রবিবার, ১৩ মে, ২০১২

মন্ত্রিসভা না ঘুষ-দুর্নীতির আখড়া?



ব দ র“ দ্দী ন উ ম র


গত ১৭ এপ্রিল বিশ্বব্যাংকের ঢাকা¯’ প্রতিনিধি অ্যালান গোল্ডস্টেইন পদ্মা সেতু প্রকল্পে বিশ্বব্যাংক কর্তৃক অর্থায়ন বিষয়ে একটি বিবৃতি দেন। তাতে তিনি বলেন, ‘বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশ সরকারের কাছে পদ্মা সেতু প্রকল্পে গুর“তর দুর্নীতির তথ্য সেপ্টেম্বর ২০১১ থেকে প্রদান শুর“ করে। বিশ্বব্যাংক নিজস্ব তদন্তে আ¯’া রাখে এবং আমরা বাংলাদেশ সরকারকে জোরালো অনুরোধ করব, যেন দেশের নিজস্ব আইন অনুসারে এই গুর“তর বিষয়ে তদন্ত করে দায়ী ব্যক্তিদের জবাবদিহিতার আওতায় আনে।’ (প্রথম আলো ১০.৫.২০১২)


পত্রিকাটির রিপোর্টে আরও বলা হয় যে, ২০১১ সালের সেপ্টেম্বরে বিশ্বব্যাংক দুর্নীতির অভিযোগসংবলিত একটি প্রতিবেদন দিয়েছিল। এরপর বিশ্বব্যাংক সূত্র থেকে জানা যায়, ওয়াশিংটনে অব¯ি’ত বিশ্বব্যাংকের দুর্নীতি প্রতিরোধ সংক্রান্ত সং¯’া ইন্টেগ্রিটির ভাইস প্রেসিডেন্টের দফতর থেকে গত এপ্রিলের দ্বিতীয় সপ্তাহে অর্থমন্ত্রীর বাসায় গিয়ে তার কাছে আরও একটি প্রতিবেদন দেয়া হয়। বাংলাদেশের অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, অর্থমন্ত্রীর কাছে দেয়া প্রতিবেদনে দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত বলে দু’জনের নাম উল্লেখ করে তাদের বির“দ্ধে ব্যব¯’া নেয়ার পরামর্শ দেয়া হয়েছে। কানাডাভিত্তিক প্রতিষ্ঠান এসএনসি লাভালিন সম্পর্কে কানাডা পুলিশের তদন্তে প্রাপ্ত তথ্য এই প্রতিবেদনে দেয়া হয়েছে। প্রতিবেদনটি হাতে পেয়ে সরকার কোন পদক্ষেপ নেয়নি এবং সরকারপক্ষ থেকে এ বিষয়ে কিছু বলাও হয়নি।
২০১১ সালের সেপ্টেম্বরে প্রদত্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল যে, সেতুর মূল অংশের প্রাকযোগ্যতা চুক্তির প্রক্রিয়ায় দুর্নীতিসংক্রান্ত অসংখ্য অভিযোগ পেয়েছে বিশ্বব্যাংক। অভিযোগগুলো মূলত যোগাযোগমন্ত্রী আবুল হোসেন ও তার মালিকানাধীন কোম্পানি ‘সাকো’র উ”চপর্যায়ের কর্মকর্তাদের বির“দ্ধে। যোগাযোগমন্ত্রীর মালিকানাধীন কোম্পানি ‘সাকো’কে অর্থ বা ঘুষ না দিয়ে কাজ পাওয়ার কোন উপায় ছিল না। ‘সাকো’র পক্ষ থেকে ঠিকাদারদের ভয়ভীতি দেখানোর বিষয়টিও বিশ্বব্যাংকের রিপোর্টটিতে উল্লেখ করা হয়।


এরপর যোগাযোগমন্ত্রী আবুল হোসেনের বির“দ্ধে কোন পদক্ষেপ না নিয়ে তাকে অন্য এক মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেয়া হয়! তার কোম্পানির বির“দ্ধেও কোন পদক্ষেপ নেয়া হয়নি!! উপরš‘ দুদক এ বিষয়ে নামমাত্র একটি তদন্ত করে বলে যে, বিশ্বব্যাংক-কথিত কোন দুর্নীতির প্রমাণ তারা পায়নি!!! নতুন যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, দুদক তো তদন্ত করে বলেছে যে কোন দুর্নীতি হয়নি! তা ছাড়া সরকার তো যোগাযোগমন্ত্রী, সচিব, পদ্মা সেতু প্রকল্প পরিচালককে মন্ত্রণালয় থেকে সরিয়ে দিয়েছে। অর্থমন্ত্রীকে রিপোর্ট দেয়া হলেও তিনি কিছুই করেননি! নতুন যোগাযোগমন্ত্রীও তার পূর্ববর্তী যোগাযোগমন্ত্রীকে বেকসুর খালাস করেছেন!! তবে গত ২০-২২ এপ্রিল ওয়াশিংটনে অনুষ্ঠিত বিশ্বব্যাংকের বসন্তকালীন অধিবেশনে বাংলাদেশের প্রতিনিধিকে বিশ্বব্যাংকের পক্ষ থেকে বলে দেয়া হয়েছে যে, দুর্নীতির বির“দ্ধে কোন ব্যব¯’া গ্রহণ না করলে তারা পদ্মা সেতু প্রকল্পে কোন অর্থায়ন করবে না। (প্রথম আলো ১০.৫.২০১২)


বর্তমান হাসিনা সরকারের সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী আবুল হোসেন যে এক মস্ত এবং ঘোরেল দুর্নীতিবাজ, এটা অনেক আগেই বাংলাদেশের লোকের জানা হয়েছিল। শুধু পদ্মা সেতু প্রকল্পই নয়, যোগাযোগের সব ক্ষেত্রে তার দুর্নীতির লম্বা হাত বিস্তৃত ছিল। এ কারণে তাকে মন্ত্রিত্ব থেকে অপসারণের দাবি ব্যাপকভাবে উঠেছিল। কিš‘ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অতি প্রিয় পাত্র এই দুর্নীতিবাজ ও ঘুষখোর আবুল হোসেন। কাজেই তাকে মন্ত্রিত্ব থেকে অপসারণ করা সম্ভব ছিল না। পরে দেশের লোকের সঙ্গে বিশ্বব্যাংক পর্যন্ত যখন তার অপসারণের জন্য জোরালো দাবি জানাল, তখন তাকে মন্ত্রিসভা থেকে বিদায় না করে অন্য মন্ত্রণালয়ে বদলি করা হল! অর্থাৎ তার দুর্নীতি, ঘুষখোরি বন্ধ না করে এবং এ জন্য তাকে কোন শাস্তি না দিয়ে অন্যখানে নিয়ে তার নতুন চুরি, ঘুষখোরির ব্যব¯’া করা হল। এক্ষেত্রে শুধু প্রধানমন্ত্রী নন, অর্থমন্ত্রী, নতুন যোগাযোগমন্ত্রীসহ গোটা মন্ত্রিসভাই একজোট হয়ে কাজ করছে। বাংলাদেশে শুধু খুনখারাবি, অপহরণ ইত্যাদির জন্যই যে কারও শাস্তির ব্যব¯’া নেই, তা নয়। নাকের ডগায় ও চোখের সামনে সরকারি মন্ত্রী থেকে নিয়ে আমলারা এবং কর্মী লোকেরা গোপনে তো বটেই, এমনকি প্রকাশ্যে দুর্নীতি, চুরি, ঘুষখোরি করলেও তাদের শাস্তির যে কোনই ব্যব¯’া নেই, এটা দুর্নীতিগ্রস্ত যোগাযোগমন্ত্রীকে মন্ত্রিত্ব থেকে বরখাস্ত না করে প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক তাকে শুধু অন্য মন্ত্রণালয়ে বদলি করার বিষয়টি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়। এটা রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের ঘুষখোরি হাতেনাতে ধরা পড়ার পরও তাকে বরখাস্ত না করে তার মন্ত্রিত্ব বদল করার মধ্যেও দেখা যায়।


বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশের মতো দেশগুলোয় ঋণের মাধ্যমে অনেক রকমভাবে সরকারের হাত মোচড় দেয়। কিš‘ তাই বলে নিজেদের দেয়া ঋণ নিয়ে কোন দেশের সরকারি কর্মকর্তারা দুর্নীতি ও চুরি, ঘুষখোরি করবে, এটা তারা করতে দিতে পারে না। কাজেই দুর্নীতির কোন সুরাহা না হলে তারা পদ্মা সেতুর প্রকল্পে কোন অর্থায়ন করবে না, এটা স্পষ্টভাবেই জানিয়ে দিয়েছে। এর ফলে পদ্মা সেতুর নির্মাণ এখন অনিশ্চিত হয়েছে, অথচ এ সেতু তৈরির ওপর দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের যাতায়াত ব্যব¯’া এবং অর্থনীতির উন্নতি অনেকখানি নির্ভর করছে।


এক্ষেত্রে অবশ্যই বলা দরকার যে, বিশ্বব্যাংক কর্তৃক যোগাযোগমন্ত্রী ও তার কোম্পানির বড় রকম দুর্নীতির অভিযোগ সত্ত্বেও প্রধানমন্ত্রী তার আচরণের মাধ্যমে প্রমাণ করছেন যে, তিনি এই দুর্নীতিবাজ ও ঘুষখোর মন্ত্রীর পক্ষে!
দুদক এখন সরকারের ধামাধরা। তারা একটা নামমাত্র, দায়সারা তদন্ত করে আবুল হোসেনকে নির্দোষ সার্টিফিকেট দিয়েছে! এসব দেখে কেউ যদি বলে যে, যোগাযোগমন্ত্রীর দুর্নীতির সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী থেকে নিয়ে মন্ত্রিপরিষদের অন্য গুর“ত্বপূর্ণ সদস্যদের সম্পর্ক আছে, তাহলে তাকে কি যুক্তিসঙ্গতভাবে দোষারোপ করা যায়! তাছাড়া এখানে উল্লেখ করা দরকার যে, আবুল হোসেন এবং যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের সচিবকে যোগাযোগ মন্ত্রণালয় থেকে বদলি করা হয়েছে। কিš‘ কেন? তারা নির্দোষ হলে তাদের বদলি করা হল কেন? বিশ্বব্যাংক অর্থমন্ত্রীর কাছে দুর্নীতি বিষয়ে যে রিপোর্ট প্রদান করেছে, সে রিপোর্ট জনগণের অবগতির জন্য প্রকাশ করা হ”েছ না কেন? তার মধ্যে যদি কোন ভুল থাকে, তাহলে সে ভুল চিহ্নিত করা জনগণের পক্ষে কঠিন নয়। তা ছাড়া শুধু জনগণই নয়, দেশে অনেক ওয়াকিবহাল এবং বিশেষজ্ঞ ব্যক্তি আছেন, তারাও রিপোর্টটির বক্তব্য সহজেই যাচাই করতে পারেন। কিš‘ এসব কিছু না করে, রিপোর্টটি গোপন রেখে অর্থমন্ত্রী দুর্নীতির বিষয়টি ধামাচাপা দেয়ার ব্যব¯’াই করেছেন এবং যেহেতু দুর্নীতি বিষয়ে কোন কার্যকর পদক্ষেপ না নিলে বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতু প্রকল্পে কোন অর্থায়ন করবে না, এ কারণে তারা এখন এই অর্থায়নের জন্য অনেক অর্থ সং¯’ার দরবারেই টোকা মারছেন!


বাংলাদেশ যে দুনিয়ার মধ্যে সব থেকে দুর্নীতিগ্রস্ত এবং চোর, ঘুষখোররা যে এ দেশের শাসন কাজ পরিচালনা করে, এটা সারা বিশ্বে এক পরিচিত এবং আলোচিত বিষয়। এখন পদ্মা সেতু নিয়ে যে কেলেংকারি যোগাযোগমন্ত্রী থেকে নিয়ে অর্থমন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত করছেন, এর থেকে প্রমাণিত হ”েছ যে, নির্বাচনের মাধ্যমে বাংলাদেশ সরকার এবং তাদের মন্ত্রিসভা দেশের শাসন কাজ পরিচালনার দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়ে পরিণত হয়েছে ঘুষ-দুর্নীতির এক শক্তিশালী আখড়ায়।
১২.৫.২০১২

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন