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলনের প্রস্তাব ও প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে ফুলবাড়ীতে এলাকার জনগণ প্রবল আন্দোলন করল, যাদের এই প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে অন্যত্রও আন্দোলন হলো, অনেক লেখালেখি হলো এবং এসবের পরিণতিতে ফুলবাড়ী থেকে এশিয়া এনার্জি কম্পানি বিতাড়িত হলো, তাদেরই টাকায় সরকারি কর্মকর্তারা উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলনের জন্য জার্মানি সফর কিভাবে করলেন? এটা কী ধরনের নৈতিক বিবেচনা এবং গণতান্ত্রিক রীতি অনুযায়ী সম্ভব এটা বোঝার উপায় নেই। শুধু তাই নয়, এর মতো ন্যক্কারজনক ব্যাপার এ ধরনের নীতিনির্ধারণের ক্ষেত্রে আর কী হতে পারে? কিন্তু বাংলাদেশ এক বিচিত্র ভূমি। এখানে দুর্নীতিবাজরা করতে পারে না এমন কাজ নেই।

যে সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ কম্পানি নিজেরা আমাদের দেশে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলনের প্রস্তাবক ও চক্রান্তকারী এবং ঘোষিতভাবে এই পদ্ধতির পক্ষে, তারা যখন সরকারি কর্মকর্তাদের অন্য দেশে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলন দেখে আসার জন্য নিজেদের ব্যয়ে সফরের ব্যবস্থা করে, তখন তার অর্থ বোঝার অসুবিধা কার হতে পারে? যেখানে কয়লা উত্তোলন পদ্ধতি নিয়ে দেশজুড়ে বিতর্ক তো চলছেই, উপরন্তু এ নিয়ে এশিয়া এনার্জির বিরোধিতা হচ্ছে রাজনৈতিভাবে, সেখানে এই বিতর্কের এক পক্ষের পয়সায় সরকারি কর্মকর্তাদের সফর করার অর্থ হলো সেই পক্ষের নুন খেয়ে নিমক হারামি করা ছাড়া আর কি? এই নিমক হারামিই তাঁরা করেছেন। শুধু তাঁরাই নয়, বাংলাদেশের মন্ত্রিসভাও এখন এশিয়া এনার্জি এবং উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলনের পক্ষে। গত বছর জুন মাসে অনাবাসী জ্বালানি বিশেষজ্ঞরাসহ সরকারি কর্মকর্তারা মিলে কয়লা উত্তোলনের ব্যাপারে যেসব বিষয়ে একমত হয়েছিলেন, তাতে কোনো বিশেষ পদ্ধতিকে অগ্রাধিকার না দিয়ে এমন পদ্ধতি অনুসরণের কথা ছিল, যাতে নির্দিষ্ট কোনো কয়লাক্ষেত্রে ভূতাত্তি্বক, পানি-ভূতাত্তি্বক, পরিবেশ ও আর্থসামাজিক অবস্থার হিসাব করে পদ্ধতি নির্ধারণের কথা ছিল। কিন্তু এক বছর ধরে এসব নিয়ে কোনো আলোচনা ও কথাবার্তার মধ্যে না গিয়ে হঠাৎ বড়পুকুরিয়া ও ফুলবাড়ী দুই ক্ষেত্রেই উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলনের সরকারি সিদ্ধান্ত আপাতদৃষ্টিতে এক রহস্যজনক ব্যাপার। কিন্তু বাংলাদেশে যেভাবে এসব কাজ হয় তা অজানা নয়। এর মধ্যে প্রকৃতপক্ষে কোনো রহস্য নেই। যেভাবে এশিয়া এনার্জি সরকারি কর্মকর্তাদের উন্মুক্ত কয়লা উত্তোলন দেখে আশার জন্য খরচার জোগান দিয়েছে তার মধ্যেই এই রহস্যের ঠিকানা আছে।

সরকারের এটা মনে রাখা অবশ্য কর্তব্য যে জনগণ তাদের ভোট দিয়ে দেশের সম্পদের মালিক করেনি, তারা তাঁদের ওপর দায়িত্ব অর্পণ করেছেন জনগণের সম্পদের রক্ষণাবেক্ষণ, সমৃদ্ধি ও সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার জন্য। কিন্তু ক্ষমতার গদিতে বসে সরকার ও তাদের আমলারা যে এর উল্টো কাজই সর্বত্র করে চলেছেন, এটা এক খোলাখুলি ব্যাপার। জ্বালানি মন্ত্রণালয়ে কিছু দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা ও সরকারের নিজস্ব লোকজন কয়লা উত্তোলন নিয়ে চক্রান্তমূলকভাবে যা শুরু করতে যাচ্ছে তার গণবিরোধী, দেশবিরোধী ও সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থ তোষণকারী চরিত্র বিষয়ে কোনো সংশয় নেই। তাদের এটা মনে রাখা দরকার যে দেশের সব সম্পদ, মাটির ওপরের ও নিচের সব সম্পদের মালিক জনগণ। সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থের সঙ্গে যোগসাজশ ও চক্রান্ত করে দেশি-বিদেশি গণবিরোধী স্বার্থ কর্তৃক এই সম্পদ লুটপাট বন্ধ আবেদন-নিবেদনের মাধ্যমে সম্ভব নয়। সরকার যেমন নিজেদের ক্ষমতার মোহে জনগণের সম্পদ এভাবে লুটপাট করতে এবং এ কাজ করতে গিয়ে এলাকার জনগণের জীবনে বিপর্যয় সৃষ্টি করতে উদ্যত হয়েছে, তেমনি জনগণ এই শত্রুতা প্রতিরোধের জন্য নিজেদের শক্তিকে সংগঠিত এবং ঐক্যবদ্ধ করবে। এর থেকে প্রমাণ হচ্ছে যে নির্বাচনে ভোট দিয়ে যাদের জনপ্রতিনিধি হিসেবে পাঠানো হয় তাঁরা প্রকৃত জনপ্রতিনিধি নন, জনগণের স্বার্থ তাঁরা দেখেন না। উপরন্তু ক্ষমতায় বসে জনগণের সঙ্গে শত্রুতা করাই হলো তাদের কাজ। এ শত্রুতার মোকাবিলা জনগণ সব সময়ই নিজেদের আন্দোলনের মাধ্যমে করেছে। বড়পুকুরিয়া ও ফুলবাড়ীতে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলনের উদ্যোগের মাধ্যমে সরকার জনগণের সম্পত্তি অপহরণ ও জীবনে বিপর্যয় সৃষ্টির জন্য যে নীতির ঘোষণা দিয়েছে, জনগণ নিজেদের ঐক্যবদ্ধ ও সংগঠিত আন্দোলনের মাধ্যমেই তাকে পরাজিত করবে। এ ছাড়া বড়পুকুরিয়া ও ফুলবাড়ীর জনগণের সামনে দ্বিতীয় পথ আর কোনো খোলা নেই।
[সূত্রঃ কালের কণ্ঠ, ০৩/০৬/১০]

বিশ্ববিদ্যালয়ে দ্বিতীয় সান্ধ্যকালীন শিফট

বদরুদ্দীন উমর


কয়েক বছর আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন সান্ধ্যকালীন ক্লাস নেওয়ার অর্থাৎ সান্ধ্য শিফট চালুর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, তখন আমি 'বিশ্ববিদ্যালয় না পাঠশালা?' নামে একটি প্রবন্ধ লিখেছিলাম। সে সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রমণ্ডলী এই সান্ধ্য শিফটের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরেও এর বিরুদ্ধে অনেক প্রতিবাদ হয়। শেষ পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এই প্রতিরোধের মুখে সান্ধ্য শিফট চালুর সিদ্ধান্ত বাতিল করে।

এ ঘটনার বেশকিছু আগে থেকে বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ) উচ্চশিক্ষা সম্প্রসারণের নামে বিশ্ববিদ্যালয়ে দ্বিতীয় শিফটের দাবি জানিয়ে আসছিল। শিক্ষা সম্মেলন করে সেখানেও তারা এই দাবির সপক্ষে অনেক আলোচনা করে এবং সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু লক্ষ্য করার বিষয় ছিল, কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন সত্যি সত্যি দুই শিফট চালুর সিদ্ধান্ত গৃহীত হলো তখন তার বিরুদ্ধে ছাত্রদের প্রতিক্রিয়া দেখে তারা আর এ নিয়ে কোনো উচ্চবাচ্য করেনি। তারা এতদিন উচ্চশিক্ষা সম্প্রসারণের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে দুই শিফটের পক্ষে যে যুক্তি বিস্তার করেছিল, সে যুক্তির ফাঁকা চরিত্র ছাত্ররাই নিজেদের আন্দোলনের মাধ্যমে দেখিয়ে দিয়েছিল।

এ প্রসঙ্গে 'বিশ্ববিদ্যালয় না পাঠশালা?' নামে যে প্রবন্ধ আমি লিখেছিলাম তাতে বলা হয়েছিল, বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস লেকচার আসলে শিক্ষার মুখ্য পদ্ধতি নয়, যেমন সেটা পাঠশালা বা স্কুলে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষায় ক্লাস লেকচারের গুরুত্ব থাকলেও ছাত্রদের আসল কাজ করতে হয় লাইব্রেরি ও ল্যাবরেটরিতে। তাছাড়া যেখানে টিউটোরিয়াল ব্যবস্থা আছে, সেখানে টিউটোরিয়ালের কাজ করে। এই টিউটোরিয়াল পেপার তৈরির জন্য লাইব্রেরি কাজের কোনো বিকল্প নেই। ঢাকাসহ অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আজকাল যত ছাত্র ভর্তি করা হয়, তার জন্য উপযুক্ত কোনো ব্যবস্থাই নেই। এর মধ্যে সব থেকে বেশি হৈচৈ হয় আবাসিক ব্যবস্থা নিয়ে। খাওয়ারও কোনো ব্যবস্থা নেই। এ কারণে ছাত্রক্ষোভ, বিশেষত ছাত্রীদের নিজেদের হোস্টেলের কামরায় নিজেদেরই রেঁধে খেতে হয়। এটা যে কোনো কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রেই এক কেলেঙ্কারি ব্যাপার। কারণ পড়তে এসে হোস্টেলে যদি ছাত্রছাত্রীদের রেঁধে খেতে হয়, তাহলে অহেতুক পরিশ্রম ও ক্লান্তির বিষয় বাদ দিয়েও পড়াশোনার জন্য সময় কমে আসে। তাছাড়া কামরাকে রান্নাঘর বানিয়ে রাখা এক অস্বাস্থ্যকর ব্যাপার। কিন্তু এসব দিকে খেয়াল করা বা এসব সমস্যা সমাধানের দিকে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কোনো আগ্রহ আছে এমন মনে হয় না।

এ তো গেল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া ছাত্রসংখ্যার তুলনায় তাদের থাকা-খাওয়ার অব্যবস্থার কথা। কিন্তু পড়াশোনার ক্ষেত্রে যে অসুবিধা তা হলো, ছাত্রসংখ্যার তুলনায় লাইব্রেরি ও ল্যাবরেটরি সুবিধা অনেক কম। বইপত্র এবং যন্ত্রপাতির কমতি তো আছেই, তার ওপর আছে স্থান সমস্যা। একসঙ্গে লাইব্রেরিতে বসে ছাত্রদের পড়াশোনা করার মতো জায়গার অভাব আছে। ল্যাবরেটরিতেও আছে প্রয়োজনীয় জায়গার অভাব। এ অবস্থায় যদি দ্বিতীয় শিফট করা হয়, তাহলে তার ফল কী দাঁড়াতে পারে, এটা অনুমান করা কঠিন নয়। এতে করে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রছাত্রীদের একটি হাটে পরিণত হয়ে শিক্ষার পরিবর্তে হট্টগোলের রাজত্বই সেখানে কায়েম হওয়ার কথা। বিশ্ববিদ্যালয়ের এই 'হাট' চরিত্র ইতিমধ্যেই দেখা যায় এবং হাটের হট্টগোল এখন এক নিয়মিত ব্যাপার।

যারা বিশ্ববিদ্যালয়ে দ্বিতীয় শিফটের চিন্তা করেন, এমনকি তা কার্যকর করতে নিযুক্ত হন, তাদের বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে ধারণার অভাব আছে। তারা মনে করেন, লেকচারই হলো বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার মূল পদ্ধতি। কাজেই লেকচারে উপস্থিত থেকে শিক্ষকদের বক্তৃতা শুনলেই ছাত্রদের উচ্চশিক্ষা এগিয়ে যায়। তার জন্য অন্য বিশেষ কিছুর প্রয়োজন হয় না। এই চিন্তা যদি তাদের মধ্যে না থাকত, তাহলে তারা অবশ্যই ভাবতেন লাইব্রেরি ও ল্যাবরেটরির অবস্থার কথা, সেখানে ছাত্রছাত্রীদের পড়াশোনা ও ল্যাবরেটরি কাজের বাস্তব অবস্থার কথা।

এখানে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার আছে। আজকাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যেসব শিক্ষক আছেন, তাদের একটা বড় সংখ্যা বিভিন্ন প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে অতিরিক্ত অধ্যাপনার কাজে নিযুক্ত থাকেন। এ কাজ করতে গিয়ে তারা নিজেদের বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার কাজে যথাযথভাবে মনোযোগ দেন না, সেখানে সময় দেন না এবং ক্লাস লেকচারের জন্য নিজেদের প্রস্তুত করতে নিয়মিত পড়াশোনাও করেন না। এর ফলে তাদের পক্ষে যতটুকু পাঠ ছাত্রদের দেওয়া সম্ভব, সেটা দেওয়াও তাদের পক্ষে সম্ভব হয় না। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে যদি সুসংগঠিত পাঠ ও গবেষণার ব্যবস্থা থাকে, তাহলে বলার কিছু নেই। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষকরা যদি নিজেদের দায়িত্ব পালন না করে অতিরিক্ত অর্থের সন্ধানে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে সময় দেন, তাহলে সেটা উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে ক্ষতিকর হতে বাধ্য। সে ক্ষতি অবশ্যই হচ্ছে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ শিক্ষকদের এই দায়িত্বহীনতা রোধ করতে সক্ষম হচ্ছে না। সন্দেহ হয়, এর কোনো গুরুত্ববোধও তাদের মধ্যে নেই এবং তারা এর বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নিতেও আগ্রহী নন। আজকের পত্রিকায় (ডেইলি স্টার, ২৪.৫.২০১০) দেখা যাচ্ছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ 'কম্পিউটার সায়েন্স ও ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপার্টমেন্টে'র সান্ধ্যকালীন মাস্টারসের প্রোগ্রাম শুরু করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। এর প্রতিক্রিয়ায় ওই ডিপার্টমেন্টের ছাত্রছাত্রীরা এই প্রোগ্রাম বাতিলের দাবিতে ক্লাস বর্জন করে বিশ্ববিদ্যালয়ের এই 'বাণিজ্যিক কোর্স' বন্ধের দাবিতে কার্জন হলের সামনে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেছে। তাদের কথা হলো, ডিপার্টমেন্টে শিক্ষকের সংখ্যা কম, তার ওপর এই শিক্ষকরা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়েও শিক্ষকতা করেন। এর ফলে তাদের পক্ষে
রহ-পড়ঁৎংব ও সরফ-ঃবৎস পরীক্ষা সময়মতো নেওয়া সম্ভব হয় না। এছাড়া তারা পরীক্ষা হয়ে যাওয়ার পর সময়মতো পরীক্ষার ফল প্রকাশ করতে পারেন না, কারণ খাতা দেখার সময় তাদের হয় না। এ অবস্থায় আবার সান্ধ্যকালীন কোর্স চালু হলে ছাত্রছাত্রীদের পড়াশোনার অবস্থা কী দাঁড়াবে, তা সহজেই অনুমান করা যায়। এই পরিস্থিতিতে ছাত্ররা অবিলম্বে দ্বিতীয় শিফট সম্পর্কিত সিদ্ধান্ত বাতিলের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে দাবি জানিয়েছে।

এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য, কয়েকদিন আগে প্রকাশিত একটি সংবাদপত্র রিপোর্টে দেখা যায়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ও একটি ডিপার্টমেন্টে সান্ধ্যকালীন দ্বিতীয় শিফট চালুর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। এর থেকে বোঝা যাচ্ছে, কিছুদিন আগে উচ্চশিক্ষা সম্প্রসারণের অজুহাত দেখিয়ে বাণিজ্যিক কারণে দ্বিতীয় শিফট চালুর যে সিদ্ধান্ত হয়েছিল এবং যা মাত্র কয়েকদিনের মধ্যেই প্রতিরোধের মুখে বাতিল করা হয়েছিল, সেই বাণিজ্যিক প্রোগ্রাম এখন আবার গোটা বিশ্ববিদ্যালয়ে একযোগে চালু না করে পর্যায়ক্রমে বিভিন্ন বিভাগে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কর্তৃক চালু করার ব্যবস্থা হচ্ছে।

বাংলাদেশে নিম্নতম থেকে উচ্চতম পর্যায় পর্যন্ত শিক্ষার বেহাল অবস্থা এক বাস্তব ব্যাপার। তার ওপর এভাবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে দ্বিতীয় শিফট চালু করে এগুলোকে পাঠশালা বানানোর যে ব্যবস্থা হচ্ছে সেটা শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদেরই নয়, বিভিন্ন ক্ষেত্রে কর্মরত শিক্ষক, শিক্ষিত সম্প্রদায় ও সেই সঙ্গে সামগ্রিকভাবে সচেতন জনগণের প্রতিরোধ দরকার। এই প্রতিরোধের দ্বারা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে দ্বিতীয় শিফট চালুর মাধ্যমে ইতিমধ্যেই বাণিজ্যিকীকরণকৃত শিক্ষাব্যবস্থার আরও শোচনীয় বাণিজ্যিকীকরণ যদি বন্ধ করা না হয়, তাহলে কার্যকরভাবে শিক্ষাব্যবস্থার ধ্বংস রোধ করা হবে এক অসম্ভব ব্যাপার।
(সুত্র, সমকাল, ২৫/০৫/২০১০)

নামকরণ পরিবর্তনের মহোত্সব দুর্নীতিরই দৃষ্টান্ত

বদরুদ্দীন উমর


বিভিন্ন রকম প্রতিষ্ঠান ও স্থাপনার নামকরণ নিজের পিতার নাম অনুযায়ী করার এক উদগ্র তাগিদ বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রীকে প্রায় দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য করে রেখেছে। তিনি শুধু নতুন নতুন প্রতিষ্ঠান ও স্থাপনার নাম নিজের পিতার নামে রেখেই ক্ষান্ত হচ্ছেন না। অনেক বিদ্যমান প্রতিষ্ঠান ও স্থাপনার নাম পর্যন্ত পরিবর্তন করে নিজের পিতার নাম সেখানে বসিয়ে দিচ্ছেন। এখানেই শেষ নয়, তিনি নিজের মাতা এবং ভাইদের নামেও এ ধরনের নামকরণ করছেন। এ কাজের মধ্যে রুচির দোষ যাই থাকুক, অন্যদিক দিয়ে বিচার করলে এটা এক ধরনের দুর্নীতিও বটে। কারণ শাসনক্ষমতার অধিকারী হয়ে বিভিন্ন সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের নাম এভাবে রাখার মধ্যে পারিবারিক গৌরব কীর্তন ছাড়া অন্য উদ্দেশ্য নেই। এই উদ্দেশ্য যে কোনো গৌরবজনক ব্যাপার নয়, এটা বলাই বাহুল্য। লক্ষণীয় ব্যাপার এই যে, তিনি শুধু নিজের পিতার নামে এভাবে নামকরণ করেই থেমে থাকছেন না। তার প্রতিহিংসাপরায়ণতা এমন যে, তিনি যাদেরকে তার রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করেন তাদের নামে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও স্থাপনার নাম পরিবর্তন করে যেখানে তার পিতার নামে মোটেই রাখা সম্ভব হচ্ছে না, সেখানে অন্য কারোর নামে তার নতুন নামকরণ করছেন। যেভাবে নাম পরিবর্তনের কাজ করা হচ্ছে তার থেকে মনে হতে পারে যে, ২০০৮ সালের ডিসেম্বরের নির্বাচনে জনগণ ভোটের কল্যাণে আওয়ামী লীগকে এ কাজ করার জন্য ম্যান্ডেট দিয়েছে। বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক প্রতিপক্ষরা ক্ষমতায় থেকে এই একই কাজ করলেও নাম পরিবর্তনের এই কুিসত ব্যাপার সবমাত্রা অতিক্রম করে কুরুচি ও অসভ্যতার এমন পরিচয় রাখছে, যা একটি দেশ ও জাতির জন্য কলঙ্কজনক।

ঢাকার আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নাম প্রথম থেকেই ছিল জিয়া আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। এই বিমানবন্দরের নাম পরিবর্তন করে এখন রাখা হয়েছে হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। একজন বড় মাপের পীর সাহেবের নামে এই নামকরণের কারণ এই ধারণা যে, পরে কেউ এই নাম পরিবর্তন করতে গেলে দেশের ধর্মপ্রাণ লোকদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লাগবে—এই ভয়ে কেউ আর সে চেষ্টা করবে না। এখানে প্রতিহিংসার হীন প্রকৃতি ছাড়াও ধর্মকে যেভাবে ব্যবহার করা হয়েছে তার মধ্যেও প্রশংসার কিছু নেই। এখানে বলা দরকার যে, মওলানা ভাসানীর নামও এভাবে মুছে ফেলা হচ্ছে। ঢাকার নভোথিয়েটারের নাম ভাসানী নভোথিয়েটারের পরিবর্তে রাখা হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর পিতার নামে।

বিদ্যমান আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নাম পরিবর্তন করতে গিয়ে যে বিশাল অংকের বৈদেশিক মুদ্রাসহ মোট অর্থ ব্যয় হয়েছে এটা বাংলাদেশের মতো একটি দেশের স্বার্থবিরোধী কাজ ছাড়া আর কী? শুধু নিজের ব্যক্তিগত প্রতিহিংসা চরিতার্থের জন্য দেশের মেহনতি জনগণের ঘাড়ে এই ব্যয়ভার চাপিয়ে দেয়ার কী এখতিয়ার আওয়ামী লীগের প্রধানমন্ত্রীর আছে? তিনি নিজের পিতার নামে আরও বিশাল এক আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর নির্মাণের পরিকল্পনা গ্রহণ করেছেন। কিন্তু তার জন্য বিদ্যমান আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরটির নাম পরিবর্তনের কী প্রয়োজন ছিল? প্রতিহিংসাপরায়ণতা ছাড়া এর আর কী ব্যাখ্যা থাকতে পারে? আমরা জিয়াউর রহমানের পক্ষপাতী নই, তার নামে কোনো কিছুর নামকরণ থাকুক বা না থাকুক তাতে আমাদের কিছু যায় আসে না। কিন্তু বিদ্যমান নাম পরিবর্তন করে দেশকে আর্থিক ক্ষতির মধ্যে নিক্ষেপ করার আমরা ঘোর বিরোধী।

বাংলাদেশে এখন দুর্নীতির প্রবল রাজত্ব। এই দুর্নীতি যে কত বিচিত্র পথগামী তার একটি দৃষ্টান্ত হিসেবেই নামকরণের বিষয়টি উল্লেখ করা হলো। দুর্নীতি বলতে সাধারণত অর্থনৈতিক দুর্নীতি অর্থাত্ চুরি, ঘুষ, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি ইত্যাদির কথা মনে হয়। কিন্তু দুর্নীতি আসলে হলো এক ধরনের অভ্যাসগত সংস্কৃতি। এই সংস্কৃতি মানুষের চেতনা থেকে নিয়ে কাজকর্মের পুরো জগেকই আচ্ছন্ন করে রাখে। কাজেই এর প্রতিফলন ঘটে সর্বত্র। মিথ্যা, প্রতারণা ইত্যাদি এই সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ।

বাংলাদেশে শাসকশ্রেণীর একের পর এক সরকার নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতাসীন হলেও দুুর্নীতির চর্চা তাদের মধ্যে প্রবল। এই দুর্নীতির সব থেকে উল্লিখিত দিক হলো তাদের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ। প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের এ বিষয়টি পূর্ব-নির্ধারিত। কারণ প্রতিশ্রুতির ফিরিস্তি তৈরি করার সময় তারা জানে যে, এসব প্রতিশ্রুতি তারা পূরণের জন্য দেয় না। এগুলো দেয়া হয় ভোটারদের প্রতারিত করার উদ্দেশ্যেই।

বাংলাদেশের বর্তমান সরকার ক্ষমতাসীন হওয়ার আগে ভোটারদের সামনে সাজানো-গোছানো এমনসব রঙিন প্রতিশ্রুতি হাজির করেছিল যার তুল্য আকর্ষণীয় প্রতিশ্রুতি অন্য কেউ, এমনকি তারা নিজেরাও এর আগে দেয়নি। একদিকে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার ও মইনউদ্দীন-ফখরুদ্দীন সরকারের সাত বছরের শোষণ-নির্যাতনে জর্জরিত হয়ে এবং অন্যদিকে আওয়ামী লীগ সরকারের ১৯৯৬-২০০১ সালের কীর্তিকলাপের কথা মনে না রেখে তাদের রঙিন প্রতিশ্রুতি দ্বারা বিভ্রান্ত হয়ে ভোটাররা আওয়ামী লীগকে বিগত নির্বাচনে বড় আকারে জিতিয়ে দিয়েছে। অন্যভাবে দেখলে বলা চলে যে, তাদের অন্য কিছু করারও থাকেনি। কারণ বিএনপিকে বাদ দিয়ে আওয়ামী লীগ ছাড়া তাদের সামনে কোনো বিকল্প ছিল না। বস্তুতপক্ষে বাংলাদেশের ভোটাররা যে নির্বাচনী কাঠামোর মধ্যে এখন বন্দি এবং যে শর্তে ওই নির্বাচন হয় তাতে বিএনপি এবং আওয়ামী লীগের মধ্যে একটিকে বাদ দিলে অন্যটি ছাড়া কোনো বিকল্প তাদের সামনে থাকে না। কাজেই প্রকৃতপক্ষে বিকল্পের অভাবেই ভোটাররা বিগত নির্বাচনে বাধ্য হয়ে আওয়ামী লীগকে ভোট দিয়ে জয়যুক্ত করেছে। নির্বাচনে জয়লাভ করে জাতীয় সংসদে বসে বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো জাতীয় সংসদের ঐতিহ্য রক্ষা করছে। প্রতিপক্ষকে কথাবার্তার প্রয়োজনীয় অধিকার থেকে বঞ্চিত রেখে সরকারদলীয় স্পিকার তার কর্তব্য পালন করে যাচ্ছেন। অন্যদিকে সরকারি ও বিরোধী দল দেশের গুরুত্বপূর্ণ সমস্যার পরিবর্তে দলীয় মতলববাজি এবং খিস্তিখেউর নিয়ে সংসদে বাক্যবিস্তার করে চলার ফলে কোনো গণতান্ত্রিক দায়িত্বই তাদের দ্বারা পালিত হয় না। এসবই হলো নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দুর্নীতির এক ধরন। এই দুর্নীতি তাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিরই অবিচ্ছেদ্য অংশ।

সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন লাভ করে ক্ষমতায় বসে আওয়ামী লীগ তাদের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি রক্ষা করছে, এমন কথা বলা যাবে না। নির্বাচনী প্রতিশ্রুতির ছিটেফোঁটা ছাড়া অন্য কিছু নিয়ে মাথা ঘামানোর সময় তাদের নেই। তারপরও তারা এমন সব কাজ করে যাচ্ছে যার সঙ্গে তাদের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতির কোনো সম্পর্ক নেই। দেশের জনগণের স্বার্থের কোনো সম্পর্ক নেই। অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক তার পিতা এবং অন্যান্য আত্মীয়স্বজনের নামে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও স্থাপনার নামকরণ এবং প্রতিহিংসার বশবর্তী হয়ে এসব থেকে অন্যদের নাম মুছে ফেলার যে ‘কর্মসূচি’ গ্রহণ করেছেন সেটা তাদের নানা ধরনের দুর্নীতিরই অন্যতম দৃষ্টান্ত।
[সূত্রঃ আমার দেশ, ১৩/০৫/১০]

বাংলাদেশের খনিজসম্পদ এবং লুণ্ঠনজীবীরা

বদরুদ্দীন উমর


মৌলভীবাজারের লাউয়াছড়া সংরক্ষিত বনাঞ্চলে গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য সরকার আমেরিকান তেল কোম্পানি শেভরনকে অনুমতি দেওয়ার বিরুদ্ধে অনেক প্রতিবাদ হয়েছিল। এর যুক্তিসম্মত কারণ এই ছিল যে, এ বনাঞ্চলে বহু ধরনের দুষ্প্রাপ্য প্রাণীর বাস। নানা জাতের পশুপাখি থেকে নিয়ে সরীসৃপের অস্তিত্বের জন্য এ বনাঞ্চলের জীববৈচিত্র্য সমৃদ্ধ। তেল কোম্পানি সেখানে ভারী ভারী যন্ত্রপাতি নিয়ে, আওয়াজ দিয়ে অনুসন্ধান কাজ চালিয়ে গেলে তার দ্বারা পরিবেশের ভারসাম্য বিনষ্ট হয়ে সেখানকার প্রাণিজগতের সমূহ ক্ষতির সম্ভাবনা। কিন্তু সরকার এ বিষয়ে ভ্রুক্ষেপ না করে শেভরনকে গ্যাস অনুসন্ধানের অনুমতি দিয়েছিল। ফলে লাউয়াছড়ার জীবজন্তু, পাখি, সরীসৃপ কীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল, কীভাবে তাদের অনেকে লোকালয়ে বের হয়ে দুর্বৃত্ত প্রকৃতির লোকজনের হাতে নিধন হয়েছিল তার অনেক রিপোর্ট সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছিল। এখন এদিক দিয়ে পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। বর্তমান সরকার আমেরিকান সাম্রাজ্যবাদী তেল কোম্পানি শেভরনকে লাউয়াছড়ায় গ্যাস উত্তোলনের চূড়ান্ত অনুমোদন প্রদান করেছে। বিস্ময়ের ব্যাপার, এ নিয়ে দেশে কোনো প্রতিবাদ নেই। একমাত্র জাতীয় মুক্তি কাউন্সিল ছাড়া এর বিরুদ্ধে কেউ মিছিল-সমাবেশ করেনি, বিবৃতিও দেয়নি। ৭ মে এই একমাত্র প্রতিবাদের শুধু ছবি ইংরেজি 'নিউ এজ' পত্রিকায় ৮ মে তারিখে প্রকাশিত হওয়া ছাড়া অন্য কোথাও এর রিপোর্ট প্রকাশিত হয়নি। 'জাতীয় তেল-গ্যাস, বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা কমিটি' চলমান বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সংকট নিরসনে তাদের সাত দফা দাবি বাস্তবায়নের জন্য ৯ মে ঢাকার পল্টন থেকে জাতীয় প্রেসক্লাব পর্যন্ত কয়েক মিনিটের এক পদযাত্রা করলেও তার মধ্যে লাউয়াছড়ায় শেভরনকে গ্যাস উত্তোলনের অনুমতি প্রদানের বিরুদ্ধে কোনো প্রতিবাদ দেখা যায়নি (কালের কণ্ঠ, ১০-৫-১০)। অথচ এই অনুমতির ফলে শেভরন যে লাউয়াছড়া সংরক্ষিত বনাঞ্চল ও সে সঙ্গে সেখানকার জীববৈচিত্র্য ধ্বংস করবে_ এ নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। এসব যে ওপরতলার সরকারি কর্তৃপক্ষকে সন্তুষ্ট করেই হচ্ছে এতেও বাংলাদেশের বিদ্যমান পরিস্থিতিতে সন্দেহের লেশমাত্র কারণ নেই।

আমেরিকান শেভরন কোম্পানি যে সরকারের কত পেয়ারের জিনিস তার ওপর ৮ মে দৈনিক যুগান্তরে একটি বড় রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে। রিপোর্টটির একটি অংশ এখানে উদ্ধৃত করলে আলোচনার সুবিধা হবে। এতে বলা হয়, 'আন্তর্জাতিক তেল কোম্পানি (আইওসি) শেভরনের বাংলাদেশ অফিসে ৮২ জন বিদেশিকে বছরে ১৮৫ কোটি টাকা বেতনভাতা দেওয়া হয়। অথচ ৮৮০ জন স্থানীয় স্টাফ বছরে পান মাত্র ৮৬ কোটি টাকা। প্রতি বছর শেভরন তিনটি গ্যাস ক্ষেত্রের পরিচালনা বাবদ সরকারের কাছ থেকে এ অর্থ আদায় করে। উৎপাদন-বণ্টন চুক্তির (পিএসসি) ফাঁকফোকরে শেভরন সরকারকে কোনো আয়কর শুল্কও দেয় না। স্থানীয় ও বিদেশিদের মধ্যে বিশাল বেতন বৈষম্য, অপ্রয়োজনীয় বিদেশি নিয়োগসহ নানা অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে শেভরনের বিরুদ্ধে। দেশীয় প্রকৌশলী বা বিশেষজ্ঞ থাকা সত্ত্বেও সেই পদে বিদেশি নিয়োগ এবং একই পদে নানা উপাধিতে একাধিক বিদেশির নিয়োগ নিয়ে পেট্রোবাংলা বারবার আপত্তি দিয়েছে। কিন্তু মার্কিন এ কোম্পানির স্বেচ্ছাচার কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে রহস্যজনকভাবে সরকার কোনো ব্যবস্থা নেয় না। অভিযোগ রয়েছে, পেট্রোবাংলা এবং জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের কয়েক পদস্থ কর্মকর্তাকে খুশি করে শেভরন তাদের বাজেট অনুমোদন করে নিচ্ছে।' এতে আরও বলা হচ্ছে, 'জালালাবাদ, মৌলভীবাজার এবং বিবিয়ানায় সরকারের লাভের গ্যাস সরকার কিনে তাদের এ পরিচালনা ব্যয় পরিশোধ করে।'

এ হলো লাভের গুড় পিঁপড়ায় খাওয়ার মতো ব্যাপার। রিপোর্টটিতে এ বিষয়ে আরও অনেক বিস্তারিত বিবরণ আছে, যার উল্লেখ এখানে নিষ্প্রয়োজন। ওপরের রিপোর্টে যা বলা হয়েছে তার থেকেই বেশ ভালোভাবে বোঝা যায়, আমাদের দেশের 'দেশপ্রেমিক' সরকার সাম্রাজ্যবাদের হাতে দেশের সম্পদ কীভাবে তুলে দিচ্ছে; জ্বালানি মন্ত্রণালয়ে ক্ষমতাসীন দলের শীর্ষস্থানীয় যারা বসে আছেন তারা পেট্রোবাংলাসহ বিভিন্ন সরকারি সংস্থার মাধ্যমে দেশের খনিজসম্পদ কীভাবে সাম্রাজ্যবাদী কোম্পানিকে লুটপাট করতে দিয়ে সেই লুটের একটা বখরা নিজেদের পকেটে ফেলে অর্থ-সম্পদের মালিক হচ্ছেন।

যে সাম্রাজ্যবাদী বিদেশি কোম্পানিগুলো বাংলাদেশের বিভিন্ন খনিজসম্পদের ওপর লোলুপ দৃষ্টি রেখেছে এবং বাস্তবত উত্তোলনের কাজে নিযুক্ত আছে, তাদের মধ্যে মার্কিন কোম্পানি শেভরনই সব থেকে শক্তিশালী এবং বাংলাদেশ সরকারের সব থেকে আদরের। এটা হওয়ারই কথা, কারণ এর সঙ্গে সাবেক মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট ডিক চেনির ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। উপরোক্ত গ্যাস ক্ষেত্রগুলো অন্যান্য মার্কিন কোম্পানির হাত থেকে এখন শেভরনের হাতে এসেছে এবং এরাই এখন বাংলাদেশে গ্যাসের সামগ্রিক কারবারে সর্বোচ্চ স্বেচ্ছাচারিতার দৃষ্টান্ত রাখছে।

বাংলাদেশে গ্যাস ও কয়লার সন্ধান পাওয়ার পর থেকে সাম্রাজ্যবাদী বিদেশি কোম্পানির কাছে যে কোনো শর্তে এসব উত্তোলনের কাজ দেওয়ার জন্য শাসকশ্রেণীর দালাল মুৎসুদ্দিরা এই যুক্তি দেখায়, মাটির তলায় এসব ফেলে রাখা অর্থহীন। কাজেই এগুলো যথাশিগগির তুলে ফেলে যা পাওয়া যায় তাই সংগ্রহ করা দরকার! এর থেকে মূঢ় এবং সে সঙ্গে দুর্নীতিবাজ বক্তব্য আর কী হতে পারে? মাটির তলায় খনিজসম্পদ থাকা মানে চিরতরে পড়ে থাকা নয়। সেটা অবশ্যই তোলা দরকার। কিন্তু কখন ও কী শর্তে সেটা তোলা যাবে এ বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তেল-গ্যাসের যে মজুদ আছে তার একটি বড় অংশ তারা নিজেরা না তুলে মাটির নিচেই রেখে দিয়েছে প্রয়োজন অনুযায়ী, বিশেষত আপৎকালে, জরুরি অবস্থায় ব্যবহারের জন্য। নিজেদের তেল-গ্যাস এভাবে মাটির নিচে রেখে তারা মরিয়া হয়ে বিশ্বজুড়ে তেল-গ্যাস লুণ্ঠনের জন্য যুদ্ধ পর্যন্ত করছে। আর আমাদের দেশের দুর্নীতিবাজ ও দেশীয় স্বার্থবিরোধী শাসকচক্র দেশের সম্পদ চরম ক্ষতিকর শর্তে ও হীন স্বার্থে বিদেশি সাম্রাজ্যবাদী কোম্পানিগুলোর হাতে তুলে দিচ্ছে।

এশিয়া এনার্জি নামে যে ব্রিটিশ কোম্পানিকে তারা ফুলবাড়ীর কয়লা উত্তোলনের ইজারা দিতে চেয়েছিল এবং এখনও তার জন্য নতুনভাবে চক্রান্ত ও পাঁয়তারা করছে, সেখানে ফুলবাড়ীর কয়লার মাত্র ৬ শতাংশ ছিল বাংলাদেশ সরকারের প্রাপ্য। বাকি ৯৪ শতাংশ পাওনা হতো এশিয়া এনার্জির। অর্থাৎ এর অর্থ হলো আমাদের দেশের মাটির তলায় আমাদের সম্পদ ফেলে না রেখে এগুলো যত তাড়াতাড়ি সম্ভব যে কোনো শর্তে সাম্রাজ্যবাদীদের হাতে তুলে দেওয়া, তাদের দ্বারা লুণ্ঠিত হতে দেওয়াই হলো দেশপ্রেমমূলক কর্তব্য!! এই হলো বাংলাদেশের শাসকশ্রেণীর চরিত্র। সাম্রাজ্যবাদী লুণ্ঠনজীবীদের (ঢ়ৎবফধঃড়ৎ) সেবাদাস হিসেবে এখানকার লুণ্ঠনজীবীদের অধীনতার সম্পর্কের মাধ্যমেই দেশীয় সম্পদ এভাবে বিদেশিদের কাছে পাচার হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে যারা দুর্নীতি করছে তারা শাসকশ্রেণী ও সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ের লোক। তারা বিদেশিদের সঙ্গে এই সম্পর্কের মাধ্যমে বিদেশে নিজেদের লুণ্ঠনের বখরা পাচার করছে। তারা এতই ধূর্ত যে, দেশের সাধারণ আইন-কানুন দিয়ে এদের দুর্নীতি ও দেশীয় স্বার্থবিরোধী কাজের জন্য শাস্তি দেওয়ার উপায় নেই।
(সুত্র, সমকাল, ১১/০৫/২০১০)

জনগণ এখন শুধু সরকার পরিবর্তন নয় সমাজব্যবস্থার পরিবর্তন চান

বদরুদ্দীন উমর


বাংলাদেশের জনগণ আজ হাজারও সমস্যায় জর্জরিত ও বিক্ষুব্ধ। জনগণের ওপর, বিশেষত বিপুল অধিকাংশ শ্রমজীবী জনগণের ওপর শোষণ-নির্যাতন কোন নতুন ব্যাপার নয়। এমন কোন সময় এ অঞ্চলে দেখা যায়নি যখন এ অবস্থার কোন ব্যতিক্রম ছিল। ব্রিটিশ, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ আমলে এ দিক দিয়ে জনগণের জীবনযাত্রা ও জীবন সংগ্রামের একটা ধারাবাহিকতা আছে।

এর প্রক্রিয়ায় দীর্ঘদিন ধরে জনগণের মধ্যেও পরিবর্তনের একটা তাগিদ স্বাভাবিকভাবেই দেখা যাচ্ছে। জনগণের একটা ক্ষুদ্র অংশ সমগ্র সমাজব্যবস্থা পরিবর্তনের একটা তাগিদ অনুভব করলেও বিপুল অধিকাংশ মানুষই এই পরিবর্তন বলতে বুঝেছেন সরকার পরিবর্তন। বিদ্যমান সরকারের শোষণ-নিপীড়নের দ্বারা জর্জরিত হয়ে তারা মনে করেছেন, সেই সরকারের পরিবর্তন হলে অবস্থার কিছু পরিবর্তন হবে। কাজেই তারা নির্বাচনের মাধ্যমে এই পরিবর্তনের চেষ্টা করেছেন। এক সরকারের পরিবর্তে অন্য সরকার ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হলে তাদের ওপর শোষণ-নির্যাতনের কিছু কমতি হবে, এটা এমনভাবে তাদের বিশ্বাসের অংশে পরিণত হয়েছিল যে, বারবার নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে কোন সুফল না পাওয়া সত্ত্বেও তারা একই প্রত্যাশায় বুক বেঁধে ভোট দিয়ে এসেছেন।

সরকার পরিবর্তন সত্ত্বেও পরিস্থিতির পরিবর্তন না হওয়ায় তাদের মধ্যে এক ধরনের হতাশার সৃষ্টি হলেও তারা চিন্তাগত অভ্যাসের বশবর্তী হয়ে এর পরও নির্বাচনে ভোট দিয়ে এক দলের পরিবর্তে অন্য দলকে ক্ষমতায় বসিয়েছেন। এ অবস্থা ১৯৯৬ সাল থেকে দেখা গেছে। এর সর্বশেষ দৃষ্টান্ত হল ২০০৮ সালের ডিসেম্বরের নির্বাচন। বিএনপি ও বেনামি সামরিক সরকারের সাত বছরের শাসনকালে জনগণ যেভাবে বিপর্যস্ত জীবনযাপন করতে বাধ্য হয়েছিলেন, তার পরিবর্তনের জন্য তারা আওয়ামী লীগকে ভোট দেন। প্রতিবারের মতো এবারও নির্বাচনী দলগুলোর ভুয়া প্রতিশ্র“তির অভাব ছিল না। এর মধ্যে আওয়ামী লীগের প্রতিশ্র“তি ছিল সব থেকে রঙিন। সাত বছরের অন্য দলীয় শাসনের প্রতি বীতশ্রদ্ধ এবং আওয়ামী লীগের রঙিন প্রতিশ্র“তির দ্বারা মোহাবিষ্ট হয়ে জনগণ তাদের নির্বাচনে জিতিয়ে দেন।

এই বড় আকারের নির্বাচন বিজয়ের পর আওয়ামী লীগ শাসক শ্রেণীর কয়েকটি ছোটখাটো দলকে লেজে বেঁধে গঠন করে তাদের তথাকথিত মহাজোট সরকার। কিন্তু বিএনপি-জামায়াতের জোট সরকার এবং মইন-ফখরুদ্দীনের বেনামি সামরিক সরকারের শাসনের অবসান হলেও পরিস্থিতির কোন পরিবর্তন তো হল না, হওয়ার কথাও নয়। দেখা গেল, পূর্ববর্তী সময়ের মতো এবারও জনগণ বিভ্রান্ত ও প্রতারিত হয়েছেন। শুধু তাই নয়, এবারের মিথ্যা নির্বাচনী প্রতিশ্র“তি তাদের এমনভাবে বিভ্রান্ত ও প্রতারিত করেছে, যার পূর্ব দৃষ্টান্ত নেই। এর কারণ আওয়ামী লীগ এবার তাদের নির্বাচনী প্রতিশ্র“তি বড় আকারে এবং নানা বর্ণে রঞ্জিত করে জনগণের সামনে উপস্থিত করেছিল। এই বড় ও আকর্ষণীয় প্রতিশ্র“তি পালনের কোন লক্ষণই বর্তমান সরকারের মধ্যে না দেখে জনগণ অল্পদিনের ভেতরেই তাদের প্রতি মোহমুক্ত হয়েছেন, যা ইতিপূর্বে এত তাড়াতাড়ি কখনও দেখা যায়নি। মাত্র পনের-ষোল মাসের মধ্যেই বর্তমান সরকার নিজের লুণ্ঠনজীবী (চৎবফধঃড়ৎু) চরিত্র জনগণের সামনে এমনভাবে উšে§াচিত করেছে যা প্রতারিত হতে অভ্যস্ত বাংলাদেশের জনগণকে শুধু বিস্মিতই করেনি, তাদের চোখ খুলে দিয়েছে। এই সরকারের চুরি, দুর্নীতি, লুণ্ঠন ও তার সঙ্গে সন্ত্রাস যুক্ত হয়ে দেশে যে অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে ও যেভাবে করেছে, এটা আগে দেখা যায়নি।

এই নৈরাজ্য সৃষ্টির ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগ এক নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। নিজেদের মূল রাজনৈতিক দলের ক্ষমতার জোরে প্রথমদিকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোয় এবং পরে তার সঙ্গে সমাজের ব্যাপকতর ক্ষেত্রে চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, গুণ্ডামি, খুনখারাবি করে চারদিকে তারা এক ভয়াবহ বিশৃংখল পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে। এটা ঘটছে এমন অবস্থায়, যখন নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের অবাধ ও আকাশচুম্বী মূল্য বৃদ্ধি, কাজ ও মজুরির অভাব, কৃষি ও শিল্পক্ষেত্রে নৈরাজ্য, জীবন ও সম্পত্তির নিরাপত্তার অভাবে সাধারণ মানুষের জীবন অতিষ্ঠ রয়েছে।

সরকারের ছত্রছায়ায় ষোল মাস ছাত্রলীগ তাদের দুর্নীতি ও সন্ত্রাস চালিয়ে এখন এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে, যাতে চারদিকে এর বিরুদ্ধে জনমত প্রবল হয়েছে। এই প্রবল বিরুদ্ধ জনমত শেষ পর্যন্ত আওয়ামী সরকারকে তাদের ছাত্র সংগঠনটির বিরুদ্ধে কিছু পদক্ষেপ নেয়ার তোড়জোড় দেখাতে বাধ্য করেছে। তারা পুলিশকে এতদিনে হুকুম দিয়েছে বিশৃংখলা সৃষ্টিকারী ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিতে। কিন্তু এই হুকুম কতটুকু কার্যকর হবে, সেটা বোঝায় অসুবিধা নেই। কারণ এ ধরনের কাজ শুধু ছাত্রলীগই করছে তাই নয়, যুবলীগ, মহিলা লীগসহ তাদের রঙবেরঙের অনেক লীগই এ কাজ করছে। কাজেই এ দিক দিয়ে ছাত্রলীগের অবস্থা হয়েছে ‘সকল পক্ষী মৎস্যভক্ষী মৎস্যরাঙা কলঙ্কিনি’র মতো।

আওয়ামী লীগের দলীয় নেতাকর্মীরা তো আছেই, তার ওপর তাদের এমপি, উপজেলা চেয়ারম্যান, মেম্বর ইত্যাদি লোকরা বিভিন্ন স্তরে ‘গডফাদার’ নামক অপরাধী চক্রের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে এখন সর্বত্র সক্রিয়। বস্তুতপক্ষে ছাত্রলীগ তাদের রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের এই চক্রের পৃষ্ঠপোষকতাতেই এবং তাদের দুর্নীতি ও সন্ত্রাসের কাঠামোর মধ্য থেকেই নিজেরা দুর্নীতি ও সন্ত্রাস চালিয়ে যাচ্ছে। আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব এখন তাদের ছাত্র সংগঠন নিয়ন্ত্রণের জন্য হম্বিতম্বি করলেও ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা জানে, তাদের দলের নেতৃস্থানীয় লোকজন একই কাজ অবাধে ও বেপরোয়াভাবে চালিয়ে যাচ্ছে। শুধু চালিয়ে যাচ্ছে তাই নয়, এ কাজ থেকে তাদের বিরত রাখা কারও পক্ষে সম্ভব নয়। আওয়ামী লীগের রাজনীতি ও সংগঠন দুর্নীতি ও সন্ত্রাসের সঙ্গে এত ওতপ্রোতভাবে সম্পর্কিত যে, এই দলকে এ দুই থেকে বিযুক্ত করার চেষ্টার অর্থ হল তাকে ভেঙে ফেলা। কে চায় নিজেদের দলকে নিজেরাই ভেঙে ফেলতে?

মাত্র ক’দিন আগে বিএনপির রাজশাহী সমাবেশে বিভিন্ন এলাকা থেকে সেখানে যাওয়ার পথে কিভাবে আওয়ামী লীগের গুণ্ডাপাণ্ডারা তাদের ওপর আক্রমণ চালিয়ে খুন-জখম করছে, তার বিবরণ সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে। বিএনপি জনস্বার্থের প্রতিনিধি নয়, তাদের মধ্যেও দুর্নীতি, প্রতারণা, সন্ত্রাস ইত্যাদির অভাব নেই। তারা আওয়ামী লীগের শ্রেণী ভাই। তা সত্ত্বেও দলীয় স্বার্থে আওয়ামী লীগ তাদের ওপর যে হামলা চালাচ্ছে, তাতে তার ফ্যাসিস্ট চরিত্র স্পষ্ট। এই সরকার যে শুধু তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী শ্রেণী দলকেই আক্রমণ করছে তা নয়। তারা আরও কঠোরভাবে নানা কায়দায় তাদের হামলা পরিচালনা করছে প্রগতিশীল সংগঠনের ওপর। তাদের সভা, সমাবেশ, মিছিলের ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করে এবং পুলিশি হামলা চালিয়ে তাদের শ্বাসরুদ্ধ করছে।

কাজেই ছাত্রলীগের বর্তমান সন্ত্রাসী তৎপরতাকে আওয়ামী লীগের এই নীতি ও তৎপরতা থেকে বিচ্ছিন্নভাবে দেখার চেষ্টা অবাস্তব। ঠিক একই কারণে ছাত্রলীগ দমনের জন্য তাদের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের কঠোর হওয়ার হুমকি যে তাদের প্রতারণার আর একটি দৃষ্টান্ত, এতে সন্দেহ নেই। তাদের এখন বাধ্য হয়ে এ কাজ করতে হলেও এর দ্বারা পরিস্থিতি সামাল দেয়ার কোন সম্ভাবনা তাদের নেই। যে রোগ দ্বারা আওয়ামী লীগ সর্বস্তরে নিজেরাই আক্রান্ত, ছাত্রলীগের সেই একই রোগ তারা সারাবে কিভাবে?

বর্তমান সরকারের ক্ষমতাসীন হওয়ার ষোল মাসের মধ্যেই জনগণ এখন পরিবর্তনের বিষয়ে নতুনভাবে চিন্তা-ভাবনা করছেন। ‘যে যায় লঙ্কায় সেই হয় রাবণ’Ñ এই চলতি কথার সারমর্ম এখন তারা উপলব্ধি করছেন। এক্ষেত্রে লঙ্কায় যাওয়ার অর্থ হল নির্বাচনের মাধ্যমে সরকারের গদিতে বসা।
আওয়ামী লীগ, বিএনপিসহ শাসক শ্রেণীর সব দলের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড, শোষণ, নির্যাতন ও প্রতারক চরিত্র জনগণ এখন গভীরভাবে উপলব্ধি করছেন। এই উপলব্ধি চিন্তার ক্ষেত্রে তাদের এমন জায়গায় এনে দাঁড় করিয়েছে, যাতে তারা এখন আর শুধু সরকার পরিবর্তনের মধ্যে আশার ক্ষীণতম আলোও দেখেন না। তারা এ বিষয়ে নিশ্চিত যে, ভোট দিয়ে সরকার পরিবর্তনের মাধ্যমে তাদের জীবনের কোন সমস্যার সমাধানই সম্ভব নয়। এজন্য প্রয়োজন বিদ্যমান সমাজব্যবস্থা ও শাসন কাঠামোর আমূল পরিবর্তন। এই পরিবর্তন কিভাবে ঘটবে এবং কারা এই পরিবর্তন ঘটাবে, এ বিষয়ে তাদের স্পষ্ট ধারণা এখনও না থাকলেও এই পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তার বিষয়ে তারা নিঃসন্দেহ এবং এর তাগিদ তারা অনুভব করছেন। তাদের চেতনার এই পরিবর্তন যে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির এক বড় ধরনের ইতিবাচক দিক এ বিষয়ে কোন সংশয় নেই।
[সূত্রঃ যুগান্তর, ০৯/০৫/১০]

বাংলাদেশে দুর্নীতিই সার্বভৌম

বদরুদ্দীন উমর


দুর্নীতি দমন কমিশনকে দমন করার ব্যবস্থা হচ্ছে। এই দমন কর্ম করছে ২০০৮ সালের সাধারণ নির্বাচনে জাতীয় সংসদে বিশাল সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনকারী আওয়ামী লীগ। এর মাধ্যমে আবার প্রমাণিত হলো যে, বাংলাদেশের রাজনীতি, অর্থনীতি, শিক্ষা, সংস্কৃতি, চিকিত্সাসহ সর্বক্ষেত্রে দুর্নীতি সার্বভৌম। দুর্নীতির সার্বভৌমত্ব তার পদচিহ্ন সর্বত্র রাখছে। এই মুহূর্তে তার দ্বারা পদদলিত হতে যাচ্ছে দুর্নীতি দমন কমিশন।

২৬ এপ্রিল মন্ত্রিসভার বৈঠকের পর প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব সাংবাদিকদের বলেন, �দুর্নীতি দমন কমিশন আইন-২০০৪ এর সংশোধনী নীতিগত অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রিসভা। এতে কিছু বিষয়ে সংশোধনী আনা হয়েছে। এর মধ্যে কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে দুর্নীতির মিথ্যা অভিযোগ আনলে অভিযোগকারীর বিরুদ্ধে পাঁচ বছরের জেল ও আর্থিক জরিমানার বিধান রয়েছে। (যুগান্তর ২৭-৪-২০১০) উপরোক্ত সংশোধনীর অন্যদিক বাদ দিয়ে এখানে যা বলা হয়েছে তা যে কোনো তদন্ত ও বিচার ব্যবস্থার ক্ষেত্রে এক বিরাট প্রতিবন্ধক, এ নিয়ে কোনো সত্ ও যুক্তিনিষ্ঠ ব্যক্তির দ্বিমত থাকার কথা নয়। শুধু তাই নয়, এটা বাস্তবত তদন্ত ও বিচার ব্যবস্থা অকার্যকর করে রাখারই এক স্বচ্ছ কৌশল। দুদকের মামলার বিষয়ে যা বলা হয়েছে সেটা যদি সাধারণ মামলার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য করার ব্যবস্থা হয়, তাহলে নিম্ন থেকে উচ্চতম আদালত পর্যন্ত যে কোনো মামলা দায়ের করে পরাজিত হওয়ার পর পরাজিত ব্যক্তির জেল-জরিমানা হওয়ার কথা। বিচার ব্যবস্থার ক্ষেত্রে এর থেকে অদ্ভুত ও হাস্যকর ব্যাপার আর কী হতে পারে? শুধু তাই নয়, এ এক মহাবিপজ্জনক ব্যাপার। কারণ এর অর্থ হবে কার্যত দেশের বিচার ব্যবস্থার উচ্ছেদ।

আদালতে শুধু দুর্নীতির বিরুদ্ধে নয়, যে কোনো বিষয়ে একজন নাগরিক অন্য একজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ এনে মামলা দায়ের করতে পারেন। এই মামলায় অভিযুক্ত ব্যক্তির বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ প্রমাণিত হলে তার শাস্তি আইন অনুযায়ী হয়। কিন্তু মামলায় হেরে গেলে একজনের শাস্তির বিধান আইনের কোন্ খাতায় লেখা আছে? কেউ যদি ইচ্ছাকৃতভাবে কোনো মিথ্যা বলে তার জন্য আইনে (চবহধষ ঈড়ফব) ব্যবস্থা আছে। কাজেই এ নিয়ে দুদকের ক্ষেত্রে কোনো বিশেষ ব্যবস্থার প্রয়োজনই নেই। মন্ত্রিপরিষদ প্রস্তাবিত সংশোধনীতে মামলায় মিথ্যা অভিযোগ সংক্রান্ত ব্যাপারে বিশেষভাবে শাস্তি বিধানের যে কথা বলা হয়েছে বাস্তবত তা হলো, দুর্নীতির বিরুদ্ধে দুদকে মামলা দায়েরকারীর বিরুদ্ধে হুমকিস্বরূপ। কারণ দুদক নিজে কোনো বিচার করে না। তদন্তে ও প্রসিকিউটরের কাজ করে। দুর্নীতি বা অন্য কোনো বিষয় নিয়ে মামলায় জয়-পরাজয় অনেক কিছুর ওপর নির্ভর করে। কাজেই পরাজিত পক্ষকে শাস্তি দেয়ার কোনো প্রশ্ন নেই। শাস্তির প্রশ্ন তখনই উঠতে পারে যখন মামলার নিষ্পত্তির মাধ্যমে প্রমাণিত হয় যে, অভিযোগকারী একেবারে ইচ্ছাকৃতভাবে মানহানি ও হয়রানির উদ্দেশ্যে কোনো মিথ্যা অভিযোগ একজনের বিরুদ্ধে এনে মামলা দায়ের করেছে। আগেই বলা হয়েছে, এর জন্য চবহধষ ঈড়ফব-এ সুনির্দিষ্ট বিধান আছে, যার অধীনে শাস্তি হতে পারে। তবে এই শাস্তি ঢালাওভাবে পাঁচ বছর জেল বা সেই সঙ্গে জরিমানা নয়। কী শাস্তি হবে সেটা মিথ্যার অভিযোগ ওজন করে আদালতেরই নির্ধারণ করার কথা। তার জন্য মন্ত্রিপরিষদের হুকুমজারির কোনো প্রয়োজন নেই।

এসব অতি সাধারণ জ্ঞানের ব্যাপার। কিন্তু যে কারণে মন্ত্রিপরিষদ এই সংশোধনী প্রস্তাব করেছে ও কার্যকর করতে যাচ্ছে তার একটিই উদ্দেশ্য�যারা দুর্নীতিবাজ তাদের দুর্নীতির বিরুদ্ধে দেশের নাগরিকদের অভিযোগ উত্থাপন করা থেকে বিরত রাখা। দুর্নীতির অভিযোগ অনেক কারণেই মিথ্যা প্রমাণিত হতে পারে। এমনকি এটা হতে পারে খোদ আদালতের দুর্নীতি ও ভ্রান্ত বিচারের কারণেও। এটা হতে পারে সরকারি কর্তাব্যক্তিদের হুমকির কারণে। এই পরিস্থিতিতে দুর্নীতির অভিযোগ এনে একজনের পক্ষে সেটা প্রমাণ করার অসুবিধা অনেক। তাছাড়া যেভাবে শীর্ষতম থেকে নিম্নপর্যায়ের সরকারি লোকদের মামলার পর মামলা আদালত বিচার না করে সরকারি চাপ ও নির্দেশের মুখে খারিজ করে চলেছে তার থেকে ভালোভাবেই বোঝা যায় যে, সরকারি লোকদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণ করা একটা মহাদুরূহ, এমনকি অসম্ভব ব্যাপার।

দুর্নীতি দমনের ক্ষেত্রে দুদক যে প্রকৃতপক্ষে ঠুঁটো জগন্নাথের ভূমিকাই পালন করবে এর আর এক ব্যবস্থা হচ্ছে দুদকে মামলা করার জন্য সরকারি অনুমতির প্রয়োজনীয়তা। দুদকে দায়েরকৃত মামলার অধিকাংশ বা একটা বড় অংশ হলো, সরকারি ও বিরোধী দলের রাজনৈতিক ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে। এই অবস্থায় দুদক কর্তৃক যে কোনো মামলা দায়েরের ক্ষেত্রে যদি সরকারের অনুমতি নিতে হয় তাহলে সরকারি লোকদের দুর্নীতির বিরুদ্ধে মামলা হবে কীভাবে? এটা কি ভাবা যায় যে, সরকার তার নিজের লোকদের বিরুদ্ধে দুদককে মামলা করার অনুমতি দেবে? বিশেষ করে শক্তিধর সরকারি নেতা-নেত্রীদের বিরুদ্ধে বর্তমান পরিস্থিতিতে দুদকের মামলা দায়ের করা কি সম্ভব, যেখানে সরকারি লোকদের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত মামলার বিচার না হয়ে আদালত কর্তৃক সেসব খারিজ হয়ে যাচ্ছে?

বাংলাদেশে সমাজের একটা বড় অংশ এখন অপরাধীকরণকৃত (Criminalised) হয়েছে। এই অপরাধীকরণকৃত অংশের মধ্যে শাসকশ্রেণীর উচ্চতম শিখরে অধিষ্ঠিত লোকজনেরই প্রাধান্য। তাদের এই প্রাধান্যের প্রভাব চুঁইয়ে চুঁইয়ে নিচের দিকে নেমে এসে নিম্নতর বিভিন্ন পর্যায়ে অবস্থিত লোকদের চরিত্র দুর্নীতির রসে সিক্ত করছে। এই দুর্নীতির কারণে সব সমাজে কীভাবে আজ চুরি-ডাকাতি, সন্ত্রাস ও খুনখারাবি ছড়িয়ে পড়ে এক বিভীষিকার রাজত্ব এখানে কায়েম হয়েছে তার চিত্র প্রতিদিনই সংবাদপত্রের পাতায় দেখা যায়। একটি দেশে যখন এই অবস্থা বিরাজ করে তখন তার নিয়ন্ত্রণে বিচার ব্যবস্থার একটা ভূমিকা থাকার কথা। কিন্তু বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থাও আজ হয়ে দাঁড়িয়েছে উপরে বর্ণিত সাধারণ অবস্থার অধীন। বিগত ২৪ এপ্রিল একটি সেমিনারে সাবেক প্রধান বিচারপতি মাহমুদুল আমিন চৌধুরী যেভাবে বিচার বিভাগকে কাচের ঘর হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন তার থেকে বিচার ব্যবস্থার ভঙ্গুর চরিত্র সহজেই বোঝা যায়।

বিচার ব্যবস্থায় এখন যেভাবে সরকার হস্তক্ষেপ করছে এদিক থেকেই সাবেক প্রধান বিচারপতি মাহমুদুল আমিন চৌধুরী তার উপরোক্ত বক্তব্য প্রদান করেছেন। এদেশে নির্বাচনী এবং আইন বিভাগের প্রতি জনগণ অনেক আগেই আস্থা হারিয়েছেন। এই পরিস্থিতিতে বিচার বিভাগকেই তারা দুর্নীতি, সন্ত্রাস ও সবরকম অবিচারের বিরুদ্ধে প্রতিকারের এক ভরসাস্থল মনে করে এসেছেন, যদিও এ ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতাও তাদের অজানা নয়। কিন্তু বর্তমানে যেভাবে বিচার বিভাগ �কাচের ঘরে� পরিণত হয়েছে এবং সরকারি হস্তক্ষেপের কারণে এটা হয়েছে তার থেকে বিপজ্জনক পরিস্থিতি একটা দেশের জন্য আর কী হতে পারে?

আসলে পরিস্থিতি এ ক্ষেত্রে কী ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে তারই এক দৃষ্টান্ত হলো, ২৬ এপ্রিল মন্ত্রিসভার বৈঠকে দুদক সম্পর্কিত সংশোধনী। দুদকে দুর্নীতির অভিযোগ দায়ের করে কেউ মামলা করে পরাজিত হলে তার পাঁচ বছর জেল ও সেই সঙ্গে জরিমানা হবে এবং সরকারি লোকদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ দায়েরের জন্য সরকারের অনুমতি লাগবে এ দুই বিধান যে ভঙ্গুর বিচার ব্যবস্থাকে একেবারে ভেঙে ফেলারই ব্যবস্থা, এতে আর সন্দেহ কী? বাংলাদেশে এখন দুর্নীতিই যে সার্বভৌম এর থেকে তার বড় প্রমাণ আর কী হতে পারে?
(সুত্র, আমার দেশ, ২৯/০৪/২০১০)

বাংলাদেশে নির্বাচনী রাজনীতি গণতন্ত্রকে সমাধিস্থ করছে

বদরুদ্দীন উমর


কোনো সমাজে দুর্নীতি প্রবল প্রতাপে সমাজের সবকিছু যখন শাসন করে তখন কোনো কিছুই তার শাসনের বাইরে থাকে না। বাংলাদেশে যে কোনো সমস্যা বিচার করলে এরই প্রমাণ মেলে। প্রত্যেক সমস্যাই এখানে দুর্নীতির থেকে মূল অথবা দুর্নীতির কারণে তার সমাধান সম্ভব নয়। জনগণের বিভিন্ন কর্মক্ষেত্র, কৃষি, শিল্প, বাণিজ্য, যাতায়াত ব্যবস্থা, চিকিৎসা, শিক্ষা, সংস্কৃতি, রাজনীতি_ সর্বত্র এখন দুর্নীতির শাসন। আর এর সবকিছুর ওপর আছে সরকার ও প্রশাসনের দুর্নীতি, তাদের সঙ্গে সম্পর্কিত অথবা সরাসরি তাদের অধীন সব ধরনের সংস্থার দুর্নীতি। বস্তুতপক্ষে এই দ্বিতীয়োক্ত ক্ষেত্রের দুর্নীতিই তার প্রভাব অন্য ক্ষেত্রে বিস্তার করে দুর্নীতিকে সমাজে এক সার্বভৌম শক্তিতে পরিণত করেছে।

বাংলাদেশের জনগণ এখন হাজারো সমস্যায় জর্জরিত। এসব সমস্যার কোনোটিই সমাধানের অযোগ্য নয়। জনগণ যেসব সমস্যার ভারে নুইয়ে আছে সেগুলোর বিপুল অধিকাংশের সমাধান সহজ ও অল্প সময়সাপেক্ষ। অন্য সমস্যাগুলোর সমাধানও যুক্তিসম্মত সময়সীমার মধ্যে সম্ভব। কিন্তু বাংলাদেশে কোনো সমস্যার সমাধানই হচ্ছে না, যেখানে সমাধান সহজ সেখানেও তা থাকছে নাগালের বাইরে। প্রত্যেক ক্ষেত্রেই দুর্নীতি এক প্রচণ্ড প্রতিবন্ধক হিসেবে সমাধানের পথ আগলে থাকছে। এবং এভাবে সমাধানের পথ আগলে রেখে শাসকশ্রেণীর রঙবেরঙের এবং নানা দলের দুর্বৃত্তরা নিজেদের স্বার্থ উদ্ধার করছে, পকেটভর্তি করছে, রাতারাতি ভৌতিকভাবে ধনসম্পদ অর্জন করছে। এদের সঙ্গে সহযোগিতার জন্য আছে পুলিশ ও বিচারব্যবস্থা। যে দল যখন ক্ষমতায় থাকে তখন পুলিশ হয় তার এমন হুকুমবরদার, যাতে এই রাষ্ট্রীয় বাহিনী সরকারি দলের খেদমত ছাড়া অন্য কিছুই করে না। কাজেই বিএনপি ক্ষমতায় থাকলে পুলিশ হয় জাতীয়তাবাদী পুলিশ দল আর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলে তারা হয় আওয়ামী পুলিশ লীগ। বাংলাদেশে এখন আওয়ামী পুলিশেরই শাসন চলছে। এরা নিজেরা তো আছেই, তার ওপর এদের ছত্রছায়ায় আওয়ামী লীগের বিভিন্ন অঙ্গ সংগঠনের গুণ্ডা ও মাফিয়া বাহিনী সব ধরনের বিরোধী পক্ষের ওপর হামলার পর হামলা চালিয়ে এখন দেশজুড়ে এক আতঙ্কজনক পরিস্থিতি সৃষ্টি করে রেখেছে।

সর্বত্র বেপরোয়া দুর্নীতির অন্যতম কারণ হলো, দুর্নীতিবাজদের বিচার ও শাস্তির ব্যবস্থা বাস্তবত না থাকা। সরকারি ক্ষমতার বলে বলীয়ান হয়ে যারা দুর্নীতি করছে তারা জানে যে, তাদের কোনো বিচার আদালতে হবে না। তাদের বিরুদ্ধে মামলা থাকলে বিচারের মাধ্যমে তার নিষ্পত্তি না হয়ে তাদের মামলার পর মামলা খারিজ হবে। একদিকে পুলিশ ও আমলাতন্ত্রের সাহায্যে দুর্নীতি করা এবং বিচারব্যবস্থায় এই দুর্নীতির জন্য শাস্তির কোনো সম্ভাবনা না থাকায় দুর্নীতি সর্বত্র অপ্রতিরোধ্য। শিক্ষা, সংস্কৃতি এবং ইতিহাস চর্চার ক্ষেত্রে দুর্নীতি তার থাবা বিস্তার করে এমন পরিস্থিতি আজ তৈরি করেছে, যা একদিক থেকে সবচেয়ে মারাত্মক ও বিপজ্জনক। কারণ শিক্ষা ও সংস্কৃতির সঠিক, গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল চর্চা এবং ইতিহাসের সত্যনিষ্ঠ চর্চাই একমাত্র পথ, যার ভিত্তিতে সংগ্রাম করে সমাজে দুর্নীতির প্রভাব পরাজিত করা সম্ভব। বলাই বাহুল্য, বাংলাদেশে বিপুল অধিকাংশ বুদ্ধিজীবীর মধ্যে দুর্নীতি যেভাবে শিকড় বিস্তার করে আছে সেটিই প্রধান কারণ, যেজন্য শিক্ষা, সংস্কৃতি, ইতিহাস চর্চা ও রাজনীতির মাধ্যমে দুর্নীতির বিরুদ্ধে সংগ্রাম সংগঠিত করা এক দুরূহ ব্যাপার।

এ পরিস্থিতিতে বাংলাদেশে কোনো ধরনেরই নির্বাচন যে দুর্নীতির কবলমুক্ত থাকবে এ চিন্তা অবাস্তব এবং সে কারণেই বড় রকম মূঢ়তারই পরিচায়ক। গত ২৪ এপ্রিল ভোলায় জাতীয় সংসদের একটি আসনে উপনির্বাচন হয়েছে। এই উপনির্বাচনে দুই প্রতিদ্বন্দ্বী দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি উভয়েই দুর্নীতি করেছে। যে যার সাধ্যমতো করেছে। কিন্তু সাধ্যের প্রতিযোগিতায় যারা ক্ষমতাসীন তাদের পাল্লাই ভারি থাকে। এ কারণে ইতিপূর্বে বাংলাদেশে যত উপনির্বাচন হয়েছে তার বিপুল অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সরকারি দলের প্রার্থী জয়লাভ করেছে। পুলিশসহ অন্য প্রশাসনিক ব্যবস্থা সরকারি দলের সহায়ক হওয়াতেই এ রকমটি ঘটে। তার অর্থ অবশ্য এই নয় যে, প্রত্যেক ক্ষেত্রে বিরোধী দলই প্রকৃতপক্ষে বেশি ভোট পায় এবং সরকারি দল কম ভোট পেয়েও জয়লাভ করে। অনেক ক্ষেত্রে বিরোধী দল কম ভোটই পায়; কিন্তু সে সময়ও সরকারি দল ক্ষমতা অপব্যবহার করার কারণে বিরোধী দল কর্তৃক সরকারি দলের বিরুদ্ধে দুর্নীতির আওয়াজ তোলা, নির্বাচন বাতিল ও পুনর্নির্বাচনের দাবি তোলা সহজ ও সম্ভব হয়।
ভোলার উপরোক্ত নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রার্থীর জয় হয়েছে। যেহেতু আসনটি আওয়ামী লীগের একটি চিহ্নিত আসন, কাজেই সেখানে তারা হয়তো বেশি ভোট পেয়ে থাকবেন। আসনে কে বেশি ভোট পেয়েছেন ও কে কম ভোট পেয়ে পরাজিত হয়েছেন, এটি এখানে মূল বিষয় নয়। মূল বিষয় এটিই যে, বর্তমান পরিস্থিতিতে বাংলাদেশে কোনো পরাজিত প্রার্থীই নিজের পরাজয় স্বীকার করে বিজয়ী প্রার্থীকে অভিনন্দন জানাতে রাজি নন। আবার বিজয়ী পক্ষ নির্বাচন নিরপেক্ষ ও কারচুপিবিহীন হয়েছে বলে জোর গলায় ঢেঁড়ি পেটান। এ প্রতিক্রিয়া আসলে দলনিরপেক্ষ। যে কোনো দলের পরাজিত প্রার্থী ও বিজয়ী প্রার্থী একই রকম বাঁধাধরা প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। ভোলার নির্বাচনের পরও তাই হয়েছে। এটা এখন বাংলাদেশের শাসকশ্রেণীর দলগুলোর নির্বাচনী রাজনীতির এক অবিচ্ছেদ্য ঐতিহ্যে পরিণত হয়েছে। দুর্নীতিই যে এই 'ঐতিহ্যের' গর্ভধারিণী এতে সন্দেহ নেই।

বাংলাদেশে নির্বাচন মূলত তিন শর্তের অধীন_ অর্থ, অস্ত্র বা পেশিশক্তি এবং সরকারি ক্ষমতা। এর মধ্যে প্রথম দুই শর্তই নির্ধারক; কারণ অর্থ ও পেশিশক্তি ছাড়া নির্বাচন এখন ভাবাই যায় না। এ দুই যার নেই তার পক্ষে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে যাওয়া উন্মাদের কাজ। এখানে উল্লেখ করা দরকার, অর্থ, অস্ত্র ও পেশিশক্তির অধিকার দুর্নীতির মাধ্যমেই অর্জিত। যেহেতু বাংলাদেশে দুর্নীতির পুরোভাগে আছে ব্যবসায়ী শ্রেণী, কাজেই দেখা যাবে, নির্বাচনে প্রার্থীদের মধ্যে এবং বিজয়ী প্রার্থীদের মধ্যে ব্যবসায়ীদেরই প্রাধান্য। বস্তুতপক্ষে বাংলাদেশে যে কোনো সরকারই এখন ব্যবসায়ী স্বার্থের দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত। ফলে ব্যবসায়ীরা রাজনীতিতে প্রাধান্য বিস্তার করে এবং অন্য রাজনৈতিক নেতা ও পাতি নেতারা ক্রমেই পরিণত হতে থাকেন ব্যবসায়ীতে। এ পরিস্থিতিতে দুর্নীতি যে নির্বাচন ক্ষেত্রে নির্ধারক ভূমিকা পালন করবে, এটিই স্বাভাবিক। ভোলার উপনির্বাচনে এ বিষয়টিই নতুন করে প্রমাণিত হলো।

যে উদ্দেশ্যে একটি দেশে পার্লামেন্ট গঠনের জন্য নির্বাচন হয়, সে উদ্দেশ্য বর্তমান বাংলাদেশে বিরাজমান পরিস্থিতিতে, যে শর্তে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় সে পরিস্থিতিতে পূর্ণ হওয়া সম্ভব নয়। অর্থাৎ নির্বাচনের মাধ্যমে প্রকৃত জনপ্রতিনিধি নির্বাচন আর একেবারেই সম্ভব নয়। কারণ নির্বাচনের মাধ্যমে বিপুল ভোটে নির্বাচিত হলেও অধিকাংশ ভোটদাতার স্বাধীন মতামতের অভিব্যক্তি তার মাধ্যমে ঘটে না এবং যারা নির্বাচিত হন তারা ভোটদাতাদের পৃষ্ঠপ্রদর্শন করে দুর্নীতির স্রোতে গা ভাসিয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে কালক্ষয় করেন না। ২০০৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচন হলো এর সর্বশেষ দৃষ্টান্ত। এসব থেকে প্রমাণিত হয়, নির্বাচনী রাজনীতির মধ্যে জনগণের স্বার্থ রক্ষার কোনো সম্ভাবনা আর নেই। অর্থাৎ নির্বাচনী রাজনীতির মধ্যে গণতান্ত্রিক চরিত্রের লেশমাত্র আর নেই। বর্তমানে যে শর্তাধীনে নির্বাচন হয়, যে ব্যবস্থাপনায় নির্বাচন হয়, তার পরিপূর্ণ উচ্ছেদ করে গোটা শাসন ব্যবস্থা ও তার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণভাবে নির্বাচনী ব্যবস্থার গণতন্ত্রীকরণ ছাড়া এ দেশে সমাজব্যবস্থার মধ্যে অর্থপূর্ণ পরিবর্তনের কোনো সম্ভাবনাই নেই।
[সূত্রঃ সমকাল, ২৭/০৪/১০]

দুর্বৃত্ত ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্র ইসরায়েলের নতুন হামলা

বদরুদ্দীন উমর


ইসরায়েল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেরই সমতুল্য একটি দুর্বৃত্ত রাষ্ট্র (rogue state), যদিও তার আকার তুলনায় অনেক ছোট। ১৯৪৮ সালে জন্মের পর থেকেই এই রাষ্ট্রটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, ফ্রান্সসহ পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদীদের ছত্রচ্ছায়ায় থেকে মধ্যপ্রাচ্যে অনেক ধরনের দুর্বৃত্তমূলক কর্মকাণ্ড করে এসেছে, কিন্তু তার জন্য আজ পর্যন্ত তারা সংশ্লিষ্ট কারো কাছে কোনো জবাবদিহিতা করেনি। তার প্রয়োজনও তারা বোধ করেনি। কারণ সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রগুলো, বিশেষত পরবর্তী সময়ে বিগত ৬০ বছর ধরে আমেরিকা তাকে চরম দায়িত্বহীনভাবে সব দুর্বৃত্তগিরি থেকে দায়মুক্ত রেখে আশ্রয় দিয়ে এসেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এখনো নাকি প্রবল পরাক্রান্ত শক্তি হলেও তার অবস্থা আর আগের মতো নেই। এ কারণে বাধ্য হয়ে তাকে ইসরায়েলের চরম বেপরোয়া কার্যকলাপের ভণ্ডামিপূর্ণ সমালোচনা মাঝেমধ্যে করতে হলেও তাদের পারস্পরিক সম্পর্কের মধ্যে কোনো পরিবর্তন এখনো হয়নি। এবং দুর্বৃত্ত রাষ্ট্র হিসেবে ইসরায়েল তাদের যেকোনো সময়ের মতোই কাজ করছে, এমনকি গোত্র বিশেষে তার এই দুর্বৃত্তগিরি সব মাত্রা অতিক্রম করছে। সম্প্রতি গাজায় যা ঘটেছে এটা হলো তার রাষ্ট্রীয় দুর্বৃত্তগিরির সাম্প্রতিকতম দৃষ্টান্ত।

২০০৯ সালের প্রথম দিকে ইসরায়েল গাজা আক্রমণ করে তিন সপ্তাহ ধরে প্রায় একতরফা সেখানে ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে ছিল। এর ফলে শত শত গাজাবাসী নারী, শিশু, বৃদ্ধ হতাহত হয়েছিলেন এবং বাড়িঘর ব্যাপক আকারে ধ্বংস হয়ে অর্থনৈতিক বিপর্যয় ঘটিয়েছিল।

২০০৭ সাল থেকে ইসরায়েল হামাস নিয়ন্ত্রিত গাজায় অবরোধ আরোপ করার পর থেকে সেখানকার রাজনৈতিক অবস্থা বিপর্যস্ত। পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদীদের বশীভূত আরব রাষ্ট্রগুলোর নিয়ন্ত্রণাধীন আরব লীগ এবং বিশেষ করে মিসর এ অবস্থায় গাজাবাসীকে সাহায্য করার পরিবর্তে নানা ধরনের প্রতিবন্ধকতাই সৃষ্টি করে এসেছে। তার মধ্যে একটি দিক রাফায় গাজার সঙ্গে তাদের সীমান্ত বন্ধ করে রাখা।

ইসরায়েল গাজায় তিন বছর ধরে অবরোধ সৃষ্টি করে রেখে সেখানকার অর্থনীতি ও জীবনযাত্রায় নিদারুণ সংকট সৃষ্টি করেছে। এই সংকটজনক সময়ে গাজায় ত্রাণ সাহায্যের জন্য 'ফ্রি গাজা মুভমেন্ট'-এর উদ্যোগে ছয়টি ত্রাণবাহী জাহাজের একটি আন্তর্জাতিক বহর ১০ হাজার টন খাদ্যসামগ্রী নিয়ে সাইপ্রাসের উপকূলীয় সাগর থেকে যাত্রা করে বিগত ৩০ মে। এই জাহাজ বহরে ছিল মার্কিন, ইতালি, সুইডেন, আয়ারল্যান্ড, গ্রিস ও তুরস্কের একটি করে জাহাজ। জাহাজের এই বহরটি আন্তর্জাতিক জলসীমায় থাকার সময়ই ৩১ মে সকালে কোনো উসকানি ছাড়াই ইসরায়েলি কমান্ডো বাহিনীর সদস্যরা হেলিকপ্টার থেকে জাহাজে অবতরণ করে নির্বিচারে গুলি চালিয়ে ত্রাণকর্মীদের ১৯ জনকে হত্যা এবং আরো অনেক বেশিসংখ্যককে আহত করেছে। এই ছয়টি জাহাজে বিশ্বের কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তিসহ ৭০০ যাত্রী ছিলেন। এই জাহাজ বহরের যাত্রার খবর শুনে ইসরায়েল ঘোষণা করেছিল যে তারা জাহাজগুলোকে গাজায় যেতে দেবে না। কিন্তু তারা যে আন্তর্জাতিক জলসীমায় তাদের ওপর এভাবে অতর্কিত ও মারাত্দক সামরিক হামলা চালাবে_এটা কেউ চিন্তা করেনি। এই আক্রমণে যাঁরা হতাহত হয়েছেন তাঁদের ১৯ জনের একজন তুরস্কের নাগরিক। ইসরায়েলি কমান্ডোরা তুরস্কের মাভি মারমারা নামক যাত্রীবাহী জাহাজটিতে হেলিকপ্টার থেকে নেমে বেপরোয়াভাবে গুলি চালিয়ে এ হত্যাকাণ্ড চালায়।

ইতালি এ ঘটনার নিন্দা করেছে এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন এ ঘটনার সরকারি তদন্তের নির্দেশ দিয়েছে। কিন্তু এ ঘটনায় সব থেকে তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে তুরস্ক। তারা এ ব্যাপারে জাতিসংঘের জরুরি বৈঠক আহ্বানের কথা জানিয়েছে। তা ছাড়া তারা ঘোষণা করেছে যে ইসরায়েল যদি এ ঘটনার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা না করে, তাহলে তারা ইসরায়েলের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করবে। তাদের সঙ্গে আপাতত সব রকম বাণিজ্য ও সামরিক সম্পর্ক শিথিল করার ঘোষণা তারা প্রদান করছে। প্রসঙ্গত, উল্লেখযোগ্য যে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর মধ্যে তুর্কির সঙ্গেই ইসরায়েলের প্রথম কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপিত হয় এবং এ সম্পর্ক দীর্ঘদিন আছে; যদিও গত বছর গাজায় ইসরায়েলের সামরিক হামলার পর প্রথমবারের মতো এ সম্পর্ক কিছুটা খারাপ হয়। মার্কিন তল্পিবাহক রাষ্ট্র মিসর তিন বছর ধরে গাজার সঙ্গে দুশমনি করে রাফা সীমান্ত বন্ধ রেখেছিল, কিন্তু ৩১ মের ঘটনার পর তারা এখন তা উন্মুক্ত করেছে।

৩১ মের ঘটনা ইসরায়েল ও তুরস্কের সম্পর্কের ক্ষেত্রে সংকট সৃষ্টি করেছে। মধ্যপ্রাচ্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিকটতম মিত্র হিসেবে তাদের উভয়ের সম্পর্ক দীর্ঘদিন অটুট থাকলেও এখন এ সম্পর্কের নিদারুণ অবনতি হয়েছে। জাতিসংঘের সেক্রেটারি জেনারেল বান কি মুন এ ঘটনার তদন্তের প্রস্তাব করেছেন। তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আহমেত দাভুতোগসু বলেছেন যে ইসরায়েলকে এই তদন্তে সম্মত হতে হবে। অন্যথায় বুঝতে হবে যে এ বিষয়ে তাদের গোপন করার মতো ব্যাপার আছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ইসরায়েলের রাষ্ট্রদূত বলেছেন, তাঁরা তদন্তের এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। তুরস্কের প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করেছেন, 'যারা গাজার জনগণকে খোলা আকাশের বন্দিশালায় জীবন যাপন করতে বাধ্য করছে, আমরা তার বিরোধী। গাজার বিরুদ্ধে অবরোধ উঠিয়ে না নেওয়া পর্যন্ত এ ব্যাপারে আমাদের অবস্থান খুব দৃঢ়।' তুরস্কের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে যে ইসরায়েলকে তার কাজের ফলাফল স্বীকার করতে এবং এর জন্য জবাবদিহিতা করতে হবে। তারা সব কিছুর মূল্যায়ন করছে এবং দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক আগের মতো অব্যাহত থাকবে কি না সেটা নির্ভর করবে ইসরায়েলের ওপর। তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আরো বলেন, তুরস্ক-ইসরায়েল সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণ সম্ভব নয়, যতক্ষণ পর্যন্ত না ইসরায়েল আন্তর্জাতিক আইন মান্য করে চলতে সম্মত হয়। একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনে এই চিত্র দেখার সময় পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা এ ব্যাপারে তুরস্কের সঙ্গে একাত্দতা ঘোষণা করেন। (Daily Star 8.6.2010) ইসরায়েল যে একটি দুর্বৃত্ত রাষ্ট্র এটা নতুন কথা নয়। কিন্তু তারা কত বড় দুর্বৃত্ত এর নতুন প্রমাণ এখন পাওয়া গেল বর্ণবাদী দক্ষিণ আফ্রিকার সঙ্গে তাদের গোপন পারমাণবিক সম্পর্ক ও লেনদেনের তথ্য প্রকাশিত হওয়ার পর। সব থেকে শক্তিশালী দুবর্ৃৃত্ত রাষ্ট্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তুরস্ক, কোরিয়া, ইরান, ইতালির পারমাণবিক কর্মসূচির বিরোধিতা করে, তাকে বিশ্বশান্তির জন্য হুমকি বলে অ্যাখ্যায়িত করে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধংদেহী ভাব ধারণ করে প্রায় প্রতিদিনই উসকানিমূলক কথাবার্তা বলছে ও হুংকার ছাড়ছে। কিন্তু তাদের প্রবল সহায়তায় মধ্যপ্রাচ্যে দীর্ঘদিন আগে ইসরায়েল পারমাণবিক বোমা তৈরি করে ইতিমধ্যেই শত শত বোমার মালিক হলেও সেখানে কোনো আন্তর্জাতিক পারমাণবিক তদন্ত কমিশন আজও যায়নি এবং তারা যে পারমাণবিক বোমার মালিক_এ কথা তারা স্বীকার করেনি। যদিও তাদের হাতে পারমাণবিক বোমা থাকার কথা সবারই জানা, এ বিষয়ে কারো কোনো সন্দেহ নেই।

সাশা পুলাকউ-সুরানস্কি নামক এক আমেরিকান টিভি গবেষকের `The unspoken Aliance : Israils secret Relationship with Apartheid South Africa` নামক একটি বই সদ্য প্রকাশিত হয়েছে। এই বইটির ওপর ভারতীয় সাংবাদিক প্রফুল বিদাই Daily Star-এ `Secret No More` নামক এক প্রবন্ধে (৬.৬.২০১০) বিস্তারিতভাবে বলেছেন, দক্ষিণ আফ্রিকায় বর্ণবাদ উচ্ছেদের আগে সেখানকার শ্বেতাঙ্গ শাসকদের সঙ্গে ইসরায়েলের পারমাণবিক লেনদেন ছিল এবং তারা দক্ষিণ আফ্রিকাকে পারমাণবিক বোমা তৈরির জন্য সব রকম প্রযুক্তিতিগত সহায়তা করেছিল। ইসরায়েলের নিজের ইউরেনিয়াম ঘাটতি ছিল, যা দক্ষিণ আফ্রিকা পূরণ করেছিল। এ ছাড়া এ ক্ষেত্রে দুই বর্ণবাদী ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রের মধ্যে অনেক ধরনের লেনদেন হয়েছিল, যার বিবরণ বইটির মধ্যে আছে। এর থেকেই প্রমাণিত হয়, ইসরায়েল ও দক্ষিণ আফ্রিকা উভয়েই আন্তর্জাতিকভাবে শাস্তিযোগ্য। দক্ষিণ আফ্রিকায় শ্বেতাঙ্গদের হাত থেকে ক্ষমতা চলে যাওয়ার ঠিক আগে অন্যদের হাতে যাতে পারমাণবিক বোমা না পড়ে এ জন্য তারা যে কয়টি বোমা তৈরি করেছিল সেগুলোর সবই নষ্ট করে দেয়। কিন্তু ইসরায়েল এখন ৩০০ বোমার মালিক! মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এ ব্যাপারে পরিপূর্ণভাবে অবহিত থাকায় এবং এই ক্রাইমের সঙ্গে জড়িত থাকায় তাদের দুর্বৃত্ত চরিত্রও এর মাধ্যমে নতুনভাবে প্রমাণিত হলো।
গাজার সব ঘটনা আলোচনা করতে গিয়ে প্রসঙ্গত ইসরায়েলের পারমাণবিক বোমার কথা উল্লেখ করা হলো তাদের ক্রিমিনাল চরিত্র কত গভীর ও বিপজ্জনক এটা আরো ভালোভাবে বোঝার জন্য। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তাদের ইউরোপিয়ান মিত্ররা ইসরায়েলকে ১৯৪৮ সাল থেকে মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে ব্যবহার করে নিজেদের সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থ নানাভাবে উদ্ধার করে এসেছে। কিন্তু এই দুর্বৃত্ত রাষ্ট্র এখন এমন পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে, যাতে খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকেও অদূর ভবিষ্যতে এর জন্য ভালো খেসারত দিতে হবে। কিন্তু যে পর্যন্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রবল প্রভাবশালী সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্র হিসেবে ক্রিয়াশীল থাকবে, সে পর্যন্ত তার জোরেই ইসরায়েল তার সব রকম দুর্বৃত্তমূলক কার্যকলাপ মধ্যপ্রাচ্য ও সেই সঙ্গে বিশ্বের বিভিন্ন ক্ষেত্রে চালিয়ে যাবে। এ কারণে তাদের কার্যকলাপকে সাধারণভাবে সাম্রাজ্যবাদের বিশ্বব্যবস্থা থেকে আলাদা করে দেখার উপায় নেই। ইসরায়েলের উৎখাত ও প্যালেস্টাইনের জনগণের মুক্তি বিশ্ব পরিসরে সাম্রাজ্যবাদের ধসের সঙ্গে একসূত্রেই গাঁথা।
[সূত্রঃ কালের কণ্ঠ, ১০/০৬/১০]

হরতাল প্রসঙ্গে

বদরুদ্দীন উমর


২৭ জুন ২০১০-এ বিএনপি হরতাল ঘোষণার পর থেকে এর সমর্থনে এবং তার থেকেও বেশি এর বিরুদ্ধে অনেক লেখালেখি, বিবৃতি, সভা-সমিতি, মিছিল ইত্যাদি হয়েছে। এসব হৈচৈ থেকে মনে হওয়া স্বাভাবিক, এটা এমন এক জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু, যা নিয়ে মাতামাতি করে নাকের ডগায় অন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুকে যুক্তিসঙ্গতভাবে ধামাচাপা দেয়া বা খর্ব করা চলে। বাস্তবত ব্যাপারটা সে রকমই দাঁড়িয়েছে।

হরতাল একটি গণতান্ত্রিক অধিকার। একথা সব পক্ষ স্বীকার করলেও কর্মক্ষেত্রে প্রত্যেক ক্ষমতাসীন দল ও তাদের সরকার বিরোধী পক্ষের যে কোন হরতাল প্রতিরোধ করার জন্য দলীয় শক্তির সঙ্গে সরকারি শক্তি ব্যবহার করে। অন্যদিকে যারা হরতাল আহ্বান করে তারা গণতান্ত্রিক হরতালের শর্ত লঙ্ঘন করে তা কার্যকর করার জন্য জোরজবরদস্তির আশ্রয় নেয়। এর ফলে হরতালের সময় প্রায়ই এক মারদাঙ্গা পরিস্থিতি সৃষ্টি হয় এবং এতে অনেক লোক হতাহত পর্যন্ত হয়ে থাকে।

হরতাল রাজনৈতিক প্রতিবাদের একটি উপায় বা পদ্ধতি। যখন কোন দল হরতাল ডাকে, তখন তার সাফল্যের জন্য শুধু তাদের দলীয় লোকদেরই অংশগ্রহণ তারা আশা করে না। তারা আশা করে, সাধারণভাবে মানুষ তাদের প্রতিবাদ কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করে হরতাল সফল করবে। এ আশা যদি তাদের না থাকে তাহলে হরতাল সাধারণত আহ্বান করা হয় না। হরতালে যদি এভাবে জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ থাকে, তাহলে কাউকে হরতালে অংশ নিতে বাধ্য করার প্রশ্ন ওঠে না। এ কারণে হরতাল যারা আহ্বান করে, জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণের ওপরই তাদের নির্ভর করা দরকার। কারণ এর দ্বারা তাদের নিজেদেরও বোঝার সুবিধা হয়, জনগণের সমর্থন কতটা তাদের পক্ষে এবং কতটা তাদের প্রতিপক্ষ সরকারের পক্ষে।

সরকারের দিক থেকেও হরতালের ব্যাপারে এই একই দৃষ্টিভঙ্গি গণতান্ত্রিক রাজনীতির এক গুরুত্বপূর্ণ শর্ত। নির্বাচন ছাড়া অর্থাৎ নির্বাচনের বাইরে হরতাল সরকার পক্ষের অবস্থান বোঝার একটা উপায়। কাজেই নিজেদের পক্ষে জনসমর্থন যাচাইয়ের জন্যও সরকারি দল ও সরকারের প্রয়োজন নির্বিঘ্নে হরতাল পালিত হতে দেয়া।

কিন্তু বাংলাদেশে গণতন্ত্র কোথায়? বাংলাদেশের ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায়, এই রাষ্ট্রের জন্মলগ্ন থেকেই এদেশে গণতন্ত্র অনুপস্থিত।
প্রথম থেকে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে যা পাওয়া যায় তা হল, নির্বাচিত সরকারের গণতান্ত্রিক স্বৈরতন্ত্র অথবা সরাসরি সামরিক শাসন। এ দুই ধরনের শাসনই হল ফ্যাসিবাদের বৃন্তে দুই ফুলের মতো। শাসনব্যবস্থার এই চরিত্র শাসকশ্রেণীর চরিত্রেরই প্রতিফলন। এই শাসকশ্রেণী বলতে শুধু সরকারি ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত দল ও লোকজনকেই বোঝায় না। বিরোধী দলসহ ধনিক শ্রেণীর সমগ্র অংশই এর অন্তর্গত। এ কারণে যে দলই ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়, সে দলই তার পূর্ববর্তী ক্ষমতাসীন প্রতিপক্ষের মতো আচরণ করে। এর দ্বারা তাদের সবার শ্রেণীগত ঐক্য এবং অভিন্নতাই প্রমাণিত হয়।

১৯৯১ সাল থেকে প্রতিটি নির্বাচিত সরকার ও বিরোধী দল অন্যান্য ক্ষেত্রের মতো হরতালের ক্ষেত্রেও একই আচরণ করে এসেছে। বিরোধী অবস্থানে থাকলে হরতাল আহ্বান, হরতাল পালনের জন্য মানুষের স্বতঃস্ফূর্ততার ওপর নির্ভর না করে অল্পবিস্তর জোরজবরদস্তির আশ্রয় গ্রহণ করা এবং ক্ষমতায় থাকার সময় বিরোধী পক্ষের হরতাল বন্ধ করার জন্য দলীয় লোকজন ও পুলিশের সহায়তায় ফ্যাসিস্ট কায়দায় বিরোধী পক্ষের ওপর আক্রমণ।

হরতাল একটি গণতান্ত্রিক অধিকার হলেও এর যথেচ্ছ ও বাড়াবাড়ি ব্যবহার শুধু যে হরতালের রাজনৈতিক কার্যকারিতা হ্রাস করে তাই নয়, এর ফলে অনেক ধরনের বিশৃংখলা সৃষ্টি হয়। এই বিশৃংখলা গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার পরিপন্থী। এটা বোঝার অসুবিধা যে শাসকশ্রেণীর প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের আছে, এমন নয়। তারা বারবার অঙ্গীকার করে হরতাল না করার। কিন্তু বিরোধী অবস্থানে যে দলই আসুক, তারা এই অঙ্গীকার ভঙ্গ করে হরতালকেই নিজেদের আন্দোলন কর্মসূচির প্রধান অবলম্বন হিসেবে ব্যবহার করে।

২৭ জুনের বিএনপি আহূত হরতাল নিয়ে বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারকে এখানকার বুর্জোয়া শাসকশ্রেণীর রাজনৈতিক ঐতিহ্য অনুযায়ী খুব স্পর্শকাতর দেখা যাচ্ছে। তারা বিএনপির হরতালের বিরুদ্ধে অনেক কঠোর হুমকি দিচ্ছে। হরতাল আহ্বানকারী বিএনপিও পাল্টা হুমকি দিয়ে যাচ্ছে, হরতালে বাধা দিলে লংকাকাণ্ড হবে। হরতাল প্রতিহত করার আহ্বান গণতান্ত্রিক রাজনীতির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ কোন আহ্বান নয়। কিন্তু ২৫ জুন ঢাকার রিপোর্টার্স ইউনিটি মিলনায়তনে ‘হরতাল প্রতিহত করুন, জঙ্গিবাদ রুখে দাঁড়ান’ শীর্ষক এক আলোচনা সভায় আওয়ামী লীগের নেতারা প্রকৃতপক্ষে এ আহ্বান জানিয়ে হরতাল বন্ধ করার উদ্দেশ্যে অনেক উসকানিমূলক বক্তব্য প্রদান করেছেন। (দৈনিক কালের কণ্ঠ, ২৬-৬-২০১০)। এই উসকানি শুধু যে দলীয় কর্মী ও লোকজনকেই দেয়া হয়েছে, তা-ই নয়। এর দ্বারা পুলিশকেও হরতাল প্রতিরোধের জন্য প্ররোচিত করা হয়েছে।
লক্ষ্য করার বিষয় যে, ২৭ তারিখের হরতাল ও জঙ্গিবাদকে একই দড়িতে বেঁধে তা রুখে দাঁড়াতে আহ্বান জানানো হয়েছে আওয়ামী লীগের উপরোক্ত আলোচনা সভায়। হরতাল ও জঙ্গিবাদকে এভাবে সম্পর্কযুক্ত করে উপস্থাপিত করা রাজনৈতিক দিক দিয়ে বিভ্রান্তিমূলক। এর দ্বারা আওয়ামী লীগেরও বিভ্রান্তির বেড়াজালে আটকা পড়ার সম্ভাবনা। কারণ ২৭ জুনের হরতালকে এভাবে দেখলে তার থেকে রাজনৈতিক শিক্ষা গ্রহণের কোন অবকাশ থাকে না যে, শিক্ষার কথা ওপরে বলা হয়েছে।

আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তা যে এখন দ্রুত কমছে, এতে সন্দেহ নেই। চট্টগ্রামে মহিউদ্দিনের শোচনীয় পরাজয়কে মূলত ব্যক্তি মহিউদ্দিনের পরাজয় হিসেবে দেখানোর একটা চেষ্টা আওয়ামী লীগ দল ও আওয়ামী ঘরানার বুদ্ধিজীবীদের আছে। কিন্তু এই পরাজয়ে মহিউদ্দিনের সৃষ্ট কর্মকাণ্ডের ভূমিকা যাই থাক, আওয়ামী লীগের প্রতি জনসমর্থন থাকলে তার এই পরাজয় হতো না। এই পরাজয়ের মূল কারণ চট্টগ্রামে আওয়ামী লীগের অজনপ্রিয়তার পাল্লা ভারি হতে থাকা। কিন্তু চট্টগ্রাম সারাদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন কোন দ্বীপ নয়। চট্টগ্রামে জনগণের মধ্যে আওয়ামী লীগ থেকে সমর্থন প্রত্যাহারের যে ব্যাপার ঘটেছে, এটা দেশজুড়েই ঘটেছে। এটাই অন্যতম কারণ, যে জন্য আওয়ামী লীগ সরকার ঢাকায় মেয়র নির্বাচনের তারিখ পিছিয়ে দিচ্ছে, যদিও বর্তমান মেয়রের মেয়াদ অনেক আগেই শেষ হয়েছে।

ঢাকার রিপোর্টার্স ইউনিটির আলোচনা সভায় ২৭ তারিখের হরতালের সঙ্গে জঙ্গিবাদ যুক্ত করে জঙ্গিবাদকে বাংলাদেশে যত বড় রকম উপদ্রব হিসেবে দেখানোর চেষ্টা হচ্ছে, আসলে সেটা তত বড় উপদ্রব নয়। যে কোন উপদ্রবকে যথাযথভাবে বিচার-বিশে¬ষণ করা দরকার। জঙ্গিবাদ নিয়ে বিশ্বজুড়ে এখন যে প্রচারণা হচ্ছে, সেটা মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ও তার সাম্রাজ্যবাদী নীতিরই সৃষ্টি। শুধু তাই নয়, এ জঙ্গিবাদ তাদেরই অর্থ এবং অস্ত্র সাহায্যে অনেক দেশেই জন্মলাভ করেছে ও পরিচালিত হচ্ছে। আমাদের দেশেও এর অস্তিত্ব আছে। তা নিয়ে বাড়াবাড়ির কোন কারণ বাংলাদেশে নেই। কিন্তু সেটা না থাকলেও রাজনৈতিক মতলববাজরা তা-ই করছে।

বাংলাদেশে জঙ্গিবাদ নামে কথিত উপদ্রব থেকে অনেক বিপজ্জনক হচ্ছে শাসকশ্রেণীর নিজেরই সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড। আওয়ামী লীগ সরকার ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে নির্বাচনে বিজয়ের পর থেকে তাদের অঙ্গসংগঠন ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও সেই সঙ্গে খোদ আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা যে চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, ভর্তি-বাণিজ্য, চুরি-ডাকাতি, ঘুষখোরি ও ভূমিদস্যুতা সন্ত্রাসী তৎপরতার মাধ্যমে চালিয়ে দেশজুড়ে এক মারাত্মক নৈরাজ্যিক পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে; এ নৈরাজ্য শুধু অর্থনৈতিক নয়, রাজনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রেও বিস্তৃত। সমাজে এখন অপরাধ যেভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে, তার সঙ্গে এ পরিস্থিতি ওতপ্রোতভাবে সম্পর্কিত।

নিজেদের অভিজ্ঞতা ও জয়-পরাজয় থেকে শিক্ষা নেয়ার কোন ক্ষমতা বাংলাদেশের শাসকশ্রেণীর নেই। এদের কোন দলেরই আদর্শ এবং অন্তর্নিহিত শক্তি নেই। কিন্তু এরা নির্বাচনের মাধ্যমে পাল্টাপাল্টি করে ক্ষমতায় থাকে। এদের একদল যেমন অন্য দলের অপকর্মের কারণে নির্বাচনে জয়ী হয়ে ক্ষমতায় বসে, তেমনি এরা শ্রেণীগতভাবে বাংলাদেশে এখনও ক্ষমতাসীন থাকার কারণ বাংলাদেশে কোন বিপ¬বী তো নয়ই, এমনকি প্রকৃত গণতান্ত্রিক শক্তির কার্যকর উপস্থিতির অভাব এবং তাদের প্রতি সাম্রাজ্যবাদের সক্রিয় সমর্থন।
[সূত্রঃ যুগান্তর, ২৭/০৬/১০]

আটকদের নিয়মিতভাবে রিমান্ডে নেয়া ফ্যাসিবাদেরই বহিঃপ্রকাশ



বাংলাদেশে যেভাবে ও যে শর্তে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে, সেটা যে জনপ্রতিনিধি নির্বাচনের উপায় নয়, এটা দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতায় দেখা গেলেও ২০০৮ সালের নির্বাচন তা আবার নতুনভাবে প্রমাণ করেছে। এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জনগণের ভোটে বিপুল বিজয় অর্জন করে, জাতীয় সংসদে বিরাট সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে সরকার গঠন করেছে। এই নির্বাচনের আগে তারা এমনভাবে প্রতিশ্রুতির বন্যা প্রবাহিত করেছিল যা ইতিপূর্বে কারও ক্ষেত্রে দেখা যায়নি। এমনকি ১৯৯৬ সালেও তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে দেখা যায়নি। সে নির্বাচনে জয়লাভ করে তারা সরকার গঠন করেছিল।

প্রতিশ্রুতি প্রদানের পর প্রতিশ্র“তি পালনের ধারে-কাছে না গিয়ে তার উল্টো কাজ করলে, তার বিরুদ্ধে জনগণের প্রতিক্রিয়া হয়। এ ধরনের প্রতিশ্রুতি যত বড় আকারে দেয়া হয়, তার বহর যত-বেশি হয়, প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়াও হয় তত বড় আকারের। শুধু তাই নয়, এ প্রতিক্রিয়া হয় ততই দ্রুত। ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ইশতেহারে ঘোষিত প্রতিশ্রুতি এবং ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে সরকার গঠনের পর এটাই দেখা যাচ্ছে। এত বড় বিজয় লাভ করে এত অল্প সময়ের মধ্যে জনপ্রিয়তা হারাতে থাকার ঘটনা ইতিপূর্বে অন্য কোন
সরকারের ক্ষেত্রে দেখা যায়নি।

শ্রেণী বিভক্ত সমাজে শাসক শ্রেণী ব্যাপক শ্রমজীবী জনগণকে শোষণ করে। এই শোষণ একটা প্রক্রিয়া বা নিয়ম অনুযায়ী চলে। এর বিরুদ্ধে জনগণের মধ্যে ক্ষোভের সঞ্চার হয়। সেটা প্রতিরোধের তাগিদ সৃষ্টি হয়, তারা এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ বিক্ষোভ ইত্যাদি করে থাকেন। কিন্তু শোষণের থেকে নির্যাতনের বিরুদ্ধে জনগণের প্রতিক্রিয়া অধিকতর তীব্র হতে দেখা যায়। এখানে বলা দরকার যে, নির্যাতন কোন স্বাধীন ব্যাপার নয়। অর্থাৎ মানুষ নির্যাতনের জন্যই নির্যাতন করে না। নির্যাতন করা হয় তখনই, যখন শোষিতরা শোষণের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেন, সংগঠিত হন, প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। জনগণের সম্পদ লুটপাটের সঙ্গেও নির্যাতন সম্পর্কিত থাকে। শোষণের মতো লুটপাটের বিরুদ্ধে দাঁড়ালেও জনগণের ওপর নির্যাতন হয়।

বাংলাদেশে এখন বিভিন্ন ক্ষেত্রে বেশ বড় আকারে নির্যাতন চলছে। এই নির্যাতনের মাত্রা ক্রমাগত বৃদ্ধি পেতে থাকাই মূল কারণ, যে জন্য বর্তমান সরকার দেড় বছরেরও কম সময়ে এত অজনপ্রিয় হয়েছে, যা ইতিপূর্বে কোন সরকারকে হতে দেখা যায়নি। এমনকি এদের ১৯৯৬-২০০১ সালে ক্ষমতাসীন সরকারের ক্ষেত্রেও এটা ঘটেনি। তারা ব্যাপকভাবে জনপ্রিয়তা হারানোর ফলে ২০০১ সালের সাধারণ নির্বাচনে পরাজিত হয়েছিল, কিন্তু সেভাবে অজনপ্রিয় হতে দেরি হয়েছিল। সেরকম কোন দেরি ২০০৯ সালে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের ক্ষেত্রে হচ্ছে না। এভাবে দ্রুত জনগণের মধ্যে তাদের সমর্থন হারানোর কারণ জনগণের ওপর তাদের ব্যাপক ও মাত্রাতিরিক্ত নির্যাতন।

যেখানে শ্রমজীবী জনগণ ও তাদের প্রতিনিধিদের আন্দোলন, সেখানেই নির্যাতন হচ্ছে। লাঠি, গুলি, ধরপাকড়, জেল-জুলুম সব কিছুই চলছে। তবে এই নির্যাতন শুধু রাস্তা ও মাঠে আন্দালনকারীদের বিরুদ্ধেই হচ্ছে না, যারা সরকারের শোষণ-নির্যাতনের বিরুদ্ধে দাঁড়াচ্ছেন, এজন্য বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমে কথা বলে ও লিখে মতপ্রকাশ করছেন, তাদের ওপর সরকারি নির্যাতন এখন যথেচ্ছভাবে শুরু হয়েছে। টিভি চ্যানেল, সংবাদপত্র বন্ধ করে দিয়েই সরকার ক্ষান্ত থাকছে না, টিভিতে যেসব প্রোগ্রামে সরকারের সমালোচনা হচ্ছে, সেগুলোও তারা বন্ধ করছে। এ ক্ষেত্রে যা বিশেষভাবে লক্ষণীয় তা হচ্ছে, শুধু সরকার বিরোধিতার কারণেই যে এসব নির্যাতনমূলক পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে তাই নয়, ব্যক্তিগত প্রতিহিংসা চরিতার্থের উদ্দেশ্যেও নির্যাতনের আশ্রয় নেয়া হচ্ছে।

চ্যানেল ওয়ান এবং যমুনা টিভি বন্ধ করার পর সরকার দৈনিক আমার দেশ শুধু বন্ধই করেনি, পত্রিকা ও তার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদকসহ অন্য কর্মীদের ওপর যেভাবে হামলা করেছে, এটা বাংলাদেশেও সংবাদপত্রের ওপর সরকারি হামলার ইতিহাসে নজিরবিহীন। যেভাবে এ কাজ করা হয়েছে তার কোন প্রকৃত আইনগত ভিত্তি না থাকলেও প্রতিহিংসার বশবর্তী হয়ে এই আক্রমণের মাধ্যমে সরকার তার ফ্যাসিবাদী চরিত্রই উন্মোচন করেছে।
এক্ষেত্রে আমার দেশ-এর ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মাহমুদুর রহমানের ওপর যে নির্যাতন করা হচ্ছে তার উল্লেখ করা দরকার। ১ জুন আমার দেশ পত্রিকার প্রকাশনা নিষিদ্ধ করে এর ভারপ্রাপ্ত সম্পাদককে গ্রেফতার করা হয়েছে। শুধু গ্রেফতার করাই হয়নি, তাকে বারবার রিমান্ডেও নেয়া হচ্ছে। রিমান্ডে নিয়ে মাহমুদুর রহমানের ওপর যে নির্যাতন করা হচ্ছে সেটা আলোচনার আগে বলা দরকার যে, কথায় কথায় যেকোন গ্রেফতার হওয়া লোককে রিমান্ডে নেয়ার ব্যাপার বাংলাদেশে আগে ছিল না। এটা শুরু হয়েছে ২০০৭-০৮ সালে ক্ষমতাসীন মইন-ফখরুদ্দীন সরকারের বেনামি সামরিক শাসনামলে। সে সময় নির্যাতনের মাত্রা এতই বৃদ্ধি পেয়েছিল যে, একজন রাজনৈতিক কারণে গ্রেফতার হওয়ার অর্থই দাঁড়িয়েছিল পুলিশ বা র‌্যাবের রিমান্ডে নিয়ে তার ওপর অকথ্য শারীরিক নির্যাতন চালানো। এসব নির্যাতন বন্ধ করার প্রতিশ্রুতি নির্বাচনের সময় আওয়ামী লীগ, বিএনপি উভয় দলই দিয়েছিল। কিন্তু নির্বাচনে জয়লাভ করে গদিনসিন হওয়ার পর অন্যান্য প্রতিশ্রুতির মতো এক্ষেত্রেও সরকার প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। এরা এখন বাস্তবত ২০০৭-০৮ সালের ফ্যাসিস্ট সরকারের যাবতীয় নীতিরই উত্তরাধিকারী হিসেবে আবির্ভূত হয়ে তাদের কীর্তিকলাপেরই পুনরাবৃত্তি ঘটাচ্ছে। এরা যদি এই পথে না হাঁটত, তাহলে পত্রিকা প্রকাশের ব্যাপারে কিছু অনিয়ম যদি হয়ে থাকত তাহলে তার জন্য প্রথম সারির একটি জাতীয় দৈনিকের সম্পাদককে এভাবে রিমান্ডে নেয়ার ঘটনা সম্ভব হতো না।

পুলিশ রিমান্ডে একজন গ্রেফতার হওয়া লোককে নিয়ে যাওয়ার অর্থই হল, জিজ্ঞাসাবাদের নামে তার ওপর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন। এই নির্যাতন বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ীও করা যায় না। কিন্তু সরকার যেভাবে সংবিধান লঙ্ঘন করে এখন নানা কাজ করছে, এর দৃষ্টান্ত একমাত্র ফখরুদ্দীন সরকারের আমল ছাড়া অন্য কোন আমলে পাওয়া যায় না। এভাবে আটক ব্যক্তিদের রিমান্ডে নেয়া সরকারের ফ্যাসিবাদী চরিত্রেরই বহিঃপ্রকাশ। ফখরুদ্দীন সরকারের মতো বর্তমান সরকারও অনুরূপ ফ্যাসিবাদী চরিত্র পরিগ্রহ করার কারণেই এরকম ঘটছে।

মাহমুদুর রহমানকে পুলিশ রিমান্ডে নিয়ে তার ওপর যে নির্মম শারীরিক নির্যাতন করা হয়েছে, তার বিবরণ তিনি আদালতের সামনে দিয়েছেন। এ বিবরণ দিয়ে তিনি আদালতের কাছে আবেদন করেছেন যাতে আবার তাকে রিমান্ডে না দেয়া হয়। কিন্তু তার আবেদন অগ্রাহ্য করে তাকে আবার রিমান্ডে দেয়া হয়েছে। প্রথমবার তাকে রিমান্ডে দেয়ার সময় আদালত তার ওপর নির্যাতন না করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু পুলিশ আদালতের সে নির্দেশ অমান্য করে মাহমুদুর রহমানের ওপর নির্যাতন করেছে, একথা তিনি আদালতের সামনে বলা সত্ত্বেও এজন্য পুলিশকে জবাবদিহি করতে বলা হয়নি। উপরন্তু মাহমুদুর রহমানকে আবার রিমান্ডে পাঠানো হয়েছে। শুধু মাহমুদুর রহমানই নয়, যে কোন গ্রেফতার হওয়া লোককে পুলিশ রিমান্ডে নিয়ে যেভাবে নির্যাতন করা হচ্ছে তার বিরুদ্ধে সাধারণভাবে রাজনৈতিক আন্দোলন আজ অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। এই পরিস্থিতিতে আদালত কর্তৃক পাইকারি হারে পুলিশের রিমান্ড আবেদন মঞ্জুর করার বিষয়টিও রীতিমতো বিস্ময়কর।

আমার দেশ পত্রিকা তাদের প্রকাশনা পুনরায় চালু করার জন্য হাইকোর্টে যে মামলাটি করেছিল তাতে আদালত সরকারি নিষেধাজ্ঞা স্থগিত করে প্রকাশনা চালু করার এবং প্রেসের তালা খুলে দেয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন। এই রায়ের ওপর ভিত্তি করে পত্রিকা কর্তৃপক্ষ সাময়িকভাবে অন্য প্রেস থেকে পত্রিকা প্রকাশের ব্যবস্থা করে। কিন্তু সরকারের পাল্টা আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে সুপ্রিমকোর্টের চেম্বার জজ আমার দেশ প্রকাশনার ওপর নিষেধাজ্ঞা বহাল রেখেছেন। কাজেই পত্রিকাটির প্রকাশনা শুরু হয়ে আবার বন্ধ হয়েছে। হাইকোর্ট এখন এক মাসের জন্য বন্ধ। কাজেই পত্রিকাটি অন্তত আরও এক মাস বন্ধ থাকবে।

বাংলাদেশে শাসন ব্যবস্থা এখন এভাবেই চলছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের মূল্যবৃদ্ধি, চুরি, চাঁদাবাজিসহ সব সম্ভাব্যরকম দুর্নীতির কবলে পড়ে সাধারণ মানুষের জীবন এখন দুর্বিষহ হয়েছে। তার ওপর পুলিশ ও র‌্যাবের ক্রসফায়ারে হত্যাকাণ্ড থেকে নিয়ে মত প্রকাশের স্বাধীনতার ওপর হামলা জীবনকে বিপর্যন্ত করছে। বর্তমান সরকার চিরদিন গদিনসিন থাকার স্বপ্নে বিভোর হয়ে বেপরোয়াভাবে জনগণের ওপর নিজেদের শোষণ-নির্যাতন চালিয়ে যাচ্ছে। সব ক্রিয়ারই প্রতিক্রিয়া আছে। কাজেই অদূর ভবিষ্যতে তাদের ক্রিয়ার প্রতিক্রিয়া যে তাদের দেখতে হবে এবং এ প্রতিক্রিয়া যে ক্রিয়ার মতোই প্রচণ্ড হবে এতে সন্দেহ নেই। ১৭ জুন অনুষ্ঠিত চট্টগ্রামের মেয়র নির্বাচনে মহিউদ্দিন চৌধুরীর পরাজয় এটা স্পষ্টভাবেই প্রমাণ করেছে।
[সূত্রঃ যুগান্তর, ২০/০৬/১০]

পাবনায় ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের চরিত্র যাচাইয়ের জন্য রক্ত পরীক্ষার কর্মসূচি

বদরুদ্দীন উমর


ফুলের মতো চরিত্রসম্পন্ন ছাত্র ছাড়া অন্য কেউ যাতে ছাত্রলীগের নেতৃত্বে না আসতে পারে তার জন্য ছাত্রলীগের জেলা ও নিম্নপর্যায়ের কমিটি নির্বাচনের আগে পাবনাবাসী স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী তার জেলা সদর পাবনা শহরের নির্বাচন পদপ্রার্থী ছাত্রলীগের কর্মীদের রক্ত পরীক্ষার ব্যবস্থা করেছেন। পত্রিকার রিপোর্টে দেখা গেল প্রতিমন্ত্রীর এই শুদ্ধি কর্মসূচিকে অভিনন্দন জানিয়ে স্থানীয় রাজনৈতিক নেতারা উল্লাস প্রকাশ করেছেন (উধরষু ঝঃধত্ ২১.৪.১০)। বর্তমানে ছাত্রলীগের দুর্বৃত্ত নেতা ও নেতৃস্থানীয় কর্মীদের নির্যাতনে ও খুন-খারাবিতে অতিষ্ঠ লোকজন ভবিষ্যতে এদের হাত থেকে পরিত্রাণ পাবেন, এই চিন্তা থেকে যদি আওয়ামী মন্ত্রীর এ কর্মসূচিকে অভিনন্দন জানিয়ে তারা কেউ কেউ উল্লাস প্রকাশ করেন তাতে তাদের দোষ দেয়া যায় না। কিন্তু ভালো একটা কিছু হবে এ চিন্তা এবং কোনো কাজের দ্বারা সত্যি সত্যি ভালো কিছু হওয়া এক জিনিস নয়। কাজেই আওয়ামী মন্ত্রীর এই শুদ্ধি অভিযান নিয়ে উল্লসিত হওয়ার কারণ আছে কিনা সেটা দেখা দরকার।

নির্বাচন পদপ্রার্থীদের মধ্যে কোনো মাদকাসক্ত যাতে না থাকে এ কারণেই নাকি মন্ত্রী এই শুদ্ধি অভিযান চালিয়েছেন। মনে হয় তার ধারণা, একমাত্র মাদকাসক্তরাই অপরাধ করে। এ ধারণার যে কোনো ভিত্তি নেই, এটা বলাই বাহুল্য। অপরাধী হলেই যে মাদকাসক্ত হতে হবে, এমন কোনো কথা নেই। তার পরও দেখা যাবে যে যারা আসল অপরাধী, তাদের মধ্যে কিন্তু অধিকাংশই মাদকাসক্ত নয়। তা ছাড়া অপরাধ যে শুধু ছাত্ররাই করে, তা নয়। ছাত্রদের যারা রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করে নিজেদের ব্যক্তিগত ও পারিবারিক স্বার্থ হাসিল করে তাদের মধ্যেই অপরাধীর অভাব নেই। শুধু তাই নয়, সাধারণভাবে অপরাধীরাই রাজনীতির এই ব্যবস্থা করে থাকে। এর জন্য তাদের মাদকাসক্ত হওয়ার প্রয়োজন হয় না।

আওয়ামী লীগের মন্ত্রী মহোদয় এবং অন্য নেতারাও যে এটা জানেন না, এমন নয়। এটা খুব সাধারণ ব্যাপার। কাজেই জেনেশুনে খুব উদ্দেশ্যমূলকভাবেই ছাত্রলীগকে পুতপবিত্র হিসেবে উপস্থিত করার জন্যই যে এই তথাকথিত শুদ্ধি অভিযান শুরু করা হয়েছে, এতে সন্দেহ নেই। আওয়ামী লীগকে দোষ দেওয়া যায় না, কারণ তাদের অঙ্গ সংগঠন ছাত্রলীগের দুর্নীতি ও সন্ত্রাস এখন এমনভাবে ছড়িয়ে গেছে, শুধু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ক্যাম্পাস নয়, তার বাইরেও এত ব্যাপকভাবে বিস্তার লাভ করে দেশজুড়ে এক আতঙ্কের রাজত্ব কায়েম করেছে, যাতে তাদের ভাবমূর্তি পরিবর্তনের প্রয়োজন আওয়ামী লীগের জন্য জরুরি হয়েছে। কিন্তু এ প্রয়োজন জরুরি হওয়া সত্ত্বেও ছাত্রলীগের ওপর আওয়ামী লীগের নেতানেত্রীদের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। না থাকারই কথা। কারণ ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা তাদের মূল রাজনৈতিক দলের নেতানেত্রীর চরিত্রও ভালোভাবে জানে, তাদের দুর্নীতিবাজ ও অপরাধী চরিত্র এখন শুধু তারাই নন, দেশের জনগণও ভালোভাবেই জানেন। কাজেই যারা নিজেরা দুর্নীতিবাজ, সন্ত্রাসীদের গডফাদার অথবা খোদ সন্ত্রাসী, তাদের আদেশ, নির্দেশ হিতোপদেশ শুনে যে তারা নিজেদের পকেট ভর্তির জন্য চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, গাড়িবাড়িতে অগ্নিসংযোগ, খুন খারাবি ইত্যাদি বাদ দেবে, এটা বর্তমান পর্যায়ে সম্ভবই নয়, এমনকি এ চিন্তাও এক অসম্ভব ব্যাপার।

মিথ্যা প্রতিশ্রুতি, ধাপ্পাবাজি, প্রতারণা ইত্যাদি ব্যাপারে শাসকশ্রেণীর বিভিন্ন দলের নেতানেত্রীরা যে কত সিদ্ধহস্ত, এটা জনগণ জানেন। তা সত্ত্বেও নিজেদের ভাবমূর্তি উন্নত করার জন্য তাদের মিথ্যা প্রতিশ্রুতি ও প্রতারণামূলক কাজের শেষ নেই। ছাত্রলীগের মধ্যে মাদকাসক্তদের নেতৃত্ব থেকে বাইরে রাখার জন্য তাদের রক্ত পরীক্ষার যে মহড়া মন্ত্রী মহোদয়ের পৌরহিত্যে পাবনায় হচ্ছে, এটা তারই এক দৃষ্টান্ত।

একদিকে এ দৃষ্টান্তের সংবাদ যখন আজকের পত্রিকায় ছাপা হয়েছে তখন একই দিনে (২১.৪.২০১০) ছাপা হয়েছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের দ্বারা শিক্ষকদের বাসে আগুন দিয়ে তাকে ভস্মীভূত করার সংবাদ। চট্টগ্রামে এই ছাত্রলীগ কর্মীরা যে মাদকাসক্ত হওয়ার কারণে এ কাজ করেছে এটা ভাবা এক মূঢ়তা এবং এ কথা বলার চেষ্টা প্রতারণা ছাড়া কিছু নয়। যারা এ ধরনের অপরাধমূলক কাজ করছে তারা মাদক আসক্ত হয়ে নয়, বেশ ঠাণ্ডা মাথাতেই অপরাধের জন্য গরম হয়ে এ কাজ করছে। এই সত্য উপলব্ধি যাদের মধ্যে নেই তারা কাণ্ডজ্ঞানশূন্য। এ দেশের বর্তমান বাস্তবতার সঙ্গেও তাদের পরিচয় নেই।

আওয়ামী লীগের নেতানেত্রীরা এখন তাদের ছাত্র নেতাদের উদ্দেশে প্রায়ই বলেন, তারা কোনো খারাপ কাজের সঙ্গে জড়িত থাকুক এটা তারা দেখতে চান না। এই শুভ প্রত্যাশার ঘোষণা দ্বারা যে কোনো কাজ হয় না, এটা এখন বাংলাদেশে কাউকে বুঝিয়ে বলার প্রয়োজন হয় না। তারা জানেন যে এসব কথাবার্তা আওয়ামী নেত্রানেত্রীদের মামুলি ও পরিচিত ভাওতাপূর্ণ কথা ছাড়া আর কিছুই নয়। তারা আরও জানেন যে, সরকারি ক্ষমতার বলে বলিয়ান হয়েই ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা পুলিশের ছত্রছায়াতে থেকেই এসব দুর্বৃত্তমূলক কাজ করছে।

আওয়ামী লীগের মন্ত্রী পাবনায় ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের মাদকাসক্তি পরীক্ষার জন্য তাদের রক্ত পরীক্ষার ব্যবস্থা করেছেন। কিন্তু বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আশার পর শুধু কি ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরাই দুর্নীতি ও সন্ত্রাস করছে? আওয়ামী লীগের শীর্ষতম-পর্যায়ের নেতানেত্রী থেকে নিয়ে নিম্নতর স্তরের নেতানেত্রীরা কি ধোয়া তুলসী পাতা? সেটা যে নয়, এই সত্য কার না জানা? তাহলে পাবনার ছাত্রলীগ কর্মীদের রক্ত পরীক্ষার পর কি পাবনা জেলার আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের রক্ত পরীক্ষা হবে, না তাদের পুতপবিত্র ধরে নিয়েই রেয়াত দেওয়া হবে এই পরীক্ষা থেকে? শুধু পাবনা কেন, তাদের দলের শীর্ষতম নেতৃত্বকেও কি এর বাইরে রাখা হবে? অপরাধের সঙ্গে মাদকাসক্তির যোগ স্থাপন করে যারা অপরাধীদের দলের বাইরে রাখার কর্মসূচি ঘোষণা করেছেন তাদের সে কর্মসূচি কি সারা দেশে ছাত্রলীগের বিভিন্ন শাখায় চালু করার দরকার নেই? আওয়ামী লীগের অন্যান্য অঙ্গসংগঠন যুবলীগ, মহিলা লীগ, তরুণ লীগ ইত্যাদির নেতৃত্বও যাতে মাদকাসক্তদের হাতে না যায় তার জন্য কি এসব সংগঠনের মধ্যেও রক্ত পরীক্ষা চালু হবে?

এসব প্রশ্ন খুব স্বাভাবিক। এসব প্রশ্নের মাধ্যমেই এ ধরনের কোনো কর্মসূচির আসল লক্ষ্য-উদ্দেশ্য ও চরিত্র নির্ধারণ সম্ভব। এ প্রসঙ্গে এখানে উল্লেখ করা দরকার যে, আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব এখন মাদকাসক্ত নয়। তারা হলো ক্ষমতা মদমত্ত। মাদকাসক্তি প্রমাণ করা রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে যেভাবে সম্ভব ক্ষমতার মদমত্ততা প্রমাণ, সেভাবে কোনো শারীরিক পরীক্ষার দ্বারা সম্ভব নয়। তার অন্য উপায় আছে এবং জনগণ সে উপায়ে এ পরীক্ষা নিজেদের মতো করে করছেন। তারা জানেন যে, ক্ষমতার মদমত্ততার সঙ্গে মাদকাসক্তির কোনো সম্পর্ক নেই। এর সঙ্গে সম্পর্ক চরিত্রের, অভ্যাসের, দুর্নীতি ও সন্ত্রাস-প্রবণতার। কাজেই আওয়ামী লীগ বা শাসক শ্রেণীর অন্য কোনো দলের নেতানেত্রীদের ক্ষমতার মদমত্ততা ও তার সঙ্গে সম্পর্কিত দুর্নীতি এবং সন্ত্রাস দমন রক্ত পরীক্ষার মতো সম্পূর্ণ নিপ্রয়োজনীয় কোনো কর্মসূচির মাধ্যমে সম্ভব নয়। এ অবস্থার পরিবর্তন আজকের বাংলাদেশে কোনো সংস্কার বা সংস্কার আন্দোলনের মাধ্যমেও সম্ভব নয়। এটা একমাত্র সম্ভব বিদ্যমান সমাজ ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তনের মাধ্যমে। এ কারণে মাদকাসক্তির জন্য রক্ত পরীক্ষা নয়, সমাজ পরিবর্তনের জন্য প্রয়োজনীয় রাজনৈতিক আন্দোলন সংগঠিত করাই জনগণের সামনে এ মুহূর্তের সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ কর্তব্য।
সূত্রঃ আমার দেশ, ২২/০৪/১০]

যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রসঙ্গে

বদরুদ্দীন উমর


যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে আওয়ামী লীগ সরকারের লোকজন ও তাদের ঘরানার বুদ্ধিজীবীর দল যেভাবে ও যেসব আওয়াজ তুলছে, তাতে দেখা যাচ্ছে, খাজনার থেকে এদের বাজনা অনেক বেশি। এর থেকে সন্দেহ হওয়া স্বাভাবিক যে এরা সত্যি সত্যিই ১৯৭১ সালের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চায় কি না। এ ক্ষেত্রে উল্লেখ্য, বিচার প্রক্রিয়ার শ্লথগতি এবং এ বিষয়ে নানা বিভ্রান্তিকর কথাবার্তা সরকারি লোকজন বলতে থাকায় আওয়ামী ঘরানার কোনো কোনো মহলও এ বিচারের ব্যাপারে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।
প্রথমেই বলা দরকার, বিচার প্রক্রিয়া ভণ্ডুল করার চক্রান্তের কথা বলে 'ওই গেল ওই গেল' রব তুলে আওয়ামী লীগ মহলের নেতৃস্থানীয় লোকজন কর্তৃক যেসব কথা প্রায় প্রতিদিন বলা হচ্ছে, তাতে এদের এসব বক্তব্য পরিণত হয়েছে এক হাস্যকর ব্যাপারে। বিএনপি ২৭ জুন হরতাল আহ্বান করেছিল। সে হরতালের সমালোচনা তাদের পক্ষ থেকে করা কোনো দোষের ব্যাপার নয়। কিন্তু যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়া ভণ্ডুল করার জন্যই হরতাল ডাকা হয়েছে বলে তারা যে আওয়াজ তুলেছিল, তার ফাঁকা চরিত্র খুব স্বচ্ছ। কোনো লোকই এ আওয়াজকে পাত্তা দেননি। কারণ, হরতালের সঙ্গে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বিষয়কে যুক্ত করা রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার এক ব্যর্থ প্রচেষ্টা বলেই তাঁরা মনে করেছেন। শুধু হরতালই নয়, দেখা যাচ্ছে বিএনপির যেকোনো কাজ, সিদ্ধান্ত বা কর্মসূচির সমালোচনা করতে গিয়ে আওয়ামী লীগ সব সময়ই তাকে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ভণ্ডুল করার চক্রান্ত বলে অভিহিত করছে। এতে নিজেদের জনগণের কাছে খেলো করা এবং যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বিষয়কে খেলো করে দেওয়া ছাড়া অন্য কিছুই হচ্ছে না। অবস্থা এ রকম দাঁড়াচ্ছে এ কারণে যে আওয়ামী লীগ বিরোধী দল কর্তৃক যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বানচালের কথা যত জোরেশোরে বলছে, এ বিচারকাজ সুষ্ঠুভাবে সংগঠিত ও ত্বরান্বিত করার ব্যাপারে সরকারিভাবে তেমন কিছুই করছে না।

যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ইস্যু কোনো নতুন ইস্যু নয়। বাস্তবত ১৯৭১ সালে যুদ্ধ শেষ হওয়ার পরই এ বিচার প্রক্রিয়া শুরু ও তৎকালীন পরিস্থিতিতে দ্রুত সম্পন্ন হওয়া দরকার ছিল। কিন্তু আওয়ামী লীগ তখন প্রবল প্রতাপে রাজত্ব করলেও তারা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করেনি। শুধু তাই নয়, এর তালিকা প্রক্রিয়া শুরু করে তারা তালিকাভুক্ত ১৯৫ পাকিস্তানি সামরিক অফিসারের বিচার না করে তাদের পাকিস্তানে ফেরত পাঠিয়েছিল। যদিও তৎকালীন সরকারের পক্ষ থেকে বারবার বলা হচ্ছিল যে সেই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বাংলার মাটিতেই হবে। সে বিচার হয়নি, তার পরও বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে যাদের আটক করা হয়েছিল তাদেরও ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল। তাদের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছিল নতুন বাংলাদেশ গড়ার কাজে অংশগ্রহণ করতে। এ কাজ শেখ মুজিব তাদের মন্ত্রিসভার কোনো সিদ্ধান্তের মাধ্যমে করেননি। সাংবিধানিকভাবে ক্ষমা ঘোষণা ছিল রাষ্ট্রপতির এখতিয়ারভুক্ত, তবু প্রধানমন্ত্রী হিসেবেই তিনি এ ক্ষমা ঘোষণা করেছিলেন নিজে এই কাজের কৃতিত্ব গ্রহণের জন্য। এ ক্ষেত্রে সব থেকে 'চমৎকৃত' হওয়ার মতো ব্যাপার ছিল প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিব কর্তৃক ১৯৭১ সালের সব থেকে বড় ও ঘৃণ্য যুদ্ধাপরাধী জুলফিকার আলী ভুট্টোকে শুধু মাফ করে দেওয়া নয়, ১৯৭৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে লাহোরে ইসলামী সম্মেলনের সময় তাঁকে পরম বন্ধু হিসেবে আলিঙ্গন করে তাঁর গালে চুমু খাওয়া এবং পরে তাঁকে মহাসম্মানিত রাষ্ট্রীয় অতিথি হিসেবে বাংলাদেশে আমন্ত্রণ জানিয়ে রাজসিক সংবর্ধনা জ্ঞাপন করা। এর পর বাস্তবত আওয়ামী লীগের পক্ষে ১৯৭১ সালের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কোনো নৈতিক অথবা আইনগত ভিত্তি থাকেনি। ১৯৯৬-২০০১ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকার সময়ও তারা যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কোনো উদ্যোগ নেয়নি। শুধু তা-ই নয়, যখনই প্রয়োজন হয়েছে তখনই তারা জামায়াতে ইসলামী এবং অন্য ধর্মীয় সংগঠনের নেতাদের সঙ্গে সমঝোতা করেছে। এসব কিছুর প্রমাণই সংবাদপত্রের পাতায় ছড়িয়ে আছে, কাজেই কারো কিছু বানিয়ে বলার প্রয়োজন নেই।

১৯৯৬ সালে ক্ষমতাসীন হওয়ার পর আওয়ামী লীগ সরকার যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বিষয়ে কোনো উদ্যোগ না নিলেও এখনকার পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে চাপে পড়ে তারা এ উদ্যোগ নিয়েছে। খুব ভালো কথা। কিন্তু উদ্যোগ নেওয়া সত্ত্বেও এ ব্যাপারে যেভাবে অগ্রসর হওয়া দরকার সেটা এদের মধ্যে দেখা যাচ্ছে না। এ ক্ষেত্রে এরা নিজেরা ইতিবাচক কাজ করার পরিবর্তে নেতিবাচকভাবে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী কর্তৃক এই বিচার ভণ্ডুল ও বানচাল করার ষড়যন্ত্রের কথাই বেশি বলছে।
বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীদের অধিকাংশই সততার জন্য বিখ্যাত নন। কাজেই সুযোগ বুঝে তাঁরা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বিষয়ে অনেক গালভরা কথা বললেও আওয়ামী লীগ সরকারের এই নেতিবাচক কার্যকলাপের বিরোধিতা না করে নিজেরাও এর সঙ্গে সুর মেলাচ্ছেন। এ কাজ করতে গিয়ে অনেক ফালতু কথাই তাঁদের বলতে হচ্ছে।

এবার অন্য এক প্রসঙ্গে আসা দরকার। এ প্রসঙ্গে এবং এ বিষয়ে কোনো কথা আওয়ামী মহলে তো শোনাই যায় না, উপরন্তু কেউ সে কথা বললে তাকে স্বাধীনতাবিরোধী হিসেবে আখ্যায়িত করার চেষ্টা করতে দেখা যায়। প্রসঙ্গটি হলো, ১৯৭১ সালে যুদ্ধাপরাধ শুধু অবাঙালি ও পাকিস্তানপন্থীরাই করেনি। বাঙালিরাও তখন যুদ্ধাপরাধ করেছে। যুদ্ধাপরাধের অর্থ শুধু স্বাধীনতার সক্রিয় বিরোধিতা নয়। যুদ্ধের সময় নিরপরাধ ব্যক্তি এবং আত্দসমর্পণকারী ব্যক্তিদের হত্যা, ধর্ষণ, নির্যাতন করাও অপরাধ। এ কাজ তখন দুই পক্ষেই হয়েছিল। ১৯৭১ সালের মার্চ-এপ্রিলে অনেক অবাঙালি নিরাপরাধ নারী-শিশু-বৃদ্ধ ব্যক্তি বাঙালিদের হাতে নিষ্ঠুরভাবে নিহত হয়েছে। আমি নিজের চোখে এ হত্যাকাণ্ড দেখেছি মার্চ মাসের শেষদিকে। আমার আত্দজীবনী 'আমার জীবন'-এর তৃতীয় খণ্ডে আমি এর বর্ণনা দিয়েছি (জাতীয় সাহিত্য প্রকাশ, পৃষ্ঠা : ১৭২-১৭৩)। এটা এমন ব্যাপার ছিল, যা গোপন বা অস্বীকার করার উপায় নেই।
'মুক্তিযুদ্ধ ও তারপর' নামে একটি বই ২০১০ সালের জানুয়ারি মাসে 'প্রথমা' প্রকাশনী কর্তৃক প্রকাশিত হয়েছে। গোলাম মুরশিদ লিখিত বইটিতে এ বিষয়ের কিছু উল্লেখ আছে। এর থেকেও মনে হয়, অবাঙালিদেরও যে মানুষ হিসেবে বিবেচনা করা দরকার এবং তাদেরও যে ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকার আছে_এ চিন্তা মুক্তিযোদ্ধা নামে পরিচিত লোকদের ছিল না। এ জন্য হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে সে সময় বাঙালিরা এমনভাবে অনেক অবাঙালি নিধন করেছিল, ঠিক যেভাবে বাঙালি নিধন করেছিল অবাঙালি পাকিস্তানিরা। গোলাম মুরশিদ লিখেছেন, "আইন হাতে তুলে নেওয়ার একটি বড় রকমের দৃষ্টান্ত দেখা যায় ১৮ তারিখ মুক্তিযোদ্ধাদের এক সমাবেশে। এই সমাবেশে দেশপ্রেমিক মুক্তিযোদ্ধারা দেশ গড়ার ব্যাপারে সবাইকে উৎসাহ দেন।...কিন্তু এই সমাবেশের পরেই হঠাৎ মুক্তিযোদ্ধারা চারজন 'দালাল'কে পেটাতে আরম্ভ করেন। বেসামরিক মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত ছিলেন কাদের সিদ্দিকী। তাঁকে নিয়ে গর্ব করতাম আমরা সবাই। সত্যিকার অর্থে তিনি যেভাবে নিজে একটি বিশাল মুক্তিবাহিনী গড়ে তোলেন, তা বিস্ময়ের ব্যাপার। যেভাবে যুদ্ধ করে তিনি টাঙ্গাইল অঞ্চল দখল করে রাখেন, তাও অবিশ্বাস্য। বস্তুত তিনি সবারই শ্রদ্ধা অর্জন করেন। কিন্তু ১৮ তারিখে 'দালাল' পেটানোর নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তিনিই। শেষ পর্যন্ত তিনি বিদেশি টেলিভিশনের সামনে বেয়োনেট দিয়ে খুঁচিয়ে এই দালালদের হত্যা করেন" (মাঈদুল, ১৯৯২)। বলাবাহুল্য, আইন হাতে তুলে নেওয়ার এ দৃষ্টান্ত শ্রদ্ধার বস্তু ছিল না। বহু দেশেই এই ঘটনার ছবি দেখানো হয়। ফলে যুদ্ধের সময় বাংলাদেশের প্রতি বিশ্বসমাজের যে শুভেচ্ছা ও সহানুভূতি তৈরি হয়েছিল, তখন থেকেই তাতে ভাটা পড়তে আরম্ভ করে (পৃষ্ঠা: ১৭৬-'৭৭)। 'কাদের সিদ্দিকী বেয়োনেট দিয়ে এক দালালকে হত্যা করতে যাচ্ছেন'_এই শিরোনামে একটি ছবিও এতে ছাপানো হয়েছে; যাতে দেখা যাচ্ছে কাদের সিদ্দিকী বেয়োনেট দিয়ে একজনকে হত্যা করে আর একজনকে হত্যা করছেন।

এই অবাঙালি নিধনের জন্য যুদ্ধাপরাধী হিসেবে বাঙালিদের কারো কোনো বিচার হবে এমন চিন্তা বাংলাদেশে দেশদ্রোহিতার শামিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও এর উল্লেখ করা হলো এ কারণে যে এর মধ্যে দেশপ্রেমিক মুক্তিযোদ্ধাদের একটা বড় অংশের উগ্র জাতীয়তাবাদী ফ্যাসিস্ট চরিত্রের প্রতিফলন ঘটে, যে চরিত্র কোনো মতেই প্রশংসাযোগ্য নয়।
(সুত্র, কালের কন্ঠ, ০১/০৭/২০১০)