বুধবার, ২৬ ডিসেম্বর, ২০১২

আওয়ামী লীগের আত্মঘাতী লাইন


ব দ রু দ্দী ন উ ম র




আওয়ামী লীগ ১৯৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চায় এটা তাদের কথাবার্তা ও কার্যকলাপ থেকে ঠিক মনে হয় না। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হলে তো সব শেষ। কিন্তু আওয়ামী লীগ এর শেষ চাওয়ার পরিবর্তে এই ইস্যুটিকে ঝুলিয়ে রেখে তার রাজনৈতিক চালবাজি চালিয়ে নিতে চায়, এমনটাই এখন দেখে-শুনে মনে হচ্ছে। এদিক দিয়ে যত গর্জে তত বর্ষে না—এটাই আওয়ামী লীগের অবস্থা।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও শাস্তির বিষয়ে সরকারি লোকজন যেসব কথাবার্তা বলছেন তাতে মনে হয় এদের ধারণা শাস্তির সব ব্যবস্থা হয়ে গেছে, বিচারকদের সঙ্গে বন্দোবস্ত করে এখন শুধু কোনো রকমে বিচার সেরে শাস্তি কার্যকর করার অপেক্ষা! মাত্র কয়েকদিন আগে আওয়ামী লীগের দফতরবিহীন পরগাছা মন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলেছেন, আগামী বছরের মধ্যেই ১৪ জন বিচারাধীন যুদ্ধাপরাধীকে ফাঁসি দেয়া হবে। একটি গুরুত্বপূর্ণ বিচারাধীন মামলার রায়ের ব্যাপারে এ ধরনের কথাবার্তা বলা যে শাস্তিযোগ্য কাজ, এটা সবাই জানে। সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত নাকি একজন বিজ্ঞ আইন বিশেষজ্ঞ! তা সত্ত্বেও তিনি এমন কথা বলছেন এটা তার স্থির বিশ্বাস থেকেই যে, আওয়ামী লীগের সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী মহল যেভাবেই হোক, বিচারাধীন ব্যক্তিদের ফাঁসি চান, এমনকি আদালতকে প্রভাবিত করে হলেও তারা এ কাজ সম্পন্ন করবেন! এটা এতই স্থূল যে, তার এই বক্তব্য প্রদানের পর আদালতেরও টনক নড়েছে এবং তারা এই পরগাছা মন্ত্রীকে এর কারণ দর্শানোর নির্দেশ দিয়েছেন।
শুধু এই মন্ত্রীই নয়, আওয়ামী লীগের কিছু ভূঁইফোড় নেতা ও তাদের সরকারি জোটের নেতা এখন প্রায় প্রতিদিনই এ বিষয়ে এমন সব বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছেন, যা একটি বিচারাধীন মামলা সম্পর্কে বলা চলে না। তারা নিজেরা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার অবশ্যই চাইতে পারেন এবং তার মধ্যে ন্যায্যতা আছে। কিন্তু এই বিচারাধীন মামলায় বিচারপতিরা কী রায় দেবেন তা নিয়ে কোনো ভবিষ্যদ্বাণী প্রদান তারা করতে পারেন না। কিন্তু আওয়ামী লীগ ও তার ঘরানার লোকরা এসবের কোনো পরোয়া করেন না। ক্ষমতার জোরে তারা বেপরোয়া। তাদের দুই মহিলা নেত্রীর জবানও এদিক দিয়ে লক্ষ্য করার মতো।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের সমাপ্তি ও কাঠগড়ায় দাঁড়ানো আসামিদের শাস্তির ব্যাপারে আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্বের আগাম স্ট্র্যাটেজি যাই হোক, এ নিয়ে জোর প্রচারের ক্ষেত্রে তারা নিজেদের যত রকম শক্তি আছে তা প্রদর্শনের চেষ্টায় এখন নিযুক্ত আছেন। এজন্য সম্প্রতি তাদের দেখা গেছে তাদের ঘরানার বামপন্থী দল ও বুদ্ধিজীবীদের দিয়ে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বিষয়ে ‘আন্দোলন’ করতে। প্রথমোক্তরা এই উদ্দেশ্যে এক সরকার সমর্থিত হরতাল ডেকে মস্তবড় কেলেঙ্কারি করেছেন এবং দ্বিতীয়োক্তরা সাম্প্রদায়িকতার নামে এক ভুয়া ‘জাতীয়’ সম্মেলন করে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ইস্যুকেই সামনে এনেছেন। তাদের সাম্প্রদায়িকতা-বিরোধী সম্মেলনের আসল লক্ষ্য এর মাধ্যমে তারা প্রকটিত করেছেন।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে এখন ঘোর অমাবস্যা। এই অমাবস্যার অবস্থায় এখন অন্ধকারের জীবদেরই রাজত্ব। চোর, দুর্নীতিবাজ, লুণ্ঠনজীবী ও দস্যুরাই এখন বাংলাদেশের রাজনীতির নির্ধারক শক্তি হিসেবে কাজ করছে এবং জনগণের জীবনে এক অভিশাপের মতো নেমে এসেছে। এ সবই যুক্ত আছে এদের সাংস্কৃতিক নিম্নমান, রুচিহীনতা ও চরম দায়িত্বজ্ঞানহীনতার সঙ্গে। এদের সাংস্কৃতিক নিম্নমান ও রুচিহীনতার যে প্রতিফলন এদের নানা বক্তব্যের মধ্যে প্রতিফলিত হয় তার থেকে পীড়াদায়ক ব্যাপার কমই আছে। এ বিষয়টি নিয়ে কাউকে বিশেষ কথাবার্তা ও আলোচনা করতে দেখা যায় না। কিন্তু নিম্ন সাংস্কৃতিক মান ও রুচিহীনতা যে নানা ধরনের অপরাধ প্রবণতার সঙ্গে যুক্ত, এটা এক প্রমাণিত সত্য।
শুধু বিচার বিষয়ে ভবিষ্যদ্বাণীই নয়, অন্য অনেকভাবেই আওয়ামী লীগ ও তাদের ঘরানার রংবেরঙের লোকজন যেসব কথা বলছে ও কাজ করছে, তাতে এ নিয়ে সন্দেহ নেই যে, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নয়, অন্য কোনো মূল উদ্দেশ্যে তারা যুদ্ধাপরাধীদের নিয়ে এত মাতামাতি করছে। বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির দিকে তাকালে এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ থাকে না, আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগের একেবারে ভরাডুবি হবে। শুধু ঢাকা নয়, দেশের সর্বত্রই এ অবস্থা। বিভিন্ন মিছিল ও সমাবেশে তারা যতই ভাড়া করা লোক নামিয়ে নিজেদের শক্তি প্রদর্শন করুক, তাদের পায়ের তলায় আর মাটি নেই। এ উপলব্ধি তাদের যতই হচ্ছে ততই তারা মরিয়া হয়ে এমন সব কাজ ও কাণ্ড করছে, যার মধ্যে কাণ্ডজ্ঞান বলেও কিছু নেই।
এদের নিম্ন সাংস্কৃতিক মান ও রুচিহীনতার যে কথা আগে বলেছি তার প্রমাণ এরা প্রায় প্রতিদিনই নানাভাবে দিয়ে যাচ্ছে। এর সাম্প্রতিকতম হাস্যকর দৃষ্টান্ত হলো—কিছুদিন আগে জাতিসংঘে শান্তি বিষয়ক শেখ হাসিনার এক প্রস্তাব গৃহীত হওয়া নিয়ে তাদের প্রচারণা। বলা দরকার, এ ধরনের প্রস্তাবের ও প্রস্তাব পাস হওয়ার কোনো গুরুত্ব বাস্তবত নেই। এমন প্রস্তাবের অভাব জাতিসংঘে নেই, যেগুলো পাস হওয়ার পর অবহেলায় পড়ে থাকে। এগুলো অনেকটা কথার কথার মতো। কিন্তু এ তুচ্ছ ব্যাপার নিয়ে আওয়ামী মহলে এখন তোলপাড় চলছে। হাসিনাকে ‘বিশ্ব শান্তি মডেলের রূপকার’ আখ্যায় ভূষিত করে তার দলের লোকরা ঢাকা শহর পোস্টারে ছেয়ে ফেলেছে। এ নিয়ে তারা মিছিল করছে, জনসভা করে বিশ্ব নেত্রী হিসেবে হাসিনার গুণকীর্তন করে গলা ফাটাচ্ছে! এসবই হচ্ছে নিম্নমানের রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও রুচির প্রতিফলন। কিন্তু হায়! এ নিয়ে তারা যতই প্রচার-প্রচারণা ও মাতামাতি করুক জনগণের মধ্যে তাদের সম্পর্কে ধারণা মোটেই পরিবর্তিত হচ্ছে না। ভোটের বাজারে তাদের দর বৃদ্ধি হচ্ছে না। উপরন্তু আওয়ামী লীগের অবস্থা এখন লেজেগোবরে হচ্ছে।
দেশের সংবাদপত্রগুলো এ নিয়ে রিপোর্ট প্রদান ও লেখালেখি প্রকাশ করছে। টিভি চ্যানেলগুলোও পিছিয়ে নেই। সমালোচনা তো বটেই, এমনকি তাদের নিজেদের কাণ্ড-কারখানার রিপোর্টও তাদের বিরুদ্ধে জনগণের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করছে। কিন্তু এসবের হিসেব করে কথাবার্তা বলা ও কাজ করার কোনো ব্যাপারই আওয়ামী লীগ, তাদের শরিক দলগুলো ও তাদের ঘরানার বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে দেখা যাচ্ছে না। অদমিতভাবে এ লাইনে কাজ করে যাওয়ার থেকে একটি ক্ষমতাসীন দলের পক্ষে আত্মঘাতী আর কী হতে পারে?
লেখক : সভাপতি, জাতীয় মুক্তি কাউন্সিল
২৬.১২.২০১২

বৃহস্পতিবার, ২০ ডিসেম্বর, ২০১২

সরকারের বেনামি হরতাল সফল হয়েছে


ব দ রু দ্দী ন উ ম র




বাংলাদেশের জনগণ বর্তমান আওয়ামী জোট সরকারের হাতে কতখানি নিরাপদ এবং এদের হাতে বাংলাদেশের ভবিষ্যত্ কতখানি উজ্জ্বল তার প্রমাণ প্রতিদিনই প্রধানমন্ত্রীর জবানীতে পাওয়া যায়। তিনি নিয়মিতভাবে প্রতিদিনই বাণী বিস্তারে অভ্যস্ত এবং এইসব বাণী যতই আবোলতাবোল ও বাস্তবের সঙ্গে সম্পর্কহীন হোক, সরকারি শাস্তির ভয়ে প্রচার মাধ্যমগুলো তা বাধ্যতামূলকভাবে প্রচার করে থাকে।
এই ধরনের বাণী বিস্তার করতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী ১৭ ডিসেম্বর বিজয় দিবস উপলক্ষে এক আলোচনা সভায় বলেন, ‘রামুর বৌদ্ধ বিহারে হামলা, তাজরীন গার্মেন্টে অগ্নিকাণ্ড অথবা হিন্দু সম্প্রদায়ের ছেলে বিশ্বজিেক কুপিয়ে কুপিয়ে হত্যা—এর কোনোটাই বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। এগুলোর উদ্দেশ্য সরকারকে হেয় করে যুদ্ধাপরাধীদের রক্ষা করা।’ তিনি এখানেই না থেমে আরও বলেছেন, ‘সরকারকে দুর্নীতিবাজ বলতে বিদেশি সংস্থার চাপ ও কৌশল আছে। সরকারের তরফ থেকে দুদককে কোনোদিন চাপ প্রয়োগ করা হয় না। তারা সম্পূর্ণ স্বাধীনতা ভোগ করছে। যখন তারা সঠিকভাবে কাজ করছে তখন কোনো কোনো বিদেশি সংস্থা দুদককে চাপ প্রয়োগ করে। এগুলো কেন? সরকারকে যদি জনগণের কাছে হেয় প্রতিপন্ন করতে পারে, তাহলে যুদ্ধাপরাধীদের রক্ষা করা যায়। তাদের বাঁচানো যায়।’ (আমার দেশ, ১৮.১২.২০১২)
এসব কথা এমন যে, দেশের প্রধানমন্ত্রীর মুখনিসৃত না হলে এগুলোকে পচা নর্দমায় নিক্ষেপ করাই সঙ্গত ও স্বাভাবিক। শুধু এসব কথাই নয়, প্রতিনিয়ত তিনি যেসব কথা অবলীলাক্রমে বলে যান সেগুলোর বিপুল অধিকাংশের অবস্থাই এরকম। কিন্তু দেশের দুর্ভাগ্য যে, প্রধানমন্ত্রীর মতো পদে সমাসীন এক ব্যক্তির এ ধরনের কথা ছাড়া অন্য কিছু বলার মতো সাংস্কৃতিক যোগ্যতা নেই। কাজেই এইসব নোংরা ও নিষ্প্রয়োজনীয় কথা ঘাঁটাঘাঁটি করে তার ওপর বাধ্য হয়েই আমাদের আলোচনা করতে হয়।
প্রথমেই বলা দরকার, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে বর্তমান আওয়ামী লীগ ও তাদের জোট সরকারের শরিকরা যেসব কথা এখন অনর্গল বলছেন ও কাণ্ডকারখানা করছেন তা রীতিমত রহস্যজনক। এ দেশের জনগণ, বিশেষ করে ১৯৭১ সালে যুদ্ধাপরাধীদের দ্বারা যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন তাদের পরিবার ও স্বজনরা ১৯৭২ সাল থেকেই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করে আসছেন। কিন্তু সে দাবির প্রতি আওয়ামী বাকশালী সরকার, জিয়াউর রহমানের সরকার, এরশাদের সরকার, খালেদা জিয়ার সরকার ও শেখ হাসিনার প্রথম পাঁচ বছরের সরকার কেউই কর্ণপাত করেনি। মুখে কেউ কেউ এ বিষয়ে কিছু কথা বললেও কার্যক্ষেত্রে কাউকে কিছুই করতে দেখা যায়নি। বিশেষ করে বর্তমান সরকার যেভাবে হঠাত্ করে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে মাতামাতি করছে তার সঙ্গে তাদের ১৯৯৬-২০০১ সালের সরকারের উদাসীনতা খুব লক্ষ্য করার মতো। এ প্রসঙ্গে এটা এখানে বলা দরকার যে, ১৯৯৬ সালের সরকারের পক্ষে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার তো দূরের কথা, সে বিষয়ে কথা বলাও সম্ভব ছিল না। কারণ নির্বাচনের পর সরকার গঠনের জন্য আওয়ামী লীগের সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছিল না। সে সংখ্যাগরিষ্ঠতা তারা যুদ্ধাপরাধীদের সহায়তাতেই লাভ করেছিল! জামায়াতে ইসলামীর ভোটেই জাতীয় সংসদে আওয়ামী লীগের মহিলা সদস্যরা নির্বাচিত হওয়ায় আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়েছিল!! সে সময়ে আওয়ামী লীগ জামায়াতে ইসলামীকেও সংসদে মহিলা সদস্যের ভাগ দিয়েছিল!!! কাজেই বলা চলে, এখন বিএনপি এবং জামায়াতে ইসলামীর মধ্যে যে সম্পর্ক সেই সম্পর্কই তখন ছিল আওয়ামী লীগের সঙ্গে যুদ্ধাপরাধীদের!!!! হতভাগ্য এই দেশে এসব বিশ্বাসঘাতকতার কথা মনে করা ও বলার মতো কেউ নেই। বর্তমানে আওয়ামী লীগ তাদের ১৯৯৬ সালের দোসরদের বিরুদ্ধে শাস্তির ব্যবস্থার জন্য যেভাবে মাতামাতি করছে তার মধ্যে প্রকৃতপক্ষে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নয়, অন্য কোনো উদ্দেশ্য যে কাজ করছে এটা বেশ স্পষ্ট হলেও এ নিয়ে আওয়ামী লীগের কাছে ব্যাখ্যা কেউ চাইছে না।
১৯৯৬ সাল থেকে টানা পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকলেও সে সময়ে যারা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করেনি, তা নিয়ে টুঁ শব্দটি পর্যন্ত করেনি, তারা এখন সেটা নিয়ে এত গলাবাজি, এত মাতামাতি যেভাবে করছে তা বিস্ময়কর। শুধু বিএনপি নয়, দেশে তাদের বিরুদ্ধে যারাই রাজনৈতিক ও পেশাগত কারণে কিছু আওয়াজ তুলছে ও কর্মসূচি পালন করছে তাকেই এরা যুদ্ধাপরাধীদের সাঙ্গাত বলে অভিযুক্ত করে তোলপাড় করছে। শুধু তাই নয়, তারা এমন সব কাজের মধ্যে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বানচালের ষড়যন্ত্র দেখছে যাকে দুরভিসন্ধিমূলক এবং সেটা না হলে উন্মাদতুল্য বলা ছাড়া উপায় নেই। প্রধানমন্ত্রী ১৭ ডিসেম্বরের আলোচনা সভায় বলেছেন যে, রামুর বৌদ্ধ বিহারে হামলা ও হিন্দু সম্প্রদায়ের ছেলে বিশ্বজিেক কুপিয়ে কুপিয়ে হত্যা করা হলো যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বানচালের উদ্দেশ্যে ষড়যন্ত্র! এসব কথা বলে কোনো লাভ নেই, কারণ রামুর ঘটনার সঙ্গে আওয়ামী লীগ, বিএনপি এবং রাজনীতির সঙ্গে সম্পর্কহীন এমন অনেক ধরনের লোকই যে জড়িত ছিল এটা বিভিন্ন দেশি-বিদেশি তদন্তের মাধ্যমেই দেখা গেছে। বিশ্বজিত্ হত্যা সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য বাস্তবিকই উন্মাদতুল্য এবং এক চরম মিথ্যা ভাষণ যা একেবারে জেনেশুনেই করা হয়েছে! এ বিষয়ে দেশের প্রত্যেকটি মানুষই জানে যে, বিশ্বজিত্ হত্যা আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের কাজ। এর সব ধরনের প্রয়োজনীয় প্রমাণই আছে। যদি এই কাজ সত্যিই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বানচালের উদ্দেশ্যেই করা হয়ে থাকে তাহলে অবশ্যই বলতে হবে যে, আওয়ামী লীগ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে আকাশ-বাতাস উতলা করলেও খুব চাতুর্যের সঙ্গে তারাই এ বিচার বানচাল করার চক্রান্তে লিপ্ত আছে। তাদের দ্বারা এই ধরনের কাজ যে অসম্ভব নয়, এটা ১৯৯৬ সালে জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে তাদের আঁতাতের কথা বিবেচনা করলে উড়িয়ে দেয়ার নয়। তাছাড়া দিবালোকে সবার সামনে নিজেরা বিশ্বজিেক হত্যা করলেও তার জন্য যারা অন্যদের দায়ী করে উঁচু গলায় কথা বলতে পারে তাদের দ্বারা এমন কী অপকর্ম আছে যা অসম্ভব!
এখানেই শেষ নয়। প্রধানমন্ত্রী বলেন যে, দুদকের ওপর তারা কোনো চাপ সৃষ্টি করছেন না, দুদক স্বাধীনভাবেই কাজ করছে। তিনি আরও বলেন, পদ্মা সেতুর দুর্নীতির অভিযোগও যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচানোর উদ্দেশ্যে এবং সে কাজ করছে কোনো বিদেশি সংস্থা! অর্থাত্ এক্ষেত্রে বিশ্বব্যাংক!! এর চেয়ে উন্মাদ এবং অর্থহীন বক্তব্য আর কী হতে পারে? এর থেকে বোঝার অসুবিধে নেই যে, আমাদের দেশ ও জনগণ এই প্রধানমন্ত্রী এবং তার দল ও জোটের শাসনে কতখানি নিরাপত্তাহীন ও বিপদগ্রস্ত। এ বিষয়ে যে বিস্তারিত কোনো আলোচনার প্রয়োজন নেই এটা বলাই বাহুল্য।
এবার আসা যেতে পারে ১৮ ডিসেম্বর সিপিবির নেতৃত্বে কতকগুলো বাম সংগঠনের হরতাল প্রসঙ্গে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বানচাল করার বিরোধিতা করে তারা তাদের হরতাল আহ্বান করেছিল। এই হরতাল সফল হয়েছে। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকারের দ্বারা প্ররোচিত ও সাহায্যপ্রাপ্ত হয়ে তাদের এই উদ্যোগ যে এক মহা রাজনৈতিক কেলেঙ্কারি এটা দেশের প্রচারমাধ্যম, সব রাজনৈতিক মহল ও জনগণের কাছে এখন স্পষ্ট। এ হরতাল এমন শান্তিপূর্ণ হয়েছে যাতে হরতাল আহ্বানকারীরা রাস্তায় গড়াগড়ি দিয়ে সঙ্গীত গেয়েছে! কোনো গাড়িঘোড়া ভাঙা হয়নি, পুলিশ কাউকে লাঠিপেটা করার প্রয়োজন বোধ করেনি। এক কথায় বলতে গেলে এটা ছিল এক আদর্শ হরতাল! এই হরতাল হয়েছে বামপন্থীদের আহ্বানে!!
প্রথমেই বলা দরকার যে, বামপন্থীরা যে মূল ইস্যুতে হরতাল ডেকেছে এটা আওয়ামী লীগেরই ইস্যু। জনগণ ১৯৭২ সাল থেকে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চাইলেও সে বিচার যে আওয়ামী লীগসহ কেউ করেনি, এটা আগেই বলা হয়েছে। কিন্তু যে কায়দায় এখন আওয়ামী লীগ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে চারদিক উতলা করছে সেটা আওয়ামী লীগের কায়দা। এই আওয়ামী কায়দাতেই বামপন্থীরা তাদের হরতাল ডেকেছে। মূল্যবৃদ্ধি, সরকারের নানা ফ্যাসিবাদী কার্যকলাপ ইত্যাদি নিয়ে আজ পর্যন্ত এই বামপন্থীরা হরতাল দেয়ার কোনো উদ্যোগ নেয়নি। কারণ সোজা। হরতাল সফল করার মতো তাদের কোনো শক্তি নেই এবং আসলে অন্য সব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে হরতাল দেয়ার আগ্রহও তাদের নেই। সেটা থাকলে ব্যর্থতার কথা জেনেও তারা হরতাল দিতে পারত। ১৮ তারিখের হরতাল দেয়া হয়েছে বর্তমান আওয়ামী লীগেরই সর্বপ্রধান ইস্যুকে সামনে রেখে এবং আওয়ামী লীগেরই উদ্যোগ ও সহায়তায়। সে কারণে তাদের নৌ পরিবহনমন্ত্রী ও সরকারি সড়ক পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি বামপন্থীদের এই হরতালকে প্রকাশ্য সমর্থন দিয়েছেন। হরতালের দিন সরকার বিআরটিসির কোনো গাড়ি পথে নামায়নি, যা তারা সাধারণত হরতালের সময় নামিয়ে থাকে। অর্থাত্ সরকারই হরতালে অংশগ্রহণ করে রাস্তায় গাড়ি নামায়নি! রাস্তায় পুলিশ ব্যারিকেড দিয়ে নিজেরাই গাড়ি চলাচলে এমনভাবে বাধা দিয়েছে যাতে রাস্তা গাড়িশূন্য থাকে। তাছাড়া অনেক জায়গায় পুলিশকে হরতালের পিকেটিংয়েও অংশ নিতে দেখা গেছে। এই অবস্থায় হরতালকারীরা যে হারমোনিয়াম বাজিয়ে গান গেয়ে তাদের হরতাল সফল করবে এতে আশ্চর্য কী? হরতাল শেষ হওয়ার পর দেখা গেল সরকারের চরম প্রতিক্রিয়াশীল ও ফ্যাসিস্ট স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বামপন্থী হরতালকারীদের ধন্যবাদ জানিয়েছেন! আমরা কি জিজ্ঞেস করতে পারি, এরপর বাকি থাকল কী? যে বামপন্থীরা এভাবে সরকারের বেনামি হরতাল সফল করলেন তাদের বুদ্ধির অভাব আছে একথা কেউ বলবেন না। আমরাও বলি না। কাজেই এই হরতালের সঙ্গে যে সরকারের সম্পর্ক নেই, এটা তাদের নিজস্ব উদ্যোগে ও নিজস্ব ক্ষমতার ভিত্তিতেই তারা করেছেন, এ নিয়ে নানা যুক্তি তারা দিচ্ছেন। কিন্তু মানুষ চোখের সামনে যা দেখেছে তা অবিশ্বাস করে সিপিবির নেতৃত্বাধীন বামপন্থীদের ধূর্ত বক্তব্য বিশ্বাস করবে এমন অবস্থা দেশের জনগণের নেই। ঢাকা ও বিভিন্ন জায়গার রিপোর্ট থেকে দেখা যায় যে, হরতালের জন্য পিকেটিং করার মতো কর্মীর সংখ্যা তাদের নগণ্য থাকা সত্ত্বেও হরতাল সফল হয়েছে। সরকার পক্ষ কর্তৃক হরতালের বিরুদ্ধে মারমার কাটকাট করে আগের দিন কোনো মিছিলও বের হয়নি। কারণ ‘বিজয়ের মাসে’ প্রধানমন্ত্রীর গদগদ হরতালবিরোধী বক্তব্য সত্ত্বেও নিজেদের দ্বারা প্ররোচিত ও সংগঠিত হরতাল সফল করতে তাদের কোনো অসুবিধে নেই! তাদের কথা ও কাজের মধ্যে গরমিল কোনো নতুন ব্যাপার নয়। বামপন্থীদের মাধ্যমে তাদের বেনামি হরতাল সফল করার মধ্যে এটা নতুনভাবে প্রমাণিত হলো।
১৯.১২.২০১২