বৃহস্পতিবার, ২২ নভেম্বর, ২০১২

টিআইবি রিপোর্টের বিরুদ্ধে জাতীয় সংসদের প্রতিক্রিয়া


ব দ রু দ্দী ন উ ম র



ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) বাংলাদেশ জাতীয় সংসদ সদস্যদের আর্থিক এবং অর্থনৈতিক আচরণের ওপর এক তদন্ত রিপোর্টে বলেছে যে, তাদের শতকরা ৯৭ ভাগই নেতিবাচক কাজ ও দুর্নীতির সঙ্গে সম্পর্কিত। অর্থাত্ তারা দুর্নীতিবাজ। তাদেরকে ধোয়া তুলসীপাতা না বলে এই রিপোর্টে দুর্নীতিবাজ বলায় জাতীয় সংসদ সদস্যরা ও সেই সঙ্গে সংসদের স্পিকার জাতীয় সংসদের অধিবেশনে তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। তাদের প্রতিক্রিয়া দেখে মনে হতে পারে যে, তারা নিজেরাও নিজেদের দুর্নীতিমুক্ত সাধু-সন্ত মনে করেন! এ কারণে তারা টিআইবির এই রিপোর্টের বিরুদ্ধে শুধু ক্রুদ্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেই ক্ষান্ত হননি, টিআইবিকে বন্ধ করে দেয়ার দাবিও জানিয়েছেন। চোখ বন্ধ করে রাখলে মানুষের দৃষ্টি অন্ধকারাছন্ন হয়, কিন্তু বাইরের জগতের আলো এর ফলে নির্বাপিত হয় না। সেভাবে টিআইবি রিপোর্ট দিক আর নাই দিক, টিআইবিকে বন্ধ করা হোক আর নাই হোক, জাতীয় সংসদ সদস্যরা যে দুর্নীতিবাজ এটা জানার জন্য এখন বাংলাদেশে কোনো গবেষণার প্রয়োজন নেই। এই সংসদ সদস্যদের সঙ্গে যদি জনগণের কোনো যোগসম্পর্ক থাকত তাহলে ট্রেন বাস লঞ্চ ও রাস্তাঘাটে লোকজন তাদের নিজস্ব অভিজ্ঞতার মাধ্যমে তাদের দুর্নীতির যেসব কথা অহরহ বলছেন, তার থেকেই তারা তাদের সম্পর্কে দেশের লোকের ধারণা বিষয়ে অবহিত হতে পারতেন। কিন্তু তাদের অবস্থা এদিক দিয়ে একেবারে ভিন্ন। তারা সরকারি ও শ্রেণীগত ক্ষমতায় বলীয়ান হয়ে পরম নিশ্চিন্তে এবং অপরাধের জন্য কোনো শাস্তির ভয়ে ভীত না হয়ে চুরি, ঘুষখোরি, জমি দখল ইত্যাদি দুর্নীতি করে গেলেও জনগণ তাদেরকে সততার পরাকাষ্ঠা মনে করে তাদের জয়গান করছে—এটাই মনে হয় তাদের ধারণা! হয়তো তাদের ধারণা, তারা যত বিচিত্র গর্হিত কাজই করে চলুন, সর্বাবস্থায় জনগণের কর্তব্য হলো ‘দেশপ্রেমিক’ দল হিসেবে তাদেরকে দুর্নীতিমুক্ত মনে করা, কৃতজ্ঞচিত্তে তাদেরকে পরবর্তী নির্বাচনে ভোট দিয়ে আবার ক্ষমতায় বসানো!!
আসলে টিআইবি সংসদ সদস্যদের ওপর তার তদন্ত রিপোর্টে যা বলেছে তাতে দেশের কোনো একজন লোকও বিস্মিত হয়েছে অথবা এ রিপোর্টের বক্তব্য অসত্য মনে করেছে, এটা আওয়ামী লীগের লোক ও তাদের ঘরানার বুদ্ধিজীবী ছাড়া অন্য কেউ মনে করে না। কাজেই টিআইবি তদন্ত করে সংসদ সদস্যদের আচরণ সম্পর্কে কী বলেছে, তার ওপর নির্ভর করে মানুষ বসে নেই। সংসদ সদস্যদের লাগামহীন চুরি, ঘুষখোরি, দুর্নীতি ও সন্ত্রাসের প্রত্যক্ষদর্শী বা ভুক্তভোগী হিসেবে টিআইবি রিপোর্টে যা আছে তার থেকে অনেক বেশি তারা জানেন।
সম্প্রতি নিযুক্ত তথ্যমন্ত্রী এ রিপোর্ট সম্পর্কে বলেছেন যে, এ রিপোর্ট যে তদন্তের ভিত্তিতে তৈরি করা হয়েছে তাতে পদ্ধতিগত ত্রুটি আছে। পদ্ধতিগত কিছু ত্রুটি আছে এটা বলাই যেতে পারে। কারণ এসব ক্ষেত্রে পদ্ধতি বিষয়ে মতপার্থক্য থাকতেই পারে। কিন্তু এখানে কথা হলো, পদ্ধতিগত কিছু ত্রুটি যদি থাকেও, তাহলে সে ত্রুটিমুক্ত হয়ে তদন্ত ও গবেষণা করলে বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ সদস্যদের বিষয়ে আলোচ্য টিআইবি রিপোর্টে যা বলা হয়েছে তার থেকে ভিন্ন কিছু পাওয়া যাবে মনে করার কারণ নেই।
জাতীয় সংসদের স্পিকারসহ সংসদ সদস্যরা টিআইবি রিপোর্টের বিরুদ্ধে যেভাবে ক্রুদ্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন, তার থেকে মনে হয় তারা নিজেদের জনগণের কাছে সত্ হিসেবে, সততার প্রতিমূর্তি হিসেবে দেখতে বড়ই পছন্দ করেন! এর জন্য সহজ উপায় হচ্ছে চুরি, ঘুষখোরি, দুর্নীতি ইত্যাদি না করা। এসব না করলে তদন্ত যে পদ্ধতিতেই হোক, কিছুই পাওয়া যাবে না। কিন্তু নিজেরা এসব গর্হিত কাজ নিয়মিতভাবে এবং লোকের নাকের ডগায় ও চোখের সামনে করে যাবেন এবং জনগণ ও সেই সঙ্গে এ বিষয়ে তদন্ত কাজে নিয়োজিত যে কোনো সংস্থা তাদের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে তাদের জয়গান করবে এটা এক অস্বাভাবিক প্রত্যাশা।
শুধু সংসদ সদস্যরাই নন, মন্ত্রিসভার সদস্য এবং উপদেষ্টারা পর্যন্ত যে চুরি, ঘুষখোরি, সব ধরনের দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত—এটা এখন এক প্রকাশ্য সত্য। রেলওয়ে, সোনালী ব্যাংক, বাংলাদেশ বিমান, পদ্মা ব্রিজ, ডেসটিনি ইত্যাদিতে সম্প্রতি যে সব দুর্নীতি কেলেঙ্কারি হয়েছে সেটা আওয়ামী লীগ সম্পর্কে অনেক আওয়ামী সমর্থকেরও চোখ খুলে দিয়েছে। এ দেশে বর্তমান সরকারের আমলে চুরি-ঘুষখোরি করলে যে শাস্তির কোনো ব্যবস্থা নেই, উপরন্তু পুরস্কৃত হওয়ার ব্যাপার আছে, আওয়ামী মন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের দৃষ্টান্ত এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য। রেলে চাকরি বাণিজ্য করতে গিয়ে পাহাড়প্রমাণ ঘুষের টাকা ধরা পড়ার পর চারদিকে তার বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়ায় শেষ পর্যন্ত সুরঞ্জিতকে রেলের মন্ত্রিত্ব থেকে সরানো হলেও পরদিনই তাকে দফতরবিহীন মন্ত্রী করে দুর্নীতির গৌরব অর্জনের জন্য পুরস্কৃত করা হয়েছে। এর ফলে মন্ত্রী হিসেবে কিছু কাজ করে তাকে আগে বেতন-ভাতা, অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা নিতে হলেও এখন তিনি কোনো কাজ না করেই সেসব সুবিধা পাচ্ছেন! অর্থাত্ জনগণের ট্যাক্সের টাকার খেয়ানত করেই এভাবে একজন দুর্নীতিবাজ দলীয় লোককে প্রতিপালন করা হচ্ছে!! সরকারের প্রধানমন্ত্রীর এ কাজ কি দুর্নীতি নয়? এ কাজ যে দলের প্রধানমন্ত্রী করেন, সে দলের সংসদ সদস্যরা সবাই নিরামিষভোজী পরম ধার্মিক—এটা মনে করাও এক অবাস্তব চিন্তা।
শুধু আওয়ামী লীগ সংসদ সদস্যরাই নয়, বর্তমান মহাজোট সরকারের অন্য ‘বিপ্লবী’ সদস্যরাও একই কাতারে থেকে একইভাবে নিজেদের সত্চরিত্র টিআইবি রিপোর্টে কলঙ্কিত হতে দেখে চিত্কার করেছেন। ১৩ জন বিরোধীদলীয় সদস্যের ওপর দেয়া টিআইবি রিপোর্টে ১২ জনকেই দুর্নীতিবাজ বলা হয়েছে। বিএনপি যদি সংসদ বর্জন না করে সংসদে থাকত, তাহলে তারাও যে একইভাবে ক্রুদ্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে চিত্কার করত, এতে কোনো সন্দেহ নেই।
বাংলাদেশে শাসক শ্রেণী ও শাসক দলভুক্ত লোকদের এই দুর্নীতি যদি শুধু তাদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকত, তাহলে তা এতখানি বিপজ্জনক হতো না, যতখানি বিপজ্জনক আজ হয়েছে। এর মূল কারণ এই শাসক শ্রেণী এবং এদের একের পর এক সরকার প্রথম থেকেই অপরাধীর শাস্তি নিশ্চিত তো করেই নি, উপরন্তু অপরাধ করলে শাস্তি যাতে না হয় সেই শর্তই শাসন ব্যবস্থার মধ্যে তৈরি করেছে। প্রেসিডেন্ট যেভাবে লক্ষ্মীপুরের ক্রিমিনাল তাহেরের বেটাসহ ২১ জনের মৃত্যুদণ্ড মাফ করেছেন, সেটা থেকে নিয়ে সুরঞ্জিত সেনগুপ্তকে তার দুর্নীতির জন্য পুরস্কৃত করা পর্যন্ত অসংখ্য দৃষ্টান্ত এ বিষয়টিকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। এই পরিস্থিতিতে সমাজে অপরাধীরা আরও সক্রিয় হয়েছে, তাদের সংখ্যা ক্রমাগত বৃদ্ধি পেয়ে যাচ্ছে এবং তাদের অপরাধের বৈচিত্র্যও দেখা যাচ্ছে অবাক হওয়ার, সেই সঙ্গে আতঙ্কিত হওয়ার মতো ব্যাপার। প্রধানত রাজনৈতিক ক্ষমতার সঙ্গে সম্পর্কিত লোকজনের দ্বারা ও তাদের পৃষ্ঠপোষকতায় এসব অপরাধ সংঘটিত হয়ে থাকলেও সাধারণভাবে সমাজে এর বিস্তৃতি ঘটে এক ভয়ঙ্কর সামাজিক নৈরাজ্য আজ বাংলাদেশে সৃষ্টি হয়েছে। এই পরিস্থিতির দিকে না তাকিয়ে টিআইবি রিপোর্টের বিরোধিতা এবং টিআইবিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে মূল সমস্যার কোনো সমাধান হবে না। কিন্তু এ বিষয়টি উপলব্ধি করার মতো অবস্থা আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব, তাদের তথাকথিত মহাজোটের শরিকবৃন্দ এবং তাদের সঙ্গে সম্পর্কিত বুদ্ধিজীবীদের নেই।
২১.১১.২০১২
লেখক : সভাপতি, জাতীয় মুক্তি কাউন্সিল

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন