ব দ র“ দ্দী ন উ ম র
যারা সরকারি গদিতে বসে আছে তাদের কাছে জনগণ ভোটার ছাড়া অন্য কিছু নয়। এ কারণে যারা ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য নির্বাচন করে, তারা ভোটের সময় জনগণের কাছে হাজির হয় ভোটের ভিক্ষার পাত্র হাতে। ভোটের বিনিময়ে তাদের সবকিছু দেয়ার প্রতিশ্র“তি দেয়। তাদের এক স্বর্ণোজ্জ্বল ভবিষ্যতের কথা বলে। এ সবটাই হল জনগণকে প্রতারিত করার ফাঁদ। এই ফাঁদে পড়ে জনগণ তাদের ভোট দিয়ে ক্ষমতায় বসান। কিš‘ ক্ষমতায় বসার পরই গদিনশিনরা ভোটের ভিক্ষা পাত্র ফেলে দিয়ে ভোটার অর্থাৎ জনগণের হাতে ভিক্ষার পাত্র তুলে দেয়। এ কারণে নির্বাচনের পর জনগণ সরকারকে তাদের নির্বাচনী প্রতিশ্র“তি পালনের জন্য আবেদন জানাতে থাকেন, কিš‘ তাদের ভিক্ষার পাত্রে প্রায় কিছুই পড়ে না। উপরš‘ তাদের অব¯’া আরও কর“ণ হয়। বাংলাদেশে যে ‘গণতান্ত্রিক’ ব্যব¯’া চালু আছে, সেই গণতন্ত্রের এটাই হল মর্মব¯‘।
ক্ষমতায় গিয়ে এরা এতই বেপরোয়াভাবে লুটপাটে মত্ত থাকে যে, নিজেদের তৈরি সংবিধান পর্যন্ত কথায় কথায় পা দিয়ে মাড়িয়ে চলতে দ্বিধাবোধ করে না। এরা এমনভাবে নিজেরাই সংবিধান লঙ্ঘন করে, যাতে অব¯’া দেখে মনে হয় দেশটা কোন সংবিধান ছাড়াই গড্ডলিকা প্রবাহে গড়িয়ে চলেছে। সংবিধানের ব্যাপারে এদের একটু চাঙ্গাভাব তখনই দেখা যায় যখন এমন কোন মামলা হয়। তখন সংবিধানকে টানাটানির প্রয়োজন হয়। সে সময় সংবিধান নিয়ে অনেক বড় বড় কথা এদের মুখে শোনা যায়। সংবিধান লঙ্ঘন করার অভিযোগে অন্যদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে এরা উৎসাহিত থাকে। এ ব্যব¯’ায় আদালত এদের কথামতোই কাজ করেন। এই হল বাংলাদেশে বিদ্যমান ‘গণতান্ত্রিক’ ব্যব¯’ার হালচাল।
এই পরি¯ি’তিতে ২০১২-১৩ সালের বাজেট জাতীয় সংসদে পেশ করা হয়েছে। গত সপ্তাহে ১৭ জুন ‘জনগণের দুশমনদের বাজেট’ এই শিরোনামে আমি লিখেছিলাম। সেখানে জনগণের স্বা¯’্য ব্যব¯’া বিষয়ে আমি সামান্য লিখেছিলাম। এখানে সে বিষয়টির ওপরই আরেকটু বিশদভাবে কিছু বলা দরকার। অর্থমন্ত্রী তার বাজেটে ‘স্বা¯’্য ও পরিবার কল্যাণ’ খাতে ৯ হাজার ৩৫৫ কোটি টাকা ধার্য করেছেন। এবার শিক্ষা খাতে ব্যয় গত বছরের তুলনায় কমিয়ে আনা হলেও স্বা¯’্য খাতের অব¯’া আরও খারাপ। যে বরাদ্দ এই খাতে বর্তমান বাজেটে ধরা হয়েছে, এর মধ্যে অনেক কারসাজি আছে। কারণ এটা শুধু স্বা¯’্য খাত নয়, এর সঙ্গে যুক্ত আছে পরিবার-পরিকল্পনা। পরিবার-পরিকল্পনার সঙ্গে স্বা¯ে’্যর একটা সম্পর্ক থাকলেও এ দুইকে এক করার কোন প্রয়োজন হয় না। ‘পরিবার-পরিকল্পনা’ খাতে বরাদ্দ পৃথকভাবে দেখানোই দরকার। কিš‘ সেটা না করে স্বা¯’্য খাতে ব্যয় যা প্রকৃতপক্ষে বরাদ্দ করা হয়েছে তার পরিমাণ বাড়িয়ে দেখানোর উদ্দেশ্যেই এখানে স্বা¯’্য খাতের সঙ্গে পরিবার পরিকল্পনাজুড়ে দেয়া হয়েছে। এভাবে কাজটি করায় এর থেকে বোঝার উপায় নেই যে, স্বা¯’্য খাত ও পরিবার-পরিকল্পনা খাতে পর্যায়ক্রমে ঠিক কত বরাদ্দ করা হয়েছে। তবে এ দুই খাতকে একত্রে উপ¯ি’ত করে যে বরাদ্দ করা হয়েছে, সেটা বাংলাদেশের জিডিপি বা জাতীয় উৎপাদনের শতকরা এক ভাগেরও কম! অথচ এটা সারা বিশ্বে এবং বিশ্ব স্বা¯’্য সং¯’া (ডব্লিউএইচও) কর্তৃকও স্বীকৃত যে স্বা¯’্য খাতে ব্যয় হওয়া দরকার জিডিপির অন্তত ৫ ভাগ!
লক্ষ্য করার বিষয় যে, অর্থমন্ত্রী দেশের জনসংখ্যা ১৫ কোটি বলে জনসংখ্যা বৃদ্ধির কথা বলেছেন। অথচ এই বর্ধিত জনসংখ্যার জন্য স্বা¯’্য খাতে এ বছর ব্যয় বরাদ্দ গত বছরের থেকে কমানো হয়েছে। এর থেকে অদ্ভুত ব্যাপার আর কী হতে পারে? কিš‘ তার থেকেও অদ্ভুত ব্যাপার এই যে, বাজেট পেশ করার পর থেকে এ নিয়ে সংবাদ মাধ্যমে আজ পর্যন্ত কোন রিপোর্টিং, আলোচনা, বিতর্ক কিছুই হয়নি। এ নিয়ে নীরবতা আপাতদৃষ্টিতে এক বিস্ময়কর ব্যাপার।
পরিবার-পরিকল্পনা খাতে বরাদ্দ পৃথকভাবে না দেখিয়ে তাকে স্বা¯’্য খাতের সঙ্গে জুড়ে দেয়া হয়েছে পরিকল্পিতভাবে স্বা¯’্য খাতের বরাদ্দ বেশি করে দেখানোর জন্য। এখানে অন্য একটি বিষয়ও আছে, যার উল্লেখ কোথাও দেখা যায় না। সেটা হ”েছ এই যে, সামরিক বাহিনীর কম্বাইন্ড মেডিকেল হাসপাতালটির (সিএমএইচ) ব্যয়ও এই স্বা¯’্য ও পরিবার পরিকল্পনার মধ্যেই আছে! সেটা সামরিক খাতে বরাদ্দের মধ্যে নেই!! শিক্ষা খাতেও একই ব্যাপার। ক্যাডেট কলেজগুলোর ব্যয়ও সামরিক বাজেটের বাইরে রেখে সেটা শিক্ষা খাতে ব্যয়ের মধ্যে ঢুকিয়ে দেয়া হয়ে থাকে। এর ফলে স্বা¯’্য ও শিক্ষা খাতে যা প্রকৃত ব্যয় তার থেকে অনেক বেশি দেখানো হয় এবং অন্যদিকে সামরিক খাতে যে ব্যয় হয় তার আকার দেখানো হয় ছোট করে।
সবাই জানেন যে, সব সরকারি হাসপাতালের মধ্যে সিএমএইচে চিকিৎসা হয় সবচেয়ে ভালো। কারণ সেখানে যা প্রয়োজন তাই দেয়া হয়, যা কিছু সরবরাহের প্রয়োজন হয় তার সবটা তো হয়ই। এমনকি সেটা হয় সর্বো”চ দ্র“তগতিতে। এর অর্থ স্বা¯’্য খাতে যে ব্যয় হয় তাতে সামরিক বাহিনীর লোক এবং তাদের আÍীয়স্বজনের চিকিৎসার জন্য সরকার যে খরচ করে তার তিলার্ধও সাধারণ মানুষের জন্য তারা খরচ করে না! এর থেকে ভয়াবহ বৈষম্যমূলক ব্যব¯’া আর কী হতে পারে?
অর্থমন্ত্রীর বাজেটে নতুন অনেক স্বা¯’্যকেন্দ্র, ২৫০ বেডের থেকে নিয়ে কিছু ছোট হাসপাতাল তৈরির পরিকল্পনার কথা বলা হয়েছে। এ পরিকল্পনার কী হবে সে প্রশ্ন বাদ দিয়েও বলা চলে যে, শুধু ইট, কাঠ, সিমেন্ট দিয়ে বিল্ডিং বানিয়ে দিলেই সেটা হাসপাতাল হয়ে যায় না। বিভিন্ন জেলায় এখনও ২৫০ বেডের হাসপাতাল এবং তার থেকে ছোট হাসপাতাল আছে। সেগুলোতে রোগীরা কী চিকিৎসা পা”েছন সেটাই দেখার কথা। প্রকৃত চিকিৎসা বলে যদি কিছু না থাকে, চিকিৎসার মান যদি খুব নিু হয়, তাহলে ২৫০ কেন, ১০০০ বেডের হাসপাতাল তৈরি হলেও জনগণের কোন লাভ নেই। অর্থমন্ত্রীর বাজেটে গ্রামাঞ্চলে স্বা¯’্যকেন্দ্রের কথা বলা হয়েছে। কিš‘ এই স্বা¯’্যকেন্দ্রগুলোর অব¯’া কী? সেখানে তো ডাক্তাররা নিয়মিত বসেন না। বসলেও একমাত্র তাদের প্রেসক্রিপশন বা ব্যব¯’াপত্র ছাড়া অন্য কিছুই পাওয়া যায় না। এই স্বা¯’্যকেন্দ্রগুলোতে দু’চারটে ট্যাবলেট বা ওই জাতীয় কিছু ওষুধ কখনও কখনও বিনামূল্যে পাওয়া গেলেও সব ওষুধই রোগীদের কিনতে হয়। পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য তাদের জেলা হাসপাতালে যেতে হয়। সে হাসপাতাল সরকারি হলেও সেখানেও রোগীদের সবকিছুর জন্যই পয়সা দিতে হয়। রোগীদের জন্য পরীক্ষা-নিরীক্ষা খাতে খরচ ছাড়ের কোন ব্যব¯’া নেই। বাংলাদেশে বর্তমানে যে সরকারি হাসপাতালগুলো আছে, সেগুলোতে বিনা খরচে চিকিৎসা ব্যব¯’া আগে যেটুকু ছিল এখন সেটাও একেবারে উঠিয়ে দেয়া হ”েছ।
অর্থমন্ত্রী তার বাজেটে তারা কত হাসপাতাল স্বা¯’্যকেন্দ্র ইত্যাদি তৈরির পরিকল্পনা নিয়েছেন তার ফিরিস্তি দিলেও এসব হাসপাতালে চলমান ব্যয়ের জন্য কী পরিমাণ বরাদ্দ তারা করেছেন তার কোন উল্লেখ নেই। কারণ এই বরাদ্দ প্রকৃতপক্ষে অনুল্লেখযোগ্য। চলমান খরচ চালিয়ে যাওয়ার জন্য সিএমএইচের মতো বরাদ্দ ব্যব¯’া না থাকায় এগুলোতে চিকিৎসা হয় নামমাত্র। এটা চিকিৎসার নামে প্রহসন ও প্রতারণা ছাড়া আর কী?
চিকিৎসা এমন এক ব্যাপার, যা দেশের ১৫ কোটি লোককেই স্পর্শ করে। এর প্রয়োজন সবারই হয়। সরকারি ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত লোকরা সরকারের খরচে নিজেদের চিকিৎসার জন্য অথবা চিকিৎসার নামে বিদেশ ভ্রমণের জন্য ই”েছমতো ব্যয় করে থাকে। কিছুদিন আগে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বাথর“মে পড়ে গিয়ে কোমরে ব্যথা পান। মন্ত্রী হওয়ার আগে এভাবে বাথর“মে পড়ে কোমরে ব্যথা পেলে তিনি হয়তো কবরেজি চিকিৎসা করাতেন কিংবা সাধারণ হাসপাতালে চিকিৎসা নিতেন। কিš‘ মন্ত্রী হয়ে তিনি চলে গেলেন এই সামান্য চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুর! এভাবে সিঙ্গাপুর গিয়ে তিনি যে জনগণের পকেট কাটলেন, তাদের চিকিৎসার কোন উপযুক্ত বা সামান্য ব্যব¯’াও এখানে নেই। প্রেসিডেন্ট থেকে শুর“ করে মন্ত্রী, এমপি এবং সরকারি কর্মচারীরা রোগের চিকিৎসা তো দূরের কথা, ‘হেলথ চেকআপ’ বা শরীরে সাধারণ পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্যও সিঙ্গাপুর, ব্যাংকক, মালয়েশিয়া, ইংল্যান্ড, আমেরিকা যান। যারা নানারকম দুর্নীতি করে বা অন্য উপায়ে টাকা-পয়সার মালিক হয়েছেন তারাও কথায় কথায় চিকিৎসার জন্য বিদেশ যান। দেশে যে কয়েকটি খুব ব্যয়সাপেক্ষ হাসপাতাল আছে যেগুলোতে এখানকার ধনী ও সম্পন্ন মধ্যবিত্তরা যান, সেগুলোতে নাকি তাদের চিকিৎসার ব্যব¯’া নেই!
যে সমাজের ও দেশের এই অব¯’া, সেখানে সাধারণ মানুষের, শ্রমজীবী গরিবদের ও মধ্যবিত্তের চিকিৎসার কোন ভালো ব্যব¯’া যে দেশের সরকার করবে না, এতে বিস্মিত হওয়ার প্রশ্ন নেই। এটা প্রকটভাবে শ্রেণীবৈষম্যের ব্যাপার। সমাজে এই শ্রেণীবৈষম্য এবং লুটপাটকারী ধনিক শ্রেণী ক্ষমতায় থাকাই চিকিৎসা ক্ষেত্রে এই বৈষম্যের কারণ। ঠিক এ কারণেই বাংলাদেশে এখন জনগণের চিকিৎসার জন্য সংগ্রাম সাধারণভাবে রাজনৈতিক শ্রেণী সংগ্রামেরই অংশ। সাধারণ শ্রেণী সংগ্রাম থেকে এই সংগ্রামকে স্বতন্ত্র বা বি”িছন্নভাবে দেখার কোন সুযোগ নেই। এই সংগ্রাম যে জনগণের জন্য প্রয়োজন, এ চিন্তা তাদের মধ্যে শুর“ হয়েছে। কারণ খাদ্য, বাস¯’ান ইত্যাদির সংকট থাকলেও চিকিৎসা সংকট এমন এক ব্যাপার যা মানুষকে বিশেষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে। এই ক্ষতি জনগণের জীবনকে আজ বিপর্যস্ত করছে।
চিকিৎসা ব্যব¯’ায় এই বঞ্চনা ও বৈষম্যের বির“দ্ধে আন্দোলন সংগঠিত করার শর্ত এখন বাংলাদেশে তৈরি হয়েছে। কারণ এই পরি¯ি’তিতে জনগণের সহ্যসীমা অতিক্রম করছে। গত ২২ জুন ঢাকায় ‘জনস্বা¯’্য সংগ্রাম পরিষদ’ নামে একটি সংগঠনের এক প্রতিনিধি সম্মেলন হয়। এই প্রতিনিধি সম্মেলনে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে প্রতিনিধিরা যোগদান করেন। বাংলাদেশের ডাক্তাররা, বিশেষত যারা বড় ও বিশেষজ্ঞ ডাক্তার, তাদের বিপুল অধিকাংশই আজ চিকিৎসার নামে ফিসহ অন্যান্য উপায়ে জনগণের পকেট মেরে থাকেন। কিš‘ ডাক্তারদের মধ্যে সবার অব¯’া এরকম নয়। অনেকের মধ্যেই পেশাগত নৈতিকতা বোধ আছে। জনগণের সেবা করার আকাক্সক্ষা আছে। তাদের মতো কয়েকজন চিকিৎসকও এই সম্মেলনে উপ¯ি’ত ছিলেন। ঢাকা মেডিকেল কলেজসহ দেশের ৮টি সরকারি মেডিকেল কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত করা এবং শেষ পর্যন্ত সেগুলো বেসরকারিকরণের বির“দ্ধে সম্মেলনে উপ¯ি’ত প্রতিনিধিরা আন্দোলনের সংকল্প ঘোষণা করেন। জনস্বা¯’্য সংগ্রাম পরিষদ একটি খসড়া ঘোষণা এবং দাবিনামা অনুমোদন করে। এর ভিত্তিতে এই প্রতিনিধি সম্মেলনে উপ¯ি’ত প্রতিনিধিরা দেশজুড়ে, শহর ও গ্রামাঞ্চলে, স্বা¯’্য আন্দোলন গড়ে তোলা এবং তাকে প্রবল করার অঙ্গীকার ঘোষণা করেন। আসলে জনগণের এই ধরনের আন্দোলন ছাড়া নিজেদের চিকিৎসার সামান্যতম ব্যব¯’া করারও অন্য উপায় নেই। সরকারই জনগণকে আজ এই আন্দোলনের পথে ঠেলে দিয়েছে। যেহেতু স্বা¯’্য ও চিকিৎসা দেশের শতকরা একশ’ ভাগ মানুষকেই স্পর্শ করে, এ কারণে এই আন্দোলন যে দ্র“ত শক্তি সঞ্চয় করবে এতে সন্দেহ নেই।
২৩.৬.২০১২
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন