শনিবার, ২ জুন, ২০১২

চট্টগ্রাম বন্দরে মার্কিন সামরিক নৌঘাঁটি নির্মাণের চক্রান্ত প্রতিহত করতে হবে

ব দ রু দ্দী ন উ ম র
অবশেষে থলের বিড়াল লাফ দিয়ে বাইরে বের হল। যা এতদিন অনেকেরই জানা ছিল এবং সরকার সাধ্যমতো সতর্কতার সঙ্গে গোপন রেখেছিল, এখন ভারতীয়রাই তা ফাঁস করল। মুম্বাই থেকে প্রকাশিত টাইমস অব ইন্ডিয়ার অনলাইন সংস্করণ ‘টাইমস নাউ’-এর এক রিপোর্টে বলা হয়েছে যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিজেদের স্ট্র্যাটেজিক উদ্দেশ্যে তাদের সপ্তম নৌবহর চট্টগ্রাম বন্দরে নোঙর করে রাখার ই”ছা প্রকাশ করেছে (উধরষু ঝঃধৎ, যুগান্তর, ইত্তেফাক ২.৬.২০১২)। এভাবে ই”ছা প্রকাশের অর্থ যে ‘ই”ছা’ পূরণের ব্যব¯’া আগেভাগেই সমাপ্ত করা, এ কথা কে না বোঝে? যে বিষয়ে যেভাবে কথাবার্তা আগে থেকেই ঠিক করে রাখা হয়েছিল, তাতেই হিলারি ক্লিনটন তার সিলমোহর মেরে গেছেন।
ফিলিপাইনের সুবিক বে-এর নৌঘাঁটি উঠিয়ে নিতে বাধ্য হওয়ার পর থেকেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অন্যত্র নৌঘাঁটির জন্য মরিয়া হয়ে চেষ্টা চালিয়ে যা”িছল। এ উদ্দেশ্যে তারা চট্টগ্রাম অথবা বাংলাদেশের অন্য কোন জায়গায় নৌঘাঁটি করার ব্যাপারে একের পর এক বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে কথাবার্তা বলে আসছিল। এখন এই প্রয়োজন তাদের আরও বৃদ্ধি পেয়েছে, কারণ ভারত মহাসাগরে দিয়াগো গার্সিয়ায় তারা ১৯৭০ দশকের মাঝামাঝি যে নৌঘাঁটি তৈরি করেছিল সেটা পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের উত্তাপ বৃদ্ধি ও বরফ গলতে থাকার সঙ্গে সঙ্গে পানিতে তলিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে এখন আর কোন অনিশ্চয়তা নেই। এই পরি¯ি’তিতে দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলে নতুন নৌঘাঁটির প্রয়োজন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য অনিবার্য হয়েছে। কিš‘ এই নৌঘাঁটির জায়গা ভারত, শ্রীলংকা থেকে নিয়ে প্রশান্ত মহাসাগরীয় কোন জায়গাতেই আর পাওয়া যা”েছ না। এদিক দিয়ে বাংলাদেশের ওপর তাদের নজর পড়েছে অনেক আগেই।
দক্ষিণ চীন সাগরে চীন বড় আকারে তার নৌবাহিনী মোতায়েন করায় জাপান থেকে নিয়ে আরব সাগর পর্যন্ত সমগ্র অঞ্চলে মার্কিন সামরিক উপ¯ি’তি জোরদার করা প্রয়োজন। মাত্র দুই দিন আগে মার্কিন প্রতিরক্ষা দফতর থেকে বলা হয়েছে যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একটি নৌশক্তি এবং এ নৌশক্তির জোরেই এ অঞ্চলে তারা আধিপত্য বজায় রেখেছে। এর থেকেই পরিষ্কার যে, তারা এ অঞ্চলে ¯’ায়ী নৌঘাঁটি নির্মাণের জন্য এখন বদ্ধপরিকর এবং মরিয়া।
এদিক দিয়ে বাংলাদেশের মতো দুর্বল এবং ই”ছুক দেশ আর কে আছে? মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এ ই”ছা অনেক আগেই পূরণ হতো যদি না এ ক্ষেত্রে তাদের ভারতের বিরোধিতার বিষয়টি হিসাব না করতে হতো। কারণ বাংলাদেশে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নৌঘাঁটি নির্মাণ করে জেঁকে বসলে বাংলাদেশের নির্ভরতা যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওপরই বৃদ্ধি পাবে এবং ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের বর্তমান সম্পর্ক যে ক্ষতিগ্রস্ত হবে এ হিসাব ভারতের আছে। অন্যান্য বিষয় ছাড়াও বাংলাদেশকে কেন্দ্র করে ভারত-মার্কিন সম্পর্ক কিছুদিন থেকে কিছুটা তিক্ত হয়েছে। বাংলাদেশ ভারতের কোলে চড়ে বসে থাকলেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার এমন এক ‘বন্ধু’ যারা বাংলাদেশে অন্যভাবে প্রভুত্ব করে। কাজেই বাংলাদেশে কার আধিপত্য অধিকতর শক্তিশালীভাবে প্রতিষ্ঠিত হবে, এ নিয়ে এখন ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে প্রতিযোগিতা বেশ তীব্র হ”েছ। চট্টগ্রামে বাংলাদেশ যদি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে নৌঘাঁটি নির্মাণ করতে দেয় এবং সপ্তম নৌবহরকে এখানে নোঙর করে রাখে, তাহলে সামরিকভাবে বাংলাদেশের ওপর যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কবজা আরও শক্ত হবে এতে সন্দেহ নেই। এটা ঘটলে চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের বর্তমান সম্পর্ক অবশ্যই খারাপ হবে। বাংলাদেশ নিজের কোন স্বার্থে এটা ঘটতে দিতে পারে? কোন লাভের আশায় বাংলাদেশ এ অঞ্চলে সাম্রাজ্যবাদের দ্বন্দ্ব-সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে মার্কিনের কলকাঠি হিসেবে নিজেকে ব্যবহƒত হতে দিতে পারে? প্রথমত উল্লেখযোগ্য যে, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ পরি¯ি’তির ওপর এর প্রভাব পড়বে খুব বিপজ্জনকভাবে। বাংলাদেশে কোন বড় আকারে গণআন্দোলন বা গণঅভ্যুত্থান হলে সে ক্ষেত্রে সরাসরি মার্কিন হস্তক্ষেপ চট্টগ্রামে অন্তত নৌবাহিনী থাকলে যত সুবিধা হবে অন্য অব¯’ায় তত সুবিধা হবে না। এটা শুধু বাংলাদেশের প্রগতিশীল, গণতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক শক্তির জন্যই নয়, ভারতের জন্যও এক অতি উদ্বেগজনক ব্যাপার।
সপ্তম নৌবহরকে চট্টগ্রাম বন্দরে নোঙর করতে দেয়া বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে এক ক্ষমার অযোগ্য বেঈমানি। অন্য কথা বাদ দিয়ে এটা মোটেই ভুলে যাওয়ার ব্যাপার নয় যে, ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় এ অঞ্চলে পাকিস্তানি শাসন টিকিয়ে রাখার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাদের এই সপ্তম নৌবহর নিয়ে আসার হুমকি দিয়েছিল এবং প্র¯‘তি গ্রহণ করেছিল। এ নিয়ে তখন বাংলাদেশে এবং বিশ্বের অন্যান্য অনেক দেশে তুমুল বিরোধিতা হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত সপ্তম নৌবহর বঙ্গোপসাগরে মোতায়েন করা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে সম্ভব হয়নি। কিš‘ সেটা সম্ভব না হলেও যে নৌবহরকে বাংলার স্বাধীনতার বির“দ্ধে ব্যবহারের হুমকি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দিয়েছিল, সেই নৌবহরকে চট্টগ্রামে নোঙর করার অনুমতি দেয়া যদি দেশের স্বাধীনতা ও জনগণের প্রতি বেঈমানি না হয়, তাহলে বেঈমানি আর কাকে বলে? বর্তমান আওয়ামী লীগ সভানেত্রী এবং তাদের তথাকথিত জোট সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এখন এই চরম বেঈমানির সব প্র¯‘তি পাকাপোক্ত করেছেন। শেখ হাসিনার বেঈমানির এটাই প্রথম দৃষ্টান্ত নয়। চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তির জন্য তিনি প্যারিসে কিসিঞ্জারের হাত থেকে ‘শান্তি পুরস্কার’ পর্যন্ত নিতে অসুবিধা বোধ করেননি! পার্বত্য চট্টগ্রামে ১৯৯৭ সালে যে শান্তিচুক্তি হয়েছিল তার ফলে পার্বত্য চট্টগ্রামে কী শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, সেটা প্রায় প্রতিদিন শান্তিচুক্তির অন্যতম স্বাক্ষরকারী সš‘ লারমার নিয়মিত বিলাপ এবং ক্রন্দন থেকেই বোঝা যায়। সš‘ লারমা ও পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির হাতে তামাক খেয়ে শেখ হাসিনা কিসিঞ্জারের হাত থেকে শান্তি পুরস্কার নিলেও যে শান্তি পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন সেখানকার অশান্ত পরি¯ি’তিই তার ভুয়া চরিত্র প্রতিদিনই প্রমাণ করছে।
এই কিসিঞ্জার কে? প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের প্রভাবশালী পররাষ্ট্রমন্ত্রী পাকিস্তানের পক্ষে এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতার বির“দ্ধে যে চরম বিরোধী অব¯’ান গ্রহণ করে অনেক শত্র“তা করেছিলেন, সেটা কারও অজানা নয়। একটি ভুয়া শান্তিচুক্তি করে শেখ হাসিনা কিসিঞ্জারের মতো একজন ঘৃণ্য সাম্রাজ্যবাদীর হাত থেকে শান্তি পুরস্কার নিয়ে নিজেকে কলঙ্কিত করেছিলেন এবং বাংলাদেশের ইজ্জত আন্তর্জাতিক মহলে ক্ষুণœ ও খর্ব করেছিলেন। এর জন্য তাকে বাংলাদেশের জনগণের কাছে ক্ষমা চাইতে বলার দাবি অবশ্যই করা যেতে পারে। কিš‘ এখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সপ্তম নৌবহরকে চট্টগ্রামে নোঙর এবং চট্টগ্রামে মার্কিন নৌঘাঁটি নির্মাণ করতে দিয়ে দেশকে সর্বনাশের দোরগোড়ায় দাঁড় করানোর যে চক্রান্ত শেখ হাসিনা করছেন তার জন্য তাকে ক্ষমা করার সব পথ তিনি নিজেই বন্ধ করেছেন। 
বাংলাদেশে সপ্তম নৌবহরকে নোঙর করতে দেয়া এবং চট্টগ্রামে মার্কিন নৌঘাঁটি ¯’াপনের অর্থ ইরাক, আফগানিস্তান, পাকিস্তান ইত্যাদি দেশ থেকে হাত গুটিয়ে আসতে বাধ্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে তাদের সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধ এলাকা বাংলাদেশে সম্প্রসারিত করারই এক চক্রান্ত। এই চক্রান্ত আমাদের জন্য এক বিপজ্জনক ব্যাপার।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বপরিসরে এখন চীনকে তার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে মনে করে। চীন প্রশান্ত মহাসাগর অঞ্চলে যেভাবে শক্তিশালী হয়েছে ও নিজের শক্তি আরও বৃদ্ধি করছে তার মোকাবেলা করা বিশ্বশক্তি হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য প্রয়োজন। কিš‘ তাদের এ প্রয়োজনের সঙ্গে বাংলাদেশ কেন জড়িত হবে? আমরা জানি, যেসব দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এই সাম্রাজ্যবাদী পরিকল্পনা ও তৎপরতার সঙ্গে জড়িত হয়েছে বা তাদের খপ্পরে পড়েছে সেসব দেশ তছনছ হয়ে গেছে। সেসব দেশের জনগণের জন্য অসীম দুর্দশা নেমে এসেছে। বাংলাদেশে এমনিতেই জনগণের দুর্দশার শেষ নেই। তার ওপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থে এ দেশে আরও বড় রকম সর্বনাশের ব্যব¯’া করা থেকে দেশ ও জনগণের প্রতি বড় বেঈমানি আর কী হতে পারে? আওয়ামী লীগ সভাপতি এবং তাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আজ দেশ ও জনগণের সঙ্গে এই বেঈমানি করে সারা বাংলাদেশকে তার ‘সদ্য বিজিত’ বঙ্গোপসাগরে ভাসিয়ে দেয়ার চক্রান্তে লিপ্ত হয়েছেন। তার এ চক্রান্ত দেশের জনগণকে ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিরোধ করতে হবে। এই মার্কিন ঘাঁটি বাংলাদেশে আমরা কিছুতেই তৈরি হতে দিতে পারি না। শেখ হাসিনা এবং আওয়ামী লীগ সরকারের এই বেঈমানি প্রতিহত করার থেকে এ মুহূর্তে জনগণের সামনে অন্য কোন গুর“ত্বপূর্ণ রাজনৈতিক কর্মসূচি আর নেই। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের গণমাধ্যমকেও উপযুক্ত গুর“ত্বসহকারে ও জর“রি ভিত্তিতে এগিয়ে আসতে হবে।
২-৬-২০১২

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন