বুধবার, ১৬ জানুয়ারী, ২০১৩

বাংলাদেশ রাশিয়া থেকে কী কারণে আট হাজার কোটি টাকার অস্ত্র কিনছে?


ব দ রু দ্দী ন উ ম র




প্রধানমন্ত্রী তার রাশিয়া সফরে গিয়ে ১৫ জানুয়ারি তাদের সঙ্গে এক বিলিয়ন ডলার বা আট হাজার কোটি টাকার এক অস্ত্র ক্রয়চুক্তি করেছেন। এই চুক্তি অনুযায়ী সরকার সামরিক বাহিনীর জন্য নানা ধরনের অস্ত্র আমদানি করবে। এর জন্য রাশিয়া বাংলাদেশকে এক বিলিয়ন ডলার ঋণ দেবে। এই ঋণের সুদসহ অন্য শর্ত সম্পর্কে কোনো রিপোর্ট আজকের (১৬.১.১৩) সংবাদপত্রে না থাকলেও আগের কিছু সূত্র থেকে জানা যায় যে, সুদের হার বেশ উঁচুই রাখা হয়েছে। মোট কথা, ঋণ নিয়ে আট হাজার কোটি ডলার মূল্যের অস্ত্র বাংলাদেশ সরকার রাশিয়া থেকে কেনার ব্যবস্থা এখন চূড়ান্ত করেছে। এছাড়া তারা রাশিয়া থেকে ঋণ নিয়ে ঈশ্বরদী থানার রূপপুরে একটি পারমাণবিক বিদ্যুত্ উত্পাদন কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার জন্যও চুক্তিবদ্ধ হয়েছে। এই চুক্তি নিয়ে বেশ কিছুদিন থেকেই বর্তমান বাংলাদেশ সরকার রাশিয়ার সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে আসছিল।
বাংলাদেশ যে এভাবে সম্পূর্ণ বেপরোয়া হয়ে বিদেশ থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়ে নিষ্প্রয়োজনে অস্ত্র কিনছে এবং পারমাণবিক বিদ্যুেকন্দ্র স্থাপন করে দেশ ও জনগণের জন্য বিপদ সৃষ্টি করছে, এটা কোনো অবহেলা বা অগ্রাহ্য করার মতো বিষয় নয়। শুধু রাশিয়ার সঙ্গে এই অস্ত্র ও ঋণচুক্তিই নয়, একইভাবে মাত্র কিছুদিন আগে এরা চীন থেকেও ট্যাঙ্কসহ বিভিন্ন সামরিক সরঞ্জাম কেনার চুক্তি করেছে। এছাড়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্যান্য দেশ থেকেও তারা সামরিক জিনিসপত্র কিনেছে। এসব ব্যয় জোড়া দিলে যে পরিমাণ দাঁড়ায় সেটা বাংলাদেশের জন্য এক বিশাল অঙ্ক। তার থেকেও বড় কথা এই ব্যয় বাংলাদেশের জন্য সম্পূর্ণ নিষ্প্রয়োজন।
আমরা এর আগেও বাংলাদেশের সামরিক খাতে ব্যয় সম্পর্কে বলেছি যে, দেশ রক্ষার নামে যে ব্যয় করা হয় এবং ক্রমাগত যেভাবে ব্যয় বৃদ্ধি করা হয় তার কোনো যৌক্তিকতা নেই। যৌক্তিকতা নেই এ কারণে যে, বাংলাদেশকে সামরিকভাবে আক্রমণ করার মতো কোনো দেশ এর চারপাশে নেই। সাত সমুদ্র পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশ আক্রমণ করতে আসবে এমন কোনো দেশও নেই। কাজেই অন্য দেশের আক্রমণ মোকাবিলার জন্য বাংলাদেশ যে যুদ্ধ প্রস্তুতি গ্রহণ করে চলেছে তা অর্থহীন ও নিষ্প্রয়োজনীয়। কিন্তু যতই অর্থহীন ও নিষ্প্রয়োজনীয় হোক, এই ব্যয় বাংলাদেশ সরকার বেপরোয়াভাবে করেই চলেছে। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী এখন রাশিয়া গিয়ে যে চুক্তি করেছেন এটা এই ধরনের অপচয়েরই এক নিকৃষ্ট দৃষ্টান্ত।
বাংলাদেশ ভারত, নেপাল, ভুটান ও মিয়ানমার দ্বারা বেষ্টিত। ভারত বাংলাদেশ সরকারের পরম বন্ধু দেশ। নেপাল ও ভুটানের পক্ষে বাংলাদেশ আক্রমণের চিন্তা উন্মাদের ব্যাপার। মিয়ানমারের সঙ্গে এটা-ওটা নিয়ে বাংলাদেশের কিছু দ্বন্দ্ব থাকলেও সেটা এমন নয় যে, তার ফলে মিয়ানমার সামরিকভাবে বাংলাদেশ আক্রমণ করতে পারে। এছাড়া অন্য কোনো দেশও নেই যাদের দ্বারা দূর থেকে এসে বাংলাদেশের ওপর সামরিক আক্রমণের সম্ভাবনা। তাহলে কার থেকে দেশ রক্ষার জন্য বাংলাদেশ সরকারের এত বিশাল ও বেপরোয়া অস্ত্র মজুত প্রয়োজন? এই শত্রুর কোনো কথা, কোনো পরিচয় বাংলাদেশ সরকারের থেকেও শোনা যায় না।
তবে শ্রেণীবিভক্ত সমাজে শুধু বাইরের শক্তিই নয়, দেশের ভেতরের শক্তিরও মোকাবিলা করতে হয়। শাসক শ্রেণী যাদের শোষণ করে, যাদের ওপর অমানুষিক নির্যাতন চালিয়ে সমগ্র শোষণ ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখে, তাদের শত্রু হিসেবে বিবেচনা করে। তাদেরকেও মনে করে নিজেদের শাসন ক্ষমতার বিরুদ্ধে হুমকিস্বরূপ। এ কারণে তাদের দমন করার জন্যও প্রয়োজন হয় বলপ্রয়োগের। এই বলপ্রয়োগ বাস্তবত করাও হয়ে থাকে যা আমরা প্রায়ই প্রত্যক্ষ করি। কিন্তু এখানেও কথা আছে। জনগণের বিরুদ্ধে বলপ্রয়োগের জন্য যে পরিমাণ অস্ত্রশস্ত্র প্রয়োজন তার থেকেও অনেক বেশি এখন সরকারের হাতে আছে। অস্ত্র শুধু এখনই কেনা হচ্ছে না। নিয়মিতভাবে অস্ত্র কিনে সরকারের অস্ত্রভাণ্ডার ভরপুর করে রাখা হয়েছে। এদিক দিয়েও বর্তমান অস্ত্র ক্রয় সম্পূর্ণ নিষ্প্রয়োজন। অথচ এই অস্ত্র ক্রয়ের ব্যাপারটি এখন ঢাকঢোল পিটিয়ে এমনভাবে প্রচার করা হচ্ছে যাতে মনে হয় এটা বর্তমান বাংলাদেশ সরকারের এক বিরাট অর্জন এবং বিজয়!
এখানে অবশ্যই বলা দরকার, এই অস্ত্র ক্রয় এমন সময়ে হচ্ছে যখন ঢাকার রাস্তায় গরিব শিক্ষকরা সামান্য বেতন নিশ্চিত করার জন্য সরকারের কাছে দাবি জানিয়ে আন্দোলন করছেন। আট হাজার কোটি টাকা দিয়ে নিষ্প্রয়োজনীয় অস্ত্র কেনার জন্য সরকার চড়া সুদে রাশিয়া থেকে ধার করছে, কিন্তু শিক্ষকদের জন্য সামান্য ব্যয়ের ক্ষমতা সরকারের নেই! তাদের মাসিক বেতন নিশ্চিত করার জন্য এমপিওভুক্তির দাবি জানিয়ে রাস্তায় আন্দোলনে নামা, অনশন করাও তাদের মস্ত অপরাধ!! এই ‘অপরাধের’ জন্য সরকার আন্দোলনকারী শিক্ষকদের ওপর লাঠি চালাচ্ছে, তাদের শরীরে মরিচের গুঁড়ো ছিটিয়ে দিচ্ছে, তাদের ওপর গরম পানি স্প্রে করছে!!! এর থেকে কি প্রমাণিত হয় না যে, ভোট পেয়ে কেউ ক্ষমতায় গেলে সে জনগণের স্বার্থের প্রতিনিধি হবে এমন কথা নেই। শুধু তা-ই নয়, এর থেকে কি প্রমাণিত হয় না, বর্তমান সংসদীয় ব্যবস্থার চরিত্র এমন যে নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের স্বার্থের প্রকৃত প্রতিনিধি ও তাদের বন্ধু নয়, বরং শত্রুরাই ক্ষমতাসীন হয়?
বাংলাদেশ সরকার যখনই কোনো বড় প্রকল্প ও বিশাল আকারে কিছু কেনার জন্য কোনো বিদেশি সরকার বা কোম্পানির সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয় তখনই তার সঙ্গে দুর্নীতি জড়িত থাকে। অস্ত্র ক্রয় এর মধ্যে একটি। শেখ হাসিনার প্রথম সরকারের সময় নৌবাহিনীর জন্য ফ্রিগেট ও বিমানবাহিনীর জন্য মিগ কেনার সময় দুর্নীতির অভিযোগে হাসিনার বিরুদ্ধে মামলা হয়, যা তিনি দ্বিতীয়বার ক্ষমতাসীন হয়ে আদালতকে দিয়ে খারিজ করিয়ে নেন। এখন রাশিয়ার সঙ্গে অস্ত্র কেনার জন্য যে আট হাজার কোটি টাকার চুক্তি হয়েছে এর সঙ্গে দুর্নীতির কোনো সম্পর্ক আছে কিনা এবং থাকলে তার পরিমাণ কত এ নিয়ে তদন্ত হওয়া দরকার। শুধু এই অস্ত্র কেনার ক্ষেত্রেই নয়, রূপপুরে পারমাণবিক বিদ্যুেকন্দ্রের জন্য প্রাক-সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের জন্য যে ৫০০ মিলিয়ন ডলার বা চার হাজার কোটি টাকার ঋণচুক্তি হয়েছে সে ক্ষেত্রেও কী পরিমাণ দুর্নীতি হয়েছে সেটাও দেখা দরকার। কারণ বিশেষজ্ঞদের হিসাব অনুযায়ী এই প্রাক-সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের (pre-feasibility study) জন্য একশ’ কোটি টাকার বেশি ব্যয় হওয়ার কথা নয়! অথচ এই বাবত ঋণ নেয়া হচ্ছে চার হাজার কোটি টাকা!! এর থেকেই বোঝা যায় বাংলাদেশে জনগণের সম্পদ কী পরিমাণে লুটপাট ও অপব্যয় হচ্ছে এবং কী পরিমাণ দুর্নীতি বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার অপরাধীকীকরণ (criminalisation) ঘটিয়েছে।
বাংলাদেশে আজ যতই উন্নতির কথা বলা হোক, এ দেশের জনগণের জীবন এখন দারিদ্র্য ও বঞ্চনার কারণে বিপর্যস্ত। চিকিত্সা এতই ব্যয়সাপেক্ষ যে সাধারণ মানুষ, শতকরা আশিভাগ মানুষের সুচিকিত্সার কোনো সুযোগ ও ব্যবস্থা নেই। এই শীতের মধ্যে গরিবদের কোনো শীতবস্ত্র নেই। খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতার কথা বলা হলেও পুষ্টির অভাবে গরিবদের মধ্যে নানা ধরনের কঠিন রোগের প্রাদুর্ভাব। শহরে হাজার হাজার বাড়ি টাকাওয়ালা লোকদের থাকলেও লাখ লাখ মানুষ ঢাকাসহ অন্যান্য শহরে বস্তিতে থেকে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। তাদের কোনো বিশুদ্ধ পানীয়জল নেই, স্যানিটারি ব্যবস্থা নেই, একই ঘরে গাদাগাদি করে তাঁদের দিনরাত্রি যাপন। এসবই বাস্তব ব্যাপার। গরিবদের স্কুলের গরিব শিক্ষকদের কী অবস্থা এটা আগেই বলা হয়েছে। এসব দিকে সরকারের কোনো দৃষ্টি নেই। তাদের অবস্থা দেখে এবং বড় বড় হামবড়া কথাবার্তা শুনে বোঝাই যায় যে, এসব নিয়ে তাদের কোনো চিন্তা-ভাবনা নেই, তাদের কোনো করণীয় নেই। তারা শুধু নিজেদের, নিজেদের পরিবার ও দলীয় লোক এবং আত্মীয়স্বজনের পকেটভর্তি করতেই ব্যস্ত। এ কারণে তারা যা-ই করে তার সঙ্গে যুক্ত থাকে দুর্নীতি। এই পরিপ্রেক্ষিতে সরকার তার শেষ সময়ে রাশিয়া থেকে অস্ত্র ক্রয় এবং রূপপুরে পারমাণবিক বিদ্যুেকন্দ্র স্থাপনের জন্য যে চুক্তি করেছে, যে বিশাল ঋণের বোঝা দেশের জনগণের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়েছে তার সঙ্গে কী পরিমাণ দুর্নীতি জড়িত আছে, এর তদন্ত অবশ্যই হওয়া দরকার।

১৬.১.২০১৩

লেখক : সভাপতি, জাতীয় মুক্তি কাউন্সিল

বুধবার, ২৬ ডিসেম্বর, ২০১২

আওয়ামী লীগের আত্মঘাতী লাইন


ব দ রু দ্দী ন উ ম র




আওয়ামী লীগ ১৯৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চায় এটা তাদের কথাবার্তা ও কার্যকলাপ থেকে ঠিক মনে হয় না। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হলে তো সব শেষ। কিন্তু আওয়ামী লীগ এর শেষ চাওয়ার পরিবর্তে এই ইস্যুটিকে ঝুলিয়ে রেখে তার রাজনৈতিক চালবাজি চালিয়ে নিতে চায়, এমনটাই এখন দেখে-শুনে মনে হচ্ছে। এদিক দিয়ে যত গর্জে তত বর্ষে না—এটাই আওয়ামী লীগের অবস্থা।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও শাস্তির বিষয়ে সরকারি লোকজন যেসব কথাবার্তা বলছেন তাতে মনে হয় এদের ধারণা শাস্তির সব ব্যবস্থা হয়ে গেছে, বিচারকদের সঙ্গে বন্দোবস্ত করে এখন শুধু কোনো রকমে বিচার সেরে শাস্তি কার্যকর করার অপেক্ষা! মাত্র কয়েকদিন আগে আওয়ামী লীগের দফতরবিহীন পরগাছা মন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলেছেন, আগামী বছরের মধ্যেই ১৪ জন বিচারাধীন যুদ্ধাপরাধীকে ফাঁসি দেয়া হবে। একটি গুরুত্বপূর্ণ বিচারাধীন মামলার রায়ের ব্যাপারে এ ধরনের কথাবার্তা বলা যে শাস্তিযোগ্য কাজ, এটা সবাই জানে। সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত নাকি একজন বিজ্ঞ আইন বিশেষজ্ঞ! তা সত্ত্বেও তিনি এমন কথা বলছেন এটা তার স্থির বিশ্বাস থেকেই যে, আওয়ামী লীগের সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী মহল যেভাবেই হোক, বিচারাধীন ব্যক্তিদের ফাঁসি চান, এমনকি আদালতকে প্রভাবিত করে হলেও তারা এ কাজ সম্পন্ন করবেন! এটা এতই স্থূল যে, তার এই বক্তব্য প্রদানের পর আদালতেরও টনক নড়েছে এবং তারা এই পরগাছা মন্ত্রীকে এর কারণ দর্শানোর নির্দেশ দিয়েছেন।
শুধু এই মন্ত্রীই নয়, আওয়ামী লীগের কিছু ভূঁইফোড় নেতা ও তাদের সরকারি জোটের নেতা এখন প্রায় প্রতিদিনই এ বিষয়ে এমন সব বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছেন, যা একটি বিচারাধীন মামলা সম্পর্কে বলা চলে না। তারা নিজেরা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার অবশ্যই চাইতে পারেন এবং তার মধ্যে ন্যায্যতা আছে। কিন্তু এই বিচারাধীন মামলায় বিচারপতিরা কী রায় দেবেন তা নিয়ে কোনো ভবিষ্যদ্বাণী প্রদান তারা করতে পারেন না। কিন্তু আওয়ামী লীগ ও তার ঘরানার লোকরা এসবের কোনো পরোয়া করেন না। ক্ষমতার জোরে তারা বেপরোয়া। তাদের দুই মহিলা নেত্রীর জবানও এদিক দিয়ে লক্ষ্য করার মতো।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের সমাপ্তি ও কাঠগড়ায় দাঁড়ানো আসামিদের শাস্তির ব্যাপারে আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্বের আগাম স্ট্র্যাটেজি যাই হোক, এ নিয়ে জোর প্রচারের ক্ষেত্রে তারা নিজেদের যত রকম শক্তি আছে তা প্রদর্শনের চেষ্টায় এখন নিযুক্ত আছেন। এজন্য সম্প্রতি তাদের দেখা গেছে তাদের ঘরানার বামপন্থী দল ও বুদ্ধিজীবীদের দিয়ে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বিষয়ে ‘আন্দোলন’ করতে। প্রথমোক্তরা এই উদ্দেশ্যে এক সরকার সমর্থিত হরতাল ডেকে মস্তবড় কেলেঙ্কারি করেছেন এবং দ্বিতীয়োক্তরা সাম্প্রদায়িকতার নামে এক ভুয়া ‘জাতীয়’ সম্মেলন করে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ইস্যুকেই সামনে এনেছেন। তাদের সাম্প্রদায়িকতা-বিরোধী সম্মেলনের আসল লক্ষ্য এর মাধ্যমে তারা প্রকটিত করেছেন।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে এখন ঘোর অমাবস্যা। এই অমাবস্যার অবস্থায় এখন অন্ধকারের জীবদেরই রাজত্ব। চোর, দুর্নীতিবাজ, লুণ্ঠনজীবী ও দস্যুরাই এখন বাংলাদেশের রাজনীতির নির্ধারক শক্তি হিসেবে কাজ করছে এবং জনগণের জীবনে এক অভিশাপের মতো নেমে এসেছে। এ সবই যুক্ত আছে এদের সাংস্কৃতিক নিম্নমান, রুচিহীনতা ও চরম দায়িত্বজ্ঞানহীনতার সঙ্গে। এদের সাংস্কৃতিক নিম্নমান ও রুচিহীনতার যে প্রতিফলন এদের নানা বক্তব্যের মধ্যে প্রতিফলিত হয় তার থেকে পীড়াদায়ক ব্যাপার কমই আছে। এ বিষয়টি নিয়ে কাউকে বিশেষ কথাবার্তা ও আলোচনা করতে দেখা যায় না। কিন্তু নিম্ন সাংস্কৃতিক মান ও রুচিহীনতা যে নানা ধরনের অপরাধ প্রবণতার সঙ্গে যুক্ত, এটা এক প্রমাণিত সত্য।
শুধু বিচার বিষয়ে ভবিষ্যদ্বাণীই নয়, অন্য অনেকভাবেই আওয়ামী লীগ ও তাদের ঘরানার রংবেরঙের লোকজন যেসব কথা বলছে ও কাজ করছে, তাতে এ নিয়ে সন্দেহ নেই যে, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নয়, অন্য কোনো মূল উদ্দেশ্যে তারা যুদ্ধাপরাধীদের নিয়ে এত মাতামাতি করছে। বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির দিকে তাকালে এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ থাকে না, আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগের একেবারে ভরাডুবি হবে। শুধু ঢাকা নয়, দেশের সর্বত্রই এ অবস্থা। বিভিন্ন মিছিল ও সমাবেশে তারা যতই ভাড়া করা লোক নামিয়ে নিজেদের শক্তি প্রদর্শন করুক, তাদের পায়ের তলায় আর মাটি নেই। এ উপলব্ধি তাদের যতই হচ্ছে ততই তারা মরিয়া হয়ে এমন সব কাজ ও কাণ্ড করছে, যার মধ্যে কাণ্ডজ্ঞান বলেও কিছু নেই।
এদের নিম্ন সাংস্কৃতিক মান ও রুচিহীনতার যে কথা আগে বলেছি তার প্রমাণ এরা প্রায় প্রতিদিনই নানাভাবে দিয়ে যাচ্ছে। এর সাম্প্রতিকতম হাস্যকর দৃষ্টান্ত হলো—কিছুদিন আগে জাতিসংঘে শান্তি বিষয়ক শেখ হাসিনার এক প্রস্তাব গৃহীত হওয়া নিয়ে তাদের প্রচারণা। বলা দরকার, এ ধরনের প্রস্তাবের ও প্রস্তাব পাস হওয়ার কোনো গুরুত্ব বাস্তবত নেই। এমন প্রস্তাবের অভাব জাতিসংঘে নেই, যেগুলো পাস হওয়ার পর অবহেলায় পড়ে থাকে। এগুলো অনেকটা কথার কথার মতো। কিন্তু এ তুচ্ছ ব্যাপার নিয়ে আওয়ামী মহলে এখন তোলপাড় চলছে। হাসিনাকে ‘বিশ্ব শান্তি মডেলের রূপকার’ আখ্যায় ভূষিত করে তার দলের লোকরা ঢাকা শহর পোস্টারে ছেয়ে ফেলেছে। এ নিয়ে তারা মিছিল করছে, জনসভা করে বিশ্ব নেত্রী হিসেবে হাসিনার গুণকীর্তন করে গলা ফাটাচ্ছে! এসবই হচ্ছে নিম্নমানের রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও রুচির প্রতিফলন। কিন্তু হায়! এ নিয়ে তারা যতই প্রচার-প্রচারণা ও মাতামাতি করুক জনগণের মধ্যে তাদের সম্পর্কে ধারণা মোটেই পরিবর্তিত হচ্ছে না। ভোটের বাজারে তাদের দর বৃদ্ধি হচ্ছে না। উপরন্তু আওয়ামী লীগের অবস্থা এখন লেজেগোবরে হচ্ছে।
দেশের সংবাদপত্রগুলো এ নিয়ে রিপোর্ট প্রদান ও লেখালেখি প্রকাশ করছে। টিভি চ্যানেলগুলোও পিছিয়ে নেই। সমালোচনা তো বটেই, এমনকি তাদের নিজেদের কাণ্ড-কারখানার রিপোর্টও তাদের বিরুদ্ধে জনগণের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করছে। কিন্তু এসবের হিসেব করে কথাবার্তা বলা ও কাজ করার কোনো ব্যাপারই আওয়ামী লীগ, তাদের শরিক দলগুলো ও তাদের ঘরানার বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে দেখা যাচ্ছে না। অদমিতভাবে এ লাইনে কাজ করে যাওয়ার থেকে একটি ক্ষমতাসীন দলের পক্ষে আত্মঘাতী আর কী হতে পারে?
লেখক : সভাপতি, জাতীয় মুক্তি কাউন্সিল
২৬.১২.২০১২

বৃহস্পতিবার, ২০ ডিসেম্বর, ২০১২

সরকারের বেনামি হরতাল সফল হয়েছে


ব দ রু দ্দী ন উ ম র




বাংলাদেশের জনগণ বর্তমান আওয়ামী জোট সরকারের হাতে কতখানি নিরাপদ এবং এদের হাতে বাংলাদেশের ভবিষ্যত্ কতখানি উজ্জ্বল তার প্রমাণ প্রতিদিনই প্রধানমন্ত্রীর জবানীতে পাওয়া যায়। তিনি নিয়মিতভাবে প্রতিদিনই বাণী বিস্তারে অভ্যস্ত এবং এইসব বাণী যতই আবোলতাবোল ও বাস্তবের সঙ্গে সম্পর্কহীন হোক, সরকারি শাস্তির ভয়ে প্রচার মাধ্যমগুলো তা বাধ্যতামূলকভাবে প্রচার করে থাকে।
এই ধরনের বাণী বিস্তার করতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী ১৭ ডিসেম্বর বিজয় দিবস উপলক্ষে এক আলোচনা সভায় বলেন, ‘রামুর বৌদ্ধ বিহারে হামলা, তাজরীন গার্মেন্টে অগ্নিকাণ্ড অথবা হিন্দু সম্প্রদায়ের ছেলে বিশ্বজিেক কুপিয়ে কুপিয়ে হত্যা—এর কোনোটাই বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। এগুলোর উদ্দেশ্য সরকারকে হেয় করে যুদ্ধাপরাধীদের রক্ষা করা।’ তিনি এখানেই না থেমে আরও বলেছেন, ‘সরকারকে দুর্নীতিবাজ বলতে বিদেশি সংস্থার চাপ ও কৌশল আছে। সরকারের তরফ থেকে দুদককে কোনোদিন চাপ প্রয়োগ করা হয় না। তারা সম্পূর্ণ স্বাধীনতা ভোগ করছে। যখন তারা সঠিকভাবে কাজ করছে তখন কোনো কোনো বিদেশি সংস্থা দুদককে চাপ প্রয়োগ করে। এগুলো কেন? সরকারকে যদি জনগণের কাছে হেয় প্রতিপন্ন করতে পারে, তাহলে যুদ্ধাপরাধীদের রক্ষা করা যায়। তাদের বাঁচানো যায়।’ (আমার দেশ, ১৮.১২.২০১২)
এসব কথা এমন যে, দেশের প্রধানমন্ত্রীর মুখনিসৃত না হলে এগুলোকে পচা নর্দমায় নিক্ষেপ করাই সঙ্গত ও স্বাভাবিক। শুধু এসব কথাই নয়, প্রতিনিয়ত তিনি যেসব কথা অবলীলাক্রমে বলে যান সেগুলোর বিপুল অধিকাংশের অবস্থাই এরকম। কিন্তু দেশের দুর্ভাগ্য যে, প্রধানমন্ত্রীর মতো পদে সমাসীন এক ব্যক্তির এ ধরনের কথা ছাড়া অন্য কিছু বলার মতো সাংস্কৃতিক যোগ্যতা নেই। কাজেই এইসব নোংরা ও নিষ্প্রয়োজনীয় কথা ঘাঁটাঘাঁটি করে তার ওপর বাধ্য হয়েই আমাদের আলোচনা করতে হয়।
প্রথমেই বলা দরকার, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে বর্তমান আওয়ামী লীগ ও তাদের জোট সরকারের শরিকরা যেসব কথা এখন অনর্গল বলছেন ও কাণ্ডকারখানা করছেন তা রীতিমত রহস্যজনক। এ দেশের জনগণ, বিশেষ করে ১৯৭১ সালে যুদ্ধাপরাধীদের দ্বারা যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন তাদের পরিবার ও স্বজনরা ১৯৭২ সাল থেকেই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করে আসছেন। কিন্তু সে দাবির প্রতি আওয়ামী বাকশালী সরকার, জিয়াউর রহমানের সরকার, এরশাদের সরকার, খালেদা জিয়ার সরকার ও শেখ হাসিনার প্রথম পাঁচ বছরের সরকার কেউই কর্ণপাত করেনি। মুখে কেউ কেউ এ বিষয়ে কিছু কথা বললেও কার্যক্ষেত্রে কাউকে কিছুই করতে দেখা যায়নি। বিশেষ করে বর্তমান সরকার যেভাবে হঠাত্ করে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে মাতামাতি করছে তার সঙ্গে তাদের ১৯৯৬-২০০১ সালের সরকারের উদাসীনতা খুব লক্ষ্য করার মতো। এ প্রসঙ্গে এটা এখানে বলা দরকার যে, ১৯৯৬ সালের সরকারের পক্ষে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার তো দূরের কথা, সে বিষয়ে কথা বলাও সম্ভব ছিল না। কারণ নির্বাচনের পর সরকার গঠনের জন্য আওয়ামী লীগের সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছিল না। সে সংখ্যাগরিষ্ঠতা তারা যুদ্ধাপরাধীদের সহায়তাতেই লাভ করেছিল! জামায়াতে ইসলামীর ভোটেই জাতীয় সংসদে আওয়ামী লীগের মহিলা সদস্যরা নির্বাচিত হওয়ায় আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়েছিল!! সে সময়ে আওয়ামী লীগ জামায়াতে ইসলামীকেও সংসদে মহিলা সদস্যের ভাগ দিয়েছিল!!! কাজেই বলা চলে, এখন বিএনপি এবং জামায়াতে ইসলামীর মধ্যে যে সম্পর্ক সেই সম্পর্কই তখন ছিল আওয়ামী লীগের সঙ্গে যুদ্ধাপরাধীদের!!!! হতভাগ্য এই দেশে এসব বিশ্বাসঘাতকতার কথা মনে করা ও বলার মতো কেউ নেই। বর্তমানে আওয়ামী লীগ তাদের ১৯৯৬ সালের দোসরদের বিরুদ্ধে শাস্তির ব্যবস্থার জন্য যেভাবে মাতামাতি করছে তার মধ্যে প্রকৃতপক্ষে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নয়, অন্য কোনো উদ্দেশ্য যে কাজ করছে এটা বেশ স্পষ্ট হলেও এ নিয়ে আওয়ামী লীগের কাছে ব্যাখ্যা কেউ চাইছে না।
১৯৯৬ সাল থেকে টানা পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকলেও সে সময়ে যারা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করেনি, তা নিয়ে টুঁ শব্দটি পর্যন্ত করেনি, তারা এখন সেটা নিয়ে এত গলাবাজি, এত মাতামাতি যেভাবে করছে তা বিস্ময়কর। শুধু বিএনপি নয়, দেশে তাদের বিরুদ্ধে যারাই রাজনৈতিক ও পেশাগত কারণে কিছু আওয়াজ তুলছে ও কর্মসূচি পালন করছে তাকেই এরা যুদ্ধাপরাধীদের সাঙ্গাত বলে অভিযুক্ত করে তোলপাড় করছে। শুধু তাই নয়, তারা এমন সব কাজের মধ্যে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বানচালের ষড়যন্ত্র দেখছে যাকে দুরভিসন্ধিমূলক এবং সেটা না হলে উন্মাদতুল্য বলা ছাড়া উপায় নেই। প্রধানমন্ত্রী ১৭ ডিসেম্বরের আলোচনা সভায় বলেছেন যে, রামুর বৌদ্ধ বিহারে হামলা ও হিন্দু সম্প্রদায়ের ছেলে বিশ্বজিেক কুপিয়ে কুপিয়ে হত্যা করা হলো যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বানচালের উদ্দেশ্যে ষড়যন্ত্র! এসব কথা বলে কোনো লাভ নেই, কারণ রামুর ঘটনার সঙ্গে আওয়ামী লীগ, বিএনপি এবং রাজনীতির সঙ্গে সম্পর্কহীন এমন অনেক ধরনের লোকই যে জড়িত ছিল এটা বিভিন্ন দেশি-বিদেশি তদন্তের মাধ্যমেই দেখা গেছে। বিশ্বজিত্ হত্যা সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য বাস্তবিকই উন্মাদতুল্য এবং এক চরম মিথ্যা ভাষণ যা একেবারে জেনেশুনেই করা হয়েছে! এ বিষয়ে দেশের প্রত্যেকটি মানুষই জানে যে, বিশ্বজিত্ হত্যা আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের কাজ। এর সব ধরনের প্রয়োজনীয় প্রমাণই আছে। যদি এই কাজ সত্যিই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বানচালের উদ্দেশ্যেই করা হয়ে থাকে তাহলে অবশ্যই বলতে হবে যে, আওয়ামী লীগ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে আকাশ-বাতাস উতলা করলেও খুব চাতুর্যের সঙ্গে তারাই এ বিচার বানচাল করার চক্রান্তে লিপ্ত আছে। তাদের দ্বারা এই ধরনের কাজ যে অসম্ভব নয়, এটা ১৯৯৬ সালে জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে তাদের আঁতাতের কথা বিবেচনা করলে উড়িয়ে দেয়ার নয়। তাছাড়া দিবালোকে সবার সামনে নিজেরা বিশ্বজিেক হত্যা করলেও তার জন্য যারা অন্যদের দায়ী করে উঁচু গলায় কথা বলতে পারে তাদের দ্বারা এমন কী অপকর্ম আছে যা অসম্ভব!
এখানেই শেষ নয়। প্রধানমন্ত্রী বলেন যে, দুদকের ওপর তারা কোনো চাপ সৃষ্টি করছেন না, দুদক স্বাধীনভাবেই কাজ করছে। তিনি আরও বলেন, পদ্মা সেতুর দুর্নীতির অভিযোগও যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচানোর উদ্দেশ্যে এবং সে কাজ করছে কোনো বিদেশি সংস্থা! অর্থাত্ এক্ষেত্রে বিশ্বব্যাংক!! এর চেয়ে উন্মাদ এবং অর্থহীন বক্তব্য আর কী হতে পারে? এর থেকে বোঝার অসুবিধে নেই যে, আমাদের দেশ ও জনগণ এই প্রধানমন্ত্রী এবং তার দল ও জোটের শাসনে কতখানি নিরাপত্তাহীন ও বিপদগ্রস্ত। এ বিষয়ে যে বিস্তারিত কোনো আলোচনার প্রয়োজন নেই এটা বলাই বাহুল্য।
এবার আসা যেতে পারে ১৮ ডিসেম্বর সিপিবির নেতৃত্বে কতকগুলো বাম সংগঠনের হরতাল প্রসঙ্গে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বানচাল করার বিরোধিতা করে তারা তাদের হরতাল আহ্বান করেছিল। এই হরতাল সফল হয়েছে। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকারের দ্বারা প্ররোচিত ও সাহায্যপ্রাপ্ত হয়ে তাদের এই উদ্যোগ যে এক মহা রাজনৈতিক কেলেঙ্কারি এটা দেশের প্রচারমাধ্যম, সব রাজনৈতিক মহল ও জনগণের কাছে এখন স্পষ্ট। এ হরতাল এমন শান্তিপূর্ণ হয়েছে যাতে হরতাল আহ্বানকারীরা রাস্তায় গড়াগড়ি দিয়ে সঙ্গীত গেয়েছে! কোনো গাড়িঘোড়া ভাঙা হয়নি, পুলিশ কাউকে লাঠিপেটা করার প্রয়োজন বোধ করেনি। এক কথায় বলতে গেলে এটা ছিল এক আদর্শ হরতাল! এই হরতাল হয়েছে বামপন্থীদের আহ্বানে!!
প্রথমেই বলা দরকার যে, বামপন্থীরা যে মূল ইস্যুতে হরতাল ডেকেছে এটা আওয়ামী লীগেরই ইস্যু। জনগণ ১৯৭২ সাল থেকে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চাইলেও সে বিচার যে আওয়ামী লীগসহ কেউ করেনি, এটা আগেই বলা হয়েছে। কিন্তু যে কায়দায় এখন আওয়ামী লীগ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে চারদিক উতলা করছে সেটা আওয়ামী লীগের কায়দা। এই আওয়ামী কায়দাতেই বামপন্থীরা তাদের হরতাল ডেকেছে। মূল্যবৃদ্ধি, সরকারের নানা ফ্যাসিবাদী কার্যকলাপ ইত্যাদি নিয়ে আজ পর্যন্ত এই বামপন্থীরা হরতাল দেয়ার কোনো উদ্যোগ নেয়নি। কারণ সোজা। হরতাল সফল করার মতো তাদের কোনো শক্তি নেই এবং আসলে অন্য সব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে হরতাল দেয়ার আগ্রহও তাদের নেই। সেটা থাকলে ব্যর্থতার কথা জেনেও তারা হরতাল দিতে পারত। ১৮ তারিখের হরতাল দেয়া হয়েছে বর্তমান আওয়ামী লীগেরই সর্বপ্রধান ইস্যুকে সামনে রেখে এবং আওয়ামী লীগেরই উদ্যোগ ও সহায়তায়। সে কারণে তাদের নৌ পরিবহনমন্ত্রী ও সরকারি সড়ক পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি বামপন্থীদের এই হরতালকে প্রকাশ্য সমর্থন দিয়েছেন। হরতালের দিন সরকার বিআরটিসির কোনো গাড়ি পথে নামায়নি, যা তারা সাধারণত হরতালের সময় নামিয়ে থাকে। অর্থাত্ সরকারই হরতালে অংশগ্রহণ করে রাস্তায় গাড়ি নামায়নি! রাস্তায় পুলিশ ব্যারিকেড দিয়ে নিজেরাই গাড়ি চলাচলে এমনভাবে বাধা দিয়েছে যাতে রাস্তা গাড়িশূন্য থাকে। তাছাড়া অনেক জায়গায় পুলিশকে হরতালের পিকেটিংয়েও অংশ নিতে দেখা গেছে। এই অবস্থায় হরতালকারীরা যে হারমোনিয়াম বাজিয়ে গান গেয়ে তাদের হরতাল সফল করবে এতে আশ্চর্য কী? হরতাল শেষ হওয়ার পর দেখা গেল সরকারের চরম প্রতিক্রিয়াশীল ও ফ্যাসিস্ট স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বামপন্থী হরতালকারীদের ধন্যবাদ জানিয়েছেন! আমরা কি জিজ্ঞেস করতে পারি, এরপর বাকি থাকল কী? যে বামপন্থীরা এভাবে সরকারের বেনামি হরতাল সফল করলেন তাদের বুদ্ধির অভাব আছে একথা কেউ বলবেন না। আমরাও বলি না। কাজেই এই হরতালের সঙ্গে যে সরকারের সম্পর্ক নেই, এটা তাদের নিজস্ব উদ্যোগে ও নিজস্ব ক্ষমতার ভিত্তিতেই তারা করেছেন, এ নিয়ে নানা যুক্তি তারা দিচ্ছেন। কিন্তু মানুষ চোখের সামনে যা দেখেছে তা অবিশ্বাস করে সিপিবির নেতৃত্বাধীন বামপন্থীদের ধূর্ত বক্তব্য বিশ্বাস করবে এমন অবস্থা দেশের জনগণের নেই। ঢাকা ও বিভিন্ন জায়গার রিপোর্ট থেকে দেখা যায় যে, হরতালের জন্য পিকেটিং করার মতো কর্মীর সংখ্যা তাদের নগণ্য থাকা সত্ত্বেও হরতাল সফল হয়েছে। সরকার পক্ষ কর্তৃক হরতালের বিরুদ্ধে মারমার কাটকাট করে আগের দিন কোনো মিছিলও বের হয়নি। কারণ ‘বিজয়ের মাসে’ প্রধানমন্ত্রীর গদগদ হরতালবিরোধী বক্তব্য সত্ত্বেও নিজেদের দ্বারা প্ররোচিত ও সংগঠিত হরতাল সফল করতে তাদের কোনো অসুবিধে নেই! তাদের কথা ও কাজের মধ্যে গরমিল কোনো নতুন ব্যাপার নয়। বামপন্থীদের মাধ্যমে তাদের বেনামি হরতাল সফল করার মধ্যে এটা নতুনভাবে প্রমাণিত হলো।
১৯.১২.২০১২

বৃহস্পতিবার, ২২ নভেম্বর, ২০১২

টিআইবি রিপোর্টের বিরুদ্ধে জাতীয় সংসদের প্রতিক্রিয়া


ব দ রু দ্দী ন উ ম র



ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) বাংলাদেশ জাতীয় সংসদ সদস্যদের আর্থিক এবং অর্থনৈতিক আচরণের ওপর এক তদন্ত রিপোর্টে বলেছে যে, তাদের শতকরা ৯৭ ভাগই নেতিবাচক কাজ ও দুর্নীতির সঙ্গে সম্পর্কিত। অর্থাত্ তারা দুর্নীতিবাজ। তাদেরকে ধোয়া তুলসীপাতা না বলে এই রিপোর্টে দুর্নীতিবাজ বলায় জাতীয় সংসদ সদস্যরা ও সেই সঙ্গে সংসদের স্পিকার জাতীয় সংসদের অধিবেশনে তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। তাদের প্রতিক্রিয়া দেখে মনে হতে পারে যে, তারা নিজেরাও নিজেদের দুর্নীতিমুক্ত সাধু-সন্ত মনে করেন! এ কারণে তারা টিআইবির এই রিপোর্টের বিরুদ্ধে শুধু ক্রুদ্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেই ক্ষান্ত হননি, টিআইবিকে বন্ধ করে দেয়ার দাবিও জানিয়েছেন। চোখ বন্ধ করে রাখলে মানুষের দৃষ্টি অন্ধকারাছন্ন হয়, কিন্তু বাইরের জগতের আলো এর ফলে নির্বাপিত হয় না। সেভাবে টিআইবি রিপোর্ট দিক আর নাই দিক, টিআইবিকে বন্ধ করা হোক আর নাই হোক, জাতীয় সংসদ সদস্যরা যে দুর্নীতিবাজ এটা জানার জন্য এখন বাংলাদেশে কোনো গবেষণার প্রয়োজন নেই। এই সংসদ সদস্যদের সঙ্গে যদি জনগণের কোনো যোগসম্পর্ক থাকত তাহলে ট্রেন বাস লঞ্চ ও রাস্তাঘাটে লোকজন তাদের নিজস্ব অভিজ্ঞতার মাধ্যমে তাদের দুর্নীতির যেসব কথা অহরহ বলছেন, তার থেকেই তারা তাদের সম্পর্কে দেশের লোকের ধারণা বিষয়ে অবহিত হতে পারতেন। কিন্তু তাদের অবস্থা এদিক দিয়ে একেবারে ভিন্ন। তারা সরকারি ও শ্রেণীগত ক্ষমতায় বলীয়ান হয়ে পরম নিশ্চিন্তে এবং অপরাধের জন্য কোনো শাস্তির ভয়ে ভীত না হয়ে চুরি, ঘুষখোরি, জমি দখল ইত্যাদি দুর্নীতি করে গেলেও জনগণ তাদেরকে সততার পরাকাষ্ঠা মনে করে তাদের জয়গান করছে—এটাই মনে হয় তাদের ধারণা! হয়তো তাদের ধারণা, তারা যত বিচিত্র গর্হিত কাজই করে চলুন, সর্বাবস্থায় জনগণের কর্তব্য হলো ‘দেশপ্রেমিক’ দল হিসেবে তাদেরকে দুর্নীতিমুক্ত মনে করা, কৃতজ্ঞচিত্তে তাদেরকে পরবর্তী নির্বাচনে ভোট দিয়ে আবার ক্ষমতায় বসানো!!
আসলে টিআইবি সংসদ সদস্যদের ওপর তার তদন্ত রিপোর্টে যা বলেছে তাতে দেশের কোনো একজন লোকও বিস্মিত হয়েছে অথবা এ রিপোর্টের বক্তব্য অসত্য মনে করেছে, এটা আওয়ামী লীগের লোক ও তাদের ঘরানার বুদ্ধিজীবী ছাড়া অন্য কেউ মনে করে না। কাজেই টিআইবি তদন্ত করে সংসদ সদস্যদের আচরণ সম্পর্কে কী বলেছে, তার ওপর নির্ভর করে মানুষ বসে নেই। সংসদ সদস্যদের লাগামহীন চুরি, ঘুষখোরি, দুর্নীতি ও সন্ত্রাসের প্রত্যক্ষদর্শী বা ভুক্তভোগী হিসেবে টিআইবি রিপোর্টে যা আছে তার থেকে অনেক বেশি তারা জানেন।
সম্প্রতি নিযুক্ত তথ্যমন্ত্রী এ রিপোর্ট সম্পর্কে বলেছেন যে, এ রিপোর্ট যে তদন্তের ভিত্তিতে তৈরি করা হয়েছে তাতে পদ্ধতিগত ত্রুটি আছে। পদ্ধতিগত কিছু ত্রুটি আছে এটা বলাই যেতে পারে। কারণ এসব ক্ষেত্রে পদ্ধতি বিষয়ে মতপার্থক্য থাকতেই পারে। কিন্তু এখানে কথা হলো, পদ্ধতিগত কিছু ত্রুটি যদি থাকেও, তাহলে সে ত্রুটিমুক্ত হয়ে তদন্ত ও গবেষণা করলে বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ সদস্যদের বিষয়ে আলোচ্য টিআইবি রিপোর্টে যা বলা হয়েছে তার থেকে ভিন্ন কিছু পাওয়া যাবে মনে করার কারণ নেই।
জাতীয় সংসদের স্পিকারসহ সংসদ সদস্যরা টিআইবি রিপোর্টের বিরুদ্ধে যেভাবে ক্রুদ্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন, তার থেকে মনে হয় তারা নিজেদের জনগণের কাছে সত্ হিসেবে, সততার প্রতিমূর্তি হিসেবে দেখতে বড়ই পছন্দ করেন! এর জন্য সহজ উপায় হচ্ছে চুরি, ঘুষখোরি, দুর্নীতি ইত্যাদি না করা। এসব না করলে তদন্ত যে পদ্ধতিতেই হোক, কিছুই পাওয়া যাবে না। কিন্তু নিজেরা এসব গর্হিত কাজ নিয়মিতভাবে এবং লোকের নাকের ডগায় ও চোখের সামনে করে যাবেন এবং জনগণ ও সেই সঙ্গে এ বিষয়ে তদন্ত কাজে নিয়োজিত যে কোনো সংস্থা তাদের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে তাদের জয়গান করবে এটা এক অস্বাভাবিক প্রত্যাশা।
শুধু সংসদ সদস্যরাই নন, মন্ত্রিসভার সদস্য এবং উপদেষ্টারা পর্যন্ত যে চুরি, ঘুষখোরি, সব ধরনের দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত—এটা এখন এক প্রকাশ্য সত্য। রেলওয়ে, সোনালী ব্যাংক, বাংলাদেশ বিমান, পদ্মা ব্রিজ, ডেসটিনি ইত্যাদিতে সম্প্রতি যে সব দুর্নীতি কেলেঙ্কারি হয়েছে সেটা আওয়ামী লীগ সম্পর্কে অনেক আওয়ামী সমর্থকেরও চোখ খুলে দিয়েছে। এ দেশে বর্তমান সরকারের আমলে চুরি-ঘুষখোরি করলে যে শাস্তির কোনো ব্যবস্থা নেই, উপরন্তু পুরস্কৃত হওয়ার ব্যাপার আছে, আওয়ামী মন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের দৃষ্টান্ত এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য। রেলে চাকরি বাণিজ্য করতে গিয়ে পাহাড়প্রমাণ ঘুষের টাকা ধরা পড়ার পর চারদিকে তার বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়ায় শেষ পর্যন্ত সুরঞ্জিতকে রেলের মন্ত্রিত্ব থেকে সরানো হলেও পরদিনই তাকে দফতরবিহীন মন্ত্রী করে দুর্নীতির গৌরব অর্জনের জন্য পুরস্কৃত করা হয়েছে। এর ফলে মন্ত্রী হিসেবে কিছু কাজ করে তাকে আগে বেতন-ভাতা, অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা নিতে হলেও এখন তিনি কোনো কাজ না করেই সেসব সুবিধা পাচ্ছেন! অর্থাত্ জনগণের ট্যাক্সের টাকার খেয়ানত করেই এভাবে একজন দুর্নীতিবাজ দলীয় লোককে প্রতিপালন করা হচ্ছে!! সরকারের প্রধানমন্ত্রীর এ কাজ কি দুর্নীতি নয়? এ কাজ যে দলের প্রধানমন্ত্রী করেন, সে দলের সংসদ সদস্যরা সবাই নিরামিষভোজী পরম ধার্মিক—এটা মনে করাও এক অবাস্তব চিন্তা।
শুধু আওয়ামী লীগ সংসদ সদস্যরাই নয়, বর্তমান মহাজোট সরকারের অন্য ‘বিপ্লবী’ সদস্যরাও একই কাতারে থেকে একইভাবে নিজেদের সত্চরিত্র টিআইবি রিপোর্টে কলঙ্কিত হতে দেখে চিত্কার করেছেন। ১৩ জন বিরোধীদলীয় সদস্যের ওপর দেয়া টিআইবি রিপোর্টে ১২ জনকেই দুর্নীতিবাজ বলা হয়েছে। বিএনপি যদি সংসদ বর্জন না করে সংসদে থাকত, তাহলে তারাও যে একইভাবে ক্রুদ্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে চিত্কার করত, এতে কোনো সন্দেহ নেই।
বাংলাদেশে শাসক শ্রেণী ও শাসক দলভুক্ত লোকদের এই দুর্নীতি যদি শুধু তাদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকত, তাহলে তা এতখানি বিপজ্জনক হতো না, যতখানি বিপজ্জনক আজ হয়েছে। এর মূল কারণ এই শাসক শ্রেণী এবং এদের একের পর এক সরকার প্রথম থেকেই অপরাধীর শাস্তি নিশ্চিত তো করেই নি, উপরন্তু অপরাধ করলে শাস্তি যাতে না হয় সেই শর্তই শাসন ব্যবস্থার মধ্যে তৈরি করেছে। প্রেসিডেন্ট যেভাবে লক্ষ্মীপুরের ক্রিমিনাল তাহেরের বেটাসহ ২১ জনের মৃত্যুদণ্ড মাফ করেছেন, সেটা থেকে নিয়ে সুরঞ্জিত সেনগুপ্তকে তার দুর্নীতির জন্য পুরস্কৃত করা পর্যন্ত অসংখ্য দৃষ্টান্ত এ বিষয়টিকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। এই পরিস্থিতিতে সমাজে অপরাধীরা আরও সক্রিয় হয়েছে, তাদের সংখ্যা ক্রমাগত বৃদ্ধি পেয়ে যাচ্ছে এবং তাদের অপরাধের বৈচিত্র্যও দেখা যাচ্ছে অবাক হওয়ার, সেই সঙ্গে আতঙ্কিত হওয়ার মতো ব্যাপার। প্রধানত রাজনৈতিক ক্ষমতার সঙ্গে সম্পর্কিত লোকজনের দ্বারা ও তাদের পৃষ্ঠপোষকতায় এসব অপরাধ সংঘটিত হয়ে থাকলেও সাধারণভাবে সমাজে এর বিস্তৃতি ঘটে এক ভয়ঙ্কর সামাজিক নৈরাজ্য আজ বাংলাদেশে সৃষ্টি হয়েছে। এই পরিস্থিতির দিকে না তাকিয়ে টিআইবি রিপোর্টের বিরোধিতা এবং টিআইবিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে মূল সমস্যার কোনো সমাধান হবে না। কিন্তু এ বিষয়টি উপলব্ধি করার মতো অবস্থা আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব, তাদের তথাকথিত মহাজোটের শরিকবৃন্দ এবং তাদের সঙ্গে সম্পর্কিত বুদ্ধিজীবীদের নেই।
২১.১১.২০১২
লেখক : সভাপতি, জাতীয় মুক্তি কাউন্সিল

বৃহস্পতিবার, ৫ জুলাই, ২০১২

পাহাড় ধসে মৃত্যুর জন্য দায়ী কারা?



ব দ রু দ্দী ন উ ম র
অন্য বছরের মতো এ বছরও চট্টগ্রামে পাহাড় ধসের ঘটনা ঘটেছে। প্রত্যেক বছরের মতো এ বছরও এই ধস রোধ করা ও পাহাড়ের নিচে বসবাসকারীদের সরিয়ে নেয়া বা তাদের সরে যেতে বলা নিয়ে স্থানীয় কর্মকর্তা, রাজনৈতিক ব্যক্তি প্রভৃতির পক্ষ থেকে নানা কথাবার্তা ও প্রস্তাব দেয়া হচ্ছে। প্রত্যেক বছরের মতো এ বছরও বর্ষাকাল পার হওয়ার পর এ নিয়ে আর কোনো কথাবার্তা হবে না, কোনো প্রস্তাব নিয়ে কেউ উচ্চকণ্ঠ হবে না এবং দেশ যেভাবে চলে আসছে সেভাবেই চলতে থাকবে!
কিন্তু তা সত্ত্বেও প্রত্যেক বছর এভাবে পাহাড় ধসে গরিবদের মৃত্যু তুচ্ছ করার মতো ব্যাপার নয়। প্রথমেই মনে রাখা দরকার যে, যে পাহাড়গুলোতে এখন বর্ষা মৌসুমে ধস নামছে সেগুলো হঠাত্ করে মাটি ফুঁড়ে বের হয়ে আসেনি। এগুলো দীর্ঘদিন থেকে আছে। ব্রিটিশ ও পাকিস্তানি আমলে তো বটেই, এমনকি ঠিক কতকাল আগে এগুলো আকস্মিকভাবে গড়ে উঠেছিল তার কোনো হিসাব নেই। তা সত্ত্বেও এ ধরনের পাহাড় ধসের ঘটনা যেমন এখন একটা বাত্সরিক বড় আকারের ঘটনায় পরিণত হয়েছে, এমনটা আগের দিনে ছিল না। তাছাড়া কখনও কখনও পাহাড় ধসলেও তাতে মানুষের এভাবে মৃত্যু হতো না, কারণ পাহাড়ের ঠিক নিচে আজকের মতো জনবসতি আগে ছিল না।
এটা বলাই বাহুল্য যে, জনবসতির জন্য বর্ষাকালে পাহাড়ে ধস নামছে না। এ ধস নামছে বর্তমানে একশ্রেণীর লুণ্ঠনজীবী মানুষ কর্তৃক পাহাড় কেটে ফেলতে থাকার জন্য। খাড়া হয়ে থাকার মতো নিজস্ব শক্তি পাহাড়ের থাকে। কিন্তু সে পাহাড় যদি পাশ থেকে কেটে ফেলা হতে থাকে তাহলে তার সেই জমাটবদ্ধতাসৃষ্ট শক্তি আগের মতো থাকে না। পাহাড়ি গঠনের মধ্যে ভারসাম্যের অভাব দেখা যায়। ভারসাম্যহীন এ অবস্থায় বর্ষার পানি বর্ষণ হতে থাকলে পাহাড়ে ধস নামে।
পাহাড়ে এভাবে ধস নামলেও তার সঙ্গে মানুষের মৃত্যুর কোনো সম্পর্ক নেই। কিন্তু এই সম্পর্ক এখন দেখা দেয়ার কারণ নিজেদের থাকার জায়গা থেকে উচ্ছেদ হয়ে যাওয়া গরিবরা বিভিন্ন কারণে জায়গার অভাবে পাহাড়ের তলদেশে ঘরবাড়ি তুলে কোনো মতে নিজেদের থাকার ব্যবস্থা করতে বাধ্য হচ্ছেন বলে। ওটা যে শুধু চট্টগ্রাম শহরেই হচ্ছে, তাই নয়। এটা হচ্ছে চট্টগ্রাম শহর থেকে শুরু করে জেলার বিভিন্ন অঞ্চলে। এটা হচ্ছে পার্বত্য চট্টগ্রামের রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবানেও। এটা হচ্ছে কক্সবাজারে।
পাহাড় ধসে মানুষের মৃত্যু, একেকটি পরিবার পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ার ব্যাপার, কোনো প্রাকৃতিক বিপর্যয় নয়। এর পুরোটাই মানুষের সৃষ্টি। মানুষ যদি পাহাড়গুলোকে কেটে মাটি সরিয়ে না নিত এবং বাসযোগ্য জায়গার অভাবে গরিব মানুষ যদি পাহাড়গুলোর নিচের দিকে বসবাস করতে বাধ্য না হতো, তাহলে এভাবে এখন প্রত্যেক বছর পাহাড় ধসে শত শত মানুষের মর্মান্তিক মৃত্যু হতো না।
শাসক শ্রেণীর ও তাদের বিভিন্ন স্তরের লোকজন পাহাড় কেটে ফেলায় যে পাহাড় ধস এবং মানুষের মৃত্যুর কারণ হিসেবে স্বীকার না করে পারে না। কিন্তু তা সত্ত্বেও তাদের কথাবার্তা ও কার্যকলাপ থেকে স্পষ্টই বোঝা যায় যে, এর মূল দায়িত্ব তারা সেই গরিবদের ঘাড়েই চাপাতে চায়, যারা বাধ্য হয়ে কোনো উপায় না দেখে, পাহাড়ের নিচের দিকে ঘরবাড়ি বানিয়ে বসবাস করতে বাধ্য হন। তাদের কথা হলো, পাহাড় ধসের ঘটনা এভাবে নিয়মিত প্রত্যেক বছর ঘটতে থাকলেও কেন তারা পাহাড়ের নিচে থেকে সরে অন্য জায়গায় যাচ্ছে না! এ কথা বলে তারা সমস্যার মূল কারণ বস্তুত স্বীকার করলেও বাস্তবত ও কার্যত স্বীকার না করে এমন কোনো নীতি-নির্ধারণও কার্যকর করে না যার ফলে এ বাত্সরিক ঘটনা না ঘটার ব্যবস্থা হয়।
প্রথমত পাহাড় কাটা তারা বন্ধ করে না। এর বিরুদ্ধে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা তারা গ্রহণ করে না, কারণ এ ব্যবস্থা যারা গ্রহণ করবে বা এ সংক্রান্ত নীতি যারা নির্ধারণ করবে তারা নিজেরা অথবা তাদের আত্মীয়-স্বজন, দলীয় লোক অথবা তাদের ঘুষের মাধ্যমে বশীভূত করা লোকরাই পাহাড় দখল করা ও ইচ্ছেমত কাটার কাজ করে। এদের আটকানোর ক্ষমতা প্রশাসনিক ব্যবস্থার মধ্যে কারও নেই। এরা এই ক্রিমিনাল কাজ এ কারণেই অপ্রতিহতভাবে করে থাকে। এ কথা বোঝার কোনো অসুবিধা হয় না যে, কোনো প্রশাসন যদি ইচ্ছে করে তাহলে এভাবে পাহাড় কাটা সহজেই বন্ধ করা যায়। কিন্তু সেটা না হওয়ার কারণ উপরে উল্লেখ করা হয়েছে। এ পরিস্থিতি রাষ্ট্র এবং সরকারের চরিত্রের কারণে, এ রাষ্ট্র ও সরকার যারা পরিচালনা করে তাদের দ্বারাই সৃষ্টি হয়েছে। এটাই আসল কারণ যে জন্য পাহাড় কাটার বিরুদ্ধে কার্যকর নিষেধাজ্ঞা ও সেই নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হচ্ছে কিনা সে ব্যাপারে কোনো তদারকি পদক্ষেপ নিতে অপারগ হয়ে প্রশাসন থেকে বলা হয়, পাহাড়ের নিচে থেকে লোকদের তাদের বাসস্থান উঠিয়ে নিতে! অন্য জায়গায় সরে যেতে!!
কিন্তু কোথায় তারা যাবে? নিজেরা অন্য কোনো জায়গার ব্যবস্থা করতে না পেরেই তো তারা পাহাড়ের নিচে বাসা বাঁধতে বাধ্য হচ্ছে। কাজেই তাদের সরে যেতে বললেই তাদের পক্ষে সরে যাওয়া সম্ভব নয়। সব রকম বিপদের ঝুঁকি, এমনকি মৃত্যুর ঝুঁকি পর্যন্ত নিয়ে তাদের পাহাড়ের নিচে বিপজ্জনক বসতি করতে হয়।
দু’দিন আগে হাইকোর্ট নির্দেশ জারি করেছেন ঢাকার ফুটপাত থেকে সব ধরনের দোকানপাট উচ্ছেদ করতে। পাহাড়ের নিচে থেকে মানুষকে সরিয়ে নেয়ার অপেক্ষায় ফুটপাথ থেকে হকার তাড়ানো অনেক সোজা। কিন্তু সেটাও হাইকোর্টের নির্দেশ সত্ত্বেও সহজ, এমনকি সম্ভব নয়। কারণ কাজের অভাবে এবং পরিবারের ভরণপোষণের জন্য বাধ্য হয়েই হকারদের রাস্তায় বসতে হয়। এতে ফুটপাথ দিয়ে হাঁটা মধ্যবিত্ত লোকদের অসুবিধা হয়। কিন্তু এ অসুবিধার জন্য প্রকৃতপক্ষে ফুটপাথের হকাররা দায়ী নন। এর জন্য দায়ী সরকার, যারা দেশের জনগণের কর্মসংস্থান করতে পারে না, এমন অবস্থা সৃষ্টি করে যাতে গ্রামাঞ্চল থেকে ক্রমাগত মানুষ শহরের দিকে, বিশেষত ঢাকা শহরের দিকে জীবিকার সন্ধানে আসতে বাধ্য হন। দেখা যায় যে, মাঝে মাঝে সরকার ফুটপাথ থেকে হকার উচ্ছেদ করলেও কিছুদিন পরই আবার হকাররা ফুটপাথে বসেন। এটা ছাড়া তাদের উপায় নেই। এটা তাদের জন্য জীবনমরণ সমস্যা।
পাহাড়ের নিচে বসতির মানে ফুটপাতে দোকান করার একটা মিল থাকার কারণেই তুলনা হিসেবে হকারদের অবস্থার কথা এখানে প্রসঙ্গত উল্লেখ করা হলো। কিন্তু হকারদের অবস্থার থেকে পাহাড়ের তলায় বসবাসকারী গরিবদের অবস্থা আরও শোচনীয়। চট্টগ্রামে স্থানীয় কর্তৃপক্ষ তাদের পাহাড়ের নিচে থেকে উচ্ছেদ করার হুমকি দিচ্ছে। কিন্তু সেখানে বসবাসকারীরা নিজেদের জায়গা বিপদ ঘাড়ে নিয়েও ছাড়তে পারছেন না বিকল্প থাকার ব্যবস্থা না থাকায়। তাদের দাবি হলো, তাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করলেই তারা পাহাড়ের নিচে বসবাস বন্ধ করতে পারেন। এর থেকে ন্যায্য দাবি আর কি হতে পারে? মানুষের থাকার বা বাসস্থানের কোনো ব্যবস্থা যদি না থাকে তাহলে তার জীবন কিভাবে বিপর্যস্ত হয় সেটা বড় বড় ভবনে বসবাসকারী, এমনকি ছোট হলেও নিজেদের বাড়িতে বসবাসকারী লোকদের পক্ষে বোঝা মুশকিল।
জনগণের বাসস্থান এবং বাস্তুচ্যুত মানুষের আবাসন ব্যবস্থা রাষ্ট্র, কেন্দ্রীয় সরকার ও স্থানীয় সরকারের জরুরি কর্তব্য। এ পর্যন্ত চট্টগ্রামের পাহাড়ের তলদেশে বসবাসকারীদের ক্ষেত্রে যতক্ষণ পর্যন্ত না সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ পালন করছে ততদিন পাহাড় ধসে মৃত্যুজনিত যে ঘটনা নিয়মিত ঘটছে তার দায়িত্ব সেখানে বসবাসকারীদের নয়। এর পূর্ণ দায়িত্ব রাষ্ট্র, সরকার এবং সর্বপ্রকার প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষের।
৪.৭.২০১২

শনিবার, ৩০ জুন, ২০১২

সিরিয়ায় বহিঃশক্তির হস্তক্ষেপ বিষয়ে কফি আনানের স্বীকৃতি




ব দ র“ দ্দী ন উ ম র
যে কথা কফি আনানের অনেক আগেই বলা দরকার বা উচিত ছিল সে কথা তিনি অবশেষে বললেন। কথাটি হল, বাইরের শক্তিগুলোই সিরিয়ায় সহিংসতা ছড়িয়ে দি”েছ (উধরষু ঝঃধৎ ৩০.৬.২০১২)। এটা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, তার পক্ষে এ কথা বলার অসুবিধা ছিল এবং এখনও আছে। আমেরিকা কর্তৃক ইরাক আক্রমণের সময় জাতিসংঘের মহাসচিব হিসেবে তিনি যেসব তথ্য জানতেন, সেগুলো কি আজ পর্যন্ত তার পক্ষে প্রকাশ করা সম্ভব হয়েছে? সাম্রাজ্যবাদের হাতিয়ার জাতিসংঘের সর্বো”চ কর্মকর্তা হিসেবে তাকে যেসব কাজ করতে হতো, তাতে তার বিবেক কি কালিমামুক্ত আছে? এসব কথা এক হিসেবে অবান্তর, কারণ জাতিসংঘের মহাসচিবের পদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তার সহযোগী সাম্রাজ্যবাদীরা এমন লোককে দেয় না বা দিতে পারে না, যিনি সাম্রাজ্যবাদের পরিবর্তে বিশ্বের অনুন্নত ও পশ্চাৎপদ দেশ এবং নিপীড়িত জনগণের স্বার্থের পক্ষে দাঁড়াবেন।
লিবিয়ায় মোয়াম্মার গাদ্দাফির শাসন উৎখাত করে সে দেশটিকে পদানত করার পর এখন সাম্রাজ্যবাদীরা সিরিয়াকে ধ্বংস করার চক্রান্ত বেশ খোলাখুলিভাবেই ঘোষণা ও কার্যকর করছে। এর জন্য তারা মধ্যপ্রাচ্যে তাদের গোলাম রাষ্ট্রগুলোকে বেশ ভালোভাবেই ব্যবহার করছে। এই গোলাম রাষ্ট্রগুলোর সংগঠন আরব লীগ লিবিয়ায় সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের সময় তাদের স্বার্থেই ছিল সক্রিয় সহযোগী হিসেবে। কিš‘ সিরিয়ায় লিবিয়ার মতো জাতিসংঘের বেপরোয়া হস্তক্ষেপের পরি¯ি’তি না থাকায় আরব লীগ এখন জাতিসংঘের লেজুড় হিসেবে সরাসরি কাজ করছে। এই কার্য সুসম্পন্ন করার উদ্দেশ্যেই জাতিসংঘ এবং আরব লীগ যৌথভাবে সাবেক জাতিসংঘ মহাসচিব কফি আনানকে তাদের প্রতিনিধি হিসেবে সিরিয়ার পরি¯ি’তি সামাল দেয়ার কাজে নিযুক্ত করেছে।
লিবিয়ায় হড় ভষু ুড়হব প্রস্তাবে রাশিয়া ও চীন ভেটো না দেয়ায় সাম্রাজ্যবাদীরা যেভাবে অবাধে সে দেশের ওপর বোমাবর্ষণ করে শুধু বিমানবাহিনী নয়, ¯’লবাহিনীকেও শেষ পর্যন্ত ধ্বংস করেছিলÑ সেরকম সুযোগ এখনও পর্যন্ত সিরিয়ার ক্ষেত্রে সৃষ্টি হয়নি। কারণ লিবিয়ার ক্ষেত্রে নিজেদের ভেটো ব্যবহার না করে রাশিয়া ও চীন যে বোকামি করেছিল, তার খেসারত তারা দিয়েছে। লিবিয়ায় ন্যাটো শক্তিগুলো তাদের তেলসহ সেখানকার কোন কিছুতে ভাগ না দিয়ে তাড়িয়ে দেয়ার পর এখন তাদের হুঁশ হয়েছে। কাজেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ ন্যাটোভুক্ত দেশগুলো সিরিয়ায়ও লিবিয়ার মতো হড় ভষু ুড়হব কার্যকর করার চেষ্টা করলেও রাশিয়া ও চীন এখন তার বিরোধী। তা ছাড়া লিবিয়া থেকে সিরিয়া স্ট্র্যাটেজির দিক দিয়ে রাশিয়ার কাছে অনেক বেশি গুর“ত্বপূর্ণ। সেদিক দিয়েও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সিরিয়ার ব্যাপারে হাত মেলানোতে রাশিয়া ও সেই সঙ্গে চীনের অসুবিধা আছে। সাম্রাজ্যবাদী শিবিরের এই দ্বন্দ্ব সিরিয়ার ক্ষেত্রে সহায়ক হয়েছে। এ কারণেই এখনও পর্যন্ত সিরিয়া একটি স্বাধীন দেশ হিসেবে টিকে আছে, যদিও শেষ পর্যন্ত অব¯’া কী দাঁড়াবে, সেটা এই মুহূর্তে বলা সম্ভব নয়।
লিবিয়ার মতো সিরিয়ায়ও সাম্রাজ্যবাদীরা প্রতিষ্ঠিত সরকারের বির“দ্ধেই বিদ্রোহের সূত্রপাত করেছে। এদিক দিয়ে ‘আরব বসন্ত’-খ্যাত তিউনিসিয়া ও মিসরের অব¯’া অন্যরকম। এই দুই দেশে বিদ্রোহ ও প্রতিরোধের ক্ষেত্রে জনগণের যে স্বতঃস্ফূর্ততা ছিল, সিরিয়ার ক্ষেত্রে তা একেবারেই নেই। প্রেসিডেন্ট আসাদ প্রথম থেকেই বলে আসছেন যে, বাইরের শক্তি সিরিয়ার বিদ্রোহীদের গ্র“প খাড়া করে তাদের অর্থ ও অস্ত্র সরবরাহ করছে। প্রথমে ছোট আকারে এটা করলেও এখন খুব বড় ও বিশাল আকারে তারা এটা করছে। এর অন্য একটি দিক হ”েছ, এ কাজ যে তারা করছে এটা গোপন করা এখন তাদের পক্ষে সম্ভব হ”েছ না। শুধু তাই নয়, তারা এবং মধ্যপ্রাচ্যে তাদের গোলাম রাষ্ট্রগুলোও এ নিয়ে কোন গোপনীয়তার প্রয়োজন বোধ করছে না। কয়েক দিন আগে সৌদি আরব সরকারিভাবে ঘোষণা করেছে যে, আসাদের বির“দ্ধে যে বিদ্রোহী বাহিনী গঠিত হয়েছে তার সদস্যদের বেতন তারা দেবে! অর্থাৎ এই ‘বিদ্রোহী’ বাহিনীকে তারা আগে অর্থ ও অস্ত্র দিয়ে সাহায্য করলেও এখন সেই বাহিনীর সদস্যদের চাকরি রক্ষার দায়িত্বও সৌদি আরব নিয়েছে! তাদের অর্থের কোন অভাব নেই। হাজার হাজার কোটি ডলার ব্যয় করে যারা নিয়মিত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে বিনা প্র্রয়োজনে সামরিক বিমান, ট্যাংক, যুদ্ধজাহাজসহ সবরকম যুদ্ধ-সরঞ্জাম কেনে, তাদের পক্ষে সিরিয়ার বিদ্রোহী বাহিনী প্রতিপালন এমন কোন বড় ব্যয়সাপেক্ষ ব্যাপার নয়। এ কাজ যে তারা শুধু নিজেদের প্রতিক্রিয়াশীল রাষ্ট্রীয় অব¯’ান থেকেই করছে তা নয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হুকুম অনুযায়ীই এটা হ”েছ। 
সিরিয়ায় এখন প্রতিদিনই দুই পক্ষের আক্রমণে মানুষের জীবন যা”েছ। এর মধ্যে যেমন সেনাবাহিনীর লোক আছে, তেমনি আছে নিরীহ লোক, নারী, শিশু, বৃদ্ধÑ সব ধরনের লোক। কাতারভিত্তিক আলজাজিরা টেলিভিশন চ্যানেল থেকে নিয়ে সিএনএন, বিবিসিসহ দেশে দেশে সাম্রাজ্যবাদীদের সহযোগী এবং আশ্রিত ও অনুগত দেশটির টিভি চ্যানেলগুলোতে ও সেই সঙ্গে সংবাদপত্রে এ খবর এমনভাবে প্রচারিত হ”েছ, যাতে মনে হবে শুধু সরকার পক্ষের আক্রমণেই এভাবে এ পর্যন্ত পনের হাজার লোক সিরিয়ায় নিহত হয়েছে। কিš‘ বাস্তব ঘটনা এই যে, তথাকথিত বিদ্রোহী বাহিনীর আক্রমণেই এসব হত্যাকাণ্ড বেশি হ”েছ। এর একটা বড় প্রমাণ এই যে, এ হত্যাকাণ্ডের শিকার হ”েছ সিরীয় সামরিক বাহিনীর সদস্যরাই। যদি সরকারবিরোধীদের শক্তিশালী আক্রমণ না হতো তাহলে এভাবে সামরিক বাহিনীর লোকেরা নিহত হতো না। এ কারণে সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার প্রথম থেকেই বলে আসছেন, যেহেতু সরকারি বাহিনীর ওপর বিদেশী সহায়তাপ্রাপ্ত তথাকথিত বিদ্রোহী বাহিনীর সন্ত্রাসীরা আক্রমণ চালা”েছ, কাজেই তাদের প্রতিহত করা ছাড়া কোন উপায় নেই। কফি আনান সিরিয়ার ‘শান্তির দূত’ হিসেবে জাতিসংঘ এবং আরব লীগের দ্বারা নিযুক্ত হওয়ার পর তার সঙ্গে সাক্ষাতের সময় প্রেসিডেন্ট আসাদ তাকে বারবার এ কথা বলেছেন। কিš‘ তিনি এ কথায় বিশেষ কান না দিয়ে প্রায় একতরফাভাবেই আসাদকে এর জন্য দায়ী করে এসেছেন। কিš‘ এখন সিরিয়ায় বিদেশী সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলোর হস্তক্ষেপ এত খোলাখুলিভাবে শুর“ হয়েছে যে, কফি আনান এটা স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছেন, সিরিয়ায় বিদেশী শক্তিগুলো সেখানে সহিংসতা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে কাজ করছে!
সিরিয়ার সীমানা লংঘন করে তুর্কি বিমান ঢুকে পড়লে তাতে দোষ নেই। দোষ হ”েছ সেই অনুপ্রবেশকারী বিমান গুলি করে ভূপাতিত করায়! আরব দেশগুলোর বাইরে তুর্কি ন্যাটোর ল্যাংড়া সদস্য হিসেবে এখন সিরিয়াবিরোধিতায় খুব সক্রিয়। তারা বলছে, প্রতিবেশী দেশ সিরিয়া আক্রমণের কোন ই”ছা তাদের নেই। কিš‘ তা সত্ত্বেও সিরিয়া সীমান্তে তারা বড় আকারে সৈন্য সমাবেশ করছে। তুর্কির কথায় বিশ্বাসের কারণ যে নেই, এটা বলার দরকার হয় না। কাজেই তুর্কি তাদের সীমান্তে সৈন্য সমাবেশ শুর“ করার পাল্টা হিসেবে সিরিয়াও এখন তাদের তুর্কি সীমান্তে সৈন্য সমাবেশ করছে। এভাবেই এ অঞ্চল এখন উত্তপ্ত হ”েছ এবং এক যুদ্ধাব¯’া সেখানে তৈরি হ”েছ।
সাম্রাজ্যবাদীদের প্রতিনিধি হিসেবে কফি আনান সিরিয়ায় একটি ‘জাতীয় ঐক্যের সরকার’ প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব করেছেন। তবে ‘ওয়াশিংটন পোস্ট’ পত্রিকায় এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, অনেক বাইরের শক্তি সিরিয়ার ব্যাপারে গভীরভাবে জড়িত আছে। তার ছয় দফা ঐক্য প্রস্তাবে তাদের আনুষ্ঠানিক সম্মতি থাকলেও তাদের মধ্যে এক্ষেত্রে বিভেদ খুব স্পষ্ট। অন্যদিকে প্রেসিডেন্ট আসাদ ২৮ জুন ইরানি টেলিভিশনকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, যারা তার সরকারের বির“দ্ধে সন্ত্রাসী আক্রমণ চালা”েছ তাদের নির্মূল করতে তারা বদ্ধপরিকর। এ প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেন, সিরিয়ার সমস্যা সিরিয়াই মোকাবেলা করবে। কোন বাইরের শক্তিকেই এখানে নাক গলাতে দেয়া হবে না। কিš‘ প্রেসিডেন্ট আসাদ যা-ই বলুন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদীরা নিজেরা তো বটেই, এমনকি মধ্যপ্রাচ্যে তাদের অনুগত রাষ্ট্রগুলোকেও তারা এখন সিরিয়ার বির“দ্ধে ব্যবহার করছে। সিরিয়ার পরিণতি শেষ পর্যন্ত কি দাঁড়াবে বলা যায় না। তবে সিরিয়া যদি সাম্রাজ্যবাদের দ্বারা ধ্বংস হয়, তাহলে তারপর তাদের দৃষ্টি পড়বে লেবাননের ওপর। সেখানে তারা হিজবুল্লাহকে ধ্বংস করে সমগ্র মধ্যপ্রাচ্যে নিজেদের অখণ্ড আধিপত্য নতুনভাবে প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে আর এক পা এগিয়ে যাবে। সিরিয়ায় যেমন, লেবাননেও তেমনি সৌদি আরব মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে গুর“ত্বপূর্ণ মধ্যপ্রাচ্য এজেন্ট হিসেবে কাজ করবে। যে পর্যন্ত না সৌদি আরবে ‘আরব বসন্তের’ তুফান উঠবে, সে পর্যন্ত এই দেশটি ইসরাইলের মতোই মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের এক শক্তিশালী ঘাঁটি এবং সমগ্র মধ্যপ্রাচ্যের জনগণের জন্য এক বিপজ্জনক রাষ্ট্র হিসেবে তাদের এই ভূমিকা পালন করে যাবে।
৩০.৬.২০১২

শনিবার, ২৩ জুন, ২০১২

জনগণের চিকিৎসার কী হবে?




ব দ র“ দ্দী ন উ ম র
যারা সরকারি গদিতে বসে আছে তাদের কাছে জনগণ ভোটার ছাড়া অন্য কিছু নয়। এ কারণে যারা ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য নির্বাচন করে, তারা ভোটের সময় জনগণের কাছে হাজির হয় ভোটের ভিক্ষার পাত্র হাতে। ভোটের বিনিময়ে তাদের সবকিছু দেয়ার প্রতিশ্র“তি দেয়। তাদের এক স্বর্ণোজ্জ্বল ভবিষ্যতের কথা বলে। এ সবটাই হল জনগণকে প্রতারিত করার ফাঁদ। এই ফাঁদে পড়ে জনগণ তাদের ভোট দিয়ে ক্ষমতায় বসান। কিš‘ ক্ষমতায় বসার পরই গদিনশিনরা ভোটের ভিক্ষা পাত্র ফেলে দিয়ে ভোটার অর্থাৎ জনগণের হাতে ভিক্ষার পাত্র তুলে দেয়। এ কারণে নির্বাচনের পর জনগণ সরকারকে তাদের নির্বাচনী প্রতিশ্র“তি পালনের জন্য আবেদন জানাতে থাকেন, কিš‘ তাদের ভিক্ষার পাত্রে প্রায় কিছুই পড়ে না। উপরš‘ তাদের অব¯’া আরও কর“ণ হয়। বাংলাদেশে যে ‘গণতান্ত্রিক’ ব্যব¯’া চালু আছে, সেই গণতন্ত্রের এটাই হল মর্মব¯‘।
ক্ষমতায় গিয়ে এরা এতই বেপরোয়াভাবে লুটপাটে মত্ত থাকে যে, নিজেদের তৈরি সংবিধান পর্যন্ত কথায় কথায় পা দিয়ে মাড়িয়ে চলতে দ্বিধাবোধ করে না। এরা এমনভাবে নিজেরাই সংবিধান লঙ্ঘন করে, যাতে অব¯’া দেখে মনে হয় দেশটা কোন সংবিধান ছাড়াই গড্ডলিকা প্রবাহে গড়িয়ে চলেছে। সংবিধানের ব্যাপারে এদের একটু চাঙ্গাভাব তখনই দেখা যায় যখন এমন কোন মামলা হয়। তখন সংবিধানকে টানাটানির প্রয়োজন হয়। সে সময় সংবিধান নিয়ে অনেক বড় বড় কথা এদের মুখে শোনা যায়। সংবিধান লঙ্ঘন করার অভিযোগে অন্যদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে এরা উৎসাহিত থাকে। এ ব্যব¯’ায় আদালত এদের কথামতোই কাজ করেন। এই হল বাংলাদেশে বিদ্যমান ‘গণতান্ত্রিক’ ব্যব¯’ার হালচাল।
এই পরি¯ি’তিতে ২০১২-১৩ সালের বাজেট জাতীয় সংসদে পেশ করা হয়েছে। গত সপ্তাহে ১৭ জুন ‘জনগণের দুশমনদের বাজেট’ এই শিরোনামে আমি লিখেছিলাম। সেখানে জনগণের স্বা¯’্য ব্যব¯’া বিষয়ে আমি সামান্য লিখেছিলাম। এখানে সে বিষয়টির ওপরই আরেকটু বিশদভাবে কিছু বলা দরকার। অর্থমন্ত্রী তার বাজেটে ‘স্বা¯’্য ও পরিবার কল্যাণ’ খাতে ৯ হাজার ৩৫৫ কোটি টাকা ধার্য করেছেন। এবার শিক্ষা খাতে ব্যয় গত বছরের তুলনায় কমিয়ে আনা হলেও স্বা¯’্য খাতের অব¯’া আরও খারাপ। যে বরাদ্দ এই খাতে বর্তমান বাজেটে ধরা হয়েছে, এর মধ্যে অনেক কারসাজি আছে। কারণ এটা শুধু স্বা¯’্য খাত নয়, এর সঙ্গে যুক্ত আছে পরিবার-পরিকল্পনা। পরিবার-পরিকল্পনার সঙ্গে স্বা¯ে’্যর একটা সম্পর্ক থাকলেও এ দুইকে এক করার কোন প্রয়োজন হয় না। ‘পরিবার-পরিকল্পনা’ খাতে বরাদ্দ পৃথকভাবে দেখানোই দরকার। কিš‘ সেটা না করে স্বা¯’্য খাতে ব্যয় যা প্রকৃতপক্ষে বরাদ্দ করা হয়েছে তার পরিমাণ বাড়িয়ে দেখানোর উদ্দেশ্যেই এখানে স্বা¯’্য খাতের সঙ্গে পরিবার পরিকল্পনাজুড়ে দেয়া হয়েছে। এভাবে কাজটি করায় এর থেকে বোঝার উপায় নেই যে, স্বা¯’্য খাত ও পরিবার-পরিকল্পনা খাতে পর্যায়ক্রমে ঠিক কত বরাদ্দ করা হয়েছে। তবে এ দুই খাতকে একত্রে উপ¯ি’ত করে যে বরাদ্দ করা হয়েছে, সেটা বাংলাদেশের জিডিপি বা জাতীয় উৎপাদনের শতকরা এক ভাগেরও কম! অথচ এটা সারা বিশ্বে এবং বিশ্ব স্বা¯’্য সং¯’া (ডব্লিউএইচও) কর্তৃকও স্বীকৃত যে স্বা¯’্য খাতে ব্যয় হওয়া দরকার জিডিপির অন্তত ৫ ভাগ!
লক্ষ্য করার বিষয় যে, অর্থমন্ত্রী দেশের জনসংখ্যা ১৫ কোটি বলে জনসংখ্যা বৃদ্ধির কথা বলেছেন। অথচ এই বর্ধিত জনসংখ্যার জন্য স্বা¯’্য খাতে এ বছর ব্যয় বরাদ্দ গত বছরের থেকে কমানো হয়েছে। এর থেকে অদ্ভুত ব্যাপার আর কী হতে পারে? কিš‘ তার থেকেও অদ্ভুত ব্যাপার এই যে, বাজেট পেশ করার পর থেকে এ নিয়ে সংবাদ মাধ্যমে আজ পর্যন্ত কোন রিপোর্টিং, আলোচনা, বিতর্ক কিছুই হয়নি। এ নিয়ে নীরবতা আপাতদৃষ্টিতে এক বিস্ময়কর ব্যাপার।
পরিবার-পরিকল্পনা খাতে বরাদ্দ পৃথকভাবে না দেখিয়ে তাকে স্বা¯’্য খাতের সঙ্গে জুড়ে দেয়া হয়েছে পরিকল্পিতভাবে স্বা¯’্য খাতের বরাদ্দ বেশি করে দেখানোর জন্য। এখানে অন্য একটি বিষয়ও আছে, যার উল্লেখ কোথাও দেখা যায় না। সেটা হ”েছ এই যে, সামরিক বাহিনীর কম্বাইন্ড মেডিকেল হাসপাতালটির (সিএমএইচ) ব্যয়ও এই স্বা¯’্য ও পরিবার পরিকল্পনার মধ্যেই আছে! সেটা সামরিক খাতে বরাদ্দের মধ্যে নেই!! শিক্ষা খাতেও একই ব্যাপার। ক্যাডেট কলেজগুলোর ব্যয়ও সামরিক বাজেটের বাইরে রেখে সেটা শিক্ষা খাতে ব্যয়ের মধ্যে ঢুকিয়ে দেয়া হয়ে থাকে। এর ফলে স্বা¯’্য ও শিক্ষা খাতে যা প্রকৃত ব্যয় তার থেকে অনেক বেশি দেখানো হয় এবং অন্যদিকে সামরিক খাতে যে ব্যয় হয় তার আকার দেখানো হয় ছোট করে।
সবাই জানেন যে, সব সরকারি হাসপাতালের মধ্যে সিএমএইচে চিকিৎসা হয় সবচেয়ে ভালো। কারণ সেখানে যা প্রয়োজন তাই দেয়া হয়, যা কিছু সরবরাহের প্রয়োজন হয় তার সবটা তো হয়ই। এমনকি সেটা হয় সর্বো”চ দ্র“তগতিতে। এর অর্থ স্বা¯’্য খাতে যে ব্যয় হয় তাতে সামরিক বাহিনীর লোক এবং তাদের আÍীয়স্বজনের চিকিৎসার জন্য সরকার যে খরচ করে তার তিলার্ধও সাধারণ মানুষের জন্য তারা খরচ করে না! এর থেকে ভয়াবহ বৈষম্যমূলক ব্যব¯’া আর কী হতে পারে?
অর্থমন্ত্রীর বাজেটে নতুন অনেক স্বা¯’্যকেন্দ্র, ২৫০ বেডের থেকে নিয়ে কিছু ছোট হাসপাতাল তৈরির পরিকল্পনার কথা বলা হয়েছে। এ পরিকল্পনার কী হবে সে প্রশ্ন বাদ দিয়েও বলা চলে যে, শুধু ইট, কাঠ, সিমেন্ট দিয়ে বিল্ডিং বানিয়ে দিলেই সেটা হাসপাতাল হয়ে যায় না। বিভিন্ন জেলায় এখনও ২৫০ বেডের হাসপাতাল এবং তার থেকে ছোট হাসপাতাল আছে। সেগুলোতে রোগীরা কী চিকিৎসা পা”েছন সেটাই দেখার কথা। প্রকৃত চিকিৎসা বলে যদি কিছু না থাকে, চিকিৎসার মান যদি খুব নিু হয়, তাহলে ২৫০ কেন, ১০০০ বেডের হাসপাতাল তৈরি হলেও জনগণের কোন লাভ নেই। অর্থমন্ত্রীর বাজেটে গ্রামাঞ্চলে স্বা¯’্যকেন্দ্রের কথা বলা হয়েছে। কিš‘ এই স্বা¯’্যকেন্দ্রগুলোর অব¯’া কী? সেখানে তো ডাক্তাররা নিয়মিত বসেন না। বসলেও একমাত্র তাদের প্রেসক্রিপশন বা ব্যব¯’াপত্র ছাড়া অন্য কিছুই পাওয়া যায় না। এই স্বা¯’্যকেন্দ্রগুলোতে দু’চারটে ট্যাবলেট বা ওই জাতীয় কিছু ওষুধ কখনও কখনও বিনামূল্যে পাওয়া গেলেও সব ওষুধই রোগীদের কিনতে হয়। পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য তাদের জেলা হাসপাতালে যেতে হয়। সে হাসপাতাল সরকারি হলেও সেখানেও রোগীদের সবকিছুর জন্যই পয়সা দিতে হয়। রোগীদের জন্য পরীক্ষা-নিরীক্ষা খাতে খরচ ছাড়ের কোন ব্যব¯’া নেই। বাংলাদেশে বর্তমানে যে সরকারি হাসপাতালগুলো আছে, সেগুলোতে বিনা খরচে চিকিৎসা ব্যব¯’া আগে যেটুকু ছিল এখন সেটাও একেবারে উঠিয়ে দেয়া হ”েছ।
অর্থমন্ত্রী তার বাজেটে তারা কত হাসপাতাল স্বা¯’্যকেন্দ্র ইত্যাদি তৈরির পরিকল্পনা নিয়েছেন তার ফিরিস্তি দিলেও এসব হাসপাতালে চলমান ব্যয়ের জন্য কী পরিমাণ বরাদ্দ তারা করেছেন তার কোন উল্লেখ নেই। কারণ এই বরাদ্দ প্রকৃতপক্ষে অনুল্লেখযোগ্য। চলমান খরচ চালিয়ে যাওয়ার জন্য সিএমএইচের মতো বরাদ্দ ব্যব¯’া না থাকায় এগুলোতে চিকিৎসা হয় নামমাত্র। এটা চিকিৎসার নামে প্রহসন ও প্রতারণা ছাড়া আর কী?
চিকিৎসা এমন এক ব্যাপার, যা দেশের ১৫ কোটি লোককেই স্পর্শ করে। এর প্রয়োজন সবারই হয়। সরকারি ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত লোকরা সরকারের খরচে নিজেদের চিকিৎসার জন্য অথবা চিকিৎসার নামে বিদেশ ভ্রমণের জন্য ই”েছমতো ব্যয় করে থাকে। কিছুদিন আগে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বাথর“মে পড়ে গিয়ে কোমরে ব্যথা পান। মন্ত্রী হওয়ার আগে এভাবে বাথর“মে পড়ে কোমরে ব্যথা পেলে তিনি হয়তো কবরেজি চিকিৎসা করাতেন কিংবা সাধারণ হাসপাতালে চিকিৎসা নিতেন। কিš‘ মন্ত্রী হয়ে তিনি চলে গেলেন এই সামান্য চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুর! এভাবে সিঙ্গাপুর গিয়ে তিনি যে জনগণের পকেট কাটলেন, তাদের চিকিৎসার কোন উপযুক্ত বা সামান্য ব্যব¯’াও এখানে নেই। প্রেসিডেন্ট থেকে শুর“ করে মন্ত্রী, এমপি এবং সরকারি কর্মচারীরা রোগের চিকিৎসা তো দূরের কথা, ‘হেলথ চেকআপ’ বা শরীরে সাধারণ পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্যও সিঙ্গাপুর, ব্যাংকক, মালয়েশিয়া, ইংল্যান্ড, আমেরিকা যান। যারা নানারকম দুর্নীতি করে বা অন্য উপায়ে টাকা-পয়সার মালিক হয়েছেন তারাও কথায় কথায় চিকিৎসার জন্য বিদেশ যান। দেশে যে কয়েকটি খুব ব্যয়সাপেক্ষ হাসপাতাল আছে যেগুলোতে এখানকার ধনী ও সম্পন্ন মধ্যবিত্তরা যান, সেগুলোতে নাকি তাদের চিকিৎসার ব্যব¯’া নেই!
যে সমাজের ও দেশের এই অব¯’া, সেখানে সাধারণ মানুষের, শ্রমজীবী গরিবদের ও মধ্যবিত্তের চিকিৎসার কোন ভালো ব্যব¯’া যে দেশের সরকার করবে না, এতে বিস্মিত হওয়ার প্রশ্ন নেই। এটা প্রকটভাবে শ্রেণীবৈষম্যের ব্যাপার। সমাজে এই শ্রেণীবৈষম্য এবং লুটপাটকারী ধনিক শ্রেণী ক্ষমতায় থাকাই চিকিৎসা ক্ষেত্রে এই বৈষম্যের কারণ। ঠিক এ কারণেই বাংলাদেশে এখন জনগণের চিকিৎসার জন্য সংগ্রাম সাধারণভাবে রাজনৈতিক শ্রেণী সংগ্রামেরই অংশ। সাধারণ শ্রেণী সংগ্রাম থেকে এই সংগ্রামকে স্বতন্ত্র বা বি”িছন্নভাবে দেখার কোন সুযোগ নেই। এই সংগ্রাম যে জনগণের জন্য প্রয়োজন, এ চিন্তা তাদের মধ্যে শুর“ হয়েছে। কারণ খাদ্য, বাস¯’ান ইত্যাদির সংকট থাকলেও চিকিৎসা সংকট এমন এক ব্যাপার যা মানুষকে বিশেষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে। এই ক্ষতি জনগণের জীবনকে আজ বিপর্যস্ত করছে।
চিকিৎসা ব্যব¯’ায় এই বঞ্চনা ও বৈষম্যের বির“দ্ধে আন্দোলন সংগঠিত করার শর্ত এখন বাংলাদেশে তৈরি হয়েছে। কারণ এই পরি¯ি’তিতে জনগণের সহ্যসীমা অতিক্রম করছে। গত ২২ জুন ঢাকায় ‘জনস্বা¯’্য সংগ্রাম পরিষদ’ নামে একটি সংগঠনের এক প্রতিনিধি সম্মেলন হয়। এই প্রতিনিধি সম্মেলনে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে প্রতিনিধিরা যোগদান করেন। বাংলাদেশের ডাক্তাররা, বিশেষত যারা বড় ও বিশেষজ্ঞ ডাক্তার, তাদের বিপুল অধিকাংশই আজ চিকিৎসার নামে ফিসহ অন্যান্য উপায়ে জনগণের পকেট মেরে থাকেন। কিš‘ ডাক্তারদের মধ্যে সবার অব¯’া এরকম নয়। অনেকের মধ্যেই পেশাগত নৈতিকতা বোধ আছে। জনগণের সেবা করার আকাক্সক্ষা আছে। তাদের মতো কয়েকজন চিকিৎসকও এই সম্মেলনে উপ¯ি’ত ছিলেন। ঢাকা মেডিকেল কলেজসহ দেশের ৮টি সরকারি মেডিকেল কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত করা এবং শেষ পর্যন্ত সেগুলো বেসরকারিকরণের বির“দ্ধে সম্মেলনে উপ¯ি’ত প্রতিনিধিরা আন্দোলনের সংকল্প ঘোষণা করেন। জনস্বা¯’্য সংগ্রাম পরিষদ একটি খসড়া ঘোষণা এবং দাবিনামা অনুমোদন করে। এর ভিত্তিতে এই প্রতিনিধি সম্মেলনে উপ¯ি’ত প্রতিনিধিরা দেশজুড়ে, শহর ও গ্রামাঞ্চলে, স্বা¯’্য আন্দোলন গড়ে তোলা এবং তাকে প্রবল করার অঙ্গীকার ঘোষণা করেন। আসলে জনগণের এই ধরনের আন্দোলন ছাড়া নিজেদের চিকিৎসার সামান্যতম ব্যব¯’া করারও অন্য উপায় নেই। সরকারই জনগণকে আজ এই আন্দোলনের পথে ঠেলে দিয়েছে। যেহেতু স্বা¯’্য ও চিকিৎসা দেশের শতকরা একশ’ ভাগ মানুষকেই স্পর্শ করে, এ কারণে এই আন্দোলন যে দ্র“ত শক্তি সঞ্চয় করবে এতে সন্দেহ নেই।
২৩.৬.২০১২