ব দ রু দ্দী ন উ ম র
ঢাকার উপকণ্ঠে আশুলিয়া শিল্পাঞ্চলে গার্মেন্ট কারখানা মালিকরা বিগত ১৭ জুন রোববার ৩০০ কারখানা বন্ধ করে দিয়েছেন। তাদের দাবি হলো, সরকার যতদিন পর্যন্ত না আশুলিয়া শিল্প এলাকায় আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক করবে এবং যে গার্মেন্ট শ্রমিকরা সেখানে ‘নৈরাজ্য’ সৃষ্টি করেছে তাদের শাস্তির ব্যবস্থা করবে—ততদিন তারা তাদের কারখানা বন্ধ রাখবেন! গার্মেন্ট ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন এবং বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন যৌথভাবে এই সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে। এর আগে ৬ দিন একটানা আশুলিয়া অঞ্চলে শ্রমিক অসন্তোষের কারণে সেখানকার কারখানাগুলো বন্ধ ছিল। এ সময় শ্রমিকরা কিছু কিছু কারখানা আক্রমণ করে ভাংচুর এবং সড়ক অবরোধ করেন।
এ ধরনের ঘটনা বাংলাদেশে নতুন নয়। কিছুদিন পরপর বিভিন্ন অঞ্চলে গার্মেন্ট শিল্পাঞ্চলগুলোতে শ্রমিক অসন্তোষ ও সংঘর্ষ দেখা যায়। একদিকে গার্মেন্ট মালিক শ্রেণী ও সরকার এবং অন্যদিকে শ্রমিকরা মুখোমুখি হয়েই সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। বাংলাদেশে গার্মেন্ট শিল্পাঞ্চলগুলোতে এভাবে যে ঘটনা দেখা যায়, এটা মনে করিয়ে দেয় ইংল্যান্ডে তিনশ’ বছর আগের কথা। শ্রমিকরা নির্মম শোষণের দুর্বিষহ অবস্থায় মাঝে মাঝে বর্ধিত মজুরি দাবি এবং নানা নির্যাতনের বিরোধিতা করতে দাঁড়িয়ে কারখানা আক্রমণ করে যন্ত্রপাতি কারখানা বিল্ডিং ভাংচুর করতেন। তাদের ওপর পুলিশি আক্রমণ হতো। ইংল্যান্ড এবং দুনিয়ার শিল্পায়িত কোনো দেশে উনিশ শতক থেকে এ রকম অবস্থা আর দেখা যায় না। ভারতে এটা কোনো সময়েই দেখা যায়নি। পাকিস্তান আমলেও এরকম কোনো ঘটনা ঘটেনি। কিন্তু বাংলাদেশের গার্মেন্ট শিল্পে এটা একরকম নিয়মিত ঘটনা। লক্ষণীয় ব্যাপার যে, গার্মেন্ট শিল্প ছাড়া অন্য কোনো শিল্পাঞ্চলে এটা ঘটে না। সেখানে শ্রমিকদের সঙ্গে পুলিশ ও মালিকদের ভাড়া করা গুণ্ডাদের সংঘর্ষ হয়, কিন্তু কারখানা, বিল্ডিং এবং যন্ত্রপাতি ভাংচুরের কোনো ঘটনা ঘটতে দেখা যায় না। বিস্ময়ের ব্যাপার যে, বাংলাদেশ সরকার এবং গার্মেন্ট শিল্প মালিকরা এসব বিষয় খেয়াল ও বিবেচনারও কোনো প্রয়োজন বোধ করেন না। ‘চক্রান্ত’ তত্ত্বের ওপর দাঁড়িয়ে তারা শ্রমিকদের ওপর হম্বিতম্বি করেন এবং পুলিশ, র্যাব, শিল্প পুলিশ ও গুণ্ডাবাহিনী দিয়ে শ্রমিকদের ঠাণ্ডা করার চেষ্টাতেই তারা নিয়োজিত থাকেন।
ইংল্যান্ডে তিনশ’ বছরেরও বেশি আগে শিল্প মালিকরা শ্রমিকদের দ্বারা কলকারখানা আক্রান্ত হতে থাকার সময় শ্রমিকদের ওপর নির্যাতন করে তা বন্ধের চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। শোষণ-নির্যাতন শ্রমিকদের মধ্যে যে ক্ষোভ সৃষ্টি করে, সেই ক্ষোভের এ ধরনের অভিব্যক্তি বন্ধ করতে না পারার পরই তারা এর কারণ অনুসন্ধানে নিযুক্ত হয় এবং নিজেদের অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে উপলব্ধি করে যে, শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধি ছাড়া উপায় নেই এবং এ জন্য দরকার শ্রমিক-মালিক আলাপ-আলোচনা ও দরদস্তুরের উপায় বের করা। শ্রমিকরা এজন্যই ট্রেড ইউনিয়ন গড়ে তোলার চেষ্টা করতেন। কিন্তু মালিকরা ছিল তার ঘোর বিরোধী। কিন্তু শেষ পর্যন্ত মালিকরা শিল্পাঞ্চলে এবং কলকারখানায় সংঘর্ষ বন্ধের উপায় হিসেবে ট্রেড ইউনিয়নকে স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হয়। ধর্মঘটও শ্রমিক আন্দোলনের একটা উপায় হিসেবে স্বীকৃত হয়। পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় শ্রমিক-মালিকের মধ্যকার দ্বন্দ্ব বন্ধ হওয়ার নয়। কিন্তু সেই দ্বন্দ্ব নিয়ন্ত্রণের জন্য যে ট্রেড ইউনিয়নের প্রয়োজনীয়তা অপরিহার্য, এই স্বীকৃতি তিনশ’ বছর আগেকার পরিস্থিতি পরিবর্তন করতে সক্ষম হয়। শ্রমিক-মালিক সম্পর্কের আধুনিকায়ন হয়। এ কারণেই আধুনিক শিল্প ব্যবস্থায় শ্রমিকদের অনেক গুরুত্বপূর্ণ অধিকার আন্তর্জাতিকভাবেও স্বীকৃত হয় এবং এর জন্য জাতিসংঘ আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) তাদের কনভেনশনে অনেক সুনির্দিষ্ট বিধি নির্ধারণ করে। এগুলোর মধ্যে শ্রমিকদের জন্য নিয়োগপত্র, ছুটি বিষয়ক নিয়মকানুন তো আছেই, কিন্তু সর্বোপরি আছে শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়নের অধিকার। বাংলাদেশ সরকার আইএলও’র সব বিধি কার্যকর না করলেও এগুলো সাধারণভাবে স্বীকার করে এবং মেনে চলে। কিন্তু এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ করা দরকার, বাংলাদেশ সরকার প্রথম থেকেই গার্মেন্ট শিল্পকে আইএলও’র সব রকম বিধির সম্পূর্ণ বাইরে রেখে এই শিল্পে সম্পূর্ণভাবে শ্রমিকবিরোধী কার্যকলাপ অবাধে চালিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করেছে। এখানে আরও বলা দরকার, দুনিয়ার বহু দেশে গার্মেন্ট শিল্প থাকলেও এই শিল্পকে আইএলও’র আওতাবহির্ভূত রেখে গার্মেন্ট শিল্প মালিকদের এভাবে অবাধ শোষণ-নির্যাতনের এখতিয়ার কোনো দেশই দেয়নি।
এসব বিষয় বিবেচনা করে বেশ জোরের সঙ্গেই বলা দরকার যে, গার্মেন্ট শিল্পে এখন যে পরিস্থিতি দেখা যাচ্ছে, যে স্থায়ী অসন্তোষ এবং সংঘর্ষ গার্মেন্ট শিল্পাঞ্চলগুলোতে দেখা যায়—এর অবসানের জন্য প্রয়োজন বাংলাদেশে এই শিল্প ব্যবস্থার বর্বর অবস্থা পরিবর্তন করে এর আধুনিকায়ন করা। এ জন্য প্রথমেই সরকারের প্রয়োজন গার্মেন্ট শিল্পকে আইএলও’র নিয়মকানুনের অধীনস্থ করা। শ্রমিকদের নিয়োগপত্র, ছুটি, মজুরি, ওভারটাইম ইত্যাদি যুক্তিসম্মত করা এবং সর্বোপরি শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন অধিকারের স্বীকৃতি প্রদান করা। প্রত্যেক গার্মেন্ট শিল্প কারখানা এবং শিল্পাঞ্চলে ও জাতীয় ভিত্তিতে যাতে ট্রেড ইউনিয়ন গঠিত হয় তার জন্য সরকারিভাবেই উদ্যোগ গ্রহণ করা।
বর্তমানে গার্মেন্ট শ্রমিকরা শুরুতে ৩০০০ টাকা থেকে নিয়ে ৫০০০ টাকা পর্যন্ত মাসিক মজুরি পেয়ে থাকেন। এছাড়া ওভারটাইম নিয়েও অনেক ফাঁকিবাজির ব্যবস্থা আছে। এই মজুরিতে একজন শ্রমিকের পক্ষে পরিবার নিয়ে সুস্থ ও কর্মক্ষম থাকা যে সম্ভব নয়, এটা কাউকে বুঝিয়ে বলার প্রয়োজন হয় না। অনেক গার্মেন্ট মালিক একটি কুকুরের পেছনেও মাসে এর থেকে অনেক বেশি টাকা ব্যয় করে থাকেন! এই পরিস্থিতি চলতে দেয়া যায় না। শ্রমিকদের মজুরি উপযুক্তভাবে বৃদ্ধি ও নিয়মিত করা থেকে নিয়ে তাদের জীবনযাপন কিছুটা স্বাভাবিক করার চেষ্টা সরকারকে আইন করেই মালিকদের এ কাজে বাধ্য করতে হবে। কারণ মানসিকভাবে বর্বর যুগে বাস করা এই মালিকরা যে স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে নিজেদের উদ্যোগে এটা করবে, এমনটা মনে করার কোনো কারণ নেই। শ্রমিকরা মূলত মজুরির দাবিতেই আন্দোলন করে থাকেন। এই দাবির স্বীকৃতি এবং এর জন্য মালিক ও সরকারের সঙ্গে আলোচনা এবং দরদস্তুরের কোনো সাংগঠনিক ব্যবস্থা না থাকায় এই মুহূর্তে শ্রমিকদের নিয়োগপত্র এবং ট্রেড ইউনিয়নের ব্যবস্থা সরকারকেই করতে হবে। কারণ বাংলাদেশে যে পরিস্থিতি বিরাজ করছে তাতে গার্মেন্ট শিল্প এলাকায় সঙ্কট কোনো দ্বিপাক্ষিক সঙ্কট নয়। এখানে তৃতীয় পক্ষ হচ্ছে সরকার। কিন্তু সরকার এ পর্যন্ত তার দায়িত্ব পালনের ধারেকাছে না গিয়ে মালিকদের পক্ষ নিয়ে গার্মেন্ট শিল্প এলাকায় র্যাব এবং পুলিশ থাকা সত্ত্বেও শিল্প পুলিশ নামে এক নতুন বাহিনী তৈরি করেছে। এই বাহিনী মালিকদের প্রয়োজনে ও মালিকদের পক্ষ নিয়ে শ্রমিকদের ওপর নির্যাতন চালিয়ে যাচ্ছে।
গার্মেন্ট মালিকরা ও তাদের একাধিক সংগঠন এবং সরকার এই শিল্পে শ্রমিক অসন্তোষকে বাইরের ষড়যন্ত্র বলে প্রচার করছে। এসব কথায় কান দেয়ার মতো লোক দেশে নেই বললেই চলে। এর দ্বারা প্রকৃতপক্ষে কেউ বিভ্রান্তও হচ্ছে না। এই পরিস্থিতিতে গার্মেন্ট মালিকরা আশুলিয়া অঞ্চলে নিজেদের ৩০০ থেকে বেশি কারখানা বন্ধ রেখেছেন এবং হুমকি দিচ্ছেন আর একটি কারখানা আক্রান্ত হলে তারা সারা দেশে যত কারখানা আছে সব বন্ধ করে দেবেন!! শ্রমিকদের ওপর অকথ্য শোষণ-নির্যাতন চালিয়ে যারা দুনিয়ার মধ্যে সব থেকে বেশি মুনাফা এই শিল্প থেকে করছেন, তারা নিজেদের কারখানা ক’দিন বন্ধ রাখতে পারেন সেটা দেখা যাবে। কারখানা যাতে তাড়াতাড়ি আবার চালু করা যায় এজন্য তারা সরকারকে তার শ্রমিক দমন কর্ম জোরদার করার জন্য চাপ দিচ্ছেন। শ্রমিকদের কাজ ও মজুরি দরকার। কিন্তু তার থেকে বেশি দরকার মালিকদের মুনাফা। কাজেই মালিকদের কারখানা অবশ্যই খুলতে হবে। এর কোনো বিকল্প তাদের সামনে নেই। তবে তারা নিজেদের অতিরিক্ত মুনাফার হার কিছুটা কমিয়ে যদি শ্রমিকদের মজুরি যুক্তিসঙ্গতভাবে বৃদ্ধি না করেন এবং তাদের বিধিসম্মত অধিকারগুলোকে যদি স্বীকৃতি না দেন তাহলে তারা নিজেরাই বাংলাদেশে গার্মেন্ট শিল্পের ধ্বংস সাধন করবেন।
২০.৬.২০১২
এ ধরনের ঘটনা বাংলাদেশে নতুন নয়। কিছুদিন পরপর বিভিন্ন অঞ্চলে গার্মেন্ট শিল্পাঞ্চলগুলোতে শ্রমিক অসন্তোষ ও সংঘর্ষ দেখা যায়। একদিকে গার্মেন্ট মালিক শ্রেণী ও সরকার এবং অন্যদিকে শ্রমিকরা মুখোমুখি হয়েই সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। বাংলাদেশে গার্মেন্ট শিল্পাঞ্চলগুলোতে এভাবে যে ঘটনা দেখা যায়, এটা মনে করিয়ে দেয় ইংল্যান্ডে তিনশ’ বছর আগের কথা। শ্রমিকরা নির্মম শোষণের দুর্বিষহ অবস্থায় মাঝে মাঝে বর্ধিত মজুরি দাবি এবং নানা নির্যাতনের বিরোধিতা করতে দাঁড়িয়ে কারখানা আক্রমণ করে যন্ত্রপাতি কারখানা বিল্ডিং ভাংচুর করতেন। তাদের ওপর পুলিশি আক্রমণ হতো। ইংল্যান্ড এবং দুনিয়ার শিল্পায়িত কোনো দেশে উনিশ শতক থেকে এ রকম অবস্থা আর দেখা যায় না। ভারতে এটা কোনো সময়েই দেখা যায়নি। পাকিস্তান আমলেও এরকম কোনো ঘটনা ঘটেনি। কিন্তু বাংলাদেশের গার্মেন্ট শিল্পে এটা একরকম নিয়মিত ঘটনা। লক্ষণীয় ব্যাপার যে, গার্মেন্ট শিল্প ছাড়া অন্য কোনো শিল্পাঞ্চলে এটা ঘটে না। সেখানে শ্রমিকদের সঙ্গে পুলিশ ও মালিকদের ভাড়া করা গুণ্ডাদের সংঘর্ষ হয়, কিন্তু কারখানা, বিল্ডিং এবং যন্ত্রপাতি ভাংচুরের কোনো ঘটনা ঘটতে দেখা যায় না। বিস্ময়ের ব্যাপার যে, বাংলাদেশ সরকার এবং গার্মেন্ট শিল্প মালিকরা এসব বিষয় খেয়াল ও বিবেচনারও কোনো প্রয়োজন বোধ করেন না। ‘চক্রান্ত’ তত্ত্বের ওপর দাঁড়িয়ে তারা শ্রমিকদের ওপর হম্বিতম্বি করেন এবং পুলিশ, র্যাব, শিল্প পুলিশ ও গুণ্ডাবাহিনী দিয়ে শ্রমিকদের ঠাণ্ডা করার চেষ্টাতেই তারা নিয়োজিত থাকেন।
ইংল্যান্ডে তিনশ’ বছরেরও বেশি আগে শিল্প মালিকরা শ্রমিকদের দ্বারা কলকারখানা আক্রান্ত হতে থাকার সময় শ্রমিকদের ওপর নির্যাতন করে তা বন্ধের চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। শোষণ-নির্যাতন শ্রমিকদের মধ্যে যে ক্ষোভ সৃষ্টি করে, সেই ক্ষোভের এ ধরনের অভিব্যক্তি বন্ধ করতে না পারার পরই তারা এর কারণ অনুসন্ধানে নিযুক্ত হয় এবং নিজেদের অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে উপলব্ধি করে যে, শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধি ছাড়া উপায় নেই এবং এ জন্য দরকার শ্রমিক-মালিক আলাপ-আলোচনা ও দরদস্তুরের উপায় বের করা। শ্রমিকরা এজন্যই ট্রেড ইউনিয়ন গড়ে তোলার চেষ্টা করতেন। কিন্তু মালিকরা ছিল তার ঘোর বিরোধী। কিন্তু শেষ পর্যন্ত মালিকরা শিল্পাঞ্চলে এবং কলকারখানায় সংঘর্ষ বন্ধের উপায় হিসেবে ট্রেড ইউনিয়নকে স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হয়। ধর্মঘটও শ্রমিক আন্দোলনের একটা উপায় হিসেবে স্বীকৃত হয়। পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় শ্রমিক-মালিকের মধ্যকার দ্বন্দ্ব বন্ধ হওয়ার নয়। কিন্তু সেই দ্বন্দ্ব নিয়ন্ত্রণের জন্য যে ট্রেড ইউনিয়নের প্রয়োজনীয়তা অপরিহার্য, এই স্বীকৃতি তিনশ’ বছর আগেকার পরিস্থিতি পরিবর্তন করতে সক্ষম হয়। শ্রমিক-মালিক সম্পর্কের আধুনিকায়ন হয়। এ কারণেই আধুনিক শিল্প ব্যবস্থায় শ্রমিকদের অনেক গুরুত্বপূর্ণ অধিকার আন্তর্জাতিকভাবেও স্বীকৃত হয় এবং এর জন্য জাতিসংঘ আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) তাদের কনভেনশনে অনেক সুনির্দিষ্ট বিধি নির্ধারণ করে। এগুলোর মধ্যে শ্রমিকদের জন্য নিয়োগপত্র, ছুটি বিষয়ক নিয়মকানুন তো আছেই, কিন্তু সর্বোপরি আছে শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়নের অধিকার। বাংলাদেশ সরকার আইএলও’র সব বিধি কার্যকর না করলেও এগুলো সাধারণভাবে স্বীকার করে এবং মেনে চলে। কিন্তু এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ করা দরকার, বাংলাদেশ সরকার প্রথম থেকেই গার্মেন্ট শিল্পকে আইএলও’র সব রকম বিধির সম্পূর্ণ বাইরে রেখে এই শিল্পে সম্পূর্ণভাবে শ্রমিকবিরোধী কার্যকলাপ অবাধে চালিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করেছে। এখানে আরও বলা দরকার, দুনিয়ার বহু দেশে গার্মেন্ট শিল্প থাকলেও এই শিল্পকে আইএলও’র আওতাবহির্ভূত রেখে গার্মেন্ট শিল্প মালিকদের এভাবে অবাধ শোষণ-নির্যাতনের এখতিয়ার কোনো দেশই দেয়নি।
এসব বিষয় বিবেচনা করে বেশ জোরের সঙ্গেই বলা দরকার যে, গার্মেন্ট শিল্পে এখন যে পরিস্থিতি দেখা যাচ্ছে, যে স্থায়ী অসন্তোষ এবং সংঘর্ষ গার্মেন্ট শিল্পাঞ্চলগুলোতে দেখা যায়—এর অবসানের জন্য প্রয়োজন বাংলাদেশে এই শিল্প ব্যবস্থার বর্বর অবস্থা পরিবর্তন করে এর আধুনিকায়ন করা। এ জন্য প্রথমেই সরকারের প্রয়োজন গার্মেন্ট শিল্পকে আইএলও’র নিয়মকানুনের অধীনস্থ করা। শ্রমিকদের নিয়োগপত্র, ছুটি, মজুরি, ওভারটাইম ইত্যাদি যুক্তিসম্মত করা এবং সর্বোপরি শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন অধিকারের স্বীকৃতি প্রদান করা। প্রত্যেক গার্মেন্ট শিল্প কারখানা এবং শিল্পাঞ্চলে ও জাতীয় ভিত্তিতে যাতে ট্রেড ইউনিয়ন গঠিত হয় তার জন্য সরকারিভাবেই উদ্যোগ গ্রহণ করা।
বর্তমানে গার্মেন্ট শ্রমিকরা শুরুতে ৩০০০ টাকা থেকে নিয়ে ৫০০০ টাকা পর্যন্ত মাসিক মজুরি পেয়ে থাকেন। এছাড়া ওভারটাইম নিয়েও অনেক ফাঁকিবাজির ব্যবস্থা আছে। এই মজুরিতে একজন শ্রমিকের পক্ষে পরিবার নিয়ে সুস্থ ও কর্মক্ষম থাকা যে সম্ভব নয়, এটা কাউকে বুঝিয়ে বলার প্রয়োজন হয় না। অনেক গার্মেন্ট মালিক একটি কুকুরের পেছনেও মাসে এর থেকে অনেক বেশি টাকা ব্যয় করে থাকেন! এই পরিস্থিতি চলতে দেয়া যায় না। শ্রমিকদের মজুরি উপযুক্তভাবে বৃদ্ধি ও নিয়মিত করা থেকে নিয়ে তাদের জীবনযাপন কিছুটা স্বাভাবিক করার চেষ্টা সরকারকে আইন করেই মালিকদের এ কাজে বাধ্য করতে হবে। কারণ মানসিকভাবে বর্বর যুগে বাস করা এই মালিকরা যে স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে নিজেদের উদ্যোগে এটা করবে, এমনটা মনে করার কোনো কারণ নেই। শ্রমিকরা মূলত মজুরির দাবিতেই আন্দোলন করে থাকেন। এই দাবির স্বীকৃতি এবং এর জন্য মালিক ও সরকারের সঙ্গে আলোচনা এবং দরদস্তুরের কোনো সাংগঠনিক ব্যবস্থা না থাকায় এই মুহূর্তে শ্রমিকদের নিয়োগপত্র এবং ট্রেড ইউনিয়নের ব্যবস্থা সরকারকেই করতে হবে। কারণ বাংলাদেশে যে পরিস্থিতি বিরাজ করছে তাতে গার্মেন্ট শিল্প এলাকায় সঙ্কট কোনো দ্বিপাক্ষিক সঙ্কট নয়। এখানে তৃতীয় পক্ষ হচ্ছে সরকার। কিন্তু সরকার এ পর্যন্ত তার দায়িত্ব পালনের ধারেকাছে না গিয়ে মালিকদের পক্ষ নিয়ে গার্মেন্ট শিল্প এলাকায় র্যাব এবং পুলিশ থাকা সত্ত্বেও শিল্প পুলিশ নামে এক নতুন বাহিনী তৈরি করেছে। এই বাহিনী মালিকদের প্রয়োজনে ও মালিকদের পক্ষ নিয়ে শ্রমিকদের ওপর নির্যাতন চালিয়ে যাচ্ছে।
গার্মেন্ট মালিকরা ও তাদের একাধিক সংগঠন এবং সরকার এই শিল্পে শ্রমিক অসন্তোষকে বাইরের ষড়যন্ত্র বলে প্রচার করছে। এসব কথায় কান দেয়ার মতো লোক দেশে নেই বললেই চলে। এর দ্বারা প্রকৃতপক্ষে কেউ বিভ্রান্তও হচ্ছে না। এই পরিস্থিতিতে গার্মেন্ট মালিকরা আশুলিয়া অঞ্চলে নিজেদের ৩০০ থেকে বেশি কারখানা বন্ধ রেখেছেন এবং হুমকি দিচ্ছেন আর একটি কারখানা আক্রান্ত হলে তারা সারা দেশে যত কারখানা আছে সব বন্ধ করে দেবেন!! শ্রমিকদের ওপর অকথ্য শোষণ-নির্যাতন চালিয়ে যারা দুনিয়ার মধ্যে সব থেকে বেশি মুনাফা এই শিল্প থেকে করছেন, তারা নিজেদের কারখানা ক’দিন বন্ধ রাখতে পারেন সেটা দেখা যাবে। কারখানা যাতে তাড়াতাড়ি আবার চালু করা যায় এজন্য তারা সরকারকে তার শ্রমিক দমন কর্ম জোরদার করার জন্য চাপ দিচ্ছেন। শ্রমিকদের কাজ ও মজুরি দরকার। কিন্তু তার থেকে বেশি দরকার মালিকদের মুনাফা। কাজেই মালিকদের কারখানা অবশ্যই খুলতে হবে। এর কোনো বিকল্প তাদের সামনে নেই। তবে তারা নিজেদের অতিরিক্ত মুনাফার হার কিছুটা কমিয়ে যদি শ্রমিকদের মজুরি যুক্তিসঙ্গতভাবে বৃদ্ধি না করেন এবং তাদের বিধিসম্মত অধিকারগুলোকে যদি স্বীকৃতি না দেন তাহলে তারা নিজেরাই বাংলাদেশে গার্মেন্ট শিল্পের ধ্বংস সাধন করবেন।
২০.৬.২০১২
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন