বৃহস্পতিবার, ৫ জুলাই, ২০১২

পাহাড় ধসে মৃত্যুর জন্য দায়ী কারা?



ব দ রু দ্দী ন উ ম র
অন্য বছরের মতো এ বছরও চট্টগ্রামে পাহাড় ধসের ঘটনা ঘটেছে। প্রত্যেক বছরের মতো এ বছরও এই ধস রোধ করা ও পাহাড়ের নিচে বসবাসকারীদের সরিয়ে নেয়া বা তাদের সরে যেতে বলা নিয়ে স্থানীয় কর্মকর্তা, রাজনৈতিক ব্যক্তি প্রভৃতির পক্ষ থেকে নানা কথাবার্তা ও প্রস্তাব দেয়া হচ্ছে। প্রত্যেক বছরের মতো এ বছরও বর্ষাকাল পার হওয়ার পর এ নিয়ে আর কোনো কথাবার্তা হবে না, কোনো প্রস্তাব নিয়ে কেউ উচ্চকণ্ঠ হবে না এবং দেশ যেভাবে চলে আসছে সেভাবেই চলতে থাকবে!
কিন্তু তা সত্ত্বেও প্রত্যেক বছর এভাবে পাহাড় ধসে গরিবদের মৃত্যু তুচ্ছ করার মতো ব্যাপার নয়। প্রথমেই মনে রাখা দরকার যে, যে পাহাড়গুলোতে এখন বর্ষা মৌসুমে ধস নামছে সেগুলো হঠাত্ করে মাটি ফুঁড়ে বের হয়ে আসেনি। এগুলো দীর্ঘদিন থেকে আছে। ব্রিটিশ ও পাকিস্তানি আমলে তো বটেই, এমনকি ঠিক কতকাল আগে এগুলো আকস্মিকভাবে গড়ে উঠেছিল তার কোনো হিসাব নেই। তা সত্ত্বেও এ ধরনের পাহাড় ধসের ঘটনা যেমন এখন একটা বাত্সরিক বড় আকারের ঘটনায় পরিণত হয়েছে, এমনটা আগের দিনে ছিল না। তাছাড়া কখনও কখনও পাহাড় ধসলেও তাতে মানুষের এভাবে মৃত্যু হতো না, কারণ পাহাড়ের ঠিক নিচে আজকের মতো জনবসতি আগে ছিল না।
এটা বলাই বাহুল্য যে, জনবসতির জন্য বর্ষাকালে পাহাড়ে ধস নামছে না। এ ধস নামছে বর্তমানে একশ্রেণীর লুণ্ঠনজীবী মানুষ কর্তৃক পাহাড় কেটে ফেলতে থাকার জন্য। খাড়া হয়ে থাকার মতো নিজস্ব শক্তি পাহাড়ের থাকে। কিন্তু সে পাহাড় যদি পাশ থেকে কেটে ফেলা হতে থাকে তাহলে তার সেই জমাটবদ্ধতাসৃষ্ট শক্তি আগের মতো থাকে না। পাহাড়ি গঠনের মধ্যে ভারসাম্যের অভাব দেখা যায়। ভারসাম্যহীন এ অবস্থায় বর্ষার পানি বর্ষণ হতে থাকলে পাহাড়ে ধস নামে।
পাহাড়ে এভাবে ধস নামলেও তার সঙ্গে মানুষের মৃত্যুর কোনো সম্পর্ক নেই। কিন্তু এই সম্পর্ক এখন দেখা দেয়ার কারণ নিজেদের থাকার জায়গা থেকে উচ্ছেদ হয়ে যাওয়া গরিবরা বিভিন্ন কারণে জায়গার অভাবে পাহাড়ের তলদেশে ঘরবাড়ি তুলে কোনো মতে নিজেদের থাকার ব্যবস্থা করতে বাধ্য হচ্ছেন বলে। ওটা যে শুধু চট্টগ্রাম শহরেই হচ্ছে, তাই নয়। এটা হচ্ছে চট্টগ্রাম শহর থেকে শুরু করে জেলার বিভিন্ন অঞ্চলে। এটা হচ্ছে পার্বত্য চট্টগ্রামের রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবানেও। এটা হচ্ছে কক্সবাজারে।
পাহাড় ধসে মানুষের মৃত্যু, একেকটি পরিবার পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ার ব্যাপার, কোনো প্রাকৃতিক বিপর্যয় নয়। এর পুরোটাই মানুষের সৃষ্টি। মানুষ যদি পাহাড়গুলোকে কেটে মাটি সরিয়ে না নিত এবং বাসযোগ্য জায়গার অভাবে গরিব মানুষ যদি পাহাড়গুলোর নিচের দিকে বসবাস করতে বাধ্য না হতো, তাহলে এভাবে এখন প্রত্যেক বছর পাহাড় ধসে শত শত মানুষের মর্মান্তিক মৃত্যু হতো না।
শাসক শ্রেণীর ও তাদের বিভিন্ন স্তরের লোকজন পাহাড় কেটে ফেলায় যে পাহাড় ধস এবং মানুষের মৃত্যুর কারণ হিসেবে স্বীকার না করে পারে না। কিন্তু তা সত্ত্বেও তাদের কথাবার্তা ও কার্যকলাপ থেকে স্পষ্টই বোঝা যায় যে, এর মূল দায়িত্ব তারা সেই গরিবদের ঘাড়েই চাপাতে চায়, যারা বাধ্য হয়ে কোনো উপায় না দেখে, পাহাড়ের নিচের দিকে ঘরবাড়ি বানিয়ে বসবাস করতে বাধ্য হন। তাদের কথা হলো, পাহাড় ধসের ঘটনা এভাবে নিয়মিত প্রত্যেক বছর ঘটতে থাকলেও কেন তারা পাহাড়ের নিচে থেকে সরে অন্য জায়গায় যাচ্ছে না! এ কথা বলে তারা সমস্যার মূল কারণ বস্তুত স্বীকার করলেও বাস্তবত ও কার্যত স্বীকার না করে এমন কোনো নীতি-নির্ধারণও কার্যকর করে না যার ফলে এ বাত্সরিক ঘটনা না ঘটার ব্যবস্থা হয়।
প্রথমত পাহাড় কাটা তারা বন্ধ করে না। এর বিরুদ্ধে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা তারা গ্রহণ করে না, কারণ এ ব্যবস্থা যারা গ্রহণ করবে বা এ সংক্রান্ত নীতি যারা নির্ধারণ করবে তারা নিজেরা অথবা তাদের আত্মীয়-স্বজন, দলীয় লোক অথবা তাদের ঘুষের মাধ্যমে বশীভূত করা লোকরাই পাহাড় দখল করা ও ইচ্ছেমত কাটার কাজ করে। এদের আটকানোর ক্ষমতা প্রশাসনিক ব্যবস্থার মধ্যে কারও নেই। এরা এই ক্রিমিনাল কাজ এ কারণেই অপ্রতিহতভাবে করে থাকে। এ কথা বোঝার কোনো অসুবিধা হয় না যে, কোনো প্রশাসন যদি ইচ্ছে করে তাহলে এভাবে পাহাড় কাটা সহজেই বন্ধ করা যায়। কিন্তু সেটা না হওয়ার কারণ উপরে উল্লেখ করা হয়েছে। এ পরিস্থিতি রাষ্ট্র এবং সরকারের চরিত্রের কারণে, এ রাষ্ট্র ও সরকার যারা পরিচালনা করে তাদের দ্বারাই সৃষ্টি হয়েছে। এটাই আসল কারণ যে জন্য পাহাড় কাটার বিরুদ্ধে কার্যকর নিষেধাজ্ঞা ও সেই নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হচ্ছে কিনা সে ব্যাপারে কোনো তদারকি পদক্ষেপ নিতে অপারগ হয়ে প্রশাসন থেকে বলা হয়, পাহাড়ের নিচে থেকে লোকদের তাদের বাসস্থান উঠিয়ে নিতে! অন্য জায়গায় সরে যেতে!!
কিন্তু কোথায় তারা যাবে? নিজেরা অন্য কোনো জায়গার ব্যবস্থা করতে না পেরেই তো তারা পাহাড়ের নিচে বাসা বাঁধতে বাধ্য হচ্ছে। কাজেই তাদের সরে যেতে বললেই তাদের পক্ষে সরে যাওয়া সম্ভব নয়। সব রকম বিপদের ঝুঁকি, এমনকি মৃত্যুর ঝুঁকি পর্যন্ত নিয়ে তাদের পাহাড়ের নিচে বিপজ্জনক বসতি করতে হয়।
দু’দিন আগে হাইকোর্ট নির্দেশ জারি করেছেন ঢাকার ফুটপাত থেকে সব ধরনের দোকানপাট উচ্ছেদ করতে। পাহাড়ের নিচে থেকে মানুষকে সরিয়ে নেয়ার অপেক্ষায় ফুটপাথ থেকে হকার তাড়ানো অনেক সোজা। কিন্তু সেটাও হাইকোর্টের নির্দেশ সত্ত্বেও সহজ, এমনকি সম্ভব নয়। কারণ কাজের অভাবে এবং পরিবারের ভরণপোষণের জন্য বাধ্য হয়েই হকারদের রাস্তায় বসতে হয়। এতে ফুটপাথ দিয়ে হাঁটা মধ্যবিত্ত লোকদের অসুবিধা হয়। কিন্তু এ অসুবিধার জন্য প্রকৃতপক্ষে ফুটপাথের হকাররা দায়ী নন। এর জন্য দায়ী সরকার, যারা দেশের জনগণের কর্মসংস্থান করতে পারে না, এমন অবস্থা সৃষ্টি করে যাতে গ্রামাঞ্চল থেকে ক্রমাগত মানুষ শহরের দিকে, বিশেষত ঢাকা শহরের দিকে জীবিকার সন্ধানে আসতে বাধ্য হন। দেখা যায় যে, মাঝে মাঝে সরকার ফুটপাথ থেকে হকার উচ্ছেদ করলেও কিছুদিন পরই আবার হকাররা ফুটপাথে বসেন। এটা ছাড়া তাদের উপায় নেই। এটা তাদের জন্য জীবনমরণ সমস্যা।
পাহাড়ের নিচে বসতির মানে ফুটপাতে দোকান করার একটা মিল থাকার কারণেই তুলনা হিসেবে হকারদের অবস্থার কথা এখানে প্রসঙ্গত উল্লেখ করা হলো। কিন্তু হকারদের অবস্থার থেকে পাহাড়ের তলায় বসবাসকারী গরিবদের অবস্থা আরও শোচনীয়। চট্টগ্রামে স্থানীয় কর্তৃপক্ষ তাদের পাহাড়ের নিচে থেকে উচ্ছেদ করার হুমকি দিচ্ছে। কিন্তু সেখানে বসবাসকারীরা নিজেদের জায়গা বিপদ ঘাড়ে নিয়েও ছাড়তে পারছেন না বিকল্প থাকার ব্যবস্থা না থাকায়। তাদের দাবি হলো, তাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করলেই তারা পাহাড়ের নিচে বসবাস বন্ধ করতে পারেন। এর থেকে ন্যায্য দাবি আর কি হতে পারে? মানুষের থাকার বা বাসস্থানের কোনো ব্যবস্থা যদি না থাকে তাহলে তার জীবন কিভাবে বিপর্যস্ত হয় সেটা বড় বড় ভবনে বসবাসকারী, এমনকি ছোট হলেও নিজেদের বাড়িতে বসবাসকারী লোকদের পক্ষে বোঝা মুশকিল।
জনগণের বাসস্থান এবং বাস্তুচ্যুত মানুষের আবাসন ব্যবস্থা রাষ্ট্র, কেন্দ্রীয় সরকার ও স্থানীয় সরকারের জরুরি কর্তব্য। এ পর্যন্ত চট্টগ্রামের পাহাড়ের তলদেশে বসবাসকারীদের ক্ষেত্রে যতক্ষণ পর্যন্ত না সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ পালন করছে ততদিন পাহাড় ধসে মৃত্যুজনিত যে ঘটনা নিয়মিত ঘটছে তার দায়িত্ব সেখানে বসবাসকারীদের নয়। এর পূর্ণ দায়িত্ব রাষ্ট্র, সরকার এবং সর্বপ্রকার প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষের।
৪.৭.২০১২

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন