ব দ র“ দ্দী ন উ ম র
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একটি লুণ্ঠনজীবী সাম্রাজ্যবাদী দেশ হিসেবে কতখানি বেপরোয়া হয়েছে তার সাম্প্রতিকতম দৃষ্টান্ত হ”েছ, ৭ জুন কাবুলে মার্কিন দেশরক্ষা সচিব প্যানেট্টার এই বক্তব্য যে, পাকিস্তানের ব্যাপারে তাদের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে পড়ছে! অন্য একটি দেশ সম্পর্কে এ ধরনের বক্তব্য যে চরম ঔদ্ধত্যপূর্ণ, এতে সন্দেহ নেই। পাকিস্তানও এই ঔদ্ধত্যের বির“দ্ধে প্রতিবাদ করেছে। কিš‘ ব্যাপারটা কী? কেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ধৈর্যের বাঁধ এভাবে ভেঙে পড়ছে? এর কারণ নাকি এই যে, পাকিস্তান-আফগানিস্তান সীমান্তে অব¯ি’ত হাক্কানি সন্ত্রাসীরা সীমান্ত পার হয়ে এসে আফগানিস্তানে মার্কিন সামরিক ঘাঁটির ওপর আক্রমণ চালা”েছ! কিš‘ কীভাবে তারা এটা চালা”েছ? মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ ন্যাটোর দেড় লাখেরও বেশি সৈন্য এখনও আফগানিস্তানে সে দেশের ‘স্বাধীনতা রক্ষা’র জন্য অব¯’ান করছে!!
এই ‘স্বাধীনতা রক্ষাকারীরা’ যদি পার্শ্ববর্তী দেশ থেকে বেসরকারি সন্ত্রাসী নামে আখ্যায়িত কিছু সন্ত্রাসীর আফগানিস্তানে প্রবেশ এবং তাদের ওপর আক্রমণ প্রতিহত ও বন্ধ করতে না পারে তাহলে তারা আফগানিস্তানে বসে কী করছে? তারা কয়েক দিন অন্তর সব আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করে আফগানিস্তানে তাদের সামরিক ঘাঁটি থেকে ড্রোন বা চালকবিহীন উড়োজাহাজ পাকিস্তান সীমান্তের ওপর ওয়াজিরিস্তানে হাক্কানি ‘সন্ত্রাসীদের’ নির্মূল করার জন্য বোমাবর্ষণ করছে। এই ক্রিমিনাল আক্রমণের ফলে পাকিস্তানের সীমান্তবর্তী অঞ্চলে মার্কিন বিমান হামলায় হাজার হাজার নারী-বৃদ্ধসহ নিরীহ মানুষ নিহত ও আহত হ”েছন। অন্য দেশের সার্বভৌমত্ব সম্পূর্ণ লঙ্ঘন করে, সে দেশের অভ্যন্তরে সামরিক হামলা চালিয়ে যারা নিরপরাধ জনগণকে হত্যা করে, গণহত্যা চালায় তারা অপরাধী তো বটেই, কিš‘ সেই সঙ্গে চরম অপদার্থও বটে। তাদের হাতে বিশ্বের সব থেকে ব্যয়বহুল ও সব থেকে মারাÍক অস্ত্র আছে, কিš‘ এসব নিয়েও কোন প্রকৃত যুদ্ধ ক্ষমতা তাদের নেই। মারাÍক অস্ত্র নিয়ে যারা জনগণের বির“দ্ধে যুদ্ধে জিততে পারে না তারা কাপুুর“ষ ছাড়া আর কী? মার্কিন দেশরক্ষা সচিব কাবুল সফরে গিয়ে সেখানে তাদের ধৈর্যের বাঁধ ভাঙার যে বক্তৃতা দিয়েছেন তার মধ্যে ঔদ্ধত্য আছে ঠিক, কিš‘ সে ঔদ্ধত্য কোন প্রকৃত শক্তিমানের ঔদ্ধত্য নয়। সে ঔদ্ধত্য এমন ধরনের যা অক্ষম কাপুর“ষের লম্ফঝম্পের মধ্যেই দেখা যায়।
যে হাক্কানি সন্ত্রাসীদের কথা বলে প্যানেট্টা তার অধৈর্য প্রকাশ করেছেন, তারা বিগত এপ্রিলে ১৮ ঘণ্টা ধরে রাজধানী কাবুল শহরের ওপর আক্রমণ পরিচালনা করেছিল। সেই হাক্কানিরাও কি পাকিস্তান থেকে সীমান্ত পার হয়ে গিয়ে এ কাজ করেছিল? আফগানিস্তানে কি হাক্কানিরা নেই? তা ছাড়া এ হাক্কানিদের আদর্শিক চিন্তাধারা যতই প্রতিক্রিয়াশীল হোক, মার্কিনিদের বিরোধিতা তারা কেন করছে? মার্কিনের সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের বির“দ্ধে, তাদের দেশের সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘন করে সামরিক তৎপরতার বির“দ্ধে তারা যা করছে সেটা কি সন্ত্রাসী কাজ, না দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব দেশ ও জনগণের শত্র“দের হাত থেকে রক্ষার কাজ? অন্য দেশের ওপর রাষ্ট্রীয় সামরিক হামলা করলে সেটা সন্ত্রাসী হয় না, কিš‘ নিজেদের দেশকে অন্য রাষ্ট্রের সামরিক হামলা প্রতিরোধের জন্য সামরিক শক্তি ব্যবহার করলে সেটা হয় সন্ত্রাসী? এটাই হল মার্কিনসহ ন্যাটো সাম্রাজ্যবাদীদের ‘সন্ত্রাসের’ সংজ্ঞা। এ সংজ্ঞা অনুযায়ী তারা দেশে দেশে অনেক স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার সংগ্রামে নিযুক্ত সংগঠনকে সন্ত্রাসী আখ্যায় দিয়ে সে সব দেশে প্রবেশ করছে।
এর থেকে বড় কথা হল, তারা প্রায়ই নিজেদের সাম্রাজ্যবাদী লক্ষ্য-উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য অন্য দেশে অর্থ, অস্ত্র, এমনকি কূটনৈতিক সহায়তা দিয়ে সন্ত্রাসী সংগঠন খাড়া করে ভেতর থেকে সে সব দেশ ধ্বংসের চক্রান্ত করে। এর অতি সাম্প্রতিক দৃষ্টান্ত হ”েছ লিবিয়া। এখন সিরিয়ায়ও তারা একই খেলা শুর“ করেছে। এর পরিণামে তারা সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধ বাধাবে এবং জাতিসংঘকে কোনভাবে ব্যবহার করে অথবা ইরাকের ক্ষেত্রে যেমন করেছিল, জাতিসংঘের কোন অনুমতি ছাড়াই তাকে ডিঙিয়ে সিরিয়া আক্রমণ ও দখল করবে। এই আন্তর্জাতিক সন্ত্রাস ও দস্যুবৃত্তিকে শাস্তি দেয়ার এমনকি প্রতিহত করার মতো কোন শক্তি এখন নেই। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর এরাই এখন একমাত্র পরাশক্তি, বিশ্বের সব থেকে পরাক্রমশালী দেশ এবং ক্ষমতামদমত্ত অব¯’ায় সম্পূর্ণ বেপরোয়া।
এবার আসা যেতে পারে প্যানেট্টা কর্তৃক ধৈর্যের বাঁধ ভাঙার মূল কারণ সম্পর্কে। ওসামা বিন লাদেনকে পাকিস্তানের ভেতরে এসে পাকিস্তানের সম্পূর্ণ অগোচরে হত্যা করে তার লাশ নিয়ে চোরের মতো পলায়ন করার পর থেকে পাকিস্তানের সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের অবনতি হতে শুর“ করে। এ ঘটনার আগে বেলুচিস্তানের মার্কিন সামরিক বিমান ঘাঁটি থেকে তাদের ড্রোনগুলো উড়ে গিয়ে ওয়াজিরিস্তানে বোমাবর্ষণ করছিল। ওসামাকে হত্যা ও তার লাশ নিয়ে যাওয়ার পর পাকিস্তান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে বেলুচিস্তানে তাদের সামরিক বিমান ঘাঁটি বন্ধ করতে নির্দেশ দেয় এবং তিনদিনের মধ্যে সেখান থেকে তাদের বিদায় করে অর্থাৎ তাড়িয়ে দেয়! পাকিস্তানের মতো মার্কিনের ওপর নির্ভরশীল ও তাদের পা-চাটা একটি দেশ এ কাজ করতে পারে, এ ঘটনার আগে সেটা ছিল চিন্তার বাইরে। তবে শুধু এ একটি কারণেই এটা ঘটেনি। উভয়ের সম্পর্কের অবনতির অন্য কারণও ছিল। তবু বিন লাদেনের ঘটনার সূত্র ধরেই এটা ঘটে। এ ছাড়া মার্কিনবিরোধী কাজের আরও বড় দুর্নীতি পরে দেখা গেল। গত নভেম্বরে আফগানিস্তান থেকে উড়ে এসে মার্কিন ড্রোন বিমান পাকিস্তানের অভ্যন্তরে আক্রমণ চালিয়ে ২৪ জন পাকিস্তানি সৈন্য হত্যা করে। এ ঘটনার পরই পাকিস্তানও তাদের সীমান্ত দিয়ে আফগানিস্তানে মার্কিনসহ পুরো ন্যাটো বাহিনীর সরবরাহ লাইন বন্ধ করে দেয়! মধ্য এশিয়ায় নানা ঝামেলা এবং সেটা অধিকতর ব্যয়বাহুল্যের কারণে প্রধানত করাচি নৌবন্দর ও পাকিস্তান সীমান্ত দিয়ে অস্ত্রসহ সব রকম সামরিক সরঞ্জাম সরবরাহ লাইন ব্যবহার করা হ”িছল। এ লাইন বন্ধ করায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বড় রকম অসুবিধায় পড়েছে। কিš‘ পাকিস্তান ছয় মাস ধরে এ লাইন তাদের জন্য খুলছে না। তাদের দাবি বেশি হয়তো নয়। তারা শুধু বলেছে, এর জন্য মার্কিনসহ ন্যাটোকে এ হামলা ও হত্যার জন্য পাকিস্তানের কাছে ক্ষমা চাইতে হবে। কিš‘ তারা এই সামান্য কাজ পর্যন্ত করতে নারাজ!! তাদের অহমিকা এবং ঔদ্ধত্য কত আকাশচুম্বী ও সম্পূর্ণ যুক্তিহীন, এর থেকেই সেটা বোঝা যায়। তারা অন্য দেশে সন্ত্রাসী হামলা চালিয়ে হত্যাযজ্ঞ চালানোসহ নানা অপকীর্তি করেও এর জন্য ক্ষমা চাওয়ার প্রয়োজন পর্যন্ত মনে করে না। কারণ তাদের ধারণা, পাকিস্তান যেহেতু তাদের ওপর নির্ভরশীল সে কারণে তারা সে দেশে যা ই”ছা তা-ই করতে পারে। কিš‘ পাকিস্তানের ভূমি বাস্তবতা (মৎড়ঁফ ৎবধষরঃু) সম্পর্কে তাদের কোন ধারণা নেই। অথবা তাদের গোয়েন্দা বিভাগ এ বিষয়ে তাদের অবহিত করলেও তারা এটা পরোয়া করে না ঔদ্ধত্যের কারণে। এই ভূমি বাস্তবতা হল, পাকিস্তানি জনগণের মার্কিন বিরোধিতা। বলা যেতে পারে যে, বর্তমান মুহূর্তে পাকিস্তানের জনগণের থেকে মার্কিনবিরোধী জনগণ বিশ্বের আর কোথাও নেই। পাকিস্তান সরকার যে আজ মার্কিনের ওপর নিজেদের অনেক ধরনের নির্ভরশীলতা থাকলেও মার্কিনিদের বির“দ্ধে অব¯’ান গ্রহণ করছে তার কারণ এই ভূমি বাস্তবতা। পাকিস্তানই এটা প্রমাণ করছে যে, জনগণ সাম্রাজ্যবাদের বিরোধী হলে শাসক শ্রেণী যতই সাম্রাজ্যবাদের ওপর নির্ভরশীল ও তাদের পা-চাটা হোক, গোলামির একটা সীমা আছে। এই সীমা অতিক্রম করলে গোলামও প্রভুর বির“দ্ধে উঠে দাঁড়াতে পারে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটো এখন যথারীতি আফগানিস্তান ছেড়ে পলায়ন করতে ব্যস্ত। যেহেতু পাকিস্তান সীমান্ত বন্ধ, এ জন্য তারা এখন মধ্য এশিয়ায় উজবেকিস্তান, তাজিকিস্তান, কিরঘিজস্তানের সঙ্গে চুক্তি করেছে ন্যাটোর যুদ্ধসরঞ্জাম আফগানিস্তান থেকে সরিয়ে তাদের দেশের মধ্য দিয়ে ইউরোপে নিয়ে যাওয়ার। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অনেক দেশেই হামলা চালিয়ে দখল করেছে। কিš‘ তাদের আবার সেখান থেকে পালিয়ে আসতে হয়েছে। আফগানিস্তান হবে এর একটি সর্বশেষ দৃষ্টান্ত।
৯.৬.২০১২
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন