বদরুদ্দীন উমর
দেশ টিভি ১৭ জুন রোববার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট হলে ২০১২-১৩-এর বাজেটের ওপর এক আলোচনার ব্যবস্থা করে। অর্থমন্ত্রীকে বাজেটের বিভিন্ন দিক নিয়ে প্রশ্ন করা এবং অর্থমন্ত্রী কর্তৃক প্রশ্নগুলোর ব্যাখ্যামূলক জবাব প্রদানের মধ্যেই এই আলোচনা সীমাবদ্ধ রাখা হয়। শিল্প ব্যবসা মালিক, আইনজীবী, শ্রমিক সংগঠনের প্রতিনিধি, সাংবাদিক, শিক্ষক, শেয়ারবাজারের কর্তাব্যক্তি প্রমুখ এবং সে সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও ঢাকার কয়েকটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা এ আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন। সাধারণভাবে যেসব হোমরাচোমরা অর্থনীতিবিদ বাজেটের ওপর আলোচনা করেন, তাদের প্রায় কাউকেই এই অনুষ্ঠানে দেখা যায়নি। মনে হয়, বাজেট নিয়ে তারা বিগত ক'দিন ধরে টিভির নানা টক শোতে এবং অন্যান্য আলোচনা সভায় অংশগ্রহণ করায় তাদের আমন্ত্রণ না জানিয়ে সেই বৃত্তের বাইরের লোকদের আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল, যাতে অন্য ধরনের কিছু কথা শোনা যায়। অবশ্য তাদের কেউ কেউ টিভি টক শো এবং অন্যত্র আলোচনাতেও যে অংশগ্রহণ করেননি এমন নয়। পরিচিত অর্থনীতিবিদরা এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত না থাকলেও যারা উপস্থিত ছিলেন তারা সকলেই নিজ নিজ ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত, গণ্যমান্য ও পরিচিত ব্যক্তি। তারা নিজেদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়েই মোটামুটি আলোচনা ও প্রশ্ন করেন। এ ধরনের কয়েকটি বিষয় এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে প্রশ্নকর্তার নাম উল্লেখ না করে। কালো টাকা সাদা করা নিয়ে কয়েকজনই বলেন। নৈতিক প্রশ্ন থেকে নিয়ে সাদা হওয়া কালো টাকার ব্যবহার কীভাবে হবে, কালো টাকার সংজ্ঞা কী ইত্যাদি নিয়ে যেসব প্রশ্ন করা হয়, তার কোনো সন্তোষজনক জবাবই অর্থমন্ত্রী দেননি। কালো টাকাকে সংজ্ঞায়িত করতে গিয়ে তিনি বলেন, কর প্রদানের ক্ষেত্রে যে আয় প্রদর্শন করা হয় না সেটাই কালো টাকা! এ জন্য তিনি একে কালো টাকা না বলে 'অপ্রদর্শিত' আয় বলে উল্লেখ করেন। অর্থাৎ তার সংজ্ঞা অনুসারে কর ফাঁকি দেওয়া ছাড়া কালো টাকার অন্য কোনো দিক নেই! এভাবে কালো টাকাকে সংজ্ঞায়িত করা যে কালো টাকাকে সম্মানজনক করা এবং এর নৈতিক দিকটিকে তরল করা অথবা অস্বীকার করার চেষ্টা এতে সন্দেহ নেই। মন্ত্রী এই অপ্রদর্শিত আয়ের দৃষ্টান্ত দিতে গিয়ে বললেন, কেউ যদি নিজের জমি বেশি দামে বিক্রি করে কাগজে-কলমে তার দাম কম দেখায়, তাহলে সেটাই হলো অপ্রদর্শিত আয়। অর্থাৎ সেটাই হলো কালো টাকা। এটা ঠিক যে, এই টাকা সাদা নয়। কিন্তু কালো টাকা মোট টাকার ৪০% থেকে ৮০%-এর যে কথা তিনি নিজেই বলেন তার সবটা কি এই ধরনের কর ফাঁকির টাকা? দেশে আমলা, পুলিশ, রাজনীতিবিদ প্রমুখ যারা শত শত, হাজার হাজার কোটি টাকার মালিক পর্যন্ত হয়েছেন এবং যাদের এই টাকার বিপুল অংশ কালো টাকা তাকে কি এই ধরনের অপ্রদর্শিত আয় বলা চলে? তাকে কি কোনোভাবে 'আয়ে'র পর্যায়ে ফেলা যায়? চুরি, ঘুষ, লুটপাট ইত্যাদি মাধ্যমে অর্জিত ধনসম্পদ কি প্রদর্শিত অথবা অপ্রদর্শিত কোনো ধরনের 'আয়' বলে গণনার যোগ্য? এটা নয় বলেই অপ্রদর্শিত আয় ঘোষণার সময় তার উৎস উল্লেখ করার কোনো ব্যবস্থা কালো টাকা সাদা করার ব্যবস্থার মধ্যে নেই। শুধু ঘোষণা করলেই হলো, একজন কী পরিমাণ 'অপ্রদর্শিত' টাকার মালিক। তার ওপর নির্ধারিত ১০% কর এবং ১০% জরিমানা দিয়েই তারা খালাস। সততা ও নৈতিক গ্রাহ্যতা যে টাকা দিয়ে কেনা যায় এর পথ দেখানোও মনে হয় কালো টাকার ওপরের সংজ্ঞা নির্ণয়ের অন্যতম উদ্দেশ্য! এভাবে সাদা করা টাকা শুধু উৎপাদন খাত ছাড়া অন্য কোনো খাতে ব্যয় করতে দেওয়া হবে কি-না এর কোনো স্পষ্ট জবাব অর্থমন্ত্রী না দিলেও ধরে নেওয়া যায় এটাই তাদের উদ্দেশ্য। কিন্তু এই সাদা টাকা ব্যক্তিগতভাবে ব্যয় না করে উৎপাদন খাতে যে ব্যয় হবে, সেটা নিশ্চিত করা হবে কীভাবে? এর তদারকি কে করবে? এ বিষয়ে সরকারের কোনো নির্ধারিত নিয়ম বা নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা নেই। কাজেই যারা 'অপ্রদর্শিত' আয়ের মালিক তারা যে সাদা করা টাকা নিজেদের ব্যক্তিগত স্বার্থ বাদ দিয়ে দেশের অর্থনীতির খাতে বিনিয়োগ করবে এর সম্ভাবনা নেই বললেই চলে অথবা এ সম্ভাবনা সামান্য।
দেশের শোচনীয় যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতির জন্য বড় আকারে বিনিয়োগের প্রয়োজন যেখানে আছে সেখানে পদ্মা সেতু নির্মাণ নিয়ে বাড়াবাড়ি রকম ব্যস্ততা কেন_ এ প্রশ্নের কোনো জবাব অর্থমন্ত্রী দেননি অথবা দিতে পারেননি। আইএমএফ যে এক বিলিয়ন বা একশ' কোটি ডলার ঋণ দেবে তার শর্তাবলি সম্পর্কে প্রশ্ন করায় অর্থমন্ত্রী সরাসরি তা অস্বীকার করেন। অথচ আইএমএফ থেকে শুধু শর্তের কথা বলা হয় কীভাবে, কোন কোন পর্যায়ে কী সব শর্ত সরকারকে মেনে চলতে হবে তার ফিরিস্তি সরকারকে দেওয়া হয়েছে এবং সংবাদপত্রে তা প্রকাশিত হয়েছে!
শ্রমিকদের অতি সামান্য মজুরি, আর্থিক দুর্নীতির উল্লেখ করে তাদের মজুরি বৃদ্ধি এবং অন্যান্য সুবিধার জন্য বাজেটে কিছু নেই। এ কথার জবাবে মন্ত্রী কিছুই বললেন না। শিক্ষাক্ষেত্রে বৈষম্য নিয়ে প্রশ্নের জবাবে তিনি বললেন, সরকার আগের থেকে অবস্থার উন্নতি করেছে। বিনা মূল্যে এখন প্রাথমিক পর্যায়ে কোটি কোটি বই দেওয়া হয়েছে। স্কুলে ছাত্রদের খাওয়ার ব্যবস্থা হয়েছে। কিন্তু এ কথার পর কেউ বলেনি যে, এই 'বিনা মূল্যের' বই বাজারে ভালো মূল্যেই বিক্রি হচ্ছে! প্রত্যেক স্কুলে খাদ্য দেওয়া হচ্ছে কি-না অথবা ঠিকমতো দেওয়া হচ্ছে কি-না এবং ছাত্ররা বিনা মূল্যে বই কতজন পাচ্ছে তার তদারকির ব্যবস্থা যে কিছুই নেই, এটা এ প্রশ্নে অর্থমন্ত্রীর নীরবতা থেকেই বোঝা গেল।
শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারি যারা করেছে, তাদের চিহ্নিত করে শাস্তি দেওয়ার ব্যবস্থা করা হলো না কেন, একজন ছাত্রের এই প্রশ্নের কোনো জবাব মন্ত্রী দিলেন না। শেয়ারবাজারকে 'দুষ্ট' বলে নিন্দা জানালেও এই দুষ্টচক্র মধুচক্র হিসেবে যারা রচনা করেছে তারা মনে হয় অর্থমন্ত্রীর সুপরিচিত। শেয়ারবাজারকে দুষ্ট বললেও সেই দুষ্ট দমনের কোনো সম্ভাবনা না দেখেই হয়তো তিনি প্রেসের সামনে আর্তনাদের মতো করে বলেছিলেন, 'আই অ্যাম একদম ফেডআপ!'
আরও অনেক বিষয়ে প্রশ্ন করা হলেও তার সবকিছু এখানে উল্লেখ করা সম্ভব নয়। একজন সামরিক খাতে ব্যয়ের উল্লেখ করে প্রশ্ন করেন, এ খাতে এত ব্যয় কেন করা হচ্ছে? শিল্প এবং অন্য প্রয়োজনীয় খাতে তার একটা অংশ ব্যয় করাই তো বেশি প্রয়োজন। মন্ত্রী এ প্রশ্নের জবাবের ধারেকাছেও গেলেন না। তবে পুরো প্রশ্নোত্তর পর্বের একটা রীতিমতো বিস্ময়কর উল্লেখযোগ্য দিক হলো, দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থা সম্পর্কে কোনো দিক থেকেই কেউ কোনো প্রশ্ন না করা! শুধু চিকিৎসা ব্যবস্থাই নয়, যারা শ্রমজীবী, যারা গরিব তাদের শিক্ষা-দীক্ষার মূল সমস্যা, তাদের জীবন-জীবিকার বিভিন্ন ক্ষেত্রে সরকারি বাজেটে যে উল্লেখযোগ্য কিছুই নেই, এ নিয়ে কেউ বস্তুতপক্ষে কোনো প্রশ্নই করলেন না? যারা গণ্যমান্য এবং অর্থনীতি ক্ষেত্রে ও সমাজে লব্ধ প্রতিষ্ঠ, তারা এ নিয়ে কিছু বলবে এটা প্রত্যাশিত নয়। কিন্তু অবাক হওয়ার ব্যাপার এই যে, ছাত্রছাত্রীদের মধ্য থেকেও কেউ এসব প্রশ্নের ধারেকাছেও গেলেন না! বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন প্রজন্মের যে ছাত্রছাত্রীরা প্রশ্ন করলেন তারাও শুধু নিজেদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়েই প্রশ্ন করলেন। তাদের কারও সামাজিক চেতনা, সমাজের প্রতি কোনো ধরনের দায়বদ্ধতার পরিচয় তাদের কোনো প্রশ্নের মধ্যে দেখা গেল না। অর্থমন্ত্রীর কথাবার্তা থেকেও এই ছাত্রছাত্রীদের অবস্থার মধ্যে দেশের পরিস্থিতির এমন একটা দিক উন্মোচিত হলো, যা রীতিমতো বেদনাদায়ক এবং ভীতিপ্রদ। সরকারি কর্তাব্যক্তিরা, শিল্প ব্যবসায়ীরা, সিভিল সোসাইটির হৃষ্টপুষ্ট গণ্যমান্য ব্যক্তিরা দেশের শতকরা আশিজন কায়িক ও মানসিক শ্রমজীবী দরিদ্রদের কথা চিন্তা করে না, এতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। তাদের পক্ষে এটা স্বাভাবিক। ৮০%কে শোষণ, নির্যাতন ও প্রতারণা করেই তারা নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তন ও ধনসম্পদ অর্জন করে। কিন্তু দেশের ছাত্রছাত্রী ও নতুন প্রজন্মের সদস্যদের মাথায় এ নিয়ে কোনো চিন্তা-ভাবনা নেই, এটা সমাজের শোচনীয় অবস্থাই নির্দেশ করে। যেখানে ভরসা, সেখানে নিরাশা, ব্যাপারটা সাময়িক হলেও সামাজিক ও রাজনৈতিক দিক দিয়ে বিপজ্জনক। এই বিপজ্জনক পরিস্থিতির মধ্যেই বাংলাদেশের জনগণ এখন
বসবাস করছে।
১৭.৬.২০১২
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন