বৃহস্পতিবার, ১২ জানুয়ারী, ২০১২

বাংলাদেশে নির্বাচনী রাজনীতি গণতন্ত্রকে সমাধিস্থ করছে

বদরুদ্দীন উমর


কোনো সমাজে দুর্নীতি প্রবল প্রতাপে সমাজের সবকিছু যখন শাসন করে তখন কোনো কিছুই তার শাসনের বাইরে থাকে না। বাংলাদেশে যে কোনো সমস্যা বিচার করলে এরই প্রমাণ মেলে। প্রত্যেক সমস্যাই এখানে দুর্নীতির থেকে মূল অথবা দুর্নীতির কারণে তার সমাধান সম্ভব নয়। জনগণের বিভিন্ন কর্মক্ষেত্র, কৃষি, শিল্প, বাণিজ্য, যাতায়াত ব্যবস্থা, চিকিৎসা, শিক্ষা, সংস্কৃতি, রাজনীতি_ সর্বত্র এখন দুর্নীতির শাসন। আর এর সবকিছুর ওপর আছে সরকার ও প্রশাসনের দুর্নীতি, তাদের সঙ্গে সম্পর্কিত অথবা সরাসরি তাদের অধীন সব ধরনের সংস্থার দুর্নীতি। বস্তুতপক্ষে এই দ্বিতীয়োক্ত ক্ষেত্রের দুর্নীতিই তার প্রভাব অন্য ক্ষেত্রে বিস্তার করে দুর্নীতিকে সমাজে এক সার্বভৌম শক্তিতে পরিণত করেছে।

বাংলাদেশের জনগণ এখন হাজারো সমস্যায় জর্জরিত। এসব সমস্যার কোনোটিই সমাধানের অযোগ্য নয়। জনগণ যেসব সমস্যার ভারে নুইয়ে আছে সেগুলোর বিপুল অধিকাংশের সমাধান সহজ ও অল্প সময়সাপেক্ষ। অন্য সমস্যাগুলোর সমাধানও যুক্তিসম্মত সময়সীমার মধ্যে সম্ভব। কিন্তু বাংলাদেশে কোনো সমস্যার সমাধানই হচ্ছে না, যেখানে সমাধান সহজ সেখানেও তা থাকছে নাগালের বাইরে। প্রত্যেক ক্ষেত্রেই দুর্নীতি এক প্রচণ্ড প্রতিবন্ধক হিসেবে সমাধানের পথ আগলে থাকছে। এবং এভাবে সমাধানের পথ আগলে রেখে শাসকশ্রেণীর রঙবেরঙের এবং নানা দলের দুর্বৃত্তরা নিজেদের স্বার্থ উদ্ধার করছে, পকেটভর্তি করছে, রাতারাতি ভৌতিকভাবে ধনসম্পদ অর্জন করছে। এদের সঙ্গে সহযোগিতার জন্য আছে পুলিশ ও বিচারব্যবস্থা। যে দল যখন ক্ষমতায় থাকে তখন পুলিশ হয় তার এমন হুকুমবরদার, যাতে এই রাষ্ট্রীয় বাহিনী সরকারি দলের খেদমত ছাড়া অন্য কিছুই করে না। কাজেই বিএনপি ক্ষমতায় থাকলে পুলিশ হয় জাতীয়তাবাদী পুলিশ দল আর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলে তারা হয় আওয়ামী পুলিশ লীগ। বাংলাদেশে এখন আওয়ামী পুলিশেরই শাসন চলছে। এরা নিজেরা তো আছেই, তার ওপর এদের ছত্রছায়ায় আওয়ামী লীগের বিভিন্ন অঙ্গ সংগঠনের গুণ্ডা ও মাফিয়া বাহিনী সব ধরনের বিরোধী পক্ষের ওপর হামলার পর হামলা চালিয়ে এখন দেশজুড়ে এক আতঙ্কজনক পরিস্থিতি সৃষ্টি করে রেখেছে।

সর্বত্র বেপরোয়া দুর্নীতির অন্যতম কারণ হলো, দুর্নীতিবাজদের বিচার ও শাস্তির ব্যবস্থা বাস্তবত না থাকা। সরকারি ক্ষমতার বলে বলীয়ান হয়ে যারা দুর্নীতি করছে তারা জানে যে, তাদের কোনো বিচার আদালতে হবে না। তাদের বিরুদ্ধে মামলা থাকলে বিচারের মাধ্যমে তার নিষ্পত্তি না হয়ে তাদের মামলার পর মামলা খারিজ হবে। একদিকে পুলিশ ও আমলাতন্ত্রের সাহায্যে দুর্নীতি করা এবং বিচারব্যবস্থায় এই দুর্নীতির জন্য শাস্তির কোনো সম্ভাবনা না থাকায় দুর্নীতি সর্বত্র অপ্রতিরোধ্য। শিক্ষা, সংস্কৃতি এবং ইতিহাস চর্চার ক্ষেত্রে দুর্নীতি তার থাবা বিস্তার করে এমন পরিস্থিতি আজ তৈরি করেছে, যা একদিক থেকে সবচেয়ে মারাত্মক ও বিপজ্জনক। কারণ শিক্ষা ও সংস্কৃতির সঠিক, গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল চর্চা এবং ইতিহাসের সত্যনিষ্ঠ চর্চাই একমাত্র পথ, যার ভিত্তিতে সংগ্রাম করে সমাজে দুর্নীতির প্রভাব পরাজিত করা সম্ভব। বলাই বাহুল্য, বাংলাদেশে বিপুল অধিকাংশ বুদ্ধিজীবীর মধ্যে দুর্নীতি যেভাবে শিকড় বিস্তার করে আছে সেটিই প্রধান কারণ, যেজন্য শিক্ষা, সংস্কৃতি, ইতিহাস চর্চা ও রাজনীতির মাধ্যমে দুর্নীতির বিরুদ্ধে সংগ্রাম সংগঠিত করা এক দুরূহ ব্যাপার।

এ পরিস্থিতিতে বাংলাদেশে কোনো ধরনেরই নির্বাচন যে দুর্নীতির কবলমুক্ত থাকবে এ চিন্তা অবাস্তব এবং সে কারণেই বড় রকম মূঢ়তারই পরিচায়ক। গত ২৪ এপ্রিল ভোলায় জাতীয় সংসদের একটি আসনে উপনির্বাচন হয়েছে। এই উপনির্বাচনে দুই প্রতিদ্বন্দ্বী দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি উভয়েই দুর্নীতি করেছে। যে যার সাধ্যমতো করেছে। কিন্তু সাধ্যের প্রতিযোগিতায় যারা ক্ষমতাসীন তাদের পাল্লাই ভারি থাকে। এ কারণে ইতিপূর্বে বাংলাদেশে যত উপনির্বাচন হয়েছে তার বিপুল অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সরকারি দলের প্রার্থী জয়লাভ করেছে। পুলিশসহ অন্য প্রশাসনিক ব্যবস্থা সরকারি দলের সহায়ক হওয়াতেই এ রকমটি ঘটে। তার অর্থ অবশ্য এই নয় যে, প্রত্যেক ক্ষেত্রে বিরোধী দলই প্রকৃতপক্ষে বেশি ভোট পায় এবং সরকারি দল কম ভোট পেয়েও জয়লাভ করে। অনেক ক্ষেত্রে বিরোধী দল কম ভোটই পায়; কিন্তু সে সময়ও সরকারি দল ক্ষমতা অপব্যবহার করার কারণে বিরোধী দল কর্তৃক সরকারি দলের বিরুদ্ধে দুর্নীতির আওয়াজ তোলা, নির্বাচন বাতিল ও পুনর্নির্বাচনের দাবি তোলা সহজ ও সম্ভব হয়।
ভোলার উপরোক্ত নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রার্থীর জয় হয়েছে। যেহেতু আসনটি আওয়ামী লীগের একটি চিহ্নিত আসন, কাজেই সেখানে তারা হয়তো বেশি ভোট পেয়ে থাকবেন। আসনে কে বেশি ভোট পেয়েছেন ও কে কম ভোট পেয়ে পরাজিত হয়েছেন, এটি এখানে মূল বিষয় নয়। মূল বিষয় এটিই যে, বর্তমান পরিস্থিতিতে বাংলাদেশে কোনো পরাজিত প্রার্থীই নিজের পরাজয় স্বীকার করে বিজয়ী প্রার্থীকে অভিনন্দন জানাতে রাজি নন। আবার বিজয়ী পক্ষ নির্বাচন নিরপেক্ষ ও কারচুপিবিহীন হয়েছে বলে জোর গলায় ঢেঁড়ি পেটান। এ প্রতিক্রিয়া আসলে দলনিরপেক্ষ। যে কোনো দলের পরাজিত প্রার্থী ও বিজয়ী প্রার্থী একই রকম বাঁধাধরা প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। ভোলার নির্বাচনের পরও তাই হয়েছে। এটা এখন বাংলাদেশের শাসকশ্রেণীর দলগুলোর নির্বাচনী রাজনীতির এক অবিচ্ছেদ্য ঐতিহ্যে পরিণত হয়েছে। দুর্নীতিই যে এই 'ঐতিহ্যের' গর্ভধারিণী এতে সন্দেহ নেই।

বাংলাদেশে নির্বাচন মূলত তিন শর্তের অধীন_ অর্থ, অস্ত্র বা পেশিশক্তি এবং সরকারি ক্ষমতা। এর মধ্যে প্রথম দুই শর্তই নির্ধারক; কারণ অর্থ ও পেশিশক্তি ছাড়া নির্বাচন এখন ভাবাই যায় না। এ দুই যার নেই তার পক্ষে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে যাওয়া উন্মাদের কাজ। এখানে উল্লেখ করা দরকার, অর্থ, অস্ত্র ও পেশিশক্তির অধিকার দুর্নীতির মাধ্যমেই অর্জিত। যেহেতু বাংলাদেশে দুর্নীতির পুরোভাগে আছে ব্যবসায়ী শ্রেণী, কাজেই দেখা যাবে, নির্বাচনে প্রার্থীদের মধ্যে এবং বিজয়ী প্রার্থীদের মধ্যে ব্যবসায়ীদেরই প্রাধান্য। বস্তুতপক্ষে বাংলাদেশে যে কোনো সরকারই এখন ব্যবসায়ী স্বার্থের দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত। ফলে ব্যবসায়ীরা রাজনীতিতে প্রাধান্য বিস্তার করে এবং অন্য রাজনৈতিক নেতা ও পাতি নেতারা ক্রমেই পরিণত হতে থাকেন ব্যবসায়ীতে। এ পরিস্থিতিতে দুর্নীতি যে নির্বাচন ক্ষেত্রে নির্ধারক ভূমিকা পালন করবে, এটিই স্বাভাবিক। ভোলার উপনির্বাচনে এ বিষয়টিই নতুন করে প্রমাণিত হলো।

যে উদ্দেশ্যে একটি দেশে পার্লামেন্ট গঠনের জন্য নির্বাচন হয়, সে উদ্দেশ্য বর্তমান বাংলাদেশে বিরাজমান পরিস্থিতিতে, যে শর্তে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় সে পরিস্থিতিতে পূর্ণ হওয়া সম্ভব নয়। অর্থাৎ নির্বাচনের মাধ্যমে প্রকৃত জনপ্রতিনিধি নির্বাচন আর একেবারেই সম্ভব নয়। কারণ নির্বাচনের মাধ্যমে বিপুল ভোটে নির্বাচিত হলেও অধিকাংশ ভোটদাতার স্বাধীন মতামতের অভিব্যক্তি তার মাধ্যমে ঘটে না এবং যারা নির্বাচিত হন তারা ভোটদাতাদের পৃষ্ঠপ্রদর্শন করে দুর্নীতির স্রোতে গা ভাসিয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে কালক্ষয় করেন না। ২০০৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচন হলো এর সর্বশেষ দৃষ্টান্ত। এসব থেকে প্রমাণিত হয়, নির্বাচনী রাজনীতির মধ্যে জনগণের স্বার্থ রক্ষার কোনো সম্ভাবনা আর নেই। অর্থাৎ নির্বাচনী রাজনীতির মধ্যে গণতান্ত্রিক চরিত্রের লেশমাত্র আর নেই। বর্তমানে যে শর্তাধীনে নির্বাচন হয়, যে ব্যবস্থাপনায় নির্বাচন হয়, তার পরিপূর্ণ উচ্ছেদ করে গোটা শাসন ব্যবস্থা ও তার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণভাবে নির্বাচনী ব্যবস্থার গণতন্ত্রীকরণ ছাড়া এ দেশে সমাজব্যবস্থার মধ্যে অর্থপূর্ণ পরিবর্তনের কোনো সম্ভাবনাই নেই।
[সূত্রঃ সমকাল, ২৭/০৪/১০]

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন