বৃহস্পতিবার, ১২ জানুয়ারী, ২০১২

হরতাল প্রসঙ্গে

বদরুদ্দীন উমর


২৭ জুন ২০১০-এ বিএনপি হরতাল ঘোষণার পর থেকে এর সমর্থনে এবং তার থেকেও বেশি এর বিরুদ্ধে অনেক লেখালেখি, বিবৃতি, সভা-সমিতি, মিছিল ইত্যাদি হয়েছে। এসব হৈচৈ থেকে মনে হওয়া স্বাভাবিক, এটা এমন এক জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু, যা নিয়ে মাতামাতি করে নাকের ডগায় অন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুকে যুক্তিসঙ্গতভাবে ধামাচাপা দেয়া বা খর্ব করা চলে। বাস্তবত ব্যাপারটা সে রকমই দাঁড়িয়েছে।

হরতাল একটি গণতান্ত্রিক অধিকার। একথা সব পক্ষ স্বীকার করলেও কর্মক্ষেত্রে প্রত্যেক ক্ষমতাসীন দল ও তাদের সরকার বিরোধী পক্ষের যে কোন হরতাল প্রতিরোধ করার জন্য দলীয় শক্তির সঙ্গে সরকারি শক্তি ব্যবহার করে। অন্যদিকে যারা হরতাল আহ্বান করে তারা গণতান্ত্রিক হরতালের শর্ত লঙ্ঘন করে তা কার্যকর করার জন্য জোরজবরদস্তির আশ্রয় নেয়। এর ফলে হরতালের সময় প্রায়ই এক মারদাঙ্গা পরিস্থিতি সৃষ্টি হয় এবং এতে অনেক লোক হতাহত পর্যন্ত হয়ে থাকে।

হরতাল রাজনৈতিক প্রতিবাদের একটি উপায় বা পদ্ধতি। যখন কোন দল হরতাল ডাকে, তখন তার সাফল্যের জন্য শুধু তাদের দলীয় লোকদেরই অংশগ্রহণ তারা আশা করে না। তারা আশা করে, সাধারণভাবে মানুষ তাদের প্রতিবাদ কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করে হরতাল সফল করবে। এ আশা যদি তাদের না থাকে তাহলে হরতাল সাধারণত আহ্বান করা হয় না। হরতালে যদি এভাবে জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ থাকে, তাহলে কাউকে হরতালে অংশ নিতে বাধ্য করার প্রশ্ন ওঠে না। এ কারণে হরতাল যারা আহ্বান করে, জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণের ওপরই তাদের নির্ভর করা দরকার। কারণ এর দ্বারা তাদের নিজেদেরও বোঝার সুবিধা হয়, জনগণের সমর্থন কতটা তাদের পক্ষে এবং কতটা তাদের প্রতিপক্ষ সরকারের পক্ষে।

সরকারের দিক থেকেও হরতালের ব্যাপারে এই একই দৃষ্টিভঙ্গি গণতান্ত্রিক রাজনীতির এক গুরুত্বপূর্ণ শর্ত। নির্বাচন ছাড়া অর্থাৎ নির্বাচনের বাইরে হরতাল সরকার পক্ষের অবস্থান বোঝার একটা উপায়। কাজেই নিজেদের পক্ষে জনসমর্থন যাচাইয়ের জন্যও সরকারি দল ও সরকারের প্রয়োজন নির্বিঘ্নে হরতাল পালিত হতে দেয়া।

কিন্তু বাংলাদেশে গণতন্ত্র কোথায়? বাংলাদেশের ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায়, এই রাষ্ট্রের জন্মলগ্ন থেকেই এদেশে গণতন্ত্র অনুপস্থিত।
প্রথম থেকে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে যা পাওয়া যায় তা হল, নির্বাচিত সরকারের গণতান্ত্রিক স্বৈরতন্ত্র অথবা সরাসরি সামরিক শাসন। এ দুই ধরনের শাসনই হল ফ্যাসিবাদের বৃন্তে দুই ফুলের মতো। শাসনব্যবস্থার এই চরিত্র শাসকশ্রেণীর চরিত্রেরই প্রতিফলন। এই শাসকশ্রেণী বলতে শুধু সরকারি ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত দল ও লোকজনকেই বোঝায় না। বিরোধী দলসহ ধনিক শ্রেণীর সমগ্র অংশই এর অন্তর্গত। এ কারণে যে দলই ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়, সে দলই তার পূর্ববর্তী ক্ষমতাসীন প্রতিপক্ষের মতো আচরণ করে। এর দ্বারা তাদের সবার শ্রেণীগত ঐক্য এবং অভিন্নতাই প্রমাণিত হয়।

১৯৯১ সাল থেকে প্রতিটি নির্বাচিত সরকার ও বিরোধী দল অন্যান্য ক্ষেত্রের মতো হরতালের ক্ষেত্রেও একই আচরণ করে এসেছে। বিরোধী অবস্থানে থাকলে হরতাল আহ্বান, হরতাল পালনের জন্য মানুষের স্বতঃস্ফূর্ততার ওপর নির্ভর না করে অল্পবিস্তর জোরজবরদস্তির আশ্রয় গ্রহণ করা এবং ক্ষমতায় থাকার সময় বিরোধী পক্ষের হরতাল বন্ধ করার জন্য দলীয় লোকজন ও পুলিশের সহায়তায় ফ্যাসিস্ট কায়দায় বিরোধী পক্ষের ওপর আক্রমণ।

হরতাল একটি গণতান্ত্রিক অধিকার হলেও এর যথেচ্ছ ও বাড়াবাড়ি ব্যবহার শুধু যে হরতালের রাজনৈতিক কার্যকারিতা হ্রাস করে তাই নয়, এর ফলে অনেক ধরনের বিশৃংখলা সৃষ্টি হয়। এই বিশৃংখলা গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার পরিপন্থী। এটা বোঝার অসুবিধা যে শাসকশ্রেণীর প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের আছে, এমন নয়। তারা বারবার অঙ্গীকার করে হরতাল না করার। কিন্তু বিরোধী অবস্থানে যে দলই আসুক, তারা এই অঙ্গীকার ভঙ্গ করে হরতালকেই নিজেদের আন্দোলন কর্মসূচির প্রধান অবলম্বন হিসেবে ব্যবহার করে।

২৭ জুনের বিএনপি আহূত হরতাল নিয়ে বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারকে এখানকার বুর্জোয়া শাসকশ্রেণীর রাজনৈতিক ঐতিহ্য অনুযায়ী খুব স্পর্শকাতর দেখা যাচ্ছে। তারা বিএনপির হরতালের বিরুদ্ধে অনেক কঠোর হুমকি দিচ্ছে। হরতাল আহ্বানকারী বিএনপিও পাল্টা হুমকি দিয়ে যাচ্ছে, হরতালে বাধা দিলে লংকাকাণ্ড হবে। হরতাল প্রতিহত করার আহ্বান গণতান্ত্রিক রাজনীতির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ কোন আহ্বান নয়। কিন্তু ২৫ জুন ঢাকার রিপোর্টার্স ইউনিটি মিলনায়তনে ‘হরতাল প্রতিহত করুন, জঙ্গিবাদ রুখে দাঁড়ান’ শীর্ষক এক আলোচনা সভায় আওয়ামী লীগের নেতারা প্রকৃতপক্ষে এ আহ্বান জানিয়ে হরতাল বন্ধ করার উদ্দেশ্যে অনেক উসকানিমূলক বক্তব্য প্রদান করেছেন। (দৈনিক কালের কণ্ঠ, ২৬-৬-২০১০)। এই উসকানি শুধু যে দলীয় কর্মী ও লোকজনকেই দেয়া হয়েছে, তা-ই নয়। এর দ্বারা পুলিশকেও হরতাল প্রতিরোধের জন্য প্ররোচিত করা হয়েছে।
লক্ষ্য করার বিষয় যে, ২৭ তারিখের হরতাল ও জঙ্গিবাদকে একই দড়িতে বেঁধে তা রুখে দাঁড়াতে আহ্বান জানানো হয়েছে আওয়ামী লীগের উপরোক্ত আলোচনা সভায়। হরতাল ও জঙ্গিবাদকে এভাবে সম্পর্কযুক্ত করে উপস্থাপিত করা রাজনৈতিক দিক দিয়ে বিভ্রান্তিমূলক। এর দ্বারা আওয়ামী লীগেরও বিভ্রান্তির বেড়াজালে আটকা পড়ার সম্ভাবনা। কারণ ২৭ জুনের হরতালকে এভাবে দেখলে তার থেকে রাজনৈতিক শিক্ষা গ্রহণের কোন অবকাশ থাকে না যে, শিক্ষার কথা ওপরে বলা হয়েছে।

আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তা যে এখন দ্রুত কমছে, এতে সন্দেহ নেই। চট্টগ্রামে মহিউদ্দিনের শোচনীয় পরাজয়কে মূলত ব্যক্তি মহিউদ্দিনের পরাজয় হিসেবে দেখানোর একটা চেষ্টা আওয়ামী লীগ দল ও আওয়ামী ঘরানার বুদ্ধিজীবীদের আছে। কিন্তু এই পরাজয়ে মহিউদ্দিনের সৃষ্ট কর্মকাণ্ডের ভূমিকা যাই থাক, আওয়ামী লীগের প্রতি জনসমর্থন থাকলে তার এই পরাজয় হতো না। এই পরাজয়ের মূল কারণ চট্টগ্রামে আওয়ামী লীগের অজনপ্রিয়তার পাল্লা ভারি হতে থাকা। কিন্তু চট্টগ্রাম সারাদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন কোন দ্বীপ নয়। চট্টগ্রামে জনগণের মধ্যে আওয়ামী লীগ থেকে সমর্থন প্রত্যাহারের যে ব্যাপার ঘটেছে, এটা দেশজুড়েই ঘটেছে। এটাই অন্যতম কারণ, যে জন্য আওয়ামী লীগ সরকার ঢাকায় মেয়র নির্বাচনের তারিখ পিছিয়ে দিচ্ছে, যদিও বর্তমান মেয়রের মেয়াদ অনেক আগেই শেষ হয়েছে।

ঢাকার রিপোর্টার্স ইউনিটির আলোচনা সভায় ২৭ তারিখের হরতালের সঙ্গে জঙ্গিবাদ যুক্ত করে জঙ্গিবাদকে বাংলাদেশে যত বড় রকম উপদ্রব হিসেবে দেখানোর চেষ্টা হচ্ছে, আসলে সেটা তত বড় উপদ্রব নয়। যে কোন উপদ্রবকে যথাযথভাবে বিচার-বিশে¬ষণ করা দরকার। জঙ্গিবাদ নিয়ে বিশ্বজুড়ে এখন যে প্রচারণা হচ্ছে, সেটা মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ও তার সাম্রাজ্যবাদী নীতিরই সৃষ্টি। শুধু তাই নয়, এ জঙ্গিবাদ তাদেরই অর্থ এবং অস্ত্র সাহায্যে অনেক দেশেই জন্মলাভ করেছে ও পরিচালিত হচ্ছে। আমাদের দেশেও এর অস্তিত্ব আছে। তা নিয়ে বাড়াবাড়ির কোন কারণ বাংলাদেশে নেই। কিন্তু সেটা না থাকলেও রাজনৈতিক মতলববাজরা তা-ই করছে।

বাংলাদেশে জঙ্গিবাদ নামে কথিত উপদ্রব থেকে অনেক বিপজ্জনক হচ্ছে শাসকশ্রেণীর নিজেরই সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড। আওয়ামী লীগ সরকার ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে নির্বাচনে বিজয়ের পর থেকে তাদের অঙ্গসংগঠন ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও সেই সঙ্গে খোদ আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা যে চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, ভর্তি-বাণিজ্য, চুরি-ডাকাতি, ঘুষখোরি ও ভূমিদস্যুতা সন্ত্রাসী তৎপরতার মাধ্যমে চালিয়ে দেশজুড়ে এক মারাত্মক নৈরাজ্যিক পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে; এ নৈরাজ্য শুধু অর্থনৈতিক নয়, রাজনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রেও বিস্তৃত। সমাজে এখন অপরাধ যেভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে, তার সঙ্গে এ পরিস্থিতি ওতপ্রোতভাবে সম্পর্কিত।

নিজেদের অভিজ্ঞতা ও জয়-পরাজয় থেকে শিক্ষা নেয়ার কোন ক্ষমতা বাংলাদেশের শাসকশ্রেণীর নেই। এদের কোন দলেরই আদর্শ এবং অন্তর্নিহিত শক্তি নেই। কিন্তু এরা নির্বাচনের মাধ্যমে পাল্টাপাল্টি করে ক্ষমতায় থাকে। এদের একদল যেমন অন্য দলের অপকর্মের কারণে নির্বাচনে জয়ী হয়ে ক্ষমতায় বসে, তেমনি এরা শ্রেণীগতভাবে বাংলাদেশে এখনও ক্ষমতাসীন থাকার কারণ বাংলাদেশে কোন বিপ¬বী তো নয়ই, এমনকি প্রকৃত গণতান্ত্রিক শক্তির কার্যকর উপস্থিতির অভাব এবং তাদের প্রতি সাম্রাজ্যবাদের সক্রিয় সমর্থন।
[সূত্রঃ যুগান্তর, ২৭/০৬/১০]

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন