মঙ্গলবার, ১২ জুন, ২০১২

'ঈশ্বর' ছাড়া এদেরকে রক্ষার কেউ নেই


বদরুদ্দীন উমর
সরকার এখন সভা-সমাবেশ-মিছিলের ওপর যেভাবে নিষেধাজ্ঞা জারি করে তা বন্ধ করার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা চালাচ্ছে এর মধ্যে তাদের শক্তি ও জনপ্রিয়তার কোনো পরিচয় নেই। যারা এ কাজ করে তারা স্বাভাবিকভাবে বিরোধিতার মোকাবেলা করতে পারে না এবং জনগণও এ কাজে তাদের সঙ্গে থাকে না। থাকার কারণ নেই। কারণ সরকার খোদ জনগণের কণ্ঠ রোধ করতেই আজ বদ্ধপরিকর। শাসন ব্যবস্থার মধ্যে শোষণ-নির্যাতন অল্পবিস্তর চলতে থাকলে তার প্রতিক্রিয়ায় শ্রমজীবী থেকে নিয়ে সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে যে ক্ষোভ তৈরি হয় তা বের হতে দেওয়াই রাজনৈতিক সুবুদ্ধি ও বিজ্ঞতার কাজ। কারণ এই ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ নানা বিধিনিষেধ ও পুলিশি কার্যকলাপের মাধ্যমে বন্ধ করার চেষ্টা করলেও সে ক্ষোভ কর্পূরের মতো কোথাও উবে যায় না

বাংলাদেশে র‌্যাব, পুলিশ ইত্যাদি সরকারি সশস্ত্র বাহিনীর শুধু শারীরিক নির্যাতন নয়, ক্রসফায়ারে হত্যার সঙ্গে সঙ্গে অপহরণ ও গুম-খুনের সংখ্যা এখন এত বৃদ্ধি পেয়েছে যা শুধু দেশের জনগণের মধ্যেই নয়, দেশের বাইরেও যথেষ্ট ভয়ভীতি এবং উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী হিসেবেই জনগণ নিজেদের ট্যাক্সের টাকা দিয়ে পুলিশ, র‌্যাব ইত্যাদি বাহিনীকে প্রতিপালন করেন। কিন্তু এই আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংগঠনগুলোর অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে, যে থালায় ভাত খায় সেই থালা ফুটো করার মতো। জনগণকে দুষ্কৃতকারীদের হাত থেকে রক্ষা করা যাদের দায়িত্ব তারাই যদি নিজেরা দুষ্কৃতকারীর ভূমিকায় নেমে জনগণের স্বার্থে কাজ করা লোকদের এবং সরকারবিরোধী যে কোনো লোককে অপহরণ ও হত্যা করে, তাহলে দেশে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক না থেকে যে দেশজুড়ে নৈরাজ্যিক পরিস্থিতি তৈরি হবে এতে সন্দেহ নেই। বাংলাদেশে এখন ঠিক তাই হয়েছে। এখানে একটা আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি আছে এবং তার ফলে চারদিকে আইনের শাসন বলতে বিশেষ কিছু নেই। কিন্তু এই পরিস্থিতি সরকারি আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংগঠনগুলোর দ্বারাই মূলত তৈরি হয়েছে। দেশে আজ অপরাধ ঠেকানোর প্রক্রিয়া একেবারে দুর্বল হয়ে পড়েছে এবং অপরাধ ঠেকানোর জন্য যারা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে নিযুক্ত হয়েছে তারাই এই পরিস্থিতি সৃষ্টির ক্ষেত্রে সব থেকে বড় ভূমিকা পালন করছে। কাজেই র‌্যাব, পুলিশ, মন্ত্রিসভা, আদালত সবকিছু থাকা সত্ত্বেও এদিক দিয়ে পরিস্থিতির উন্নতির পরিবর্তে চারদিকে দ্রুত অবনতি ঘটছে।
গত কয়েক মাসে অসংখ্য গুম ও হত্যাকাণ্ড ঘটেছে, যার মধ্যে কিছু চাঞ্চল্যকর ঘটনাও আছে। এসবের বিরুদ্ধে নানা ধরনের আন্দোলনও হচ্ছে। কিন্তু এর কোনো ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া সরকারের মধ্যে হচ্ছে এমন কোনো প্রমাণ এখন পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। এসব অপহরণ ও হত্যাকাণ্ডের মধ্যে একটি হলো গার্মেন্ট শ্রমিক নেতা আমিনুল ইসলামের অপহরণ ও হত্যা। গত ৪ এপ্রিল সন্ধ্যায় তাকে অপহরণ করা হয়। পরদিন ৫ এপ্রিল রাত পৌনে ৮টায় টাঙ্গাইল জেলার ঘাটাইল থানা পুলিশ ব্রাহ্মণশাসন মহিলা বিদ্যালয়ের প্রধান গেটের সামনের রাস্তা থেকে তার লাশ উদ্ধার করে। লাশের পরিচয় না পেয়ে টাঙ্গাইল থানা পুলিশ বেওয়ারিশ লাশ হিসেবে তাকে দাফন করে। ৭ এপ্রিল দৈনিক আমার দেশ পত্রিকায় ভেতরের পাতায় ছবিসহ রিপোর্টে বলা হয়, টাঙ্গাইল থানা পুলিশ অজ্ঞাত এক পুরুষের লাশ উদ্ধার করেছে। ছবি দেখে আমিনুল ইসলামের স্ত্রী অনুমান করেন, সেটা তার স্বামীর লাশ। এরপর তিনি টাঙ্গাইল থানায় যোগাযোগ করেন এবং লাশটি টাঙ্গাইল থেকে তুলে এনে তাদের গ্রামের কবরস্থানে দাফন করা হয়। টাঙ্গাইলে লাশের প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, লাশটির সর্বত্র নানা ধরনের নিষ্ঠুর নির্যাতনের চিহ্ন তারা দেখেছেন। অর্থাৎ আমিনুল ইসলামকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হয় (আমার দেশ, ১০.৬.২০১২)।
মানবাধিকার সংগঠন 'অধিকার'-এর রিপোর্টে বলা হয়েছে, তারা যে তদন্ত করেছেন তার থেকে বোঝা যায় যে, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীই আমিনুলকে ধরে নিয়ে গিয়ে হত্যা করেছে। এ ব্যাপারে তারা পূর্ণ তদন্তেরও দাবি করেছেন। (ঐ) আমিনুল ইসলামের এই হত্যাকাণ্ড বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ এ কারণে যে, প্রায় নেতৃত্ববিহীন গার্মেন্ট শ্রমিকদের তিনি ছিলেন একজন উল্লেখযোগ্য নেতা। কাজেই গার্মেন্ট শ্রমিকদের মধ্যে যাতে কোনো বড় ধরনের আন্দোলন না হয় তার জন্যই তারা এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। কিন্তু শুধু হত্যাকাণ্ডই তারা ঘটায়নি, তারা কত প্রতিহিংসাপরায়ণ এর প্রমাণও তারা রেখেছে হত্যার পূর্বে তাকে নিষ্ঠুরভাবে নির্যাতন করে।
বর্তমান সরকার কার বুদ্ধি-পরামর্শে চলছে বোঝা মুশকিল। মনে হয়, তারা নিজেদের বুদ্ধি-পরামর্শ দ্বারাই চালিত হচ্ছে এবং নিজেদের সর্বনাশের ব্যবস্থাও নিজেরাই করছে। একদিকে সরকারি লোকদের চরম দুর্নীতি এবং এর জন্য শাস্তির হাত এড়িয়ে চলার নিশ্চয়তার কারণে ঘুষ, দুর্নীতি, কালোবাজারি ও তার প্রয়োজনে সাধারণভাবে সন্ত্রাসের অভূতপূর্ব প্রয়োজন অপরাধ জগতের মধ্যেই সৃষ্টি হয়েছে। এ কারণে সরকারি কাঠামোর বাইরেও চলছে চরম দুর্নীতি, সন্ত্রাস ও হত্যাকাণ্ড। অন্যদিকে সরকার এসবের বিরুদ্ধে সবরকম প্রতিরোধ এবং আন্দোলন দমন করতে বদ্ধপরিকর হয়ে দেশের জনগণের নিম্নতম মতপ্রকাশের ও ক্ষোভ প্রকাশের স্বাধীনতাও হরণ করে বসে আছে। এর ফলে সমাজে ঘুষ, দুর্নীতি, প্রতারণা, সন্ত্রাস, রাহাজানি, জমি ও জায়গা দখল ইত্যাদি অপরাধ ঘটতে থাকা সত্ত্বেও তার কোনো প্রতিকার বা প্রতিরোধ এখন নেই। যাকে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বলা হয় তার কাজও হয়ে দাঁড়িয়েছে উল্টো। তাদের কার্যকলাপ এদিক দিয়ে এত জনবিরোধী যে, জনগণের ট্যাক্সের টাকায় প্রতিপালিত এই সংস্থাগুলোকে নেমকহারাম ছাড়া অন্য কিছু বলার উপায় নেই।
সরকার এখন সভা-সমাবেশ-মিছিলের ওপর যেভাবে নিষেধাজ্ঞা জারি করে তা বন্ধ করার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা চালাচ্ছে এর মধ্যে তাদের শক্তি ও জনপ্রিয়তার কোনো পরিচয় নেই। যারা এ কাজ করে তারা স্বাভাবিকভাবে বিরোধিতার মোকাবেলা করতে পারে না এবং জনগণও এ কাজে তাদের সঙ্গে থাকে না। থাকার কারণ নেই। কারণ সরকার খোদ জনগণের কণ্ঠ রোধ করতেই আজ বদ্ধপরিকর। শাসন ব্যবস্থার মধ্যে শোষণ-নির্যাতন অল্পবিস্তর চলতে থাকলে তার প্রতিক্রিয়ায় শ্রমজীবী থেকে নিয়ে সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে যে ক্ষোভ তৈরি হয় তা বের হতে দেওয়াই রাজনৈতিক সুবুদ্ধি ও বিজ্ঞতার কাজ। কারণ এই ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ নানা বিধিনিষেধ ও পুলিশি কার্যকলাপের মাধ্যমে বন্ধ করার চেষ্টা করলেও সে ক্ষোভ কর্পূরের মতো কোথাও উবে যায় না। তা জমতে থাকে। যেহেতু নিয়মিতভাবে এই ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশের পথ খোলা থাকে না, সে কারণে তা সময়ে সকল নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে সামাজিক ও রাজনৈতিক শক্তির বাঁধ ভেঙে সব প্রতিবন্ধক উড়িয়ে দেয়। এর ফলে সরকারের পতন তো ঘটেই, উপরন্তু বিশেষ ঐতিহাসিক পরিস্থিতিতে পুরো শাসন ব্যবস্থাই উচ্ছেদ হয়। অদূর ভবিষ্যতেই দেখা যাবে যে, বাংলাদেশ এদিক দিয়ে কোনো ব্যতিক্রম নয়।
বর্তমানে সরকার কর্তৃক যে ব্যাপক নির্যাতন জারি আছে, তার মধ্যে রাজনৈতিকভাবে সব থেকে বড় প্রতিরোধের শর্ত তৈরি হয় সভা-সমাবেশ-মিছিল ইত্যাদি নিষিদ্ধ করা এবং সে নিষেধ অমান্য করলে সভা-সমাবেশ ও মিছিলে লাঠিচার্জ, কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ ও গুলি চালনা করা। বাংলাদেশে এখন এটাই পুরোদমে চলছে। সরকার যতই জনবিচ্ছিন্ন হচ্ছে, জনগণের মধ্যে এর সমর্থন ও জনপ্রিয়তা যত কমছে ততই তারা অধিকতর প্রতিহিংসাপরায়ণ ও হিংস্র হচ্ছে। জনগণকে প্রতিপক্ষ মনে করে তাদের ওপরই নিজেদের শক্তি প্রয়োগ করছে! এটা হলো যে ডালে তারা বসে আছে সেই ডালটি কাটার ব্যবস্থা। অদূর ভবিষ্যতে তারা এই পরিণতির দিকেই এগিয়ে যাচ্ছে। 'ঈশ্বর' ছাড়া এই পরিস্থিতি থেকে তাদের রক্ষা করার আর কেউ নেই!
১১.৬.২০১২

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন