বুধবার, ১৬ মে, ২০১২

হুমায়ূন আহমেদের বইয়ের ওপর সরকারি হামলা



ব দ রু দ্দী ন উ ম র
কারও মাথা যখন বিগড়ে যায় তখন তার শেষ অবস্থা। মনে হয় আওয়ামী লীগ এখন সেই অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছে। আজ ১৬ মে সংবাদপত্রে ‘দেয়াল’ নামে হুমায়ূন আহমেদের একটি উপন্যাস প্রকাশের ওপর হাইকোর্টের এক নিষেধাজ্ঞার রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে। এতে বলা হয়েছে যে, শেখ মুজিবুর রহমানের ছোট ছেলে রাসেলের হত্যা বিষয়ক যে কথা উপন্যাসটিতে লেখা হয়েছে সেটা ভুল। এই ভুল সংশোধন না করা পর্যন্ত উপন্যাসটি হুমায়ূন প্রকাশ করবেন না, হাইকোর্ট এটা আশা করেন। তাদের এই ‘আশা’ করার অর্থ হুকুম জারি। কারণ তাদের আশা অনুযায়ী কাজ না করলে আদালত অবমাননার দায়ে দণ্ডিত বা অন্যভাবে বেইজ্জত হতে হবে।


সরকারের অ্যাটর্নি জেনারেল এ বিষয়ে বিচারপতি শামসুদ্দীন চৌধুরী ও জাহাঙ্গীর হোসেনের দ্বারা গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চের দৃষ্টি আকর্ষণ করার পর তারা এই আশা ব্যক্ত করেন (Daily Star-১৬.৫.২০১২)। একটি suo moto রুল জারি করে আদালত এ সম্পর্কিত সব প্রাথমিক দলিলপত্র অর্থাত্ ভাষ্য সংবলিত কাগজপত্র হুমায়ূন আহমেদকে দেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন, যাতে হুমায়ূন সেগুলোর মাধ্যমে নতুন তথ্য এবং সরকারি ভাষ্য সম্পর্কে অবগত হয়ে অর্থাত্ সত্যের সঙ্গে পরিচিত হয়ে তাঁর বইটিতে বলা কথা পরিবর্তন করতে পারেন। মহামান্য আদালত কর্তৃক মিথ্যার পরিবর্তে সত্য প্রতিষ্ঠার এই প্রচেষ্টা প্রশংসাযোগ্য। কিন্তু এখানে কথা আছে। কথাটি হলো এই যে, ঐতিহাসিক ঘটনাসহ যে কোনো ঘটনার সত্যাসত্য নির্ধারণের মালিকানা কারও নেই। কোনো সরকারের তো নেই-ই। আদালতেরও নেই। ঘটনা বিশ্লেষণের কিছু নিয়মকানুন আছে এবং তার চর্চার মাধ্যমে যে কোনো ব্যক্তির অধিকার আছে নিজের ভাষ্য প্রকাশ করার। এ ব্যাপারে হস্তক্ষেপের অধিকার কারও নেই। যাই হোক, এ ব্যাপারে পরে আসা যাবে। এখন দেখা যাক হুমায়ূনের এবং সরকারের ভাষ্যে কী বলা হয়েছে।
১১ মে দৈনিক ‘প্রথম আলো’ পত্রিকায় হুমায়ূনের ‘দেয়াল’ নামক উপন্যাসের দুটি পরিচ্ছেদ প্রকাশিত হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, শেখ মুজিবের দুই পুত্রবধূ ও ছোট ছেলে রাসেল বিছানায় জড়াজড়ি করে থেকে ভয়ে কাঁপছিলেন। যখন ঘাতকরা তাদের কামরায় ঢোকে তখন রাসেল কাপড়ের আলনার পেছনে লুকিয়ে পড়ে ও কাঁদতে কাঁদতে বলে, ‘আমাকে গুলি কোরো না’। ঘাতকরা তাকে সেখান থেকে বের করে হত্যা করে।


অ্যাটর্নি জেনারেল এই বর্ণনার বিরোধিতা করে আদালতকে বলেন যে, দলিলপত্র এবং শেখ মুজিবের হত্যাকাণ্ডের বিচারের রায়ে বলা হয়েছে, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বিক্ষুব্ধ সামরিক অফিসারদের একটি গ্রুপ শেখ মুজিব ও তার পরিবারের ১৩ জন সদস্যকে হত্যা করে। তারা শেখ রাসেলকে শেখ মুজিবের ব্যক্তিগত সহকারী এএফএম মোহিতুল ইসলামের কাছ থেকে এই বলে ছিনিয়ে নেয় যে, তারা তাকে তার মায়ের কাছে নিয়ে যাবে। সে সময় রাসেল মোহিতুল ইসলামকে জিজ্ঞেস করে, তারা তাকে মেরে ফেলবে কি-না। মোহিতুল তাকে বলেন, তারা সেটা করবে না। কিন্তু ঘাতকরা রাসেলকে নিচের তলা থেকে দোতলায় নিয়ে গিয়ে হত্যা করে। (Daily Star-১৬.৫.২০১২)
প্রথমেই বলা দরকার, শেখ মুজিব হত্যার রায়ে যা-ই বলা থাক, অ্যাটর্নি জেনারেল তার ভিত্তিতে যে বর্ণনা দিয়েছেন তা কোনো সাধারণ বুদ্ধিসম্পন্ন সচেতন লোকের পক্ষে স্বাভাবিকভাবে গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। এর অযৌক্তিক চরিত্র পরিষ্কার বোঝা যাবে যদি সেই রাতে শেখ মুজিবের বাড়ির রাত্রিকালীন অবস্থার কথা চিন্তা করা যায়। সবাই যে যার কামরায় ঘুমিয়ে ছিল। শেখ রাসেলও তার নিজের কামরায় ঘুমিয়ে ছিল। সামরিক বাহিনীর ঘাতকরা বাড়িতে ঢুকে গুলিগালা ও তাণ্ডব শুরু করার পর সবারই ঘুম ভেঙে যায়। সেই অবস্থায় রাসেলের পক্ষে তার দুই ভাবীর কাছে দৌড়ে গিয়ে আশ্রয় নেয়ার চেষ্টা খুব স্বাভাবিক, যখন তার পিতা-মাতাকে এরই মধ্যে হত্যা করা হয়েছে। প্রাণভয়ে কাপড়ের আলনা বা কোনো পর্দার আড়ালে সেই কোমলমতি বালকের আশ্রয় নেয়ার মধ্যে দোষের বা কাপুরুষতার কোনো ব্যাপার নেই। এসব স্বাভাবিক। অন্যদিকে অ্যাটর্নি জেনারেল যে ভাষ্য উপস্থিত করেছেন তা অস্বাভাবিক। বাড়ির অন্যদের যখন হত্যা করা হয়েছে, শেখ মুজিবের লাশ যখন সিঁড়ির ওপর পড়ে আছে, তখন শেখ রাসেল কীভাবে ওপরতলা থেকে মোহিতুল ইসলামের হাত ধরে নিচের তলায় আসতে পারে?
এখানে জোর দিয়ে যা বলা দরকার তা হলো, এ ধরনের ঘটনার কোন ভাষ্য খাঁটি সত্য এটা নির্ধারণের কোনো উপায় নেই। ঐতিহাসিক বিশ্লেষণের এমন কোনো নির্ধারিত ও সর্বসম্মত নিয়ম নেই, যা দিয়ে কোনো ঘটনার সত্যাসত্য চূড়ান্তভাবে নির্ধারণ করা যায়। তাছাড়া কোনো ঐতিহাসিক বিষয়ে চূড়ান্ত রায় ঘোষণা করাও চলে না। যে কোনো আদালত কোনো মামলার ক্ষেত্রে বিদ্যমান আইনের ও বিচার পদ্ধতির দ্বারা সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও রায় প্রকাশ করতে পারেন। কিন্তু সেটা যে সবার মেনে নিতেই হবে, এমন বাধ্যবাধকতা কোনো গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নেই।

এক্ষেত্রে অন্য কথার আগে এটা বলা দরকার যে, উপন্যাস ও ইতিহাস এক জিনিস নয়। ঔপন্যাসিক কোনো ঐতিহাসিক ঘটনা অবলম্বন করে গল্প লেখার সময় ইতিহাস লেখেন না। তাছাড়া ‘দেয়াল’ উপন্যাসের ক্ষেত্রে হুমায়ূন যদি শেখ রাসেলের হত্যাবিষয়ক ঘটনার বর্ণনায় সরকারি ভাষ্য ছাড়া অন্য কিছু বলে থাকেন তাতে এমন কি এসে যায় যাতে অ্যাটর্নি জেনারেলকে এ নিয়ে হাইকোর্টে নালিশ করতে হবে, অগ্রহণযোগ্য হিসেবে বাতিল না করে হাইকোর্টকে ‘আশা’ ব্যক্ত করতে হবে যাতে হুমায়ূন তার বর্ণনা পরিবর্তন করে সরকারি ‘সত্য’ ভাষ্য তার উপন্যাসে নতুন করে লেখেন?
অবস্থা দেখে মনে হয়, ১৫ আগস্ট রাতে ৩২ নম্বর ধানমন্ডিতে শেখ মুজিবের হত্যাকাণ্ডের সময় বালক শেখ রাসেল যে ভয়ভীতির ঊর্ধ্বে ছিল, ঘাতক মিলিটারি অফিসারের বন্দুকের নল দেখে তাদের পরিবারের সদস্য হিসেবে সাহসী রাসেলের পক্ষে যে পর্দার আড়ালে কাঁপতে থাকা এবং প্রাণ রক্ষার আবেদন করার মতো কিছু ঘটতে পারে না, এটা প্রমাণ করার জন্যই রাসেলের হত্যার সরকারি ভাষ্য তৈরি করা হয়েছে!! ১৯৭২ সাল থেকেই ইতিহাসের ছোট-বড়, গুরুত্বপূর্ণ, এমনকি তুচ্ছ ঘটনার বিকৃত ভাষ্য প্রচার করার যে সংস্কৃতি আওয়ামী লীগ গায়ের জোরে চালু করেছে—এসব হলো তারই ধারাবাহিকতা।

পরিশেষে এটা বলা দরকার যে, সরকারি অ্যাটর্নি জেনারেলের আবেদনের দ্বারা লেখকের স্বাধীনতায় যেভাবে হস্তক্ষেপ করা হয়েছে আমরা তার তীব্র প্রতিবাদ করি। সরকারের এই হস্তক্ষেপ প্রমাণ করে, বাংলাদেশে সরকারের ফ্যাসিবাদী কার্যকলাপ সমাজের কত গভীর দেশ পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে। জনগণের সভা-সমিতি-মিছিলের অধিকার হরণ থেকে নিয়ে সব রকম রাজনৈতিক কাজের ওপর যেভাবে হাজার রকমভাবে নিষেধাজ্ঞা বলবত্ করে জনগণের টুঁটি টিপে ধরার ব্যবস্থা হয়েছে, হুমায়ূন আহমেদের বইয়ের ওপর হামলা তার থেকে বিচ্ছিন্ন কোনো ব্যাপার নয়। লেখকদের স্বাধীনতার ওপর ফ্যাসিস্ট হামলার প্রস্তুতিও যে এগিয়ে চলেছে, এর থেকে সেটাই প্রমাণিত হয়। হুমায়ূন আহমেদ এই পরিস্থিতিতে কি করবেন সেটা তার ব্যাপার। তবে আমি এ কথা অবশ্যই বলতে পারি যে, এই ধরনের হস্তক্ষেপ আমি কোনোভাবেই মেনে নিতে পারি না। আমি হলে এ নিয়ে আমার ভাষ্য পরিবর্তন তো করতামই না, উপরন্তু প্রয়োজন হলে অবশ্যই পাল্টা মামলা করতাম। 

১৬.০৫.২০১২

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন