বৃহস্পতিবার, ৩ মে, ২০১২

কিসের সমুদ্র জয়?



ব দ রু দ্দী ন উ ম র
২৮ এপ্রিল জাতীয় সংসদের দক্ষিণ প্লাজায় আওয়ামী লীগ ও তাদের সরকারের উদ্যোগে শেখ হাসিনার ‘বঙ্গোপসাগর জয়’ উপলক্ষে তাকে এক জৌলুসপূর্ণ সংবর্ধনা দেয়া হয়। বঙ্গোপসাগরে জলসীমা নিয়ে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে একটা মতপার্থক্য বা বিবাদ বেশ কিছুদিন ধরেই ছিল। মাছ ধরা ও সাগরের তলদেশে তেল-গ্যাসসহ খনিজ সম্পদের ওপর অধিকার নিয়ে এই বিবাদের মীমাংসার জন্য আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালে বাংলাদেশ সরকার ২০০৯ সালে মামলা দায়ের করেছিল। যে কোনো সরকারকেই বর্তমান অবস্থায় এই মামলা বাধ্য হয়েই দায়ের করতে হতো। কারণ এই বিবাদ নিষ্পত্তি ছাড়া কোনো ব্লকই আইনসিদ্ধভাবে বরাদ্দ করা সম্ভব হচ্ছিল না। এই মামলার রায়টি এমন যাতে বাংলাদেশ ও মিয়মানমার উভয় সরকারই সন্তোষ প্রকাশ করেছে। বাংলাদেশ একে আখ্যায়িত করেছে সমুদ্র জয় হিসেবে। উপকূলবর্তী দেশগুলোর সমুদ্রসীমা নির্ধারণের জন্য সুনির্দিষ্ট আইন আছে। বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের দাবির যথার্থতা বিচার করে এই আইন অনুযায়ীই ট্রাইব্যুনাল রায় দিয়েছেন। কাজেই এই রায় দ্বারা কোনো দেশের জয় হওয়ার প্রশ্ন ওঠে না। এ প্রশ্ন যে ওঠে না এটা মিয়ানমার সরকার কর্তৃক এই রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করা থেকেও বোঝা যায়। কিন্তু ব্যাপারটা এরকম হওয়া সত্ত্বেও এই রায়কে বাংলাদেশের অভূতপূর্ব বিজয় আখ্যা দিয়ে আওয়ামী লীগ ও তাদের সরকার এক হুলুস্থুল পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে।
বঙ্গোপসাগরের সীমা নির্ধারণ নিয়ে মামলার নিষ্পত্তি এইভাবে হওয়ায় মিয়ানমার সন্তোষ প্রকাশ করলেও তারা এ নিয়ে কোনো হুলুস্থুল করছে না। কিন্তু বাংলাদেশে সেটা হচ্ছে। এর থেকে অন্য যাই হোক, দুই দেশের শাসক শ্রেণীর ও তাদের সরকারি নেতৃত্বের সাংস্কৃতিক মানের একটা পরিচয় পাওয়া যায়। মিয়ানমারের নেতৃত্বের সাংস্কৃতিক মান বাংলাদেশের নেতৃত্বের সাংস্কৃতিক মান থেকে অনেক উঁচু হওয়ায় রায় নিয়ে লাফালাফির কোনো মানসিকতা তাদের নেই। বিষয়টিকে তারা সহজভাবেই নিয়েছে, যেমনভাবে তা নেয়া দরকার। মিয়ানমার বাংলাদেশ থেকে কোনো দুর্বল দেশ নয়। আকারে এবং খনিজ সম্পদসহ নানা সম্পদে তারা বাংলাদেশের থেকে অনেক বড় ও সমৃদ্ধ। দীর্ঘদিন সেখানে সামরিক শাসন বলবত্ থাকলেও সাধারণ সাংস্কৃতিক মানের উচ্চতার কারণে লাফালাফি ও দম্ভ প্রকাশের প্রবণতা তাদের সামরিক বাহিনীরও নেই। এর জন্য কোনো বুদ্ধিজীবী গোষ্ঠী প্রতিপালনের প্রয়োজনও তাদের হয় না।
এদিক দিয়ে বাংলাদেশ এক বিচিত্র দেশ। শুধু ‘সমুদ্র জয়’ নিয়ে নয়, বাংলাদেশের শাসক শ্রেণী ও তাদের বিভিন্ন রাজনৈতিক দল সব ক্ষেত্রেই আজ যে পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে, তার মূলে আছে সাংস্কৃতিক মানের এই ভয়াবহ নিম্নতা। দৃষ্টিকে একটু গভীর করলে দেখা যাবে লুটতরাজ, চুরি, দুর্নীতি, প্রতারণা, সন্ত্রাস এবং বর্তমানে সৃষ্ট অরাজকতা—সবকিছুই এই সাংস্কৃতিক অবস্থার সঙ্গে সম্পর্কিত। এদিক দিয়ে উনিশ ও বিশ শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত বাংলার সংস্কৃতির সঙ্গে বর্তমান বাংলাদেশের সংস্কৃতির আকাশপাতাল পার্থক্য। কীভাবে এই পার্থক্য তৈরি হলো তার সুনির্দিষ্ট কারণ আছে, যা নিয়ে আলোচনার সুযোগ এখানে নেই।
‘সমুদ্র জয়’-এর কথা যখন উঠেছে তখন এ নিয়ে কিছু কথা বলা দরকার। সমুদ্রযুদ্ধে বাংলাদেশের জয় অর্থাত্ তার সীমানা নির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত হওয়ায় আসল লাভ হয়েছে সাম্রাজ্যবাদীদের, আমেরিকানদের। তেল কোম্পানি তাল্লো এবং কনোকো ফিলিপসকে বাংলাদেশ গ্যাস উত্তোলনের ইজারা দিয়েছে। কিন্তু জলসীমা নিয়ে বিবাদ থাকায় বাংলাদেশের এ কাজ আইনসিদ্ধ ছিল না। এখন সীমানা চিহ্নিত হওয়ার ফলে বাংলাদেশের সীমানার মধ্যে ইজারাপ্রাপ্ত তেল-গ্যাস কোম্পানিগুলো পরম নিশ্চিন্তে গ্যাস উত্তোলনের কাজ এগিয়ে নিতে পারবে।
আমেরিকানদের সমুদ্রে গ্যাস উত্তোলনের সুবিধা যে দেয়া হবে এটা আওয়ামী লীগ নেত্রী শেখ হাসিনা বিগত নির্বাচনের আগেই জানিয়েছেন। সেই অনুযায়ী বঙ্গোপসাগরে তাল্লো এবং কনোকো ফিলিপস ইজারা পেয়েছে। শুধু এই একটি ব্লকই নয়, অন্য ব্লকগুলোর ইজারাও এভাবেই একাধিক আমেরিকান কোম্পানিকে যে দেয়া হবে—এটা প্রায় নিশ্চিত ব্যাপার। কাজেই বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের সীমানা নির্ধারণের মাধ্যমে যদি কারও জয় হয়ে থাকে তাহলে সে জয় আমেরিকার, তাদের তেল কোম্পানিগুলোর। একই সঙ্গে তাদের মত্স্য ব্যবসায়ী ইত্যাদির। তারাই প্রকৃতপক্ষে বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশের জলসীমার ওপর নিজেদের আধিপত্য কায়েম রেখে পাহাড়প্রমাণ মুনাফা অর্জন করবে, বাংলাদেশের হাতে কিছু গুঁজে দিয়ে। অর্থাত্ বঙ্গোপসাগরে তারা বাংলাদেশের হাতে তামাক খাবে।
বঙ্গোপসাগরে ব্লক ইজারা দেয়া সত্ত্বেও তার কোনো আইনগত ভিত্তি আগে ছিল না। এখন তা তৈরি হয়েছে। এক্ষেত্রে বিবাদ নিষ্পত্তির কাজটি করেছে বৈদেশিক মন্ত্রণালয়ের সমুদ্র ডেস্ক। এ কাজ করতে গিয়ে কারও ওকালতির কোনো প্রয়োজন হয়নি। সুনির্দিষ্ট আইন অনুযায়ীই এটা হয়েছে। এতে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বা প্রধানমন্ত্রীর কোনো কৃতিত্ব নেই। সমুদ্রে গ্যাস কোম্পানিগুলোর ইজারা কার্যকর করার তাগিদই এক্ষেত্রে কাজ করেছে। বাংলাদেশের যে কোনো সরকারকেই এই পরিস্থিতিতে এটা করতে হতো। এখন এর ফলে ইজারা থেকে শত শত কোটি আইনি-বেআইনি ডলার লেনদেন হবে। আওয়ামী লীগের আগামী নির্বাচনের খরচও এর থেকে তোলার ব্যবস্থা হবে। আওয়ামী লীগের সমুদ্র বিজয় উত্সবের এটাই হলো মূল কারণ।
সমুদ্র বিজয় উপলক্ষে আওয়ামী লীগ তাদের দল ও সরকারের নেত্রীকে সংবর্ধনা দেয়ার মাধ্যমে যে কৃতিত্ব তাকে দেয়ার চেষ্টা করেছে, সে কৃতিত্বের কানাকড়িও তার পাওনা নয়। যারা এ বিষয়ে ওয়াকিবহাল তারা জানেন যে, এ ধরনের সীমানা নির্ধারণ এই প্রথম নয়। এটা এক প্রচলিত ব্যাপার। কিন্তু এর আগে কোনো দেশকেই একে সমুদ্র জয় হিসেবে আখ্যায়িত করে বিজয় উত্সব পালন করতে দেখা যায়নি। যা অন্য কোনো দেশে এই অবস্থায় দেখা যায়নি, এই বিচিত্র বাংলাদেশে সেটাই কাড়া নাকাড়া বাজিয়ে জনগণকে দেখানো হলো!!
২৮ এপ্রিল সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় এক বিরাট মঞ্চ তৈরি করে প্রধানমন্ত্রীর সংবর্ধনার আয়োজন হলো। আওয়ামী লীগের দ্বারা আয়োজিত এই সংবর্ধনা উপলক্ষে মঞ্চে বেশ কয়েকজন অদ্ভুত বুদ্ধিজীবীর উপস্থিতি দেখা গেল। এদের মধ্যে আওয়ামী লীগের খুঁটিতে বাঁধা কয়েকজন বুদ্ধিজীবীর সঙ্গে নবাগত কয়েকজনও মঞ্চ আলোকিত করেছিলেন। দেশে সুবিধাবাদ এবং বুদ্ধিজীবীদের চরিত্রহীনতা কোন পর্যায়ে পৌঁছেছে—এটা চোখে আঙুল দিয়ে দেখানোর মতোই ব্যাপার।
খুঁটিতে বাঁধা আওয়ামী বুদ্ধিজীবী সৈয়দ শামসুল হক (যিনি অনেক আগে আওয়ামী লীগের এক সমাবেশে হাসিনাকে ‘দেশরত্ন’ উপাধিতে ভূষিত করেছিলেন এবং যিনি নিজের উদ্যোগেই নিজের নামের আগে ‘সব্যসাচী’ লেখার প্রচলন করেছেন) অভিজ্ঞানপত্র নামে একটি চতুর্থ শ্রেণীর রচনা পাঠ করার মধ্য দিয়েই সংবর্ধনা সভার কাজ শুরু হয়। তার পরই শুরু হয় অন্য বুদ্ধিজীবীদের দ্বারা হাসিনার প্রশস্তি কীর্তন। নাগরিক সংবর্ধনা কমিটির সভাপতি জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী বলেন, তারা হাসিনার মতো নেতা পেয়ে নিজেদের ধন্য মনে করেন। তিনি আরও অনেকদিন দেশে ক্ষমতার হাল ধরে রেখে জনগণের ও দেশের জন্য কাজ করতে পারবেন, এই আশা তিনি ব্যক্ত করেন। চিত্রশিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী উপস্থিত শ্রোতৃমণ্ডলী ও জনগণের কাছে আকুল আবেদন জানান যাতে তারা শেখ হাসিনার মতো দেশনেত্রীকে আরও অন্তত দুই টার্ম ক্ষমতায় রেখে বাংলাদেশকে একটি সুখী ও সমৃদ্ধ দেশ হিসেবে গড়ে তোলার জন্য ভোট দেন!!! অন্য চামচাদের কথাবার্তাও ছিল একই রকম যার বিস্তারিত উল্লেখের প্রয়োজন নেই। এই সংবর্ধনা থেকে স্পষ্টই বোঝা গেল যে, বর্তমানে আওয়ামী লীগ সরকারের জন্য যে সঙ্কটজনক পরিস্থিতি তৈরি তারা নিজেরাই করেছে, সে সঙ্কট থেকে জনগণের দৃষ্টি অন্যদিকে সরিয়ে দেয়া এবং নির্বাচনে ভোটের বাক্স ভর্তি করাই ছিল এই সংবর্ধনার মূল উদ্দেশ্য।
এই সংবর্ধনার আয়োজন যে শেখ হাসিনার নিজের উদ্যোগেই এবং চামচাদের উত্সাহে হয়েছে, এতে সন্দেহ নেই। একটি দেশের প্রধানমন্ত্রী যে কতখানি নির্লজ্জ এবং আত্মসম্মানহীন আচরণ করতে পারেন, এটা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এই সংবর্ধনার মাধ্যমে শুধু দেশের লোককেই নয়, দুনিয়ার লোককেও দেখিয়ে দিয়েছেন। এই সঙ্গে নিজেকে বর্ণনাতীতভাবে হাস্যস্পদ করেছেন।
২.৫.২০১২

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন