বুধবার, ৯ মে, ২০১২

সন্ত্রাসী রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ



ব দ রু দ্দী ন উ ম র
‘সন্ত্রাসের’ বিরুদ্ধে যুদ্ধই এখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ সাম্রাজ্যবাদী এজেন্ডা! তাদের এই এজেন্ডার একটা মহাহাস্যকর দিক আছে। কারণ এই রাষ্ট্রটি আজকের দুনিয়ায় নিজেই সব থেকে মারাত্মক সন্ত্রাসী রাষ্ট্র!! এশিয়া, আফ্রিকা, ল্যাটিন আমেরিকায় খুব কম রাষ্ট্রই আছে যারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সন্ত্রাসী হামলার বাইরে। তারা যা করে সেটা শুধু সন্ত্রাসী হামলাই নয়, এই সন্ত্রাসী হামলা সামরিক বাহিনীর মাধ্যমে পরিচালনা করে তারা দেশের পর দেশ দখলও করে। আফগানিস্তান, ইরাক, লিবিয়া হলো এর সাম্প্রতিক দৃষ্টান্ত। কিন্তু মিথ্যাচার ও ভাঁওতাবাজিতে সাম্রাজ্যবাদীদের সঙ্গে পাল্লা দেয়া অন্য কারও পক্ষে সম্ভব নয়। কারণ এই মিথ্যার পেছনে থাকে তাদের গায়ের জোর। কাজেই কোনো দুর্বল দেশ এই ধরনের মিথ্যা বললে বা ভাঁওতাবাজি করলে তাকে যে শাস্তি পেতে হয়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার থেকে নিরাপদ থাকে। মিথ্যাচারের যেখানে নিরাপত্তা আছে সেখানে মিথ্যাচর্চা যে অবাধ হবে এটা স্বাভাবিক। কয়েকদিন আগে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন ঢাকায় এসে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে সংগ্রামে বাংলাদেশের ভূমিকা ও কৃতকার্যতার ভূয়সী প্রশংসা করেন! আসলে এ সংগ্রাম হলো এমন যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসেরই পরিপূরক এবং সহায়ক। এছাড়া বাংলাদেশের সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধের অন্য কোনো বোধগম্য অর্থ নেই।হিলারি ক্লিনটন সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধে বাংলাদেশের সাফল্যের প্রশংসা করেছেন। এই যুদ্ধ বাংলাদেশ কীভাবে করল? এর একমাত্র দৃষ্টান্ত আমরা দেখি উত্তর-পূর্ব ভারতের কয়েকটি অঞ্চলে যারা নিজেদের ভাষা ও জাতীয়তার ভিত্তিতে স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করছে তাদের মধ্যে কয়েকজন বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া নেতাকে গ্রেফতার করে ভারতের হাতে তুলে দেয়া। ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের কোনো extradition treaty বা বন্দী বিনিময় চুক্তি নেই। কিন্তু তা সত্ত্বেও বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক আইন সম্পূর্ণভাবে লঙ্ঘন করে এই গর্হিত কাজ করেছে। এটা ভারতের তো বটেই, এমনকি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেরও বড়ই পছন্দের কাজ!! এই কাজের জন্যই হিলারি ক্লিনটন কর্তৃক ‘সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধে’ বাংলাদেশের প্রশংসা!বাংলাদেশে পাকিস্তান বা ভারতের মতো কোনো জঙ্গি তত্পরতা না থাকলেও মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী কর্তৃক সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধে বাংলাদেশের সাহায্যে সন্তোষ প্রকাশের কারণ ভারতের কিছু রাজনৈতিক ব্যক্তিকে ‘সন্ত্রাসী’ হিসেবে অপহরণ করে গোপনে ভারতের হাতে তুলে দিয়ে মার্কিন স্টাইলে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হওয়া। এদিক দিয়ে বাংলাদেশের কাজ যে কোনো সন্ত্রাসী রাষ্ট্রের থেকে অন্য প্রকার নয়। কিন্তু সন্ত্রাসী রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের পরিচয় এর মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই। এই রাষ্ট্রের সন্ত্রাস মূলত অভ্যন্তরীণ। সরকারের বিরুদ্ধে, তাদের রাজনীতি ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে যারা দাঁড়ায়, তাদের বিরুদ্ধে এদের সন্ত্রাস এখন এমন পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে যাতে এই রাষ্ট্রকে চরম সন্ত্রাসী ছাড়া অন্য কিছু বলা যায় না। সাধারণ রাজনৈতিক কাজকর্মে নিযুক্ত, কিন্তু আওয়ামী লীগবিরোধী, রাজনৈতিক ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে এখন বাংলাদেশ সরকার বেপরোয়া সন্ত্রাস চালিয়ে যাচ্ছে।মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র হলো এমন এক সন্ত্রাসী রাষ্ট্র যে মূলত আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সন্ত্রাস করে, অন্য দেশের ওপর হামলা করে। বাংলাদেশ হলো এমন এক সন্ত্রাসী রাষ্ট্র যে নিজের দেশের ভেতরেই সন্ত্রাসী হামলা পরিচালনা করে। বিশেষ ক্ষেত্রে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া বিদেশিরা তাদের সন্ত্রাসের লক্ষ্যবস্তু হলেও, মূল লক্ষ্যবস্তু হচ্ছে দেশের জনগণ। ১৯৭১ সালের পর শেখ মুজিবের নেতৃত্বে তত্কালীন আওয়ামী লীগ নিজেদের বেসরকারি ঠেঙাড়ে বাহিনী ছাড়াও রক্ষীবাহিনী নামে এক সরকারি ফ্যাসিস্ট বাহিনী গঠন করেছিল। তাদের মাধ্যমেই অভ্যন্তরীণ সন্ত্রাস পরিচালিত হতো। সে সময় হাজার হাজার শ্রমিক এবং বিরোধীদলীয় কর্মী ও নেতাকে, বিশেষত বামপন্থীদেরকে, রক্ষীবাহিনী খুন করে গুম করত। নদীতে ফেলে দিত। ১৯৭৫ সালের পর শেখ মুজিবের রক্ষীবাহিনী উঠিয়ে দেয়া হলেও পরবর্তীকালে পুলিশ এবং অন্যান্য বাহিনীর মাধ্যমে একই কাজ করা হতো। ২০০৩ সালে এখানে গঠিত হলো র্যাব। র্যাব গঠনে যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নির্দেশ ও সহায়তা ছিল এটা র্যাবকে শক্তিশালী করার ব্যাপারে তাদের স্টেট ডিপার্টমেন্টের প্রকাশ্য তাগিদ থেকেই বোঝা যেত। সেই র্যাব এখন এ দেশে ক্রসফায়ার ইত্যাদির মাধ্যমে এক ফ্যাসিস্ট বাহিনী হিসেবে জনগণের কাছে পরিচিত হয়েছে। পুলিশের একটা নিয়মকানুন আছে যা মান্য করে চলার থেকে লঙ্ঘিত হয় বেশি। কিন্তু তা সত্ত্বেও তাদের একটা জবাবদিহিতা আছে। কিন্তু র্যাবের সে সব কিছুই নেই। এখন সরকার পুলিশ ও র্যাবকে দিয়ে অবৈধভাবে নানা সন্ত্রাসী কাজ করিয়ে নিতে থাকার ফল হিসেবে পুলিশ ও র্যাবের উচ্চ পদস্থ অফিসাররা পর্যন্ত ডাকাতি, খুন-খারাবি, প্রতারণা ইত্যাদি কাজে প্রায় লিপ্ত থাকছে ও কোনো কোনো সময় ধরা পড়ছে। এদের এই কার্যকলাপ এখন রক্ষীবাহিনীর কার্যকলাপের মতোই দাঁড়িয়েছে। অপহরণ, গুম, খুন, ক্রসফায়ার ইত্যাদি এখন তাদের অভ্যন্তরীণ সন্ত্রাসের মূল রূপ।রাষ্ট্রের প্রতিনিধি হিসেবে বাংলাদেশ সরকারের একটা উল্লেখযোগ্য কর্মকাণ্ড এখন দাঁড়িয়েছে দেশের জনগণের বিরুদ্ধে সন্ত্রাস। এ পরিস্থিতিতে সমগ্র জনগণের মধ্যেই নিরাপত্তার অভাব ব্যাপকভাবে অনুভূত হচ্ছে। অপহরণ ও গুম-খুন এখন যে শুধু ওপরতলার রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ আছে তা নয়। এটা এখন এমন আশঙ্কাজনকভাবে বিস্তারলাভ করেছে যে কেউই আর নিজেকে নিরাপদ মনে করে না। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী বাংলাদেশের অনেক অভ্যন্তরীণ বিষয়ে এখানে এসে কথা বলেছেন। কিন্তু ইলিয়াস আলী ও আমিনুল ইসলামের অপহরণ ও গুম হওয়ার ব্যাপারে উদ্বেগ প্রকাশ করা ছাড়া তাঁর অন্য কোনো বক্তব্য এ ব্যাপারে থাকেনি। এ দুই ঘটনাকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবেই উল্লেখ করে তিনি নিজের দায়সারা বক্তব্য দিয়েছেন। এসবই যে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ সন্ত্রাসেরই দৃষ্টান্ত এ বিষয়ে তাঁদের পক্ষে কিছু বলা সম্ভব নয়। কারণ তাঁরা নিজেরাই তাঁদের ওপর নির্ভরশীল দেশগুলোতে এই ধরনের সন্ত্রাস নিজেদের প্রয়োজন অনুযায়ী পরিচালনার চক্রান্ত করে থাকেন। কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, তাদের ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদী মিত্ররা এবং ভারতসহ অন্যান্য দেশ বাংলাদেশকে সন্ত্রাসী রাষ্ট্র না বললেও, কার্যত বাংলাদেশ একটি সন্ত্রাসী রাষ্ট্র। এই রাষ্ট্র যেভাবে এখন বিভিন্ন সরকারি বাহিনীর মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ সন্ত্রাস ফ্যাসিস্ট কায়দায় চালিয়ে যাচ্ছে, তাতে বাংলাদেশের জনগণের স্বাধীনতা বলতে আর কিছু নেই। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে সরকারি লোকজন, তাদের নেতানেত্রীরা গদগদভাবে যতই মিথ্যা বলুক, তারা যেভাবে এখন সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে জনগণের স্বাধীনতা সর্বতোভাবে হরণ করেছে তাতে তাদের কথাবার্তা মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ইত্যাদিকে ভেংচি কাটারই শামিল।৯.৫.২০১২

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন