শনিবার, ৩০ জুন, ২০১২

সিরিয়ায় বহিঃশক্তির হস্তক্ষেপ বিষয়ে কফি আনানের স্বীকৃতি




ব দ র“ দ্দী ন উ ম র
যে কথা কফি আনানের অনেক আগেই বলা দরকার বা উচিত ছিল সে কথা তিনি অবশেষে বললেন। কথাটি হল, বাইরের শক্তিগুলোই সিরিয়ায় সহিংসতা ছড়িয়ে দি”েছ (উধরষু ঝঃধৎ ৩০.৬.২০১২)। এটা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, তার পক্ষে এ কথা বলার অসুবিধা ছিল এবং এখনও আছে। আমেরিকা কর্তৃক ইরাক আক্রমণের সময় জাতিসংঘের মহাসচিব হিসেবে তিনি যেসব তথ্য জানতেন, সেগুলো কি আজ পর্যন্ত তার পক্ষে প্রকাশ করা সম্ভব হয়েছে? সাম্রাজ্যবাদের হাতিয়ার জাতিসংঘের সর্বো”চ কর্মকর্তা হিসেবে তাকে যেসব কাজ করতে হতো, তাতে তার বিবেক কি কালিমামুক্ত আছে? এসব কথা এক হিসেবে অবান্তর, কারণ জাতিসংঘের মহাসচিবের পদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তার সহযোগী সাম্রাজ্যবাদীরা এমন লোককে দেয় না বা দিতে পারে না, যিনি সাম্রাজ্যবাদের পরিবর্তে বিশ্বের অনুন্নত ও পশ্চাৎপদ দেশ এবং নিপীড়িত জনগণের স্বার্থের পক্ষে দাঁড়াবেন।
লিবিয়ায় মোয়াম্মার গাদ্দাফির শাসন উৎখাত করে সে দেশটিকে পদানত করার পর এখন সাম্রাজ্যবাদীরা সিরিয়াকে ধ্বংস করার চক্রান্ত বেশ খোলাখুলিভাবেই ঘোষণা ও কার্যকর করছে। এর জন্য তারা মধ্যপ্রাচ্যে তাদের গোলাম রাষ্ট্রগুলোকে বেশ ভালোভাবেই ব্যবহার করছে। এই গোলাম রাষ্ট্রগুলোর সংগঠন আরব লীগ লিবিয়ায় সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের সময় তাদের স্বার্থেই ছিল সক্রিয় সহযোগী হিসেবে। কিš‘ সিরিয়ায় লিবিয়ার মতো জাতিসংঘের বেপরোয়া হস্তক্ষেপের পরি¯ি’তি না থাকায় আরব লীগ এখন জাতিসংঘের লেজুড় হিসেবে সরাসরি কাজ করছে। এই কার্য সুসম্পন্ন করার উদ্দেশ্যেই জাতিসংঘ এবং আরব লীগ যৌথভাবে সাবেক জাতিসংঘ মহাসচিব কফি আনানকে তাদের প্রতিনিধি হিসেবে সিরিয়ার পরি¯ি’তি সামাল দেয়ার কাজে নিযুক্ত করেছে।
লিবিয়ায় হড় ভষু ুড়হব প্রস্তাবে রাশিয়া ও চীন ভেটো না দেয়ায় সাম্রাজ্যবাদীরা যেভাবে অবাধে সে দেশের ওপর বোমাবর্ষণ করে শুধু বিমানবাহিনী নয়, ¯’লবাহিনীকেও শেষ পর্যন্ত ধ্বংস করেছিলÑ সেরকম সুযোগ এখনও পর্যন্ত সিরিয়ার ক্ষেত্রে সৃষ্টি হয়নি। কারণ লিবিয়ার ক্ষেত্রে নিজেদের ভেটো ব্যবহার না করে রাশিয়া ও চীন যে বোকামি করেছিল, তার খেসারত তারা দিয়েছে। লিবিয়ায় ন্যাটো শক্তিগুলো তাদের তেলসহ সেখানকার কোন কিছুতে ভাগ না দিয়ে তাড়িয়ে দেয়ার পর এখন তাদের হুঁশ হয়েছে। কাজেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ ন্যাটোভুক্ত দেশগুলো সিরিয়ায়ও লিবিয়ার মতো হড় ভষু ুড়হব কার্যকর করার চেষ্টা করলেও রাশিয়া ও চীন এখন তার বিরোধী। তা ছাড়া লিবিয়া থেকে সিরিয়া স্ট্র্যাটেজির দিক দিয়ে রাশিয়ার কাছে অনেক বেশি গুর“ত্বপূর্ণ। সেদিক দিয়েও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সিরিয়ার ব্যাপারে হাত মেলানোতে রাশিয়া ও সেই সঙ্গে চীনের অসুবিধা আছে। সাম্রাজ্যবাদী শিবিরের এই দ্বন্দ্ব সিরিয়ার ক্ষেত্রে সহায়ক হয়েছে। এ কারণেই এখনও পর্যন্ত সিরিয়া একটি স্বাধীন দেশ হিসেবে টিকে আছে, যদিও শেষ পর্যন্ত অব¯’া কী দাঁড়াবে, সেটা এই মুহূর্তে বলা সম্ভব নয়।
লিবিয়ার মতো সিরিয়ায়ও সাম্রাজ্যবাদীরা প্রতিষ্ঠিত সরকারের বির“দ্ধেই বিদ্রোহের সূত্রপাত করেছে। এদিক দিয়ে ‘আরব বসন্ত’-খ্যাত তিউনিসিয়া ও মিসরের অব¯’া অন্যরকম। এই দুই দেশে বিদ্রোহ ও প্রতিরোধের ক্ষেত্রে জনগণের যে স্বতঃস্ফূর্ততা ছিল, সিরিয়ার ক্ষেত্রে তা একেবারেই নেই। প্রেসিডেন্ট আসাদ প্রথম থেকেই বলে আসছেন যে, বাইরের শক্তি সিরিয়ার বিদ্রোহীদের গ্র“প খাড়া করে তাদের অর্থ ও অস্ত্র সরবরাহ করছে। প্রথমে ছোট আকারে এটা করলেও এখন খুব বড় ও বিশাল আকারে তারা এটা করছে। এর অন্য একটি দিক হ”েছ, এ কাজ যে তারা করছে এটা গোপন করা এখন তাদের পক্ষে সম্ভব হ”েছ না। শুধু তাই নয়, তারা এবং মধ্যপ্রাচ্যে তাদের গোলাম রাষ্ট্রগুলোও এ নিয়ে কোন গোপনীয়তার প্রয়োজন বোধ করছে না। কয়েক দিন আগে সৌদি আরব সরকারিভাবে ঘোষণা করেছে যে, আসাদের বির“দ্ধে যে বিদ্রোহী বাহিনী গঠিত হয়েছে তার সদস্যদের বেতন তারা দেবে! অর্থাৎ এই ‘বিদ্রোহী’ বাহিনীকে তারা আগে অর্থ ও অস্ত্র দিয়ে সাহায্য করলেও এখন সেই বাহিনীর সদস্যদের চাকরি রক্ষার দায়িত্বও সৌদি আরব নিয়েছে! তাদের অর্থের কোন অভাব নেই। হাজার হাজার কোটি ডলার ব্যয় করে যারা নিয়মিত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে বিনা প্র্রয়োজনে সামরিক বিমান, ট্যাংক, যুদ্ধজাহাজসহ সবরকম যুদ্ধ-সরঞ্জাম কেনে, তাদের পক্ষে সিরিয়ার বিদ্রোহী বাহিনী প্রতিপালন এমন কোন বড় ব্যয়সাপেক্ষ ব্যাপার নয়। এ কাজ যে তারা শুধু নিজেদের প্রতিক্রিয়াশীল রাষ্ট্রীয় অব¯’ান থেকেই করছে তা নয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হুকুম অনুযায়ীই এটা হ”েছ। 
সিরিয়ায় এখন প্রতিদিনই দুই পক্ষের আক্রমণে মানুষের জীবন যা”েছ। এর মধ্যে যেমন সেনাবাহিনীর লোক আছে, তেমনি আছে নিরীহ লোক, নারী, শিশু, বৃদ্ধÑ সব ধরনের লোক। কাতারভিত্তিক আলজাজিরা টেলিভিশন চ্যানেল থেকে নিয়ে সিএনএন, বিবিসিসহ দেশে দেশে সাম্রাজ্যবাদীদের সহযোগী এবং আশ্রিত ও অনুগত দেশটির টিভি চ্যানেলগুলোতে ও সেই সঙ্গে সংবাদপত্রে এ খবর এমনভাবে প্রচারিত হ”েছ, যাতে মনে হবে শুধু সরকার পক্ষের আক্রমণেই এভাবে এ পর্যন্ত পনের হাজার লোক সিরিয়ায় নিহত হয়েছে। কিš‘ বাস্তব ঘটনা এই যে, তথাকথিত বিদ্রোহী বাহিনীর আক্রমণেই এসব হত্যাকাণ্ড বেশি হ”েছ। এর একটা বড় প্রমাণ এই যে, এ হত্যাকাণ্ডের শিকার হ”েছ সিরীয় সামরিক বাহিনীর সদস্যরাই। যদি সরকারবিরোধীদের শক্তিশালী আক্রমণ না হতো তাহলে এভাবে সামরিক বাহিনীর লোকেরা নিহত হতো না। এ কারণে সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার প্রথম থেকেই বলে আসছেন, যেহেতু সরকারি বাহিনীর ওপর বিদেশী সহায়তাপ্রাপ্ত তথাকথিত বিদ্রোহী বাহিনীর সন্ত্রাসীরা আক্রমণ চালা”েছ, কাজেই তাদের প্রতিহত করা ছাড়া কোন উপায় নেই। কফি আনান সিরিয়ার ‘শান্তির দূত’ হিসেবে জাতিসংঘ এবং আরব লীগের দ্বারা নিযুক্ত হওয়ার পর তার সঙ্গে সাক্ষাতের সময় প্রেসিডেন্ট আসাদ তাকে বারবার এ কথা বলেছেন। কিš‘ তিনি এ কথায় বিশেষ কান না দিয়ে প্রায় একতরফাভাবেই আসাদকে এর জন্য দায়ী করে এসেছেন। কিš‘ এখন সিরিয়ায় বিদেশী সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলোর হস্তক্ষেপ এত খোলাখুলিভাবে শুর“ হয়েছে যে, কফি আনান এটা স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছেন, সিরিয়ায় বিদেশী শক্তিগুলো সেখানে সহিংসতা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে কাজ করছে!
সিরিয়ার সীমানা লংঘন করে তুর্কি বিমান ঢুকে পড়লে তাতে দোষ নেই। দোষ হ”েছ সেই অনুপ্রবেশকারী বিমান গুলি করে ভূপাতিত করায়! আরব দেশগুলোর বাইরে তুর্কি ন্যাটোর ল্যাংড়া সদস্য হিসেবে এখন সিরিয়াবিরোধিতায় খুব সক্রিয়। তারা বলছে, প্রতিবেশী দেশ সিরিয়া আক্রমণের কোন ই”ছা তাদের নেই। কিš‘ তা সত্ত্বেও সিরিয়া সীমান্তে তারা বড় আকারে সৈন্য সমাবেশ করছে। তুর্কির কথায় বিশ্বাসের কারণ যে নেই, এটা বলার দরকার হয় না। কাজেই তুর্কি তাদের সীমান্তে সৈন্য সমাবেশ শুর“ করার পাল্টা হিসেবে সিরিয়াও এখন তাদের তুর্কি সীমান্তে সৈন্য সমাবেশ করছে। এভাবেই এ অঞ্চল এখন উত্তপ্ত হ”েছ এবং এক যুদ্ধাব¯’া সেখানে তৈরি হ”েছ।
সাম্রাজ্যবাদীদের প্রতিনিধি হিসেবে কফি আনান সিরিয়ায় একটি ‘জাতীয় ঐক্যের সরকার’ প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব করেছেন। তবে ‘ওয়াশিংটন পোস্ট’ পত্রিকায় এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, অনেক বাইরের শক্তি সিরিয়ার ব্যাপারে গভীরভাবে জড়িত আছে। তার ছয় দফা ঐক্য প্রস্তাবে তাদের আনুষ্ঠানিক সম্মতি থাকলেও তাদের মধ্যে এক্ষেত্রে বিভেদ খুব স্পষ্ট। অন্যদিকে প্রেসিডেন্ট আসাদ ২৮ জুন ইরানি টেলিভিশনকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, যারা তার সরকারের বির“দ্ধে সন্ত্রাসী আক্রমণ চালা”েছ তাদের নির্মূল করতে তারা বদ্ধপরিকর। এ প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেন, সিরিয়ার সমস্যা সিরিয়াই মোকাবেলা করবে। কোন বাইরের শক্তিকেই এখানে নাক গলাতে দেয়া হবে না। কিš‘ প্রেসিডেন্ট আসাদ যা-ই বলুন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদীরা নিজেরা তো বটেই, এমনকি মধ্যপ্রাচ্যে তাদের অনুগত রাষ্ট্রগুলোকেও তারা এখন সিরিয়ার বির“দ্ধে ব্যবহার করছে। সিরিয়ার পরিণতি শেষ পর্যন্ত কি দাঁড়াবে বলা যায় না। তবে সিরিয়া যদি সাম্রাজ্যবাদের দ্বারা ধ্বংস হয়, তাহলে তারপর তাদের দৃষ্টি পড়বে লেবাননের ওপর। সেখানে তারা হিজবুল্লাহকে ধ্বংস করে সমগ্র মধ্যপ্রাচ্যে নিজেদের অখণ্ড আধিপত্য নতুনভাবে প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে আর এক পা এগিয়ে যাবে। সিরিয়ায় যেমন, লেবাননেও তেমনি সৌদি আরব মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে গুর“ত্বপূর্ণ মধ্যপ্রাচ্য এজেন্ট হিসেবে কাজ করবে। যে পর্যন্ত না সৌদি আরবে ‘আরব বসন্তের’ তুফান উঠবে, সে পর্যন্ত এই দেশটি ইসরাইলের মতোই মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের এক শক্তিশালী ঘাঁটি এবং সমগ্র মধ্যপ্রাচ্যের জনগণের জন্য এক বিপজ্জনক রাষ্ট্র হিসেবে তাদের এই ভূমিকা পালন করে যাবে।
৩০.৬.২০১২

শনিবার, ২৩ জুন, ২০১২

জনগণের চিকিৎসার কী হবে?




ব দ র“ দ্দী ন উ ম র
যারা সরকারি গদিতে বসে আছে তাদের কাছে জনগণ ভোটার ছাড়া অন্য কিছু নয়। এ কারণে যারা ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য নির্বাচন করে, তারা ভোটের সময় জনগণের কাছে হাজির হয় ভোটের ভিক্ষার পাত্র হাতে। ভোটের বিনিময়ে তাদের সবকিছু দেয়ার প্রতিশ্র“তি দেয়। তাদের এক স্বর্ণোজ্জ্বল ভবিষ্যতের কথা বলে। এ সবটাই হল জনগণকে প্রতারিত করার ফাঁদ। এই ফাঁদে পড়ে জনগণ তাদের ভোট দিয়ে ক্ষমতায় বসান। কিš‘ ক্ষমতায় বসার পরই গদিনশিনরা ভোটের ভিক্ষা পাত্র ফেলে দিয়ে ভোটার অর্থাৎ জনগণের হাতে ভিক্ষার পাত্র তুলে দেয়। এ কারণে নির্বাচনের পর জনগণ সরকারকে তাদের নির্বাচনী প্রতিশ্র“তি পালনের জন্য আবেদন জানাতে থাকেন, কিš‘ তাদের ভিক্ষার পাত্রে প্রায় কিছুই পড়ে না। উপরš‘ তাদের অব¯’া আরও কর“ণ হয়। বাংলাদেশে যে ‘গণতান্ত্রিক’ ব্যব¯’া চালু আছে, সেই গণতন্ত্রের এটাই হল মর্মব¯‘।
ক্ষমতায় গিয়ে এরা এতই বেপরোয়াভাবে লুটপাটে মত্ত থাকে যে, নিজেদের তৈরি সংবিধান পর্যন্ত কথায় কথায় পা দিয়ে মাড়িয়ে চলতে দ্বিধাবোধ করে না। এরা এমনভাবে নিজেরাই সংবিধান লঙ্ঘন করে, যাতে অব¯’া দেখে মনে হয় দেশটা কোন সংবিধান ছাড়াই গড্ডলিকা প্রবাহে গড়িয়ে চলেছে। সংবিধানের ব্যাপারে এদের একটু চাঙ্গাভাব তখনই দেখা যায় যখন এমন কোন মামলা হয়। তখন সংবিধানকে টানাটানির প্রয়োজন হয়। সে সময় সংবিধান নিয়ে অনেক বড় বড় কথা এদের মুখে শোনা যায়। সংবিধান লঙ্ঘন করার অভিযোগে অন্যদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে এরা উৎসাহিত থাকে। এ ব্যব¯’ায় আদালত এদের কথামতোই কাজ করেন। এই হল বাংলাদেশে বিদ্যমান ‘গণতান্ত্রিক’ ব্যব¯’ার হালচাল।
এই পরি¯ি’তিতে ২০১২-১৩ সালের বাজেট জাতীয় সংসদে পেশ করা হয়েছে। গত সপ্তাহে ১৭ জুন ‘জনগণের দুশমনদের বাজেট’ এই শিরোনামে আমি লিখেছিলাম। সেখানে জনগণের স্বা¯’্য ব্যব¯’া বিষয়ে আমি সামান্য লিখেছিলাম। এখানে সে বিষয়টির ওপরই আরেকটু বিশদভাবে কিছু বলা দরকার। অর্থমন্ত্রী তার বাজেটে ‘স্বা¯’্য ও পরিবার কল্যাণ’ খাতে ৯ হাজার ৩৫৫ কোটি টাকা ধার্য করেছেন। এবার শিক্ষা খাতে ব্যয় গত বছরের তুলনায় কমিয়ে আনা হলেও স্বা¯’্য খাতের অব¯’া আরও খারাপ। যে বরাদ্দ এই খাতে বর্তমান বাজেটে ধরা হয়েছে, এর মধ্যে অনেক কারসাজি আছে। কারণ এটা শুধু স্বা¯’্য খাত নয়, এর সঙ্গে যুক্ত আছে পরিবার-পরিকল্পনা। পরিবার-পরিকল্পনার সঙ্গে স্বা¯ে’্যর একটা সম্পর্ক থাকলেও এ দুইকে এক করার কোন প্রয়োজন হয় না। ‘পরিবার-পরিকল্পনা’ খাতে বরাদ্দ পৃথকভাবে দেখানোই দরকার। কিš‘ সেটা না করে স্বা¯’্য খাতে ব্যয় যা প্রকৃতপক্ষে বরাদ্দ করা হয়েছে তার পরিমাণ বাড়িয়ে দেখানোর উদ্দেশ্যেই এখানে স্বা¯’্য খাতের সঙ্গে পরিবার পরিকল্পনাজুড়ে দেয়া হয়েছে। এভাবে কাজটি করায় এর থেকে বোঝার উপায় নেই যে, স্বা¯’্য খাত ও পরিবার-পরিকল্পনা খাতে পর্যায়ক্রমে ঠিক কত বরাদ্দ করা হয়েছে। তবে এ দুই খাতকে একত্রে উপ¯ি’ত করে যে বরাদ্দ করা হয়েছে, সেটা বাংলাদেশের জিডিপি বা জাতীয় উৎপাদনের শতকরা এক ভাগেরও কম! অথচ এটা সারা বিশ্বে এবং বিশ্ব স্বা¯’্য সং¯’া (ডব্লিউএইচও) কর্তৃকও স্বীকৃত যে স্বা¯’্য খাতে ব্যয় হওয়া দরকার জিডিপির অন্তত ৫ ভাগ!
লক্ষ্য করার বিষয় যে, অর্থমন্ত্রী দেশের জনসংখ্যা ১৫ কোটি বলে জনসংখ্যা বৃদ্ধির কথা বলেছেন। অথচ এই বর্ধিত জনসংখ্যার জন্য স্বা¯’্য খাতে এ বছর ব্যয় বরাদ্দ গত বছরের থেকে কমানো হয়েছে। এর থেকে অদ্ভুত ব্যাপার আর কী হতে পারে? কিš‘ তার থেকেও অদ্ভুত ব্যাপার এই যে, বাজেট পেশ করার পর থেকে এ নিয়ে সংবাদ মাধ্যমে আজ পর্যন্ত কোন রিপোর্টিং, আলোচনা, বিতর্ক কিছুই হয়নি। এ নিয়ে নীরবতা আপাতদৃষ্টিতে এক বিস্ময়কর ব্যাপার।
পরিবার-পরিকল্পনা খাতে বরাদ্দ পৃথকভাবে না দেখিয়ে তাকে স্বা¯’্য খাতের সঙ্গে জুড়ে দেয়া হয়েছে পরিকল্পিতভাবে স্বা¯’্য খাতের বরাদ্দ বেশি করে দেখানোর জন্য। এখানে অন্য একটি বিষয়ও আছে, যার উল্লেখ কোথাও দেখা যায় না। সেটা হ”েছ এই যে, সামরিক বাহিনীর কম্বাইন্ড মেডিকেল হাসপাতালটির (সিএমএইচ) ব্যয়ও এই স্বা¯’্য ও পরিবার পরিকল্পনার মধ্যেই আছে! সেটা সামরিক খাতে বরাদ্দের মধ্যে নেই!! শিক্ষা খাতেও একই ব্যাপার। ক্যাডেট কলেজগুলোর ব্যয়ও সামরিক বাজেটের বাইরে রেখে সেটা শিক্ষা খাতে ব্যয়ের মধ্যে ঢুকিয়ে দেয়া হয়ে থাকে। এর ফলে স্বা¯’্য ও শিক্ষা খাতে যা প্রকৃত ব্যয় তার থেকে অনেক বেশি দেখানো হয় এবং অন্যদিকে সামরিক খাতে যে ব্যয় হয় তার আকার দেখানো হয় ছোট করে।
সবাই জানেন যে, সব সরকারি হাসপাতালের মধ্যে সিএমএইচে চিকিৎসা হয় সবচেয়ে ভালো। কারণ সেখানে যা প্রয়োজন তাই দেয়া হয়, যা কিছু সরবরাহের প্রয়োজন হয় তার সবটা তো হয়ই। এমনকি সেটা হয় সর্বো”চ দ্র“তগতিতে। এর অর্থ স্বা¯’্য খাতে যে ব্যয় হয় তাতে সামরিক বাহিনীর লোক এবং তাদের আÍীয়স্বজনের চিকিৎসার জন্য সরকার যে খরচ করে তার তিলার্ধও সাধারণ মানুষের জন্য তারা খরচ করে না! এর থেকে ভয়াবহ বৈষম্যমূলক ব্যব¯’া আর কী হতে পারে?
অর্থমন্ত্রীর বাজেটে নতুন অনেক স্বা¯’্যকেন্দ্র, ২৫০ বেডের থেকে নিয়ে কিছু ছোট হাসপাতাল তৈরির পরিকল্পনার কথা বলা হয়েছে। এ পরিকল্পনার কী হবে সে প্রশ্ন বাদ দিয়েও বলা চলে যে, শুধু ইট, কাঠ, সিমেন্ট দিয়ে বিল্ডিং বানিয়ে দিলেই সেটা হাসপাতাল হয়ে যায় না। বিভিন্ন জেলায় এখনও ২৫০ বেডের হাসপাতাল এবং তার থেকে ছোট হাসপাতাল আছে। সেগুলোতে রোগীরা কী চিকিৎসা পা”েছন সেটাই দেখার কথা। প্রকৃত চিকিৎসা বলে যদি কিছু না থাকে, চিকিৎসার মান যদি খুব নিু হয়, তাহলে ২৫০ কেন, ১০০০ বেডের হাসপাতাল তৈরি হলেও জনগণের কোন লাভ নেই। অর্থমন্ত্রীর বাজেটে গ্রামাঞ্চলে স্বা¯’্যকেন্দ্রের কথা বলা হয়েছে। কিš‘ এই স্বা¯’্যকেন্দ্রগুলোর অব¯’া কী? সেখানে তো ডাক্তাররা নিয়মিত বসেন না। বসলেও একমাত্র তাদের প্রেসক্রিপশন বা ব্যব¯’াপত্র ছাড়া অন্য কিছুই পাওয়া যায় না। এই স্বা¯’্যকেন্দ্রগুলোতে দু’চারটে ট্যাবলেট বা ওই জাতীয় কিছু ওষুধ কখনও কখনও বিনামূল্যে পাওয়া গেলেও সব ওষুধই রোগীদের কিনতে হয়। পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য তাদের জেলা হাসপাতালে যেতে হয়। সে হাসপাতাল সরকারি হলেও সেখানেও রোগীদের সবকিছুর জন্যই পয়সা দিতে হয়। রোগীদের জন্য পরীক্ষা-নিরীক্ষা খাতে খরচ ছাড়ের কোন ব্যব¯’া নেই। বাংলাদেশে বর্তমানে যে সরকারি হাসপাতালগুলো আছে, সেগুলোতে বিনা খরচে চিকিৎসা ব্যব¯’া আগে যেটুকু ছিল এখন সেটাও একেবারে উঠিয়ে দেয়া হ”েছ।
অর্থমন্ত্রী তার বাজেটে তারা কত হাসপাতাল স্বা¯’্যকেন্দ্র ইত্যাদি তৈরির পরিকল্পনা নিয়েছেন তার ফিরিস্তি দিলেও এসব হাসপাতালে চলমান ব্যয়ের জন্য কী পরিমাণ বরাদ্দ তারা করেছেন তার কোন উল্লেখ নেই। কারণ এই বরাদ্দ প্রকৃতপক্ষে অনুল্লেখযোগ্য। চলমান খরচ চালিয়ে যাওয়ার জন্য সিএমএইচের মতো বরাদ্দ ব্যব¯’া না থাকায় এগুলোতে চিকিৎসা হয় নামমাত্র। এটা চিকিৎসার নামে প্রহসন ও প্রতারণা ছাড়া আর কী?
চিকিৎসা এমন এক ব্যাপার, যা দেশের ১৫ কোটি লোককেই স্পর্শ করে। এর প্রয়োজন সবারই হয়। সরকারি ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত লোকরা সরকারের খরচে নিজেদের চিকিৎসার জন্য অথবা চিকিৎসার নামে বিদেশ ভ্রমণের জন্য ই”েছমতো ব্যয় করে থাকে। কিছুদিন আগে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বাথর“মে পড়ে গিয়ে কোমরে ব্যথা পান। মন্ত্রী হওয়ার আগে এভাবে বাথর“মে পড়ে কোমরে ব্যথা পেলে তিনি হয়তো কবরেজি চিকিৎসা করাতেন কিংবা সাধারণ হাসপাতালে চিকিৎসা নিতেন। কিš‘ মন্ত্রী হয়ে তিনি চলে গেলেন এই সামান্য চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুর! এভাবে সিঙ্গাপুর গিয়ে তিনি যে জনগণের পকেট কাটলেন, তাদের চিকিৎসার কোন উপযুক্ত বা সামান্য ব্যব¯’াও এখানে নেই। প্রেসিডেন্ট থেকে শুর“ করে মন্ত্রী, এমপি এবং সরকারি কর্মচারীরা রোগের চিকিৎসা তো দূরের কথা, ‘হেলথ চেকআপ’ বা শরীরে সাধারণ পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্যও সিঙ্গাপুর, ব্যাংকক, মালয়েশিয়া, ইংল্যান্ড, আমেরিকা যান। যারা নানারকম দুর্নীতি করে বা অন্য উপায়ে টাকা-পয়সার মালিক হয়েছেন তারাও কথায় কথায় চিকিৎসার জন্য বিদেশ যান। দেশে যে কয়েকটি খুব ব্যয়সাপেক্ষ হাসপাতাল আছে যেগুলোতে এখানকার ধনী ও সম্পন্ন মধ্যবিত্তরা যান, সেগুলোতে নাকি তাদের চিকিৎসার ব্যব¯’া নেই!
যে সমাজের ও দেশের এই অব¯’া, সেখানে সাধারণ মানুষের, শ্রমজীবী গরিবদের ও মধ্যবিত্তের চিকিৎসার কোন ভালো ব্যব¯’া যে দেশের সরকার করবে না, এতে বিস্মিত হওয়ার প্রশ্ন নেই। এটা প্রকটভাবে শ্রেণীবৈষম্যের ব্যাপার। সমাজে এই শ্রেণীবৈষম্য এবং লুটপাটকারী ধনিক শ্রেণী ক্ষমতায় থাকাই চিকিৎসা ক্ষেত্রে এই বৈষম্যের কারণ। ঠিক এ কারণেই বাংলাদেশে এখন জনগণের চিকিৎসার জন্য সংগ্রাম সাধারণভাবে রাজনৈতিক শ্রেণী সংগ্রামেরই অংশ। সাধারণ শ্রেণী সংগ্রাম থেকে এই সংগ্রামকে স্বতন্ত্র বা বি”িছন্নভাবে দেখার কোন সুযোগ নেই। এই সংগ্রাম যে জনগণের জন্য প্রয়োজন, এ চিন্তা তাদের মধ্যে শুর“ হয়েছে। কারণ খাদ্য, বাস¯’ান ইত্যাদির সংকট থাকলেও চিকিৎসা সংকট এমন এক ব্যাপার যা মানুষকে বিশেষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে। এই ক্ষতি জনগণের জীবনকে আজ বিপর্যস্ত করছে।
চিকিৎসা ব্যব¯’ায় এই বঞ্চনা ও বৈষম্যের বির“দ্ধে আন্দোলন সংগঠিত করার শর্ত এখন বাংলাদেশে তৈরি হয়েছে। কারণ এই পরি¯ি’তিতে জনগণের সহ্যসীমা অতিক্রম করছে। গত ২২ জুন ঢাকায় ‘জনস্বা¯’্য সংগ্রাম পরিষদ’ নামে একটি সংগঠনের এক প্রতিনিধি সম্মেলন হয়। এই প্রতিনিধি সম্মেলনে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে প্রতিনিধিরা যোগদান করেন। বাংলাদেশের ডাক্তাররা, বিশেষত যারা বড় ও বিশেষজ্ঞ ডাক্তার, তাদের বিপুল অধিকাংশই আজ চিকিৎসার নামে ফিসহ অন্যান্য উপায়ে জনগণের পকেট মেরে থাকেন। কিš‘ ডাক্তারদের মধ্যে সবার অব¯’া এরকম নয়। অনেকের মধ্যেই পেশাগত নৈতিকতা বোধ আছে। জনগণের সেবা করার আকাক্সক্ষা আছে। তাদের মতো কয়েকজন চিকিৎসকও এই সম্মেলনে উপ¯ি’ত ছিলেন। ঢাকা মেডিকেল কলেজসহ দেশের ৮টি সরকারি মেডিকেল কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত করা এবং শেষ পর্যন্ত সেগুলো বেসরকারিকরণের বির“দ্ধে সম্মেলনে উপ¯ি’ত প্রতিনিধিরা আন্দোলনের সংকল্প ঘোষণা করেন। জনস্বা¯’্য সংগ্রাম পরিষদ একটি খসড়া ঘোষণা এবং দাবিনামা অনুমোদন করে। এর ভিত্তিতে এই প্রতিনিধি সম্মেলনে উপ¯ি’ত প্রতিনিধিরা দেশজুড়ে, শহর ও গ্রামাঞ্চলে, স্বা¯’্য আন্দোলন গড়ে তোলা এবং তাকে প্রবল করার অঙ্গীকার ঘোষণা করেন। আসলে জনগণের এই ধরনের আন্দোলন ছাড়া নিজেদের চিকিৎসার সামান্যতম ব্যব¯’া করারও অন্য উপায় নেই। সরকারই জনগণকে আজ এই আন্দোলনের পথে ঠেলে দিয়েছে। যেহেতু স্বা¯’্য ও চিকিৎসা দেশের শতকরা একশ’ ভাগ মানুষকেই স্পর্শ করে, এ কারণে এই আন্দোলন যে দ্র“ত শক্তি সঞ্চয় করবে এতে সন্দেহ নেই।
২৩.৬.২০১২

বুধবার, ২০ জুন, ২০১২

সরকার ও গার্মেন্ট শিল্প মালিকরাই গার্মেন্ট শিল্প ক্ষেত্রে সঙ্কটের সৃষ্টিকর্তা



ব দ রু দ্দী ন উ ম র
ঢাকার উপকণ্ঠে আশুলিয়া শিল্পাঞ্চলে গার্মেন্ট কারখানা মালিকরা বিগত ১৭ জুন রোববার ৩০০ কারখানা বন্ধ করে দিয়েছেন। তাদের দাবি হলো, সরকার যতদিন পর্যন্ত না আশুলিয়া শিল্প এলাকায় আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক করবে এবং যে গার্মেন্ট শ্রমিকরা সেখানে ‘নৈরাজ্য’ সৃষ্টি করেছে তাদের শাস্তির ব্যবস্থা করবে—ততদিন তারা তাদের কারখানা বন্ধ রাখবেন! গার্মেন্ট ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন এবং বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন যৌথভাবে এই সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে। এর আগে ৬ দিন একটানা আশুলিয়া অঞ্চলে শ্রমিক অসন্তোষের কারণে সেখানকার কারখানাগুলো বন্ধ ছিল। এ সময় শ্রমিকরা কিছু কিছু কারখানা আক্রমণ করে ভাংচুর এবং সড়ক অবরোধ করেন।
এ ধরনের ঘটনা বাংলাদেশে নতুন নয়। কিছুদিন পরপর বিভিন্ন অঞ্চলে গার্মেন্ট শিল্পাঞ্চলগুলোতে শ্রমিক অসন্তোষ ও সংঘর্ষ দেখা যায়। একদিকে গার্মেন্ট মালিক শ্রেণী ও সরকার এবং অন্যদিকে শ্রমিকরা মুখোমুখি হয়েই সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। বাংলাদেশে গার্মেন্ট শিল্পাঞ্চলগুলোতে এভাবে যে ঘটনা দেখা যায়, এটা মনে করিয়ে দেয় ইংল্যান্ডে তিনশ’ বছর আগের কথা। শ্রমিকরা নির্মম শোষণের দুর্বিষহ অবস্থায় মাঝে মাঝে বর্ধিত মজুরি দাবি এবং নানা নির্যাতনের বিরোধিতা করতে দাঁড়িয়ে কারখানা আক্রমণ করে যন্ত্রপাতি কারখানা বিল্ডিং ভাংচুর করতেন। তাদের ওপর পুলিশি আক্রমণ হতো। ইংল্যান্ড এবং দুনিয়ার শিল্পায়িত কোনো দেশে উনিশ শতক থেকে এ রকম অবস্থা আর দেখা যায় না। ভারতে এটা কোনো সময়েই দেখা যায়নি। পাকিস্তান আমলেও এরকম কোনো ঘটনা ঘটেনি। কিন্তু বাংলাদেশের গার্মেন্ট শিল্পে এটা একরকম নিয়মিত ঘটনা। লক্ষণীয় ব্যাপার যে, গার্মেন্ট শিল্প ছাড়া অন্য কোনো শিল্পাঞ্চলে এটা ঘটে না। সেখানে শ্রমিকদের সঙ্গে পুলিশ ও মালিকদের ভাড়া করা গুণ্ডাদের সংঘর্ষ হয়, কিন্তু কারখানা, বিল্ডিং এবং যন্ত্রপাতি ভাংচুরের কোনো ঘটনা ঘটতে দেখা যায় না। বিস্ময়ের ব্যাপার যে, বাংলাদেশ সরকার এবং গার্মেন্ট শিল্প মালিকরা এসব বিষয় খেয়াল ও বিবেচনারও কোনো প্রয়োজন বোধ করেন না। ‘চক্রান্ত’ তত্ত্বের ওপর দাঁড়িয়ে তারা শ্রমিকদের ওপর হম্বিতম্বি করেন এবং পুলিশ, র্যাব, শিল্প পুলিশ ও গুণ্ডাবাহিনী দিয়ে শ্রমিকদের ঠাণ্ডা করার চেষ্টাতেই তারা নিয়োজিত থাকেন।
ইংল্যান্ডে তিনশ’ বছরেরও বেশি আগে শিল্প মালিকরা শ্রমিকদের দ্বারা কলকারখানা আক্রান্ত হতে থাকার সময় শ্রমিকদের ওপর নির্যাতন করে তা বন্ধের চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। শোষণ-নির্যাতন শ্রমিকদের মধ্যে যে ক্ষোভ সৃষ্টি করে, সেই ক্ষোভের এ ধরনের অভিব্যক্তি বন্ধ করতে না পারার পরই তারা এর কারণ অনুসন্ধানে নিযুক্ত হয় এবং নিজেদের অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে উপলব্ধি করে যে, শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধি ছাড়া উপায় নেই এবং এ জন্য দরকার শ্রমিক-মালিক আলাপ-আলোচনা ও দরদস্তুরের উপায় বের করা। শ্রমিকরা এজন্যই ট্রেড ইউনিয়ন গড়ে তোলার চেষ্টা করতেন। কিন্তু মালিকরা ছিল তার ঘোর বিরোধী। কিন্তু শেষ পর্যন্ত মালিকরা শিল্পাঞ্চলে এবং কলকারখানায় সংঘর্ষ বন্ধের উপায় হিসেবে ট্রেড ইউনিয়নকে স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হয়। ধর্মঘটও শ্রমিক আন্দোলনের একটা উপায় হিসেবে স্বীকৃত হয়। পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় শ্রমিক-মালিকের মধ্যকার দ্বন্দ্ব বন্ধ হওয়ার নয়। কিন্তু সেই দ্বন্দ্ব নিয়ন্ত্রণের জন্য যে ট্রেড ইউনিয়নের প্রয়োজনীয়তা অপরিহার্য, এই স্বীকৃতি তিনশ’ বছর আগেকার পরিস্থিতি পরিবর্তন করতে সক্ষম হয়। শ্রমিক-মালিক সম্পর্কের আধুনিকায়ন হয়। এ কারণেই আধুনিক শিল্প ব্যবস্থায় শ্রমিকদের অনেক গুরুত্বপূর্ণ অধিকার আন্তর্জাতিকভাবেও স্বীকৃত হয় এবং এর জন্য জাতিসংঘ আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) তাদের কনভেনশনে অনেক সুনির্দিষ্ট বিধি নির্ধারণ করে। এগুলোর মধ্যে শ্রমিকদের জন্য নিয়োগপত্র, ছুটি বিষয়ক নিয়মকানুন তো আছেই, কিন্তু সর্বোপরি আছে শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়নের অধিকার। বাংলাদেশ সরকার আইএলও’র সব বিধি কার্যকর না করলেও এগুলো সাধারণভাবে স্বীকার করে এবং মেনে চলে। কিন্তু এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ করা দরকার, বাংলাদেশ সরকার প্রথম থেকেই গার্মেন্ট শিল্পকে আইএলও’র সব রকম বিধির সম্পূর্ণ বাইরে রেখে এই শিল্পে সম্পূর্ণভাবে শ্রমিকবিরোধী কার্যকলাপ অবাধে চালিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করেছে। এখানে আরও বলা দরকার, দুনিয়ার বহু দেশে গার্মেন্ট শিল্প থাকলেও এই শিল্পকে আইএলও’র আওতাবহির্ভূত রেখে গার্মেন্ট শিল্প মালিকদের এভাবে অবাধ শোষণ-নির্যাতনের এখতিয়ার কোনো দেশই দেয়নি।
এসব বিষয় বিবেচনা করে বেশ জোরের সঙ্গেই বলা দরকার যে, গার্মেন্ট শিল্পে এখন যে পরিস্থিতি দেখা যাচ্ছে, যে স্থায়ী অসন্তোষ এবং সংঘর্ষ গার্মেন্ট শিল্পাঞ্চলগুলোতে দেখা যায়—এর অবসানের জন্য প্রয়োজন বাংলাদেশে এই শিল্প ব্যবস্থার বর্বর অবস্থা পরিবর্তন করে এর আধুনিকায়ন করা। এ জন্য প্রথমেই সরকারের প্রয়োজন গার্মেন্ট শিল্পকে আইএলও’র নিয়মকানুনের অধীনস্থ করা। শ্রমিকদের নিয়োগপত্র, ছুটি, মজুরি, ওভারটাইম ইত্যাদি যুক্তিসম্মত করা এবং সর্বোপরি শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন অধিকারের স্বীকৃতি প্রদান করা। প্রত্যেক গার্মেন্ট শিল্প কারখানা এবং শিল্পাঞ্চলে ও জাতীয় ভিত্তিতে যাতে ট্রেড ইউনিয়ন গঠিত হয় তার জন্য সরকারিভাবেই উদ্যোগ গ্রহণ করা।
বর্তমানে গার্মেন্ট শ্রমিকরা শুরুতে ৩০০০ টাকা থেকে নিয়ে ৫০০০ টাকা পর্যন্ত মাসিক মজুরি পেয়ে থাকেন। এছাড়া ওভারটাইম নিয়েও অনেক ফাঁকিবাজির ব্যবস্থা আছে। এই মজুরিতে একজন শ্রমিকের পক্ষে পরিবার নিয়ে সুস্থ ও কর্মক্ষম থাকা যে সম্ভব নয়, এটা কাউকে বুঝিয়ে বলার প্রয়োজন হয় না। অনেক গার্মেন্ট মালিক একটি কুকুরের পেছনেও মাসে এর থেকে অনেক বেশি টাকা ব্যয় করে থাকেন! এই পরিস্থিতি চলতে দেয়া যায় না। শ্রমিকদের মজুরি উপযুক্তভাবে বৃদ্ধি ও নিয়মিত করা থেকে নিয়ে তাদের জীবনযাপন কিছুটা স্বাভাবিক করার চেষ্টা সরকারকে আইন করেই মালিকদের এ কাজে বাধ্য করতে হবে। কারণ মানসিকভাবে বর্বর যুগে বাস করা এই মালিকরা যে স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে নিজেদের উদ্যোগে এটা করবে, এমনটা মনে করার কোনো কারণ নেই। শ্রমিকরা মূলত মজুরির দাবিতেই আন্দোলন করে থাকেন। এই দাবির স্বীকৃতি এবং এর জন্য মালিক ও সরকারের সঙ্গে আলোচনা এবং দরদস্তুরের কোনো সাংগঠনিক ব্যবস্থা না থাকায় এই মুহূর্তে শ্রমিকদের নিয়োগপত্র এবং ট্রেড ইউনিয়নের ব্যবস্থা সরকারকেই করতে হবে। কারণ বাংলাদেশে যে পরিস্থিতি বিরাজ করছে তাতে গার্মেন্ট শিল্প এলাকায় সঙ্কট কোনো দ্বিপাক্ষিক সঙ্কট নয়। এখানে তৃতীয় পক্ষ হচ্ছে সরকার। কিন্তু সরকার এ পর্যন্ত তার দায়িত্ব পালনের ধারেকাছে না গিয়ে মালিকদের পক্ষ নিয়ে গার্মেন্ট শিল্প এলাকায় র্যাব এবং পুলিশ থাকা সত্ত্বেও শিল্প পুলিশ নামে এক নতুন বাহিনী তৈরি করেছে। এই বাহিনী মালিকদের প্রয়োজনে ও মালিকদের পক্ষ নিয়ে শ্রমিকদের ওপর নির্যাতন চালিয়ে যাচ্ছে।
গার্মেন্ট মালিকরা ও তাদের একাধিক সংগঠন এবং সরকার এই শিল্পে শ্রমিক অসন্তোষকে বাইরের ষড়যন্ত্র বলে প্রচার করছে। এসব কথায় কান দেয়ার মতো লোক দেশে নেই বললেই চলে। এর দ্বারা প্রকৃতপক্ষে কেউ বিভ্রান্তও হচ্ছে না। এই পরিস্থিতিতে গার্মেন্ট মালিকরা আশুলিয়া অঞ্চলে নিজেদের ৩০০ থেকে বেশি কারখানা বন্ধ রেখেছেন এবং হুমকি দিচ্ছেন আর একটি কারখানা আক্রান্ত হলে তারা সারা দেশে যত কারখানা আছে সব বন্ধ করে দেবেন!! শ্রমিকদের ওপর অকথ্য শোষণ-নির্যাতন চালিয়ে যারা দুনিয়ার মধ্যে সব থেকে বেশি মুনাফা এই শিল্প থেকে করছেন, তারা নিজেদের কারখানা ক’দিন বন্ধ রাখতে পারেন সেটা দেখা যাবে। কারখানা যাতে তাড়াতাড়ি আবার চালু করা যায় এজন্য তারা সরকারকে তার শ্রমিক দমন কর্ম জোরদার করার জন্য চাপ দিচ্ছেন। শ্রমিকদের কাজ ও মজুরি দরকার। কিন্তু তার থেকে বেশি দরকার মালিকদের মুনাফা। কাজেই মালিকদের কারখানা অবশ্যই খুলতে হবে। এর কোনো বিকল্প তাদের সামনে নেই। তবে তারা নিজেদের অতিরিক্ত মুনাফার হার কিছুটা কমিয়ে যদি শ্রমিকদের মজুরি যুক্তিসঙ্গতভাবে বৃদ্ধি না করেন এবং তাদের বিধিসম্মত অধিকারগুলোকে যদি স্বীকৃতি না দেন তাহলে তারা নিজেরাই বাংলাদেশে গার্মেন্ট শিল্পের ধ্বংস সাধন করবেন।
২০.৬.২০১২

মঙ্গলবার, ১৯ জুন, ২০১২

দেশ টিভির বাজেট আলোচনা


 বদরুদ্দীন উমর
দেশে আমলা, পুলিশ, রাজনীতিবিদ প্রমুখ যারা শত শত, হাজার হাজার কোটি টাকার মালিক পর্যন্ত হয়েছেন এবং যাদের এই টাকার বিপুল অংশ কালো টাকা তাকে কি এই ধরনের অপ্রদর্শিত আয় বলা চলে? তাকে কি কোনোভাবে 'আয়ে'র পর্যায়ে ফেলা যায়? চুরি, ঘুষ, লুটপাট ইত্যাদি মাধ্যমে অর্জিত ধনসম্পদ কি প্রদর্শিত অথবা অপ্রদর্শিত কোনো ধরনের 'আয়' বলে গণনার যোগ্য? এটা নয় বলেই অপ্রদর্শিত আয় ঘোষণার সময় তার উৎস উল্লেখ করার কোনো ব্যবস্থা কালো টাকা সাদা করার ব্যবস্থার মধ্যে নেই। শুধু ঘোষণা করলেই হলো, একজন কী পরিমাণ 'অপ্রদর্শিত' টাকার মালিক। তার ওপর নির্ধারিত ১০% কর এবং ১০% জরিমানা দিয়েই তারা খালাস
দেশ টিভি ১৭ জুন রোববার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট হলে ২০১২-১৩-এর বাজেটের ওপর এক আলোচনার ব্যবস্থা করে। অর্থমন্ত্রীকে বাজেটের বিভিন্ন দিক নিয়ে প্রশ্ন করা এবং অর্থমন্ত্রী কর্তৃক প্রশ্নগুলোর ব্যাখ্যামূলক জবাব প্রদানের মধ্যেই এই আলোচনা সীমাবদ্ধ রাখা হয়। শিল্প ব্যবসা মালিক, আইনজীবী, শ্রমিক সংগঠনের প্রতিনিধি, সাংবাদিক, শিক্ষক, শেয়ারবাজারের কর্তাব্যক্তি প্রমুখ এবং সে সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও ঢাকার কয়েকটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা এ আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন। সাধারণভাবে যেসব হোমরাচোমরা অর্থনীতিবিদ বাজেটের ওপর আলোচনা করেন, তাদের প্রায় কাউকেই এই অনুষ্ঠানে দেখা যায়নি। মনে হয়, বাজেট নিয়ে তারা বিগত ক'দিন ধরে টিভির নানা টক শোতে এবং অন্যান্য আলোচনা সভায় অংশগ্রহণ করায় তাদের আমন্ত্রণ না জানিয়ে সেই বৃত্তের বাইরের লোকদের আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল, যাতে অন্য ধরনের কিছু কথা শোনা যায়। অবশ্য তাদের কেউ কেউ টিভি টক শো এবং অন্যত্র আলোচনাতেও যে অংশগ্রহণ করেননি এমন নয়। পরিচিত অর্থনীতিবিদরা এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত না থাকলেও যারা উপস্থিত ছিলেন তারা সকলেই নিজ নিজ ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত, গণ্যমান্য ও পরিচিত ব্যক্তি। তারা নিজেদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়েই মোটামুটি আলোচনা ও প্রশ্ন করেন। এ ধরনের কয়েকটি বিষয় এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে প্রশ্নকর্তার নাম উল্লেখ না করে। কালো টাকা সাদা করা নিয়ে কয়েকজনই বলেন। নৈতিক প্রশ্ন থেকে নিয়ে সাদা হওয়া কালো টাকার ব্যবহার কীভাবে হবে, কালো টাকার সংজ্ঞা কী ইত্যাদি নিয়ে যেসব প্রশ্ন করা হয়, তার কোনো সন্তোষজনক জবাবই অর্থমন্ত্রী দেননি। কালো টাকাকে সংজ্ঞায়িত করতে গিয়ে তিনি বলেন, কর প্রদানের ক্ষেত্রে যে আয় প্রদর্শন করা হয় না সেটাই কালো টাকা! এ জন্য তিনি একে কালো টাকা না বলে 'অপ্রদর্শিত' আয় বলে উল্লেখ করেন। অর্থাৎ তার সংজ্ঞা অনুসারে কর ফাঁকি দেওয়া ছাড়া কালো টাকার অন্য কোনো দিক নেই! এভাবে কালো টাকাকে সংজ্ঞায়িত করা যে কালো টাকাকে সম্মানজনক করা এবং এর নৈতিক দিকটিকে তরল করা অথবা অস্বীকার করার চেষ্টা এতে সন্দেহ নেই। মন্ত্রী এই অপ্রদর্শিত আয়ের দৃষ্টান্ত দিতে গিয়ে বললেন, কেউ যদি নিজের জমি বেশি দামে বিক্রি করে কাগজে-কলমে তার দাম কম দেখায়, তাহলে সেটাই হলো অপ্রদর্শিত আয়। অর্থাৎ সেটাই হলো কালো টাকা। এটা ঠিক যে, এই টাকা সাদা নয়। কিন্তু কালো টাকা মোট টাকার ৪০% থেকে ৮০%-এর যে কথা তিনি নিজেই বলেন তার সবটা কি এই ধরনের কর ফাঁকির টাকা? দেশে আমলা, পুলিশ, রাজনীতিবিদ প্রমুখ যারা শত শত, হাজার হাজার কোটি টাকার মালিক পর্যন্ত হয়েছেন এবং যাদের এই টাকার বিপুল অংশ কালো টাকা তাকে কি এই ধরনের অপ্রদর্শিত আয় বলা চলে? তাকে কি কোনোভাবে 'আয়ে'র পর্যায়ে ফেলা যায়? চুরি, ঘুষ, লুটপাট ইত্যাদি মাধ্যমে অর্জিত ধনসম্পদ কি প্রদর্শিত অথবা অপ্রদর্শিত কোনো ধরনের 'আয়' বলে গণনার যোগ্য? এটা নয় বলেই অপ্রদর্শিত আয় ঘোষণার সময় তার উৎস উল্লেখ করার কোনো ব্যবস্থা কালো টাকা সাদা করার ব্যবস্থার মধ্যে নেই। শুধু ঘোষণা করলেই হলো, একজন কী পরিমাণ 'অপ্রদর্শিত' টাকার মালিক। তার ওপর নির্ধারিত ১০% কর এবং ১০% জরিমানা দিয়েই তারা খালাস। সততা ও নৈতিক গ্রাহ্যতা যে টাকা দিয়ে কেনা যায় এর পথ দেখানোও মনে হয় কালো টাকার ওপরের সংজ্ঞা নির্ণয়ের অন্যতম উদ্দেশ্য! এভাবে সাদা করা টাকা শুধু উৎপাদন খাত ছাড়া অন্য কোনো খাতে ব্যয় করতে দেওয়া হবে কি-না এর কোনো স্পষ্ট জবাব অর্থমন্ত্রী না দিলেও ধরে নেওয়া যায় এটাই তাদের উদ্দেশ্য। কিন্তু এই সাদা টাকা ব্যক্তিগতভাবে ব্যয় না করে উৎপাদন খাতে যে ব্যয় হবে, সেটা নিশ্চিত করা হবে কীভাবে? এর তদারকি কে করবে? এ বিষয়ে সরকারের কোনো নির্ধারিত নিয়ম বা নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা নেই। কাজেই যারা 'অপ্রদর্শিত' আয়ের মালিক তারা যে সাদা করা টাকা নিজেদের ব্যক্তিগত স্বার্থ বাদ দিয়ে দেশের অর্থনীতির খাতে বিনিয়োগ করবে এর সম্ভাবনা নেই বললেই চলে অথবা এ সম্ভাবনা সামান্য।
দেশের শোচনীয় যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতির জন্য বড় আকারে বিনিয়োগের প্রয়োজন যেখানে আছে সেখানে পদ্মা সেতু নির্মাণ নিয়ে বাড়াবাড়ি রকম ব্যস্ততা কেন_ এ প্রশ্নের কোনো জবাব অর্থমন্ত্রী দেননি অথবা দিতে পারেননি। আইএমএফ যে এক বিলিয়ন বা একশ' কোটি ডলার ঋণ দেবে তার শর্তাবলি সম্পর্কে প্রশ্ন করায় অর্থমন্ত্রী সরাসরি তা অস্বীকার করেন। অথচ আইএমএফ থেকে শুধু শর্তের কথা বলা হয় কীভাবে, কোন কোন পর্যায়ে কী সব শর্ত সরকারকে মেনে চলতে হবে তার ফিরিস্তি সরকারকে দেওয়া হয়েছে এবং সংবাদপত্রে তা প্রকাশিত হয়েছে!
শ্রমিকদের অতি সামান্য মজুরি, আর্থিক দুর্নীতির উল্লেখ করে তাদের মজুরি বৃদ্ধি এবং অন্যান্য সুবিধার জন্য বাজেটে কিছু নেই। এ কথার জবাবে মন্ত্রী কিছুই বললেন না। শিক্ষাক্ষেত্রে বৈষম্য নিয়ে প্রশ্নের জবাবে তিনি বললেন, সরকার আগের থেকে অবস্থার উন্নতি করেছে। বিনা মূল্যে এখন প্রাথমিক পর্যায়ে কোটি কোটি বই দেওয়া হয়েছে। স্কুলে ছাত্রদের খাওয়ার ব্যবস্থা হয়েছে। কিন্তু এ কথার পর কেউ বলেনি যে, এই 'বিনা মূল্যের' বই বাজারে ভালো মূল্যেই বিক্রি হচ্ছে! প্রত্যেক স্কুলে খাদ্য দেওয়া হচ্ছে কি-না অথবা ঠিকমতো দেওয়া হচ্ছে কি-না এবং ছাত্ররা বিনা মূল্যে বই কতজন পাচ্ছে তার তদারকির ব্যবস্থা যে কিছুই নেই, এটা এ প্রশ্নে অর্থমন্ত্রীর নীরবতা থেকেই বোঝা গেল।
শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারি যারা করেছে, তাদের চিহ্নিত করে শাস্তি দেওয়ার ব্যবস্থা করা হলো না কেন, একজন ছাত্রের এই প্রশ্নের কোনো জবাব মন্ত্রী দিলেন না। শেয়ারবাজারকে 'দুষ্ট' বলে নিন্দা জানালেও এই দুষ্টচক্র মধুচক্র হিসেবে যারা রচনা করেছে তারা মনে হয় অর্থমন্ত্রীর সুপরিচিত। শেয়ারবাজারকে দুষ্ট বললেও সেই দুষ্ট দমনের কোনো সম্ভাবনা না দেখেই হয়তো তিনি প্রেসের সামনে আর্তনাদের মতো করে বলেছিলেন, 'আই অ্যাম একদম ফেডআপ!'
আরও অনেক বিষয়ে প্রশ্ন করা হলেও তার সবকিছু এখানে উল্লেখ করা সম্ভব নয়। একজন সামরিক খাতে ব্যয়ের উল্লেখ করে প্রশ্ন করেন, এ খাতে এত ব্যয় কেন করা হচ্ছে? শিল্প এবং অন্য প্রয়োজনীয় খাতে তার একটা অংশ ব্যয় করাই তো বেশি প্রয়োজন। মন্ত্রী এ প্রশ্নের জবাবের ধারেকাছেও গেলেন না। তবে পুরো প্রশ্নোত্তর পর্বের একটা রীতিমতো বিস্ময়কর উল্লেখযোগ্য দিক হলো, দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থা সম্পর্কে কোনো দিক থেকেই কেউ কোনো প্রশ্ন না করা! শুধু চিকিৎসা ব্যবস্থাই নয়, যারা শ্রমজীবী, যারা গরিব তাদের শিক্ষা-দীক্ষার মূল সমস্যা, তাদের জীবন-জীবিকার বিভিন্ন ক্ষেত্রে সরকারি বাজেটে যে উল্লেখযোগ্য কিছুই নেই, এ নিয়ে কেউ বস্তুতপক্ষে কোনো প্রশ্নই করলেন না? যারা গণ্যমান্য এবং অর্থনীতি ক্ষেত্রে ও সমাজে লব্ধ প্রতিষ্ঠ, তারা এ নিয়ে কিছু বলবে এটা প্রত্যাশিত নয়। কিন্তু অবাক হওয়ার ব্যাপার এই যে, ছাত্রছাত্রীদের মধ্য থেকেও কেউ এসব প্রশ্নের ধারেকাছেও গেলেন না! বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন প্রজন্মের যে ছাত্রছাত্রীরা প্রশ্ন করলেন তারাও শুধু নিজেদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়েই প্রশ্ন করলেন। তাদের কারও সামাজিক চেতনা, সমাজের প্রতি কোনো ধরনের দায়বদ্ধতার পরিচয় তাদের কোনো প্রশ্নের মধ্যে দেখা গেল না। অর্থমন্ত্রীর কথাবার্তা থেকেও এই ছাত্রছাত্রীদের অবস্থার মধ্যে দেশের পরিস্থিতির এমন একটা দিক উন্মোচিত হলো, যা রীতিমতো বেদনাদায়ক এবং ভীতিপ্রদ। সরকারি কর্তাব্যক্তিরা, শিল্প ব্যবসায়ীরা, সিভিল সোসাইটির হৃষ্টপুষ্ট গণ্যমান্য ব্যক্তিরা দেশের শতকরা আশিজন কায়িক ও মানসিক শ্রমজীবী দরিদ্রদের কথা চিন্তা করে না, এতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। তাদের পক্ষে এটা স্বাভাবিক। ৮০%কে শোষণ, নির্যাতন ও প্রতারণা করেই তারা নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তন ও ধনসম্পদ অর্জন করে। কিন্তু দেশের ছাত্রছাত্রী ও নতুন প্রজন্মের সদস্যদের মাথায় এ নিয়ে কোনো চিন্তা-ভাবনা নেই, এটা সমাজের শোচনীয় অবস্থাই নির্দেশ করে। যেখানে ভরসা, সেখানে নিরাশা, ব্যাপারটা সাময়িক হলেও সামাজিক ও রাজনৈতিক দিক দিয়ে বিপজ্জনক। এই বিপজ্জনক পরিস্থিতির মধ্যেই বাংলাদেশের জনগণ এখন
বসবাস করছে।
১৭.৬.২০১২

রবিবার, ১৭ জুন, ২০১২

জনগণের শত্র“দের বাজেট


ব দ র“ দ্দী ন উ ম র
অর্থমন্ত্রী বেশ গরম মেজাজে জাতীয় সংসদে ২০১২-১৩ অর্থবছরের বাজেট পেশ করেছেন। এমনিতেই অর্থমন্ত্রী হিসেবে তিনি নানা ধরনের অর্থহীন বক্তব্য প্রদান করতে অভ্যস্ত। এসব কথা শুনে মনে হয় না দিগি¦দিক জ্ঞান বলে তার কিছু আছে। গরম অব¯’ায় উত্তেজিতভাবে শেয়ারবাজার সম্পর্কে তিনি যা বলেছেন তা অর্থহীন এবং বিস্ময়করই বটে। তিনি পুুঁজিবাজারকে ‘দুষ্টু শেয়ারবাজার’ বলে আখ্যায়িত করে বলেছেন, ‘এ বাজারের কথা না ভাবলেও অর্থনীতির কোন ক্ষতি হবে না!’ পুঁজির কারবার যেখানে থাকে সেখানে দুষ্টু ব্যাপারও থাকে। কিš‘ একটি পুঁজিবাদী অর্থ ব্যব¯’ায় শেয়ারবাজার সম্পর্কে এ ধরনের বক্তব্য শুধু অর্থমন্ত্রী নন, কোন শিক্ষিত লোকের পক্ষে দেয়া যে সম্ভব এটা ভাবনার অতীত। কিš‘ যে কথা স্বাভাবিকভাবে ভাবনার অতীত সে কথাই অর্থমন্ত্রী তার গরম বাজেট বক্তৃতায় উদগিরণ করেছেন। এর মধ্যে আর যা-ই হোক, শেয়ারবাজার নিয়ন্ত্রণে সরকারের এবং বিশেষত অর্থমন্ত্রীর চরম ব্যর্থতার প্রতিফলন ছাড়া আর কী আছে? স্বাভাবিকভাবেই মন্ত্রীর এ বক্তব্যে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) নিজেদের ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে। ডিএসই সভাপতি এ প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘সরকার ডিএসই থেকে গত তিন বছরে এক হাজার কোটি টাকার বেশি রাজস্ব পেয়েছে। পুঁজিবাজার হল বিকল্প অর্থ সংগ্রহের জায়গা। ভারত 
সরকার পুঁজিবাজার থেকে টাকা উত্তোলন করে 
পিপিপির আওতায় বড় বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে। (সকালের খবর, ১৩.৬.১২)
ভারতের কোন অর্থমন্ত্রী পার্লামেন্টে বাজেট পেশ করার সময় এ ধরনের উক্তি করলে তাকে পার্লামেন্টেই রীতিমতো বিপদে পড়তে হতো। কারণ এ কথা নির্বোধ এবং নিজেদের সাধের পুঁজিবাদের চরিত্র সম্পর্কেও প্রকৃতপক্ষে অজ্ঞ এবং পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রণে সম্পূর্ণ অক্ষম, এমন একজন লোকের পক্ষেই বলা সম্ভব। কিš‘ বাংলাদেশের সংসদে অর্থমন্ত্রীর সে রকম কোন বিপদ হয়নি! আমলা মহল থেকে এসে এই অর্থমন্ত্রী রাজনীতিবিদ হয়েছেন। রাজনীতিবিদ হিসেবেও তিনি অনেক ঘাটের পানি খাওয়া এক চরম সুবিধাবাদী লোক। ভুলে যাওয়ার উপায় নেই যে, অর্থমন্ত্রী হিসেবে তিনি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের শাসনামলেও বাংলাদেশ জাতীয় সংসদে বাজেট পেশ করে কৃতিত্ব দেখিয়েছিলেন। এখন আওয়ামী লীগের অর্থমন্ত্রী হিসেবে ক্ষমতামদমত্ত অব¯’ায় তার মেজাজ গরম। এই গরম অব¯’ায় বাজেট পেশ করলে বাজেটের যে অব¯’া হয় এই বাজেটের অব¯’াও তা-ই হয়েছে। এতে বিভিন্ন ক্ষেত্রে যেসব লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে, তার অর্থায়নের যেসব কাল্পনিক বা আয়ত্তবহির্ভূত উৎসের কথা বলা হয়েছে তাতে এই বাজেট দেশকে অদূর ভবিষ্যতেই যে চরম অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে নিক্ষেপ করবে এতে সন্দেহ নেই। অর্থমন্ত্রী তার বাজেটে ৭ দশমিক ৫ ভাগ প্রবৃদ্ধি অর্জনের কথা বলেছেন। কিš‘ এর কোন সম্ভাবনা যে তার টালমাটাল বাজেটের মধ্যে নেই তা বিশেষভাবে লক্ষণীয়। তিনি বাহাদুরি দেখানোর জন্য এক বিরাট অংকের বাজেট পেশ করলেও এমন সব অনিশ্চয়তার মধ্যে তার ‘সাফল্যকে’ দাঁড় করিয়েছেন যার ফলে শেষ পর্যন্ত তার বাজেটের অব¯’া লেজেগোবরে হওয়ার কথা। মূল্যবৃদ্ধি রোধ ও নিয়ন্ত্রণ হল এ ধরনেরই এক অনিশ্চয়তা। মূল্যবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণের কোন ব্যব¯’া তার বাজেটে নেই। যা আছে তা হল, এক ধরনের ফাঁকা আশাবাদ। সংসদে বসে থাকা তার সহযোদ্ধা এবং তাদের আÍীয়-স্বজন, বন্ধুবান্ধব ও দুর্নীতির ভাগীদাররাই যে তার এই ফাঁকা আশাবাদের মাথা মুড়িয়ে ঘোল ঢালবেন এতে সন্দেহ নেই। আমার এ কথা ‘অসংসদীয়’ হলেও এটা এক নির্জলা সত্য। এ সত্য বর্তমান সরকারের ঊর্ধ্বতন থেকে নিুতম পর্যায়ের নেতারা এরই মধ্যে প্রমাণ করেছেন। শেয়ারবাজার সম্পর্কে নিজের অক্ষমতা-হতাশা প্রকাশ করতে গিয়ে অর্থমন্ত্রী বলেছেন, ‘আই অ্যাম একদম ফেডআপ!’ তার এই ইঙ্গ-বঙ্গ ভাষা আমাদের মনে করিয়ে দেয় বিগত বিএনপি সরকারের কুখ্যাত স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বাবরের ‘উই আর লুকিং ফর শত্র“জ’-এর কথা। অর্থমন্ত্রী ও তার বাজেটের অব¯’া দেখে মনে হয় কিছুদিন পর তিনি মূল্যবৃদ্ধি প্রসঙ্গেও বলবেন, ‘আই অ্যাম একদম ফেডআপ’ এবং মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে না ভাবলেও অর্থনীতির কোন ক্ষতি নেই, বাজেটের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের কোন অসুবিধা নেই!
আমি বর্তমান সরকারের বাজেটের যে সমালোচনা এখানে করছি ও যেভাবে করছি এটা লব্ধপ্রতিষ্ঠ অর্থনীতিবিদ, সিভিল সোসাইটির হƒষ্টপুষ্ট ভদ্রলোক, শিল্প ব্যবসায়ী শ্রেণীর নেতৃবৃন্দ প্রভৃতির দৃষ্টিতে ঁহড়ৎঃযড়ফড়ী বা গতানুগতিক বাজেট আলোচনার স্টাইলবহির্ভূত। এতে কোন সন্দেহ নেই। কারণ এটা করা হ”েছ সম্পূর্ণ অন্য দৃষ্টিকোণ থেকে, অন্য দৃষ্টিভঙ্গিতে। এ প্রসঙ্গে প্রথমেই বলা দরকার যে, সংসদে বাজেট পেশ করার পর উপরোক্ত গণ্যমান্য ব্যক্তি, সমাজপতি, অর্থনীতিবিদ, ব্যাংকার প্রভৃতিরা যে সমালোচনা করেন, সেটা তারা করে থাকেন শতভাগ পুঁজিবাদী হিসেবে। পুঁজিবাদী ব্যব¯’া অটুট রাখা ও তা আরও সুসংহত করার লক্ষ্য সামনে রেখেই তারা অর্থমন্ত্রীর নানা বাজেট প্রস্তাবে বন্ধুপ্রতিম সমালোচনা করে থাকেন। সে ধরনের সমালোচনার মধ্যে যাওয়ার প্রয়োজন আমাদের নেই।
অর্থমন্ত্রীর বাজেটে দরিদ্র শ্রমজীবী জনগণের ওপর অর্থনৈতিক চাপ বৃদ্ধির সব রকম ব্যব¯’াই রাখা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে প্রথমেই উল্লেখ করা যেতে পারে মূল্যবৃদ্ধি ও মজুরি অপরিবর্তিত রাখার কথা। প্রথমত, বাংলাদেশে বেকারের সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পা”েছ। বাজেটে কর্মসং¯’ানের যে কথা বলা হয়েছে তার বেশিটাই ভুয়া। কাগজে-কলমে কর্মসং¯’ান বৃদ্ধির যে কথা বলা হয়েছে তার সঙ্গে বাস্তবতার কোন সম্পর্ক নেই। তাছাড়া এই কর্মসং¯’ানের অধিকাংশই ¯’ায়ী নয়, সাময়িক। বছরের বেশি সময়টাই এই ‘কর্মরত’ শ্রমিকরা বেকার থাকতে বাধ্য হন। দ্বিতীয়ত, যারা মোটামুটি ¯’ায়ী শ্রমিক হিসেবে কল-কারখানায় কাজ করেন তাদের মজুরি বাজারদরের পরিপ্রেক্ষিতে অতি সামান্য। ঘর ভাড়া, খাওয়া ইত্যাদির খরচও এই মজুরি দিয়ে চালানো যায় না। এ পরি¯ি’তিতে তাদের সন্তানদের শিক্ষার কোন ব্যব¯’া নেই। মজুরি নির্ধারণের সময় শিক্ষা, চিকিৎসা খাতে যা প্রয়োজন সেটা থাকে বিবেচনার বাইরে। যারা এখন মাসে তিন থেকে পাঁচ হাজার টাকা মজুরি পান তারা ঘর ভাড়া, খাওয়ার খরচ দিয়ে সন্তানদের শিক্ষা ও নিজেদের পরিবারের চিকিৎসা ব্যয় কীভাবে মেটাবেন তার কোন ব্যব¯’া বাজেটে নেই। এরা ধরেই নিয়েছেন, এদের শিক্ষা ও চিকিৎসার কোন প্রয়োজন নেই!
দেশে স্কুলের সংখ্যা বৃদ্ধির কথা বাজেটে রাখা হয়েছে। কিš‘ বাস্তবত দেখা যাবে যে, এ সংখ্যা বৃদ্ধি সত্ত্বেও স্কুলগুলোতে শিক্ষার তেমন কোন ব্যব¯’া নেই। স্কুলের ঘরবাড়ি নির্মাণের একটা ফিরিস্তও এতে দেয়া হয়েছে, কিš‘ দেখা যাবে এর অধিকাংশই প্রকৃতপক্ষে ভুয়া ব্যাপার। শুধু তাই নয়, প্রাথমিক-মাধ্যমিক শিক্ষকদের বেতনের পরিমাণ যা, তাতে তাদের পক্ষে সু¯’ ও নিশ্চিত হয়ে ছাত্রদের শিক্ষা দেয়া সম্ভব নয়। এ জন্য শিক্ষকরা দফায় দফায় আন্দোলন করেও কতগুলো মিথ্যা প্রতিশ্র“তি ছাড়া সরকারের কাছ থেকে কিছুই পাননি। তাদের জন্য এ বাজেটে কোন সং¯’ানও নেই। ঝরে পড়া ছাত্রদের আটকে রাখার জন্য স্কুলে থাকা অব¯’ায় খাওয়ার যে ব্যব¯’ার কথা বলা হয়েছে তা কতখানি কার্যকর সেটা দেখার কেউ নেই। কাজেই এ কর্মসূচির ক্ষেত্রে খাজনার থেকে বাজনা অনেক বেশি। চুরি, দুর্নীতি এ ক্ষেত্রে কারা করে সেটা দেশের লোকের অজানা নয়। প্রত্যেক বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনার সুযোগ এখানে নেই, কিš‘ একটি বিষয়ের উল্লেখ অবশ্যই করা দরকার। কারণ, শিক্ষা বিষয়ে সরকারের এবং তার অর্থমন্ত্রীর শিক্ষা সম্পর্কিত দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় এর মধ্যে ভালোভাবেই পাওয়া যায়। মন্ত্রী তার বাজেট বক্তৃতায় বলছেন, ‘আমরা বিশেষ গুর“ত্ব দি”িছ বৃত্তিমূলক ও কারিগরি শিক্ষার প্রসারের ওপর, আন্তর্জাতিক বাজারে রফতানি উপযোগী দক্ষ জনশক্তি তৈরির ওপর।’ যে কোন দেশ থেকে লোক অন্য দেশের শ্রমবাজারে প্রবেশ করতে পারে। এর মূল কারণ দেশে উপযুক্ত বা কোন ধরনের কর্মসং¯’ান না থাকা। কিš‘ এ প্রক্রিয়াকে শিক্ষার সঙ্গে সম্পর্কিত করে তাকে ‘বিশেষ গুর“ত্ব’ দেয়ার ব্যাপার বাংলাদেশ ছাড়া অন্য কোন দেশে আছে বলে জানা নেই। রফতানির উদ্দেশ্যে শিক্ষা ব্যব¯’া!! এর থেকে আজগুবি শিক্ষানীতি আর কী হতে পারে? বাজেটে কর্মসং¯’ান সৃষ্টির ওপর অনেক লম্বা-চওড়া কথা বলা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে এ কর্মসং¯’ান বৃদ্ধি আসলে দেশের থেকে বিদেশেই বেশি হয়েছে। বিদেশে কর্মরত এ শ্রমিকরাই বাংলাদেশে বৈদেশিক মুদ্রায় বছরে ১ হাজার ২০০ কোটি ডলারের জোগান দিয়ে থাকেন! এদের অধিকাংশই অদক্ষ শ্রমিক। এর সঙ্গে আরও বেশিসংখ্যক দক্ষ শ্রমিককে বিদেশে রফতানি করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনই বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রীর বাজেটে শিক্ষা ক্ষেত্রে অতি গুর“ত্বপূর্ণ ¯’ান অধিকার করে আছে।
বাংলাদেশে এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশিত হওয়ার সময়ে দেখা যায়, রাজধানী ঢাকাসহ কয়েকটি বড় শহরের কিছু ব্যয়বহুল স্কুলের ছেলেমেয়েরাই পরীক্ষায় সব সময় ভালো ফল করে। পত্রপত্রিকায় এ ভালো ফল অর্জনকারী ছাত্রছাত্রীদের লাফালাফির ছবি প্রত্যেক বছরেই দেখা যায়। যে সব স্কুলে শতভাগ ছাত্র পরীক্ষা পাস করে সেগুলো এ ধরনেরই স্কুল। যে সব স্কুলে পরীক্ষার ফল খুব খারাপ হয় এবং শতভাগ ছাত্র ফেল করে সেগুলো গ্রামাঞ্চলে অব¯ি’ত। গরিবদের সন্তানরাই সেগুলোতে পড়াশোনা করে। এর থেকেই বোঝা যায় বাংলাদেশের সামগ্রিক শিক্ষা ব্যব¯’ার শ্রেণীচরিত্র কতখানি প্রকট। শিক্ষাসুবিধা যেটুকু আছে তার প্রায় সবটাই ভোগ করে থাকে মধ্যবিত্ত, উ”চমধ্যবিত্ত ও ধনিক পরিবারের সন্তানেরা। এর কোন পরিবর্তনের ব্যব¯’া বাজেটে নেই। শিক্ষা সংস্কার বিষয়ে অনেক কথা বলা হলেও তা এ ক্ষেত্রে একেবারেই অপ্রাসঙ্গিক।
চিকিৎসা ক্ষেত্রে পরি¯ি’তি আরও ভয়াবহ। কাগজে-কলমে ও মন্ত্রীর বাজেটে স্বা¯’্যসেবা বিষয়ে অনেক গালভরা কথা থাকলেও এবং এগুলোর সংখ্যা বৃদ্ধি ইত্যাদি বিষয়ে অনেক কথা বলা হলেও আসলে সারা বাংলাদেশে গরিবদের এবং অল্প আয়ের লোকদের চিকিৎসার কোন ব্যব¯’া নেই বললেই চলে। গ্রামাঞ্চলের স্বা¯’্য কেন্দ্রগুলোতে চিকিৎসকরা নিয়মিত উপ¯ি’ত থাকেন না। ওষুধপত্র কিছুই পাওয়া যায় না। একমাত্র ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন ছাড়া চিকিৎসার জন্য যা কিছু প্রয়োজন তার সব কিছুর জন্যই টাকা দিতে হয়। শুধু যে গ্রামাঞ্চল ও মফস্বল শহরের কথা তা নয়, ঢাকা শহরেও একই অব¯’া। ভর্তি হলে ইউজার ফি দিতে হয়। তবু এখনও পর্যন্ত ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালেই বিনা পয়সায় ও অল্প খরচায় কিছু চিকিৎসার ব্যব¯’া আছে। এর আগে পিজি হাসপাতালে যে বিনা খরচায় মেডিসিন ও ডাক্তারের প্রেসক্রিপশনের ব্যব¯’া ছিল সেটা এখন উঠিয়ে দিয়ে এই সরকারি হাসপাতালের ডাক্তাররা বিকালের দিকে ২০০ টাকা ফি নিয়ে রোগীদের প্রেসক্রিপশন দেন! ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ প্রতিটি সরকারি মেডিকেল কলেজকে এখন বিশ্ববিদ্যালয় করে হসপাতালগুলোর অব¯’া পিজি হাসপাতালের মতো করার ব্যব¯’াই হ”েছ। এ বিষয়ে অর্থমন্ত্রীর স্বা¯’্যবিষয়ক কর্মসূচির মধ্যে কিছুই বলা নেই। এ সব কাজ বাজেটের বাইরে থেকেই নানা কলকাঠি নেড়ে করা হয়। বাস্তবত বাংলাদেশে গরিবের এবং স্বল্প আয়ের লোকের চিকিৎসার ব্যব¯’া শোচনীয়। যে কোন হাসপাতালে গেলেই এটা দেখা যায়। অন্যদিকে ডাক্তাররা নিজেদের ফি বাড়িয়ে, ওষুধ কোম্পানিগুলো ওষুধের দাম বাড়িয়ে এবং বেসরকারি ক্লিনিক ও হাসপাতালগুলো নিজেদের ফি আকাশচুম্বী করে এমন অব¯’া করেছে যাতে এ সব চিকিৎসা কেন্দ্রে ভর্তি হলে কোনমতে প্রাণ নিয়ে বের হয়ে আসতে পারলেও সর্বস্বান্ত হতে হয়। এ হাসপাতালগুলোর ওপর সরকারের কোন নিয়ন্ত্রণ নেই। এ বিষয়ে বাজেটে কোন কথা নেই। না থাকারই কথা। কারণ অর্থমন্ত্রী এবং তাদের মতো লোকেরা তো দেশে চিকিৎসাই করেন না। তারা সামান্য সামান্য কারণেই ব্যাংকক, সিঙ্গাপুর, সৌদি আরব, আমেরিকা যান। তাদের যেমন টাকা-পয়সা আমদানির হিসাব নেই, তেমনি খরচেরও হিসাব নেই!
এ সব বিষয় বিবেচনা করলে দেখা যাবে যে, এই বাজেটে প্রবৃদ্ধি, জনকল্যাণ ইত্যাদি বিষয়ে অনেক কিছু বলা হলেও গরিব ও মধ্যবিত্তের জন্য কিছুই নেই। তবে তাদের গাঁট কাটার ব্যব¯’া পুরোদ¯‘র আছে। এই গাঁট কাটার ব্যব¯’া করা হয়েছে পরোক্ষ কর আদায়ের মাধ্যমে। হাজার রকম জিনিসের ওপর যেভাবে ভ্যাট বসানো হয়েছে তার টাকা শেষ পর্যন্ত ক্রেতাদেরই দিতে হয়। পরোক্ষ করের বোঝা যে গরিব ও নিুআয়ের লোকদেরই বহন করতে হয়, এটা কে না জানে। বাংলাদেশে মোবাইল ফোনসেট আছে ৯ কোটির মতো। ১৫ কোটি জনসংখ্যার দেশে মোবাইল ফোনসেটের সংখ্যা ৯ কোটি হলে সেটার বিপুল অধিকাংশ ব্যবহারকারী যে সাধারণ লোক, গরিব ও মধ্যবিত্ত এতে সন্দেহ নেই। এই মোবাইল ফোন ব্যবহারকারীদের রিচার্জ করার সময় কর দিতে হবে শতকরা দুই টাকা এবং প্রত্যেক কলের জন্যও দিতে হবে পৃথক কর! সাধারণ লোকের পকেট এভাবে মেরে অর্থমন্ত্রী নাকি জ্বালানি বাবদ খরচের সং¯’ান করবেন! এ কাজ যে গরিবের স্বার্থরক্ষকদের নয়, তাদের দুশমনদেরÑ এ নিয়ে তর্কের কিছু নেই। এর বির“দ্ধে চারদিকে বেশ তীব্র প্রতিক্রিয়া হয়েছে। এ প্রতিক্রিয়া দেখে সাংবাদিকদের সামনে অর্থমন্ত্রী বলেছেন, এটা তিনি ভাবতেও পারেননি!! ভাবতে পারবেন কীভাবে? জনগণের থেকে কতখানি বি”িছন্ন হলে কোন সরকারের অর্থমন্ত্রী এ কথা বলতে পারেন, এটা বোঝা কঠিন নয়।
এ আলোচনা সংক্ষেপ করার জন্য এবার অন্য এক প্রসঙ্গে আসা দরকার। অর্থ ও পরিকল্পনা কমিশন থেকে বলা হয়েছে যে, এবারে সামরিক খাতে বাজেটে ব্যয় বরাদ্দ বেশি রাখা হয়েছে। বাজেটে ঠিক কত হাজার কোটি রাখা হয়েছে তার কোন হিসাব নেই। তবে বলা হয়েছে, এবার সামরিক বাহিনীর আধুনিকীকরণের জন্য যুদ্ধবিমান, যুদ্ধ নৌজাহাজসহ বিভিন্ন সামরিক সরঞ্জাম ও অস্ত্র কেনা হবে। এর কারণ, বাংলাদেশের প্রতিরক্ষাশক্তি বাড়ানো দরকার দেশকে বাইরের আক্রমণ প্রতিরোধ করার জন্য! এর থেকে ফাঁকা, অর্থহীন এবং প্রতারণামূলক কথা কী হতে পারে? কোন দেশের বির“দ্ধে এই প্রতিরক্ষা ব্যব¯’া? ভারত এ দেশ আক্রমণ করবে, এ সম্ভাবনা সামনে রেখে এই ব্যব¯’া? ভারত বাংলাদেশ আক্রমণ করবে, এ চিন্তা এক বড় আহাম্মকি ছাড়া আর কী? তাছাড়া ভারতের মতো পরাক্রমশালী সামরিক শক্তি যদি বাংলাদেশ আক্রমণ করে, তাহলে এখানকার প্রতিরক্ষা ব্যব¯’াকে তারা সাত দিনের মধ্যে ছাতু বানিয়ে দেবে। তাহলে কি আমাদের সম্ভাব্য দুশমন মিয়ানমার? তার সঙ্গে যুদ্ধের জন্যই এই বর্ধিত ব্যয় বরাদ্দ এবং যুদ্ধ সরঞ্জাম? নাকি এ তালিকায় নেপাল ও ভুটানও আছে? সব মিলিয়ে এই মিলিটারি বাজেট যে একেবারে অর্থহীন এবং সম্পূর্ণ অপচয়মূলক, এতে সন্দেহ নেই।
এ ক্ষেত্রে সব থেকে বড় কথা হল, দেশে যেখানে জিনিসপত্রের মূল্যহ্রাসের জন্য সর্বাÍক চেষ্টা দরকার, শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধি, গরিবদের আয় বৃদ্ধি, তাদের খাদ্য, শিক্ষা, চিকিৎসা ইত্যাদির সন্তোষজনক ব্যব¯’া দরকার, সেখানে এই সামরিক ব্যয় যে সম্পূর্ণ এক জনবিরোধী কাজ, এ নিয়ে বিতর্ক করবে কারা? যারা বিতর্ক করবে তাদের শ্রেণীচরিত্র কী?
সব শেষে এটা বলা দরকার যে, সামরিক বাজেট, তার কেনাকাটা ইত্যাদির মধ্যে যেহেতু কোন স্ব”ছতা নেই, কাজেই এ ক্ষেত্রে দুর্নীতির সুযোগ একেবারে অবাধ। এর আগে ফ্রিগেট, যুদ্ধবিমান ইত্যাদি কেনা নিয়ে অনেক মামলা হয়েছে; সে সব মামলা বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর আদালতকে দিয়ে খারিজ করিয়ে নেয়া হয়েছে। যা হোক, এই দুর্নীতির বিষয়টি বাদ দিয়েও এ কথা অবশ্যই বলা দরকার যে, দেশে জনগণের মৌলিক প্রয়োজন মেটানোর জন্য যখন পর্যাপ্ত অর্থসম্পদ নেই সে অব¯’ায় এভাবে সামরিক খাতে ব্যয় বরাদ্দ অবশ্যই বড় আকারে কমিয়ে আনা দরকার। এ কাজ না করলে এ সরকার জনগণের সরকার যে নয়, এ বিষয়ে সাধারণ মানুষেরও কোন সন্দেহ আর থাকবে, এটা মনে করার কারণ নেই।
১৬.৬.২০১২

বুধবার, ১৩ জুন, ২০১২

১৭০ আসনে আওয়ামী লীগের অবস্থা ভালো!


ব দ রু দ্দী ন উ ম র
সর্বনাশ যখন দোরগোড়ায় এসে কড়া নাড়ে তখন হুঁশ বলে আর কিছু থাকে না। আওয়ামী লীগের এখন হয়েছে সেই অবস্থা। কাজেই ১১ জুন ঢাকায় বিএনপির সমাবেশ ঠেকাবার জন্য যখন তারা ঢাকায় পুলিশ দিয়ে পরিবহন চলাচল জোর করে বন্ধ করে এবং বাইরে থেকে ঢাকায় আসা শত শত বাসের ঢাকা প্রবেশ পুলিশ দিয়ে আটকে রেখে ব্যাপকভাবে জনগণের গালাগালি খাচ্ছে, তখন তারা নিজেদের সংসদীয় দলের সভায় ঘোষণার মতো করে বলছে যে, আগামী ২০১৩ সালের নির্বাচনে তারা ১৭৫টি আসনে জয়লাভ করবে!
একটি সংবাদপত্র রিপোর্টে বলা হয়, ‘প্রধানমন্ত্রী সোমবার সংসদ ভবনে আওয়ামী লীগ সংসদীয় দলের পঞ্চদশ বৈঠকে নির্বাচনের প্রস্তুতি গ্রহণের জন্য সংসদ সদস্যদের নির্দেশ দিয়ে বলেন, নির্বাচিত হওয়ার মতো কাজ করুন। গণমুখী না হলে আগামী নির্বাচনে মনোনয়ন পাবেন না। আমার কাছে সবার খবর আছে। জরিপ রিপোর্টও রয়েছে। এ রিপোর্ট অনুযায়ী ২৫ জন সংসদ সদস্যের বিজয়ী হওয়ার সম্ভাবনা নেই। এরই মধ্যে তাদের ডেকে সেটা জানিয়ে দেয়া হয়েছে। ৩০ থেকে ৩৫ জন সংসদ সদস্য ঝুঁকিমুক্ত নন। আগামী দেড় বছরে এ সংখ্যা কমতেও পারে আবার বাড়তেও পারে। অন্য সদস্যরা ঝুঁকিমুক্ত। বর্তমান সংসদে আওয়ামী লীগের সদস্য সংখ্যা ২৩০। এর মধ্যে ২৫ জনের বিজয়ী না হওয়ার আশঙ্কা থাকলে বাদবাকি ২০৫ জন সম্ভাব্য বিজয়ের তালিকায় থাকবেন। এর মধ্যে কমপক্ষে ৩০ জন বিপদমুক্ত না হলে সম্ভাব্য বিজয়ীর তালিকায় থাকবেন ১৭৫ জন।’ (সমকাল ১২.৬.২০১২)
অন্য এক পত্রিকা রিপোর্টে বলা হয়েছে, গতকাল আওয়ামী লীগের সংসদীয় দলের সভায় শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমরা দলীয় সোর্স এবং গভর্নমেন্ট ইনটেলিজেন্স দিয়ে সার্ভে করিয়েছি, এখন আওয়ামী লীগের যে আসন রয়েছে, তার মধ্যে ৩০টির অবস্থা খুবই খারাপ। আরও ৩০টির অবস্থা ফিফটি ফিফটি। বাকি ১৭০টি আসনে আওয়ামী লীগের অবস্থা ভালো। তবে নির্বাচনের দেড় বছর বাকি রয়েছে, এ অবস্থার কমবেশি পরিবর্তন হতে পারে।’ (আমার দেশ, ১২.৬.২০১২)
এ দুই রিপোর্ট থেকেই দেখা যায় যে, কালো মেঘ যখন আওয়ামী লীগের ভবিষ্যেক অন্ধকারে ঢেকে ফেলেছে তখন সেই অন্ধকারের মধ্যেই বিজয়ের আলোক রশ্মি ছড়িয়ে আওয়ামী লীগের সুযোগ্য নেতৃত্ব বাতাসে ভাসছে!
সমকালের রিপোর্ট অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাদের সংসদ সদস্যদের উদ্দেশ করে বলেছেন, ‘নির্বাচিত হওয়ার মতো কাজ করুন। গণমুখী না হলে আগামী নির্বাচনে মনোনয়ন পাবেন না।’ নির্বাচিত হওয়ার মতো কাজ না করলে এবং গণমুখী না হলে তার সামনে বসা বশংবদ সংসদ সদস্যরা মনোনয়ন পাবেন না। এটা না হয় বোঝা গেল। কিন্তু মনোনয়ন পাওয়া ও নির্বাচনে জেতা তো এক জিনিস নয়। হাসিনা কি নিজেকে জিজ্ঞেস করেছেন যে, ১১ জুন তারিখে তিনি পুলিশ দিয়ে ঢাকায় যে হরতাল করেছেন এবং পুলিশ দিয়ে শুধু ঢাকা নয়, দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ঢাকা আসার ক্ষেত্রে যাত্রীদের জন্য যে দুর্ভোগ তৈরি করেছেন সেটা নির্বাচিত হওয়ার মতো কাজ, নির্বাচনে জয়লাভের মতো গণমুখী কাজ? বুদ্ধির দৌড় তো একেই বলে!
ক্ষমতায় আসার পর থেকে বর্তমান সরকার যেসব কাজ করে চলেছে তাতে তার জনসমর্থন দ্রুত কমে গেছে। ঢাকার করপোরেশন নির্বাচন তারা এ পর্যন্ত না করতে পারার কারণ এই নির্বাচনে জেতার কোনো সম্ভাবনা তাদের নিজেদের পক্ষ থেকেই দেখতে না পাওয়া। যাতে নির্বাচনে জেতা যায় এজন্য তারা নানা ল্যাংড়া যুক্তি দেখিয়ে ঢাকা সিটি করপোরেশনকে দুই ভাগ করে নির্বাচনের ঘোষণাও দিয়েছিল। কিন্তু তারপরও যখন তারা দেখল যে এ নির্বাচনে জেতার কোনো সম্ভাবনা নেই তখন তারা সেটা বন্ধ করল! ঢাকায় করপোরেশন নির্বাচন হলে আওয়ামী লীগ যে চরম আকারে পরাজিত হবে তাতে সন্দেহ নেই। শুধু করপোরেশন নির্বাচনই নয়, সাধারণ নির্বাচনেও ঢাকায় তাদের অবস্থা শোচনীয় হবে। কোনো একজন মনোনয়ন পাওয়া আওয়ামী লীগ প্রার্থীও এখানে জয়লাভ করবে না। শেখ হাসিনা নিজে দাঁড়ালেও তার পরাজয় একেবারে অবধারিত। ১৯৯১ সালে তিনি ঢাকায় দুটি আসনে নিজে পরাজিত হয়েছিলেন। ২০১৩ সালে তিনি যদি ঢাকায় প্রার্থী হন, তাহলে জয়ের সম্ভাবনা তো থাকবেই না, তারপরও তার জামানতের টাকা পর্যন্ত বাজেয়াপ্ত হবে। আগামী নির্বাচনে ঢাকা থেকে প্রার্থী হয়ে তিনি এখানে নিজের জনপ্রিয়তা যাচাই করতে পারেন।
শুধু ঢাকা নয়, সারাদেশে আওয়ামী লীগ এখন তার জনপ্রিয়তা যেভাবে হারিয়েছে, জনগণ তাদেরকে যেভাবে বাতিল করে বসে আছেন, তাতে আগামী নির্বাচনে সর্বসাকুল্যে তাদের পক্ষে ২০/২৫টি আসনে জয়লাভ করাও মুশকিল হবে। শেখ হাসিনা নিজেও যদি পরাজয়ের হাত থেকে রক্ষা পেতে চান তাহলে অবাস্তব চিন্তা বাদ দিয়ে তাকে ভালোভাবে যাচাই করে এমন এলাকায় দাঁড়াতে হবে যাতে তিনি নিজে কোনোমতে নির্বাচিত হতে পারেন। শেখ মুজিবের কন্যা বলে ভোটাররা তাকে আগামী নির্বাচনে আদরের সঙ্গে নির্বাচিত করবে এমন ভাবার কারণ নেই। এক্ষেত্রে তিনি কার জরিপের ওপর নির্ভর করবেন এটা এক বড় প্রশ্ন। কারণ উপরোক্ত দ্বিতীয় রিপোর্টটিতে আগামী নির্বাচন সম্পর্কে শেখ হাসিনা বলেছেন, নিজেদের দলীয় এবং সরকারি গোয়েন্দা সোর্স উভয়ের জরিপ রিপোর্টের ভিত্তিতেই তিনি তাদের নির্বাচন জয়ের তথ্য লাভ করেছেন! এই ‘তথ্য’ যদি তিনি সত্যিই পেয়ে থাকেন তাহলে সেটা সম্পূর্ণ ভ্রান্ত। এই ধরনের তথ্যের ওপর ভিত্তি করে তিনি যদি ২০১৩ সালে নিজের নির্বাচনী এলাকা বাছাই করেন তাহলে তার জয়লাভের বিষয়ে নিশ্চিত হওয়ার কিছু নেই। কিন্তু বুদ্ধি যেখানে সামান্য ও বিভ্রান্ত সেখানেই ঔদ্ধত্যের রাজত্ব। আওয়ামী লীগ এখন এই ঔদ্ধত্যের রাজত্ব এমনভাবে কায়েম করেছে যেখানে সুবুদ্ধি প্রবেশের দরজা কড়াকড়িভাবে বন্ধ। ১১ জুন আওয়ামী লীগের ঢাকা বন্ধ এবং সংসদ সদস্যদের সভা ও সেই সভায় শেখ হাসিনার বক্তব্যের থেকে এর বড় প্রমাণ আর কী আছে।
বিএনপি কোনো ফেরেশতাদের পার্টি নয়। তারা আওয়ামী লীগেরই ভগ্নিপ্রতিম দল। কিন্তু বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে বিএনপির জনপ্রিয়তা এখন আওয়ামী লীগের থেকে অনেক বেশি। তাদের এই জনপ্রিয়তা তাদের নিজেদের কোনো সত্ কর্মের ফল নয়। জনপ্রিয়তা তাদের বৃদ্ধি পেয়েছে এবং পাচ্ছে আওয়ামী লীগের ব্যাপক জনবিরোধী কার্যকলাপ ও তত্পরতার কারণে। অর্থাত্ কোনো ইতিবাচক কারণে নয়, নেতিবাচক কারণেই বিএনপি এখন জনপ্রিয় হয়েছে। এ কারণে স্বাধীন ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হলে ২০১৩ সালের নির্বাচনে বিএনপির খুব বড় আকারের জয়ের সম্ভাবনা। সেটা হলে আওয়ামী লীগের সভাপতি কথিত ‘পরাজিত শত্রুদের’ হাতেই আওয়ামী লীগ নির্বাচনে পরাজিত হয়ে সরকারি ক্ষমতা থেকে উত্খাত হবে। তবে এবার শুধু সরকারেরই পতন হবে না, রাজনৈতিক দল হিসেবেও আওয়ামী লীগে ধস নামবে।
১৩.৬.২০১২

মঙ্গলবার, ১২ জুন, ২০১২

'ঈশ্বর' ছাড়া এদেরকে রক্ষার কেউ নেই


বদরুদ্দীন উমর
সরকার এখন সভা-সমাবেশ-মিছিলের ওপর যেভাবে নিষেধাজ্ঞা জারি করে তা বন্ধ করার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা চালাচ্ছে এর মধ্যে তাদের শক্তি ও জনপ্রিয়তার কোনো পরিচয় নেই। যারা এ কাজ করে তারা স্বাভাবিকভাবে বিরোধিতার মোকাবেলা করতে পারে না এবং জনগণও এ কাজে তাদের সঙ্গে থাকে না। থাকার কারণ নেই। কারণ সরকার খোদ জনগণের কণ্ঠ রোধ করতেই আজ বদ্ধপরিকর। শাসন ব্যবস্থার মধ্যে শোষণ-নির্যাতন অল্পবিস্তর চলতে থাকলে তার প্রতিক্রিয়ায় শ্রমজীবী থেকে নিয়ে সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে যে ক্ষোভ তৈরি হয় তা বের হতে দেওয়াই রাজনৈতিক সুবুদ্ধি ও বিজ্ঞতার কাজ। কারণ এই ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ নানা বিধিনিষেধ ও পুলিশি কার্যকলাপের মাধ্যমে বন্ধ করার চেষ্টা করলেও সে ক্ষোভ কর্পূরের মতো কোথাও উবে যায় না

বাংলাদেশে র‌্যাব, পুলিশ ইত্যাদি সরকারি সশস্ত্র বাহিনীর শুধু শারীরিক নির্যাতন নয়, ক্রসফায়ারে হত্যার সঙ্গে সঙ্গে অপহরণ ও গুম-খুনের সংখ্যা এখন এত বৃদ্ধি পেয়েছে যা শুধু দেশের জনগণের মধ্যেই নয়, দেশের বাইরেও যথেষ্ট ভয়ভীতি এবং উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী হিসেবেই জনগণ নিজেদের ট্যাক্সের টাকা দিয়ে পুলিশ, র‌্যাব ইত্যাদি বাহিনীকে প্রতিপালন করেন। কিন্তু এই আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংগঠনগুলোর অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে, যে থালায় ভাত খায় সেই থালা ফুটো করার মতো। জনগণকে দুষ্কৃতকারীদের হাত থেকে রক্ষা করা যাদের দায়িত্ব তারাই যদি নিজেরা দুষ্কৃতকারীর ভূমিকায় নেমে জনগণের স্বার্থে কাজ করা লোকদের এবং সরকারবিরোধী যে কোনো লোককে অপহরণ ও হত্যা করে, তাহলে দেশে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক না থেকে যে দেশজুড়ে নৈরাজ্যিক পরিস্থিতি তৈরি হবে এতে সন্দেহ নেই। বাংলাদেশে এখন ঠিক তাই হয়েছে। এখানে একটা আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি আছে এবং তার ফলে চারদিকে আইনের শাসন বলতে বিশেষ কিছু নেই। কিন্তু এই পরিস্থিতি সরকারি আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংগঠনগুলোর দ্বারাই মূলত তৈরি হয়েছে। দেশে আজ অপরাধ ঠেকানোর প্রক্রিয়া একেবারে দুর্বল হয়ে পড়েছে এবং অপরাধ ঠেকানোর জন্য যারা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে নিযুক্ত হয়েছে তারাই এই পরিস্থিতি সৃষ্টির ক্ষেত্রে সব থেকে বড় ভূমিকা পালন করছে। কাজেই র‌্যাব, পুলিশ, মন্ত্রিসভা, আদালত সবকিছু থাকা সত্ত্বেও এদিক দিয়ে পরিস্থিতির উন্নতির পরিবর্তে চারদিকে দ্রুত অবনতি ঘটছে।
গত কয়েক মাসে অসংখ্য গুম ও হত্যাকাণ্ড ঘটেছে, যার মধ্যে কিছু চাঞ্চল্যকর ঘটনাও আছে। এসবের বিরুদ্ধে নানা ধরনের আন্দোলনও হচ্ছে। কিন্তু এর কোনো ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া সরকারের মধ্যে হচ্ছে এমন কোনো প্রমাণ এখন পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। এসব অপহরণ ও হত্যাকাণ্ডের মধ্যে একটি হলো গার্মেন্ট শ্রমিক নেতা আমিনুল ইসলামের অপহরণ ও হত্যা। গত ৪ এপ্রিল সন্ধ্যায় তাকে অপহরণ করা হয়। পরদিন ৫ এপ্রিল রাত পৌনে ৮টায় টাঙ্গাইল জেলার ঘাটাইল থানা পুলিশ ব্রাহ্মণশাসন মহিলা বিদ্যালয়ের প্রধান গেটের সামনের রাস্তা থেকে তার লাশ উদ্ধার করে। লাশের পরিচয় না পেয়ে টাঙ্গাইল থানা পুলিশ বেওয়ারিশ লাশ হিসেবে তাকে দাফন করে। ৭ এপ্রিল দৈনিক আমার দেশ পত্রিকায় ভেতরের পাতায় ছবিসহ রিপোর্টে বলা হয়, টাঙ্গাইল থানা পুলিশ অজ্ঞাত এক পুরুষের লাশ উদ্ধার করেছে। ছবি দেখে আমিনুল ইসলামের স্ত্রী অনুমান করেন, সেটা তার স্বামীর লাশ। এরপর তিনি টাঙ্গাইল থানায় যোগাযোগ করেন এবং লাশটি টাঙ্গাইল থেকে তুলে এনে তাদের গ্রামের কবরস্থানে দাফন করা হয়। টাঙ্গাইলে লাশের প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, লাশটির সর্বত্র নানা ধরনের নিষ্ঠুর নির্যাতনের চিহ্ন তারা দেখেছেন। অর্থাৎ আমিনুল ইসলামকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হয় (আমার দেশ, ১০.৬.২০১২)।
মানবাধিকার সংগঠন 'অধিকার'-এর রিপোর্টে বলা হয়েছে, তারা যে তদন্ত করেছেন তার থেকে বোঝা যায় যে, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীই আমিনুলকে ধরে নিয়ে গিয়ে হত্যা করেছে। এ ব্যাপারে তারা পূর্ণ তদন্তেরও দাবি করেছেন। (ঐ) আমিনুল ইসলামের এই হত্যাকাণ্ড বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ এ কারণে যে, প্রায় নেতৃত্ববিহীন গার্মেন্ট শ্রমিকদের তিনি ছিলেন একজন উল্লেখযোগ্য নেতা। কাজেই গার্মেন্ট শ্রমিকদের মধ্যে যাতে কোনো বড় ধরনের আন্দোলন না হয় তার জন্যই তারা এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। কিন্তু শুধু হত্যাকাণ্ডই তারা ঘটায়নি, তারা কত প্রতিহিংসাপরায়ণ এর প্রমাণও তারা রেখেছে হত্যার পূর্বে তাকে নিষ্ঠুরভাবে নির্যাতন করে।
বর্তমান সরকার কার বুদ্ধি-পরামর্শে চলছে বোঝা মুশকিল। মনে হয়, তারা নিজেদের বুদ্ধি-পরামর্শ দ্বারাই চালিত হচ্ছে এবং নিজেদের সর্বনাশের ব্যবস্থাও নিজেরাই করছে। একদিকে সরকারি লোকদের চরম দুর্নীতি এবং এর জন্য শাস্তির হাত এড়িয়ে চলার নিশ্চয়তার কারণে ঘুষ, দুর্নীতি, কালোবাজারি ও তার প্রয়োজনে সাধারণভাবে সন্ত্রাসের অভূতপূর্ব প্রয়োজন অপরাধ জগতের মধ্যেই সৃষ্টি হয়েছে। এ কারণে সরকারি কাঠামোর বাইরেও চলছে চরম দুর্নীতি, সন্ত্রাস ও হত্যাকাণ্ড। অন্যদিকে সরকার এসবের বিরুদ্ধে সবরকম প্রতিরোধ এবং আন্দোলন দমন করতে বদ্ধপরিকর হয়ে দেশের জনগণের নিম্নতম মতপ্রকাশের ও ক্ষোভ প্রকাশের স্বাধীনতাও হরণ করে বসে আছে। এর ফলে সমাজে ঘুষ, দুর্নীতি, প্রতারণা, সন্ত্রাস, রাহাজানি, জমি ও জায়গা দখল ইত্যাদি অপরাধ ঘটতে থাকা সত্ত্বেও তার কোনো প্রতিকার বা প্রতিরোধ এখন নেই। যাকে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বলা হয় তার কাজও হয়ে দাঁড়িয়েছে উল্টো। তাদের কার্যকলাপ এদিক দিয়ে এত জনবিরোধী যে, জনগণের ট্যাক্সের টাকায় প্রতিপালিত এই সংস্থাগুলোকে নেমকহারাম ছাড়া অন্য কিছু বলার উপায় নেই।
সরকার এখন সভা-সমাবেশ-মিছিলের ওপর যেভাবে নিষেধাজ্ঞা জারি করে তা বন্ধ করার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা চালাচ্ছে এর মধ্যে তাদের শক্তি ও জনপ্রিয়তার কোনো পরিচয় নেই। যারা এ কাজ করে তারা স্বাভাবিকভাবে বিরোধিতার মোকাবেলা করতে পারে না এবং জনগণও এ কাজে তাদের সঙ্গে থাকে না। থাকার কারণ নেই। কারণ সরকার খোদ জনগণের কণ্ঠ রোধ করতেই আজ বদ্ধপরিকর। শাসন ব্যবস্থার মধ্যে শোষণ-নির্যাতন অল্পবিস্তর চলতে থাকলে তার প্রতিক্রিয়ায় শ্রমজীবী থেকে নিয়ে সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে যে ক্ষোভ তৈরি হয় তা বের হতে দেওয়াই রাজনৈতিক সুবুদ্ধি ও বিজ্ঞতার কাজ। কারণ এই ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ নানা বিধিনিষেধ ও পুলিশি কার্যকলাপের মাধ্যমে বন্ধ করার চেষ্টা করলেও সে ক্ষোভ কর্পূরের মতো কোথাও উবে যায় না। তা জমতে থাকে। যেহেতু নিয়মিতভাবে এই ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশের পথ খোলা থাকে না, সে কারণে তা সময়ে সকল নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে সামাজিক ও রাজনৈতিক শক্তির বাঁধ ভেঙে সব প্রতিবন্ধক উড়িয়ে দেয়। এর ফলে সরকারের পতন তো ঘটেই, উপরন্তু বিশেষ ঐতিহাসিক পরিস্থিতিতে পুরো শাসন ব্যবস্থাই উচ্ছেদ হয়। অদূর ভবিষ্যতেই দেখা যাবে যে, বাংলাদেশ এদিক দিয়ে কোনো ব্যতিক্রম নয়।
বর্তমানে সরকার কর্তৃক যে ব্যাপক নির্যাতন জারি আছে, তার মধ্যে রাজনৈতিকভাবে সব থেকে বড় প্রতিরোধের শর্ত তৈরি হয় সভা-সমাবেশ-মিছিল ইত্যাদি নিষিদ্ধ করা এবং সে নিষেধ অমান্য করলে সভা-সমাবেশ ও মিছিলে লাঠিচার্জ, কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ ও গুলি চালনা করা। বাংলাদেশে এখন এটাই পুরোদমে চলছে। সরকার যতই জনবিচ্ছিন্ন হচ্ছে, জনগণের মধ্যে এর সমর্থন ও জনপ্রিয়তা যত কমছে ততই তারা অধিকতর প্রতিহিংসাপরায়ণ ও হিংস্র হচ্ছে। জনগণকে প্রতিপক্ষ মনে করে তাদের ওপরই নিজেদের শক্তি প্রয়োগ করছে! এটা হলো যে ডালে তারা বসে আছে সেই ডালটি কাটার ব্যবস্থা। অদূর ভবিষ্যতে তারা এই পরিণতির দিকেই এগিয়ে যাচ্ছে। 'ঈশ্বর' ছাড়া এই পরিস্থিতি থেকে তাদের রক্ষা করার আর কেউ নেই!
১১.৬.২০১২

শনিবার, ৯ জুন, ২০১২

মার্কিন দেশরক্ষা সচিব প্যানেট্টার ঔদ্ধত্য


ব দ র“ দ্দী ন উ ম র
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একটি লুণ্ঠনজীবী সাম্রাজ্যবাদী দেশ হিসেবে কতখানি বেপরোয়া হয়েছে তার সাম্প্রতিকতম দৃষ্টান্ত হ”েছ, ৭ জুন কাবুলে মার্কিন দেশরক্ষা সচিব প্যানেট্টার এই বক্তব্য যে, পাকিস্তানের ব্যাপারে তাদের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে পড়ছে! অন্য একটি দেশ সম্পর্কে এ ধরনের বক্তব্য যে চরম ঔদ্ধত্যপূর্ণ, এতে সন্দেহ নেই। পাকিস্তানও এই ঔদ্ধত্যের বির“দ্ধে প্রতিবাদ করেছে। কিš‘ ব্যাপারটা কী? কেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ধৈর্যের বাঁধ এভাবে ভেঙে পড়ছে? এর কারণ নাকি এই যে, পাকিস্তান-আফগানিস্তান সীমান্তে অব¯ি’ত হাক্কানি সন্ত্রাসীরা সীমান্ত পার হয়ে এসে আফগানিস্তানে মার্কিন সামরিক ঘাঁটির ওপর আক্রমণ চালা”েছ! কিš‘ কীভাবে তারা এটা চালা”েছ? মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ ন্যাটোর দেড় লাখেরও বেশি সৈন্য এখনও আফগানিস্তানে সে দেশের ‘স্বাধীনতা রক্ষা’র জন্য অব¯’ান করছে!!
এই ‘স্বাধীনতা রক্ষাকারীরা’ যদি পার্শ্ববর্তী দেশ থেকে বেসরকারি সন্ত্রাসী নামে আখ্যায়িত কিছু সন্ত্রাসীর আফগানিস্তানে প্রবেশ এবং তাদের ওপর আক্রমণ প্রতিহত ও বন্ধ করতে না পারে তাহলে তারা আফগানিস্তানে বসে কী করছে? তারা কয়েক দিন অন্তর সব আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করে আফগানিস্তানে তাদের সামরিক ঘাঁটি থেকে ড্রোন বা চালকবিহীন উড়োজাহাজ পাকিস্তান সীমান্তের ওপর ওয়াজিরিস্তানে হাক্কানি ‘সন্ত্রাসীদের’ নির্মূল করার জন্য বোমাবর্ষণ করছে। এই ক্রিমিনাল আক্রমণের ফলে পাকিস্তানের সীমান্তবর্তী অঞ্চলে মার্কিন বিমান হামলায় হাজার হাজার নারী-বৃদ্ধসহ নিরীহ মানুষ নিহত ও আহত হ”েছন। অন্য দেশের সার্বভৌমত্ব সম্পূর্ণ লঙ্ঘন করে, সে দেশের অভ্যন্তরে সামরিক হামলা চালিয়ে যারা নিরপরাধ জনগণকে হত্যা করে, গণহত্যা চালায় তারা অপরাধী তো বটেই, কিš‘ সেই সঙ্গে চরম অপদার্থও বটে। তাদের হাতে বিশ্বের সব থেকে ব্যয়বহুল ও সব থেকে মারাÍক অস্ত্র আছে, কিš‘ এসব নিয়েও কোন প্রকৃত যুদ্ধ ক্ষমতা তাদের নেই। মারাÍক অস্ত্র নিয়ে যারা জনগণের বির“দ্ধে যুদ্ধে জিততে পারে না তারা কাপুুর“ষ ছাড়া আর কী? মার্কিন দেশরক্ষা সচিব কাবুল সফরে গিয়ে সেখানে তাদের ধৈর্যের বাঁধ ভাঙার যে বক্তৃতা দিয়েছেন তার মধ্যে ঔদ্ধত্য আছে ঠিক, কিš‘ সে ঔদ্ধত্য কোন প্রকৃত শক্তিমানের ঔদ্ধত্য নয়। সে ঔদ্ধত্য এমন ধরনের যা অক্ষম কাপুর“ষের লম্ফঝম্পের মধ্যেই দেখা যায়।
যে হাক্কানি সন্ত্রাসীদের কথা বলে প্যানেট্টা তার অধৈর্য প্রকাশ করেছেন, তারা বিগত এপ্রিলে ১৮ ঘণ্টা ধরে রাজধানী কাবুল শহরের ওপর আক্রমণ পরিচালনা করেছিল। সেই হাক্কানিরাও কি পাকিস্তান থেকে সীমান্ত পার হয়ে গিয়ে এ কাজ করেছিল? আফগানিস্তানে কি হাক্কানিরা নেই? তা ছাড়া এ হাক্কানিদের আদর্শিক চিন্তাধারা যতই প্রতিক্রিয়াশীল হোক, মার্কিনিদের বিরোধিতা তারা কেন করছে? মার্কিনের সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের বির“দ্ধে, তাদের দেশের সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘন করে সামরিক তৎপরতার বির“দ্ধে তারা যা করছে সেটা কি সন্ত্রাসী কাজ, না দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব দেশ ও জনগণের শত্র“দের হাত থেকে রক্ষার কাজ? অন্য দেশের ওপর রাষ্ট্রীয় সামরিক হামলা করলে সেটা সন্ত্রাসী হয় না, কিš‘ নিজেদের দেশকে অন্য রাষ্ট্রের সামরিক হামলা প্রতিরোধের জন্য সামরিক শক্তি ব্যবহার করলে সেটা হয় সন্ত্রাসী? এটাই হল মার্কিনসহ ন্যাটো সাম্রাজ্যবাদীদের ‘সন্ত্রাসের’ সংজ্ঞা। এ সংজ্ঞা অনুযায়ী তারা দেশে দেশে অনেক স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার সংগ্রামে নিযুক্ত সংগঠনকে সন্ত্রাসী আখ্যায় দিয়ে সে সব দেশে প্রবেশ করছে।
এর থেকে বড় কথা হল, তারা প্রায়ই নিজেদের সাম্রাজ্যবাদী লক্ষ্য-উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য অন্য দেশে অর্থ, অস্ত্র, এমনকি কূটনৈতিক সহায়তা দিয়ে সন্ত্রাসী সংগঠন খাড়া করে ভেতর থেকে সে সব দেশ ধ্বংসের চক্রান্ত করে। এর অতি সাম্প্রতিক দৃষ্টান্ত হ”েছ লিবিয়া। এখন সিরিয়ায়ও তারা একই খেলা শুর“ করেছে। এর পরিণামে তারা সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধ বাধাবে এবং জাতিসংঘকে কোনভাবে ব্যবহার করে অথবা ইরাকের ক্ষেত্রে যেমন করেছিল, জাতিসংঘের কোন অনুমতি ছাড়াই তাকে ডিঙিয়ে সিরিয়া আক্রমণ ও দখল করবে। এই আন্তর্জাতিক সন্ত্রাস ও দস্যুবৃত্তিকে শাস্তি দেয়ার এমনকি প্রতিহত করার মতো কোন শক্তি এখন নেই। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর এরাই এখন একমাত্র পরাশক্তি, বিশ্বের সব থেকে পরাক্রমশালী দেশ এবং ক্ষমতামদমত্ত অব¯’ায় সম্পূর্ণ বেপরোয়া।
এবার আসা যেতে পারে প্যানেট্টা কর্তৃক ধৈর্যের বাঁধ ভাঙার মূল কারণ সম্পর্কে। ওসামা বিন লাদেনকে পাকিস্তানের ভেতরে এসে পাকিস্তানের সম্পূর্ণ অগোচরে হত্যা করে তার লাশ নিয়ে চোরের মতো পলায়ন করার পর থেকে পাকিস্তানের সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের অবনতি হতে শুর“ করে। এ ঘটনার আগে বেলুচিস্তানের মার্কিন সামরিক বিমান ঘাঁটি থেকে তাদের ড্রোনগুলো উড়ে গিয়ে ওয়াজিরিস্তানে বোমাবর্ষণ করছিল। ওসামাকে হত্যা ও তার লাশ নিয়ে যাওয়ার পর পাকিস্তান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে বেলুচিস্তানে তাদের সামরিক বিমান ঘাঁটি বন্ধ করতে নির্দেশ দেয় এবং তিনদিনের মধ্যে সেখান থেকে তাদের বিদায় করে অর্থাৎ তাড়িয়ে দেয়! পাকিস্তানের মতো মার্কিনের ওপর নির্ভরশীল ও তাদের পা-চাটা একটি দেশ এ কাজ করতে পারে, এ ঘটনার আগে সেটা ছিল চিন্তার বাইরে। তবে শুধু এ একটি কারণেই এটা ঘটেনি। উভয়ের সম্পর্কের অবনতির অন্য কারণও ছিল। তবু বিন লাদেনের ঘটনার সূত্র ধরেই এটা ঘটে। এ ছাড়া মার্কিনবিরোধী কাজের আরও বড় দুর্নীতি পরে দেখা গেল। গত নভেম্বরে আফগানিস্তান থেকে উড়ে এসে মার্কিন ড্রোন বিমান পাকিস্তানের অভ্যন্তরে আক্রমণ চালিয়ে ২৪ জন পাকিস্তানি সৈন্য হত্যা করে। এ ঘটনার পরই পাকিস্তানও তাদের সীমান্ত দিয়ে আফগানিস্তানে মার্কিনসহ পুরো ন্যাটো বাহিনীর সরবরাহ লাইন বন্ধ করে দেয়! মধ্য এশিয়ায় নানা ঝামেলা এবং সেটা অধিকতর ব্যয়বাহুল্যের কারণে প্রধানত করাচি নৌবন্দর ও পাকিস্তান সীমান্ত দিয়ে অস্ত্রসহ সব রকম সামরিক সরঞ্জাম সরবরাহ লাইন ব্যবহার করা হ”িছল। এ লাইন বন্ধ করায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বড় রকম অসুবিধায় পড়েছে। কিš‘ পাকিস্তান ছয় মাস ধরে এ লাইন তাদের জন্য খুলছে না। তাদের দাবি বেশি হয়তো নয়। তারা শুধু বলেছে, এর জন্য মার্কিনসহ ন্যাটোকে এ হামলা ও হত্যার জন্য পাকিস্তানের কাছে ক্ষমা চাইতে হবে। কিš‘ তারা এই সামান্য কাজ পর্যন্ত করতে নারাজ!! তাদের অহমিকা এবং ঔদ্ধত্য কত আকাশচুম্বী ও সম্পূর্ণ যুক্তিহীন, এর থেকেই সেটা বোঝা যায়। তারা অন্য দেশে সন্ত্রাসী হামলা চালিয়ে হত্যাযজ্ঞ চালানোসহ নানা অপকীর্তি করেও এর জন্য ক্ষমা চাওয়ার প্রয়োজন পর্যন্ত মনে করে না। কারণ তাদের ধারণা, পাকিস্তান যেহেতু তাদের ওপর নির্ভরশীল সে কারণে তারা সে দেশে যা ই”ছা তা-ই করতে পারে। কিš‘ পাকিস্তানের ভূমি বাস্তবতা (মৎড়ঁফ ৎবধষরঃু) সম্পর্কে তাদের কোন ধারণা নেই। অথবা তাদের গোয়েন্দা বিভাগ এ বিষয়ে তাদের অবহিত করলেও তারা এটা পরোয়া করে না ঔদ্ধত্যের কারণে। এই ভূমি বাস্তবতা হল, পাকিস্তানি জনগণের মার্কিন বিরোধিতা। বলা যেতে পারে যে, বর্তমান মুহূর্তে পাকিস্তানের জনগণের থেকে মার্কিনবিরোধী জনগণ বিশ্বের আর কোথাও নেই। পাকিস্তান সরকার যে আজ মার্কিনের ওপর নিজেদের অনেক ধরনের নির্ভরশীলতা থাকলেও মার্কিনিদের বির“দ্ধে অব¯’ান গ্রহণ করছে তার কারণ এই ভূমি বাস্তবতা। পাকিস্তানই এটা প্রমাণ করছে যে, জনগণ সাম্রাজ্যবাদের বিরোধী হলে শাসক শ্রেণী যতই সাম্রাজ্যবাদের ওপর নির্ভরশীল ও তাদের পা-চাটা হোক, গোলামির একটা সীমা আছে। এই সীমা অতিক্রম করলে গোলামও প্রভুর বির“দ্ধে উঠে দাঁড়াতে পারে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটো এখন যথারীতি আফগানিস্তান ছেড়ে পলায়ন করতে ব্যস্ত। যেহেতু পাকিস্তান সীমান্ত বন্ধ, এ জন্য তারা এখন মধ্য এশিয়ায় উজবেকিস্তান, তাজিকিস্তান, কিরঘিজস্তানের সঙ্গে চুক্তি করেছে ন্যাটোর যুদ্ধসরঞ্জাম আফগানিস্তান থেকে সরিয়ে তাদের দেশের মধ্য দিয়ে ইউরোপে নিয়ে যাওয়ার। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অনেক দেশেই হামলা চালিয়ে দখল করেছে। কিš‘ তাদের আবার সেখান থেকে পালিয়ে আসতে হয়েছে। আফগানিস্তান হবে এর একটি সর্বশেষ দৃষ্টান্ত।
৯.৬.২০১২

বৃহস্পতিবার, ৭ জুন, ২০১২



সুপ্রিমকোর্ট ও জাতীয় সংসদের দ্বন্দ্ব গভীর শাসন সঙ্কটের প্রতিফলন



ব দ রু দ্দী ন উ ম র
বাংলাদেশে এখন সমস্ত শাসন ব্যবস্থারই বেহাল অবস্থা। প্রথমত, এখানে মন্ত্রিসভা বলতে কার্যত যা বোঝায় তা নেই। মাঝে মাঝে এর বৈঠক হয় এবং সেখানে প্রধানমন্ত্রী তার ‘জ্ঞানগর্ভ’ ও ‘দেশপ্রেমমূলক’ নানা বক্তব্য প্রদান করে ভাষণ দেন। এটা-ওটা নির্দেশও তিনি তার পারিষদতুল্য মন্ত্রীদের দিয়ে থাকেন। কখনও সখনও তিনি তাদের কাউকে কাউকে ধমক-ধামক এবং হুমকিও দেন। এসবই হলো মন্ত্রিসভার রুটিন ব্যাপার। এসব থেকে বোঝা যায়, এই মন্ত্রিসভাটি মন্ত্রিপরিষদের সদস্যদের দ্বারা গঠিত কোনো প্রকৃত মন্ত্রিসভা নয়। এই মন্ত্রিসভা হলো শেখ এবং হাসিনার মন্ত্রিসভা! মন্ত্রিসভার জন্য একাধিক মন্ত্রীর প্রয়োজন। কিন্তু যেহেতু সেরকম কোনো মন্ত্রী নেই, এ কারণে মন্ত্রিসভাকে এভাবেই আখ্যায়িত করা ছাড়া আর কী করা যেতে পারে?
মন্ত্রিসভায় প্রধানমন্ত্রীর একক ভূমিকা থাকার জন্য মন্ত্রীদের মধ্যে চিন্তার যে ঐক্য বিভিন্ন নীতি-বিষয়ে থাকা দরকার সেটা নেই। প্রধানমন্ত্রী যা বলেন, সেটাই নীতি। আবার তিনি যে সব সময় একইভাবে কথা বলেন তা নয়। একই বিষয়ে তিনি সুযোগ বুঝে নানা রকম পরস্পরবিরোধী কথাও বলে থাকেন। তার এই ধরনের স্ববিরোধিতা এবং অসংলগ্ন কথাবার্তায় মন্ত্রিসভার কোনো অসুবিধা হয় না। উপরন্তু তারা এসবের ব্যাখ্যা দিতে ব্যস্ত থাকেন! দেশে-বিদেশে অবস্থিত আওয়ামী লীগের চামচা বুদ্ধিজীবীরাও গায়ে পড়ে একই কাজ করেন। এর পরিণামে দেখা যায়, মন্ত্রীরা নিজেরাও বিভিন্ন ইস্যুতে একে অপরের বিপরীত মতামত সংবাদ মাধ্যমে দিতে অসুবিধা বোধ করেন না। মনে হয়, মন্ত্রিপরিষদে তাদের এই পরস্পরবিরোধী বক্তব্য নিয়ে কোনো আলোচনাও হয় না। হলেও তার কোনো গুরুত্ব থাকে না।
মন্ত্রিসভার মধ্যে এমন কয়েকজন আছেন যারা সংবাদ মাধ্যমের সামনে ও সভা-সমিতিতে প্রায়ই নানা বক্তব্য দিয়ে থাকেন। এর মধ্যে অর্থমন্ত্রী একজন। কোনো অর্থমন্ত্রী যে এত অর্থহীন কথা মুখ থেকে নিয়মিত উদগিরণ করতে পারেন এটা সংবাদপত্রে এ বিষয়ে রিপোর্ট প্রকাশিত না হলে বিশ্বাস করা কঠিন। শেয়ারবাজার, বিভিন্ন প্রকল্প, বৈদেশিক বাণিজ্য ইত্যাদি নিয়ে তার আবোল-তাবোল কথাবার্তায় হদিস পাওয়া মুশকিল। তবে এই আবোল-তাবোল বকার সময় তিনি আবার মুখ ফসকে অনেক সময় এমন কথাও বলে থাকেন, যা সরকারের পক্ষে ক্ষতিকর। উদাহরণস্বরূপ কয়েকদিন আগে তিনি বললেন, পুলিশই হচ্ছে দেশের সব থেকে দুর্নীতিগ্রস্ত সংস্থা এবং তাদের জন্যই উন্নয়ন কাজ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। পুলিশ সব সময়ই সরকারের পেয়ারের সংস্থা। কারণ পুলিশ দিয়েই তারা নিজেদের দুর্নীতি এবং অকর্মণ্যতার মোকাবিলা করে থাকেন। কাজেই অর্থমন্ত্রীর এই বক্তব্যের পাল্টা বক্তব্য দিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বললেন, পুলিশের কার্যকলাপ এবং অবস্থা এখন আগের যে কোনো সময়ের থেকেই ভালো! দেশে যখন পুলিশের হাজার রকম দুর্নীতি, অপহরণ, গুম-খুন, নির্যাতন নিয়ে তোলপাড় হচ্ছে তখন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর এই বক্তব্য শুধু যে অসত্য তাই নয়, হাস্যকরও বটে। তিনি অবশ্য এরই মধ্যে অনেক লোক হাসানো বক্তব্য দিয়ে প্রসিদ্ধ হয়েছেন। এলজিআরডি মন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকসহ অন্য মন্ত্রীদের এই ধরনের বাগাড়ম্বরের বর্ণনা দেয়ার কোনো প্রয়োজন এখানে নেই। যারা নিয়মিত খবরের কাগজ পড়েন তারা আওয়ামী লীগের মন্ত্রী ও দলনেতাদের ক্ষমতামদমত্ত কথাবার্তার সঙ্গে ভালোভাবেই পরিচিত। এসব দেখে মনে হয় না যে, বাংলাদেশে কোনো সুস্থ প্রশাসনিক ব্যবস্থা ও নিয়মকানুনের শাসন আছে।
এ তো গেল সরকার ও সরকারি প্রশাসনের কথা। কিন্তু রাষ্ট্র ব্যবস্থার খবর কী? সেখানে সংকট কতখানি ঘনীভূত হয়েছে এটা এই মুহূর্তে সর্বোচ্চ আদালত ও জাতীয় সংসদের মধ্যে যে বিতর্ক শুরু হয়েছে তার দিকে তাকালে বোঝা যাবে। একে বিতর্ক না বলে প্রকৃতপক্ষে গালাগালি বলাই সঙ্গত। সুপ্রিমকোর্ট ও জাতীয় সংসদ উভয়েই দেশের সর্বোচ্চ সাংবিধানিক সংস্থা। কাজেই এ দুইয়ের মধ্যে এ ধরনের দ্বন্দ্ব সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত কোনো শাসনব্যবস্থার লক্ষণ নয়।
লক্ষণীয় ব্যাপার, এই দ্বন্দ্ব এমন কোনো নীতিগত দ্বন্দ্ব নয়, যা সম্মানজনকভাবে পরিচালিত হচ্ছে। ১৯৪৯ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট ট্রুম্যানের সময় মার্কিন কংগ্রেস ইস্পাত শিল্প জাতীয়করণ করেছিল। সেখানকার সুপ্রিমকোর্ট কংগ্রেসের সেই সিদ্ধান্ত নাকচ করেছিল, সেটা সংবিধানে ব্যক্তিগত সম্পত্তি বিষয়ক অধিকার লঙ্ঘনের কারণ দেখিয়ে। কিন্তু এ নিয়ে মার্কিন কংগ্রেস ও সুপ্রিমকোর্টের মধ্যে কোনো দ্বন্দ্ব ও গালাগালির পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়নি। সুপ্রিমকোর্টের সংবিধানসম্মত রায় মার্কিন কংগ্রেস স্বীকার করে নিয়েছিল। সুষ্ঠু বুর্জোয়া শাসনব্যবস্থায় এটাই হয়ে থাকে। বাংলাদেশে এখন সুপ্রিমকোর্ট ও জাতীয় সংসদের মধ্যে যে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয়েছে সেটা একটা জমিকে কেন্দ্র করে। সুপ্রিমকোর্ট সংলগ্ন একটি জায়গায় সরকারের রোডস অ্যান্ড হাইওয়েজ ডিপার্টমেন্ট নিজেদের হেড কোয়ার্টার বিল্ডিং তৈরি করেছিল। এটা প্রায় ৫০ বছর আগের কথা। তার আগে ওই জায়গাটিতে ছিল একটি বড় সরকারি নার্সারি। নার্সারিটিকে উচ্ছেদ করে সেখানে সড়ক ও জনপথ বিভাগ তাদের বিল্ডিং তৈরি করেছিল। যখন তারা এ কাজ করে তখন সুপ্রিমকোর্ট থেকে সেটা বন্ধের জন্য কোনো পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। এখন কোর্ট থেকে বলা হচ্ছে যে, যেহেতু সুপ্রিমকোর্টের কাজের পরিধি বেড়েছে সে কারণে বর্তমান সুপ্রিমকোর্ট বিল্ডিংয়ে তাদের স্থান সঙ্কুলান হচ্ছে না। কাজেই ওই জায়গা এখন তাদের দরকার হয়েছে।
এটা হতেই পারে। কিন্তু এ নিয়ে যে দ্বন্দ্ব ও সাংবিধানিক সাংঘর্ষিক পরিস্থিতি দেখা দিয়েছে এটা কোনো স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে হতে পারে না। এর মীমাংসা সুপ্রিমকোর্ট এবং সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের পারস্পরিক আলাপ আলোচনার মাধ্যমেই হতে পারত। কিন্তু তার পরিবর্তে এখন দেখা যাচ্ছে, সড়ক ও জনপথ বিভাগ নয়, জাতীয় সংসদ এ নিয়ে সুপ্রিমকোর্টের সঙ্গে এক কুিসত বিবাদ ও বিতর্কে জড়িয়ে পড়েছে। আমাদের জানা নেই যে, বিষয়টি নিয়ে সুপ্রিমকোর্ট ও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের মধ্যে কোনো আলোচনা হয়েছিল কি-না এবং সে আলোচনা ব্যর্থ হওয়ার পর এই পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে কি-না। তবে এ পর্যন্ত সংবাদ মাধ্যমে যা জানা গেছে, তাতে মনে হয় না এ ধরনের কোনো আলোচনা ও মীমাংসার চেষ্টা এর আগে হয়েছে। সঙ্কট এখানেই। অন্যভাবে বলা চলে, দেশব্যাপী যে সাধারণ সঙ্কট দেখা যাচ্ছে তার প্রতিফলনই এর মধ্যে ঘটছে। সেটা না হলে, আগেই যা বলা হয়েছে, সুপ্রিমকোর্ট সড়ক মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আলোচনা করেই এ ব্যাপারে একটা মীমাংসা করতে পারতেন। এ প্রসঙ্গে জাতীয় সংসদের স্পিকার ২৯ মে জাতীয় সংসদে বিতর্কের সময় বলেন, ‘আদালত নিরপেক্ষ ও স্বাধীন। কিন্তু দেশের মানুষের বিচারের ক্ষেত্রে বছরের পর বছর লেগে যাবে আর নিজেদের বিষয় বলে বিচার বিভাগ ঝটপট সিদ্ধান্ত নেবেন, এটি ভালো দেখায় না। উচ্চ আদালতের প্রতি ইঙ্গিত করে স্পিকার বলেন, কেবল নিজেদের বিষয়টি দেখলে সরকার কীভাবে চলবে? সরকারকেও সহযোগিতা করতে হবে।’ এ ক্ষেত্রে সরকার ও বিচার বিভাগের মধ্যে আলোচনার পরামর্শ দেন তিনি। (সমকাল ৬.৬.১২)।
সুপ্রিমকোর্টের সংশ্লিষ্ট বিচারপতি বলেন, স্পিকার তাদের উদ্দেশে বলেছেন, তারা নিজেদের মনে করেন ‘আমরা কি হনু রে!’ (Daily Star 6.6.12)। এই ভাষা সম্পূর্ণ অসংসদীয় বা আন-পার্লামেন্টারি। তিনি বলেন, সংসদের কোনো সদস্য কোনো বিষয় আলোচনার জন্য উপস্থাপন করলে স্পিকারের দায়িত্ব হচ্ছে তা বিধিমোতাবেক পরিচালনা করা। কিন্তু এ ক্ষেত্রে স্পিকার নিজেই বিতর্কে অংশগ্রহণ করে নিজের পদমর্যাদার অবমাননা করে প্রচলিত সাংবিধানিক রীতিনীতির বিরোধী কাজ করেছেন।
গত মঙ্গলবার ৫.৬.২০১২ তারিখে জাতীয় সংসদের এই বিতর্কে শুধু আওয়ামী লীগ সদস্যরাই নন, তাদের জোট সরকারের অন্য শরিকরাও অংশগ্রহণ করে স্পিকারকে সমর্থন করে সুপ্রিমকোর্টের সমালোচনা করেন। এই সমালোচনা কোন পর্যায়ে পৌঁছায় এটা বোঝা যাবে যখন আমরা লক্ষ্য করব একজন আওয়ামী লীগ এবং একজন জাতীয় পার্টির সদস্যের বক্তব্য। তারা দু’জনই বলেন, ‘বিচারপতি শামসুদ্দীন চৌধুরী মানিক খুব ভাগ্যবান ব্যক্তি। আওয়ামী লীগের পূর্ববর্তী সরকারের আমলে তাকে কোনো মৌখিক বা লিখিত পরীক্ষা ছাড়াই হাইকোর্টের একজন অতিরিক্ত জজ করা হয়েছিল। পূর্ববর্তী বিএনপি সরকার তার এই নিয়োগ অনুমোদন না করলেও বর্তমান সরকার তা করেছে।’ বলাই বাহুল্য, এ কাজ আওয়ামী লীগ সরকারের বাহাদুরি হিসেবে তারা দেখাতে চাইলেও এটাকে একটা দুর্নীতি হিসেবেও চিহ্নিত করা যেতে পারে। থাক সে কথা। বিচারপতি মানিককে ব্যক্তিগত আক্রমণ করতে গিয়ে আওয়ামী লীগ সদস্য বলেন যে, তিনি রাস্তায় যাওয়ার সময় একবার এক ট্রাফিক পুলিশ অফিসার তাকে স্যালুট না করায় তাকে শাস্তি দিয়েছিলেন! তিনি অন্যের ওপর জুলুম করে মজা পান!! জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য বলেন, একবার বিমানের যাত্রী হিসেবে সাধারণ টিকিট কিনে বিজনেস ক্লাসে তাকে আসন করে দিতে বিমান কর্তৃপক্ষকে তিনি বাধ্য করেন!!! তিনি আসলে একজন উন্মাদ!!!! (Daily Star 6.6.2012).
যাই হোক, এটা অবশ্যই বলা যেতে পারে যে, আদালত সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের কর্তাদের সঙ্গে আলাপ আলোচনা করে বিষয়টি নিয়ে একটা মীমাংসায় অনায়াসেই আসতে পারতেন। কিন্তু সেটা না করে যেভাবে সুপ্রিমকোর্ট এবং জাতীয় সংসদ পরস্পরের বিরুদ্ধে কুিসতভাবে বিতর্ক ও গালাগালিতে নিযুক্ত হয়েছেন—এটা লঘুভাবে নেয়ার কোনো ব্যাপার নয়। এটা শুধু একজন সুপ্রিমকোর্টের বিচারপতি এবং জাতীয় সংসদের স্পিকার ও সদস্যদের বাকবিতণ্ডা নয়। বর্তমান রাষ্ট্রের গভীর দেশে যে দ্বন্দ্ব পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে তার প্রতিফলনই এসবের মাধ্যমে ঘটছে। দুই পক্ষই যেভাবে নিজেদের অবস্থান যুক্তিযুক্ত করার জন্য সংবিধানের আশ্রয় গ্রহণ করে বিতর্ক করেছে তার থেকে এটা বোঝারও অসুবিধা নেই যে, বাংলাদেশের সংবিধানও এখন বাস্তবতার কাঠগড়ায় এসে দাঁড়িয়েছে। আদালত ও জাতীয় সংসদের দ্বন্দ্ব ও সাংঘর্ষিক সম্পর্ক অবসানের ক্ষেত্রে সংবিধান শেষ পর্যন্ত কীভাবে ব্যবহৃত হয় সেটাও দেখার বিষয়। বাংলাদেশের শাসক শ্রেণী ও শাসন ব্যবস্থা যে এক সমাধান অযোগ্য সঙ্কটের মধ্যে নিমজ্জিত হয়েছে, সরকার ও রাষ্ট্রের বিভিন্ন অংশের মধ্যে অনৈক্য এবং দ্বন্দ্বের মধ্যেই এর পরিচয় স্পষ্টভাবে পাওয়া যাচ্ছে।
৬.৬.২০১২

সোমবার, ৪ জুন, ২০১২

যে দুর্নীতির মামলার নিষ্পত্তি হয়নি


বদরুদ্দীন উমর
ৃযদি এপিএস ৭০ লাখ টাকার উৎস প্রকাশ করতে দুদকের কাছে অস্বীকৃত হন, তাহলে দুদকের পরবর্তী কর্তব্য হবে তাকে পুলিশের হাতে সমর্পণ করা এবং পুলিশের উচিত হবে তাকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা। অনেক নিরীহ লোককে পুলিশ ও র‌্যাব রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতন করছে। সে ক্ষেত্রে এপিএসের মতো একজন 'দুর্নীতিবাজ'কে যদি দুদক পুলিশের হাতে তুলে না দেয় এবং পুলিশ যদি তাকে রিমান্ডে না নেয়, তাহলে বুঝতে হবে এ দেশে ইতিমধ্যেই দুর্নীতির রাজত্ব প্রশাসন ক্ষেত্রে সার্বভৌম হয়েছে

অধস্তন কর্মচারীদের দিয়ে গঠিত তার নিজের দুর্নীতি বিষয়ক তদন্ত করিয়ে নিজেকে খালাস দেখিয়ে সুরঞ্জিত বাবু এখন আবার রাজনীতির মাঠে নেমে পড়েছেন। বাংলাদেশের অবস্থা এমনই করুণ যে, ক্ষমতাসীন একটি রাজনৈতিক দলের উচ্চ পর্যায়ের একজন নেতার এসব করতে লজ্জা-শরম অথবা অন্য কোনো প্রকার অসুবিধা হয় না। দুর্নীতি ইত্যাদি ধরা পড়লে তাদের মতো লোকেরা লজ্জা-শরম একেবারেই পান না বা তাদের কোনো প্রকার অসুবিধাই হয় না, এটা অবশ্য ষোলোআনা ঠিক নয়। কারণ তারা বিপাকে পড়লে প্রথম কয়েকদিন মুখ লুকিয়ে থাকেন। ছোটখাটো অসুখ থেকে সেরে ওঠার মতো করে তারা আবার চাঙ্গা হয়ে ওঠেন। তাদের কথাবার্তা শুনে মনে হয় তাদের কিছুই হয়নি!
দুর্নীতিবিরোধী কমিশনের কাছে সাবেক রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের এপিএস, রেলের জেনারেল ম্যানেজার ও ঢাকা বিভাগীয় রেলের নিরাপত্তা কর্মকর্তা সপরিবারে নিজেদের সম্পদের হিসাব দাখিল করেছেন। এভাবে দুর্নীতিবাজরা নিজেদের সম্পদের যে হিসাব সরকারিভাবে দাখিল করেন সেটা যে তাদের প্রকৃত সম্পদের সামান্য একটা অংশমাত্র এটা বাংলাদেশের মতো দুর্নীতিবাজ অধ্যুষিত আমলা ও রাজনৈতিক ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে এক সাধারণ ও পরিচিত ব্যাপার। উপরোক্ত তিনজন যে ধাতুর দুর্নীতিবাজ তাতে এদিক দিয়ে তাদের অবস্থা ব্যতিক্রমী হওয়ার কোনো কারণ নেই। কিন্তু তা সত্ত্বেও নিজেদের সম্পদের যে হিসাব তারা দিয়েছেন (ডেইলি স্টার, ৪.৬.২০১২) তার থেকেও এটা পরিষ্কার যে, আয়ের তুলনায় তাদের প্রদর্শিত সম্পদের পরিমাণ পাহাড়তুল্য। এর মধ্যে এপিএসের সম্পদের হিসাবটাই সব থেকে চোখে পড়ার মতো। কারণ, এর পরিমাণ তো বেশি বটেই। উপরোক্ত ব্যাংকে জমা ৯১ লাখ টাকার মধ্যে গাড়িতে যে ৭০ লাখ টাকা ধরা পড়েছিল তার উৎস নির্দেশ করতে তিনি পারেননি। শুধু তাই নয়, সেটা করতে তিনি অস্বীকার করেছেন। রেলের এই কর্মচারীরা যে তাদের সাবেক মন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের খুবই অনুগত এবং পেয়ারের লোক এতে সন্দেহ নেই। শোনা যাচ্ছে, উপরোক্ত তিন রেল কর্মচারীর সম্পদের বিষয় নিয়ে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করবে। এই জিজ্ঞাসাবাদের সময় এপিএসের গাড়িতে পাওয়া ৭০ লাখ টাকার উৎসই হওয়া দরকার প্রধান জানার বিষয়। এই উৎস নিয়ে এপিএসকে উল্টেপাল্টে জেরা করলে শুধু যে সেই টাকার উৎসই ধরা পড়বে তাই নয়, সে টাকা কোথা থেকে এসে কোথায় যাচ্ছিল সে বিষয়টিও স্পষ্টভাবে জানা যাবে।
এ প্রসঙ্গে একটি কথা অবশ্যই বলা দরকার। যদি এপিএস ৭০ লাখ টাকার উৎস প্রকাশ করতে দুদকের কাছে অস্বীকৃত হন, তাহলে দুদকের পরবর্তী কর্তব্য হবে তাকে পুলিশের হাতে সমর্পণ করা এবং পুলিশের উচিত হবে তাকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা। অনেক নিরীহ লোককে পুলিশ ও র‌্যাব রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতন করছে। সে ক্ষেত্রে এপিএসের মতো একজন 'দুর্নীতিবাজ'কে যদি দুদক পুলিশের হাতে তুলে না দেয় এবং পুলিশ যদি তাকে রিমান্ডে না নেয়, তাহলে বুঝতে হবে এ দেশে ইতিমধ্যেই দুর্নীতির রাজত্ব প্রশাসন ক্ষেত্রে সার্বভৌম হয়েছে।
এবার আসা দরকার এই মামলার অন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ দিকে। সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের দ্বারা গঠিত তদন্ত কমিটির চেয়ারম্যান রেলের ম্যানেজিং ডিরেক্টর তদন্ত শেষ করার পর সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে বলেছেন, এপিএসের ড্রাইভার আলী আজমকে জেরা করার বা তার সাক্ষ্য নেওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। কারণ অন্য সকলের সাক্ষ্যই নেওয়া হয়েছে! এই প্রধান সাক্ষীরা কারা? তারা হলো এমন ব্যক্তি যাদের দুর্নীতির তদন্তের জন্যই কমিটি গঠন করা হয়েছে! যে ড্রাইভারের কারণে পুরো বিষয়টি প্রকাশ্য হলো এবং চারদিকে সরকারি প্রশাসন ও মন্ত্রীর দুর্নীতি নিয়ে তুলকালাম কাণ্ড শুরু হলো, সেই ড্রাইভারেরই সাক্ষ্য নাকি এতই নিষ্প্রয়োজনীয় যে, তার সামান্য প্রয়োজনও এই তথাকথিত তদন্ত কমিটি বোধ করেনি! এই প্রয়োজন তাদের বোধ না করারই কথা। কারণ সেটা করলে তাদের সাজানো মামলা লণ্ডভণ্ড হয়ে যেত। কিন্তু এই কমিটির বাইরে দুদকের পক্ষ থেকে স্পষ্ট বলা হয়েছে যে, ড্রাইভার আজমের সাক্ষ্য ছাড়া এই মামলার তদন্ত সম্পূর্ণ হতে পারে না। খুব আশ্চর্য হওয়ার মতো ব্যাপার যে, দুদকের মতো একটি সংস্থার এই বক্তব্যকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে সরকার দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত সাবেক রেলমন্ত্রীর দ্বারা গঠিত একটি বিভাগীয় তদন্ত কমিটিকেই আসল তদন্ত কমিটি বলে ধরে নিয়ে দুদককে প্রায় নাকচ করে বসে আছে! এই সুযোগে সুরঞ্জিত বাবু নিজেকে নির্দোষ 'প্রমাণ' করে সভা-সমিতিতে, টিভি টক শোতে এবং সাংবাদিকদের সামনে নিজের ডানা ঝাপটাচ্ছেন! এটা বলাবাহুল্য যে, সরকার দুদককে এই পর্যায়ে এনে দাঁড় করানোই দুর্নীতি আজ সর্বত্র মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়ার অন্যতম কারণ।
এখন প্রশ্ন হলো, এপিএসের ড্রাইভার আলী আজম কোথায়? তার কী হলো? এ প্রশ্ন আমি আগেও করেছি কিন্তু বিস্ময়ের ব্যাপার যে, সরকার তো বটেই, এমনকি সংবাদপত্র অথবা টিভিতেও এ বিষয়ে এমন এক নীরবতা পালন করা হচ্ছে যা বোধগম্য নয়। সাংবাদিকরা অন্য খুন, গুম, অপহরণ ইত্যাদি নিয়ে অনেক বড় গলায় কথা বলেন অথচ এই ধরনের এক মামলায় এক গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষী গুম হওয়া নিয়ে তাদের কোনো মাথাব্যথা নেই কেন? বর্ডার গার্ডের হাতে আইন থাকার পর রাত ভোর হলে তিনজন রেল কর্মচারীকে তাদের চুরি করা মালামালসহ পুলিশের হাতে সোপর্দ না করে বেবাক ছেড়ে দেওয়া হলো। তারা সেখান থেকে বের হয়ে বুক ফুলিয়ে বেড়াচ্ছেন, অথচ সেই গরিব ড্রাইভার যে চুরি-দুর্নীতির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে তা ধরিয়ে দেওয়ার জন্য বর্ডার গার্ডের হেডকোয়ার্টারে গাড়ি ঢোকাল তার কোনো খবর নেই কেন?
বর্ডার গার্ড থেকে পরে বলা হয়েছে যে, ড্রাইভারকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তার স্ত্রী সাংবাদিকদের বলেছেন, তার স্বামীর কোনো খবর তার কাছে নেই। তাছাড়া তিনি তাকে বলতেন, এপিএসের গাড়িতে তাকে প্রায়ই অবৈধ অর্থ বহন করতে হতো। এ জন্য তিনি যথেচ্ছ বিরক্তিও প্রকাশ করতেন। এই অবস্থায় সরকারের পক্ষ থেকে ড্রাইভার আজমের খোঁজের জন্য কোনো চেষ্টা করা হচ্ছে না কেন, এ প্রশ্ন দেশের যে কোনো নাগরিক অবশ্যই করতে পারেন। যে সাক্ষীর সাক্ষের ওপর রেলমন্ত্রীর দুর্নীতি বিষয়ক মামলাটি বড় আকারে নির্ভরশীল, সেই সাক্ষীর কোনো খোঁজখবর নেই এটা কোনো গুরুত্বহীন ব্যাপার নয়। বাংলাদেশে বর্তমানে সরকারের অপহরণ, গুম, খুন ইত্যাদির বিরুদ্ধে ব্যাপকভাবে আন্দোলন হচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে এ ধরনের একজন সাক্ষীকে গুম করে গায়েব করে দেওয়া কোনো অস্বাভাবিক ব্যাপার নয়। উপরন্তু এটাই এখন বাংলাদেশের পরিস্থিতিতে স্বাভাবিক। বর্ডার গার্ড ড্রাইভার আজমকে অন্য তিনজনের মতো ছেড়ে দেওয়ার কথা বলেছে। কিন্তু তাদের যে এক সঙ্গে ছাড়া হয়নি, এটা অন্য তিন কর্মচারী তাদের প্রাথমিক বক্তব্য দেওয়ার সময় বলেছিলেন। এটা সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছিল। বর্ডার গার্ড বলেছে, পরে ড্রাইভারকেও ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু বর্ডার গার্ডের এই কথার ওপর আস্থা রাখার মতো বাস্তব অবস্থা বাংলাদেশে নেই। তারা হলো বাংলাদেশ সরকারের অধীন সশস্ত্র সংস্থা। তাদের ভূমিকা পুলিশ ও র‌্যাবের থেকে ভিন্ন হওয়ার কথা নয়। এ নিয়ে সংবাদমাধ্যমেই এখন ব্যাপকভাবে আলোচনা হওয়া দরকার। কিন্তু তা হচ্ছে না। কাজেই বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমের চরিত্র এবং ভূমিকাও যে কতখানি গণতান্ত্রিক ও মানবিক সেটাও এ প্রসঙ্গে ভেবে দেখার যথেষ্ট অবকাশ আছে। গরিব ড্রাইভার আজমের নিখোঁজ হওয়ার বিষয়ে বৈদ্যুতিন ও সংবাদপত্রমাধ্যমের এই উৎসাহের অভাব ও নীরবতার তাৎপর্য অবহেলার বিষয় নয়।
৪.৬.২০১২

শনিবার, ২ জুন, ২০১২

চট্টগ্রাম বন্দরে মার্কিন সামরিক নৌঘাঁটি নির্মাণের চক্রান্ত প্রতিহত করতে হবে

ব দ রু দ্দী ন উ ম র
অবশেষে থলের বিড়াল লাফ দিয়ে বাইরে বের হল। যা এতদিন অনেকেরই জানা ছিল এবং সরকার সাধ্যমতো সতর্কতার সঙ্গে গোপন রেখেছিল, এখন ভারতীয়রাই তা ফাঁস করল। মুম্বাই থেকে প্রকাশিত টাইমস অব ইন্ডিয়ার অনলাইন সংস্করণ ‘টাইমস নাউ’-এর এক রিপোর্টে বলা হয়েছে যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিজেদের স্ট্র্যাটেজিক উদ্দেশ্যে তাদের সপ্তম নৌবহর চট্টগ্রাম বন্দরে নোঙর করে রাখার ই”ছা প্রকাশ করেছে (উধরষু ঝঃধৎ, যুগান্তর, ইত্তেফাক ২.৬.২০১২)। এভাবে ই”ছা প্রকাশের অর্থ যে ‘ই”ছা’ পূরণের ব্যব¯’া আগেভাগেই সমাপ্ত করা, এ কথা কে না বোঝে? যে বিষয়ে যেভাবে কথাবার্তা আগে থেকেই ঠিক করে রাখা হয়েছিল, তাতেই হিলারি ক্লিনটন তার সিলমোহর মেরে গেছেন।
ফিলিপাইনের সুবিক বে-এর নৌঘাঁটি উঠিয়ে নিতে বাধ্য হওয়ার পর থেকেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অন্যত্র নৌঘাঁটির জন্য মরিয়া হয়ে চেষ্টা চালিয়ে যা”িছল। এ উদ্দেশ্যে তারা চট্টগ্রাম অথবা বাংলাদেশের অন্য কোন জায়গায় নৌঘাঁটি করার ব্যাপারে একের পর এক বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে কথাবার্তা বলে আসছিল। এখন এই প্রয়োজন তাদের আরও বৃদ্ধি পেয়েছে, কারণ ভারত মহাসাগরে দিয়াগো গার্সিয়ায় তারা ১৯৭০ দশকের মাঝামাঝি যে নৌঘাঁটি তৈরি করেছিল সেটা পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের উত্তাপ বৃদ্ধি ও বরফ গলতে থাকার সঙ্গে সঙ্গে পানিতে তলিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে এখন আর কোন অনিশ্চয়তা নেই। এই পরি¯ি’তিতে দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলে নতুন নৌঘাঁটির প্রয়োজন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য অনিবার্য হয়েছে। কিš‘ এই নৌঘাঁটির জায়গা ভারত, শ্রীলংকা থেকে নিয়ে প্রশান্ত মহাসাগরীয় কোন জায়গাতেই আর পাওয়া যা”েছ না। এদিক দিয়ে বাংলাদেশের ওপর তাদের নজর পড়েছে অনেক আগেই।
দক্ষিণ চীন সাগরে চীন বড় আকারে তার নৌবাহিনী মোতায়েন করায় জাপান থেকে নিয়ে আরব সাগর পর্যন্ত সমগ্র অঞ্চলে মার্কিন সামরিক উপ¯ি’তি জোরদার করা প্রয়োজন। মাত্র দুই দিন আগে মার্কিন প্রতিরক্ষা দফতর থেকে বলা হয়েছে যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একটি নৌশক্তি এবং এ নৌশক্তির জোরেই এ অঞ্চলে তারা আধিপত্য বজায় রেখেছে। এর থেকেই পরিষ্কার যে, তারা এ অঞ্চলে ¯’ায়ী নৌঘাঁটি নির্মাণের জন্য এখন বদ্ধপরিকর এবং মরিয়া।
এদিক দিয়ে বাংলাদেশের মতো দুর্বল এবং ই”ছুক দেশ আর কে আছে? মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এ ই”ছা অনেক আগেই পূরণ হতো যদি না এ ক্ষেত্রে তাদের ভারতের বিরোধিতার বিষয়টি হিসাব না করতে হতো। কারণ বাংলাদেশে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নৌঘাঁটি নির্মাণ করে জেঁকে বসলে বাংলাদেশের নির্ভরতা যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওপরই বৃদ্ধি পাবে এবং ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের বর্তমান সম্পর্ক যে ক্ষতিগ্রস্ত হবে এ হিসাব ভারতের আছে। অন্যান্য বিষয় ছাড়াও বাংলাদেশকে কেন্দ্র করে ভারত-মার্কিন সম্পর্ক কিছুদিন থেকে কিছুটা তিক্ত হয়েছে। বাংলাদেশ ভারতের কোলে চড়ে বসে থাকলেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার এমন এক ‘বন্ধু’ যারা বাংলাদেশে অন্যভাবে প্রভুত্ব করে। কাজেই বাংলাদেশে কার আধিপত্য অধিকতর শক্তিশালীভাবে প্রতিষ্ঠিত হবে, এ নিয়ে এখন ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে প্রতিযোগিতা বেশ তীব্র হ”েছ। চট্টগ্রামে বাংলাদেশ যদি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে নৌঘাঁটি নির্মাণ করতে দেয় এবং সপ্তম নৌবহরকে এখানে নোঙর করে রাখে, তাহলে সামরিকভাবে বাংলাদেশের ওপর যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কবজা আরও শক্ত হবে এতে সন্দেহ নেই। এটা ঘটলে চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের বর্তমান সম্পর্ক অবশ্যই খারাপ হবে। বাংলাদেশ নিজের কোন স্বার্থে এটা ঘটতে দিতে পারে? কোন লাভের আশায় বাংলাদেশ এ অঞ্চলে সাম্রাজ্যবাদের দ্বন্দ্ব-সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে মার্কিনের কলকাঠি হিসেবে নিজেকে ব্যবহƒত হতে দিতে পারে? প্রথমত উল্লেখযোগ্য যে, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ পরি¯ি’তির ওপর এর প্রভাব পড়বে খুব বিপজ্জনকভাবে। বাংলাদেশে কোন বড় আকারে গণআন্দোলন বা গণঅভ্যুত্থান হলে সে ক্ষেত্রে সরাসরি মার্কিন হস্তক্ষেপ চট্টগ্রামে অন্তত নৌবাহিনী থাকলে যত সুবিধা হবে অন্য অব¯’ায় তত সুবিধা হবে না। এটা শুধু বাংলাদেশের প্রগতিশীল, গণতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক শক্তির জন্যই নয়, ভারতের জন্যও এক অতি উদ্বেগজনক ব্যাপার।
সপ্তম নৌবহরকে চট্টগ্রাম বন্দরে নোঙর করতে দেয়া বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে এক ক্ষমার অযোগ্য বেঈমানি। অন্য কথা বাদ দিয়ে এটা মোটেই ভুলে যাওয়ার ব্যাপার নয় যে, ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় এ অঞ্চলে পাকিস্তানি শাসন টিকিয়ে রাখার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাদের এই সপ্তম নৌবহর নিয়ে আসার হুমকি দিয়েছিল এবং প্র¯‘তি গ্রহণ করেছিল। এ নিয়ে তখন বাংলাদেশে এবং বিশ্বের অন্যান্য অনেক দেশে তুমুল বিরোধিতা হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত সপ্তম নৌবহর বঙ্গোপসাগরে মোতায়েন করা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে সম্ভব হয়নি। কিš‘ সেটা সম্ভব না হলেও যে নৌবহরকে বাংলার স্বাধীনতার বির“দ্ধে ব্যবহারের হুমকি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দিয়েছিল, সেই নৌবহরকে চট্টগ্রামে নোঙর করার অনুমতি দেয়া যদি দেশের স্বাধীনতা ও জনগণের প্রতি বেঈমানি না হয়, তাহলে বেঈমানি আর কাকে বলে? বর্তমান আওয়ামী লীগ সভানেত্রী এবং তাদের তথাকথিত জোট সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এখন এই চরম বেঈমানির সব প্র¯‘তি পাকাপোক্ত করেছেন। শেখ হাসিনার বেঈমানির এটাই প্রথম দৃষ্টান্ত নয়। চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তির জন্য তিনি প্যারিসে কিসিঞ্জারের হাত থেকে ‘শান্তি পুরস্কার’ পর্যন্ত নিতে অসুবিধা বোধ করেননি! পার্বত্য চট্টগ্রামে ১৯৯৭ সালে যে শান্তিচুক্তি হয়েছিল তার ফলে পার্বত্য চট্টগ্রামে কী শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, সেটা প্রায় প্রতিদিন শান্তিচুক্তির অন্যতম স্বাক্ষরকারী সš‘ লারমার নিয়মিত বিলাপ এবং ক্রন্দন থেকেই বোঝা যায়। সš‘ লারমা ও পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির হাতে তামাক খেয়ে শেখ হাসিনা কিসিঞ্জারের হাত থেকে শান্তি পুরস্কার নিলেও যে শান্তি পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন সেখানকার অশান্ত পরি¯ি’তিই তার ভুয়া চরিত্র প্রতিদিনই প্রমাণ করছে।
এই কিসিঞ্জার কে? প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের প্রভাবশালী পররাষ্ট্রমন্ত্রী পাকিস্তানের পক্ষে এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতার বির“দ্ধে যে চরম বিরোধী অব¯’ান গ্রহণ করে অনেক শত্র“তা করেছিলেন, সেটা কারও অজানা নয়। একটি ভুয়া শান্তিচুক্তি করে শেখ হাসিনা কিসিঞ্জারের মতো একজন ঘৃণ্য সাম্রাজ্যবাদীর হাত থেকে শান্তি পুরস্কার নিয়ে নিজেকে কলঙ্কিত করেছিলেন এবং বাংলাদেশের ইজ্জত আন্তর্জাতিক মহলে ক্ষুণœ ও খর্ব করেছিলেন। এর জন্য তাকে বাংলাদেশের জনগণের কাছে ক্ষমা চাইতে বলার দাবি অবশ্যই করা যেতে পারে। কিš‘ এখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সপ্তম নৌবহরকে চট্টগ্রামে নোঙর এবং চট্টগ্রামে মার্কিন নৌঘাঁটি নির্মাণ করতে দিয়ে দেশকে সর্বনাশের দোরগোড়ায় দাঁড় করানোর যে চক্রান্ত শেখ হাসিনা করছেন তার জন্য তাকে ক্ষমা করার সব পথ তিনি নিজেই বন্ধ করেছেন। 
বাংলাদেশে সপ্তম নৌবহরকে নোঙর করতে দেয়া এবং চট্টগ্রামে মার্কিন নৌঘাঁটি ¯’াপনের অর্থ ইরাক, আফগানিস্তান, পাকিস্তান ইত্যাদি দেশ থেকে হাত গুটিয়ে আসতে বাধ্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে তাদের সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধ এলাকা বাংলাদেশে সম্প্রসারিত করারই এক চক্রান্ত। এই চক্রান্ত আমাদের জন্য এক বিপজ্জনক ব্যাপার।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বপরিসরে এখন চীনকে তার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে মনে করে। চীন প্রশান্ত মহাসাগর অঞ্চলে যেভাবে শক্তিশালী হয়েছে ও নিজের শক্তি আরও বৃদ্ধি করছে তার মোকাবেলা করা বিশ্বশক্তি হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য প্রয়োজন। কিš‘ তাদের এ প্রয়োজনের সঙ্গে বাংলাদেশ কেন জড়িত হবে? আমরা জানি, যেসব দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এই সাম্রাজ্যবাদী পরিকল্পনা ও তৎপরতার সঙ্গে জড়িত হয়েছে বা তাদের খপ্পরে পড়েছে সেসব দেশ তছনছ হয়ে গেছে। সেসব দেশের জনগণের জন্য অসীম দুর্দশা নেমে এসেছে। বাংলাদেশে এমনিতেই জনগণের দুর্দশার শেষ নেই। তার ওপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থে এ দেশে আরও বড় রকম সর্বনাশের ব্যব¯’া করা থেকে দেশ ও জনগণের প্রতি বড় বেঈমানি আর কী হতে পারে? আওয়ামী লীগ সভাপতি এবং তাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আজ দেশ ও জনগণের সঙ্গে এই বেঈমানি করে সারা বাংলাদেশকে তার ‘সদ্য বিজিত’ বঙ্গোপসাগরে ভাসিয়ে দেয়ার চক্রান্তে লিপ্ত হয়েছেন। তার এ চক্রান্ত দেশের জনগণকে ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিরোধ করতে হবে। এই মার্কিন ঘাঁটি বাংলাদেশে আমরা কিছুতেই তৈরি হতে দিতে পারি না। শেখ হাসিনা এবং আওয়ামী লীগ সরকারের এই বেঈমানি প্রতিহত করার থেকে এ মুহূর্তে জনগণের সামনে অন্য কোন গুর“ত্বপূর্ণ রাজনৈতিক কর্মসূচি আর নেই। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের গণমাধ্যমকেও উপযুক্ত গুর“ত্বসহকারে ও জর“রি ভিত্তিতে এগিয়ে আসতে হবে।
২-৬-২০১২