বাংলাদেশে
যেভাবে ও যে শর্তে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে, সেটা যে জনপ্রতিনিধি
নির্বাচনের উপায় নয়, এটা দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতায় দেখা গেলেও ২০০৮ সালের
নির্বাচন তা আবার নতুনভাবে প্রমাণ করেছে। এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জনগণের
ভোটে বিপুল বিজয় অর্জন করে, জাতীয় সংসদে বিরাট সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে
সরকার গঠন করেছে। এই নির্বাচনের আগে তারা এমনভাবে প্রতিশ্রুতির বন্যা
প্রবাহিত করেছিল যা ইতিপূর্বে কারও ক্ষেত্রে দেখা যায়নি। এমনকি ১৯৯৬ সালেও
তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে দেখা যায়নি। সে নির্বাচনে জয়লাভ করে তারা সরকার
গঠন করেছিল।
প্রতিশ্রুতি প্রদানের পর প্রতিশ্র“তি পালনের ধারে-কাছে না গিয়ে তার উল্টো কাজ করলে, তার বিরুদ্ধে জনগণের প্রতিক্রিয়া হয়। এ ধরনের প্রতিশ্রুতি যত বড় আকারে দেয়া হয়, তার বহর যত-বেশি হয়, প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়াও হয় তত বড় আকারের। শুধু তাই নয়, এ প্রতিক্রিয়া হয় ততই দ্রুত। ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ইশতেহারে ঘোষিত প্রতিশ্রুতি এবং ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে সরকার গঠনের পর এটাই দেখা যাচ্ছে। এত বড় বিজয় লাভ করে এত অল্প সময়ের মধ্যে জনপ্রিয়তা হারাতে থাকার ঘটনা ইতিপূর্বে অন্য কোন সরকারের ক্ষেত্রে দেখা যায়নি। শ্রেণী বিভক্ত সমাজে শাসক শ্রেণী ব্যাপক শ্রমজীবী জনগণকে শোষণ করে। এই শোষণ একটা প্রক্রিয়া বা নিয়ম অনুযায়ী চলে। এর বিরুদ্ধে জনগণের মধ্যে ক্ষোভের সঞ্চার হয়। সেটা প্রতিরোধের তাগিদ সৃষ্টি হয়, তারা এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ বিক্ষোভ ইত্যাদি করে থাকেন। কিন্তু শোষণের থেকে নির্যাতনের বিরুদ্ধে জনগণের প্রতিক্রিয়া অধিকতর তীব্র হতে দেখা যায়। এখানে বলা দরকার যে, নির্যাতন কোন স্বাধীন ব্যাপার নয়। অর্থাৎ মানুষ নির্যাতনের জন্যই নির্যাতন করে না। নির্যাতন করা হয় তখনই, যখন শোষিতরা শোষণের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেন, সংগঠিত হন, প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। জনগণের সম্পদ লুটপাটের সঙ্গেও নির্যাতন সম্পর্কিত থাকে। শোষণের মতো লুটপাটের বিরুদ্ধে দাঁড়ালেও জনগণের ওপর নির্যাতন হয়। বাংলাদেশে এখন বিভিন্ন ক্ষেত্রে বেশ বড় আকারে নির্যাতন চলছে। এই নির্যাতনের মাত্রা ক্রমাগত বৃদ্ধি পেতে থাকাই মূল কারণ, যে জন্য বর্তমান সরকার দেড় বছরেরও কম সময়ে এত অজনপ্রিয় হয়েছে, যা ইতিপূর্বে কোন সরকারকে হতে দেখা যায়নি। এমনকি এদের ১৯৯৬-২০০১ সালে ক্ষমতাসীন সরকারের ক্ষেত্রেও এটা ঘটেনি। তারা ব্যাপকভাবে জনপ্রিয়তা হারানোর ফলে ২০০১ সালের সাধারণ নির্বাচনে পরাজিত হয়েছিল, কিন্তু সেভাবে অজনপ্রিয় হতে দেরি হয়েছিল। সেরকম কোন দেরি ২০০৯ সালে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের ক্ষেত্রে হচ্ছে না। এভাবে দ্রুত জনগণের মধ্যে তাদের সমর্থন হারানোর কারণ জনগণের ওপর তাদের ব্যাপক ও মাত্রাতিরিক্ত নির্যাতন। যেখানে শ্রমজীবী জনগণ ও তাদের প্রতিনিধিদের আন্দোলন, সেখানেই নির্যাতন হচ্ছে। লাঠি, গুলি, ধরপাকড়, জেল-জুলুম সব কিছুই চলছে। তবে এই নির্যাতন শুধু রাস্তা ও মাঠে আন্দালনকারীদের বিরুদ্ধেই হচ্ছে না, যারা সরকারের শোষণ-নির্যাতনের বিরুদ্ধে দাঁড়াচ্ছেন, এজন্য বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমে কথা বলে ও লিখে মতপ্রকাশ করছেন, তাদের ওপর সরকারি নির্যাতন এখন যথেচ্ছভাবে শুরু হয়েছে। টিভি চ্যানেল, সংবাদপত্র বন্ধ করে দিয়েই সরকার ক্ষান্ত থাকছে না, টিভিতে যেসব প্রোগ্রামে সরকারের সমালোচনা হচ্ছে, সেগুলোও তারা বন্ধ করছে। এ ক্ষেত্রে যা বিশেষভাবে লক্ষণীয় তা হচ্ছে, শুধু সরকার বিরোধিতার কারণেই যে এসব নির্যাতনমূলক পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে তাই নয়, ব্যক্তিগত প্রতিহিংসা চরিতার্থের উদ্দেশ্যেও নির্যাতনের আশ্রয় নেয়া হচ্ছে। চ্যানেল ওয়ান এবং যমুনা টিভি বন্ধ করার পর সরকার দৈনিক আমার দেশ শুধু বন্ধই করেনি, পত্রিকা ও তার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদকসহ অন্য কর্মীদের ওপর যেভাবে হামলা করেছে, এটা বাংলাদেশেও সংবাদপত্রের ওপর সরকারি হামলার ইতিহাসে নজিরবিহীন। যেভাবে এ কাজ করা হয়েছে তার কোন প্রকৃত আইনগত ভিত্তি না থাকলেও প্রতিহিংসার বশবর্তী হয়ে এই আক্রমণের মাধ্যমে সরকার তার ফ্যাসিবাদী চরিত্রই উন্মোচন করেছে। এক্ষেত্রে আমার দেশ-এর ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মাহমুদুর রহমানের ওপর যে নির্যাতন করা হচ্ছে তার উল্লেখ করা দরকার। ১ জুন আমার দেশ পত্রিকার প্রকাশনা নিষিদ্ধ করে এর ভারপ্রাপ্ত সম্পাদককে গ্রেফতার করা হয়েছে। শুধু গ্রেফতার করাই হয়নি, তাকে বারবার রিমান্ডেও নেয়া হচ্ছে। রিমান্ডে নিয়ে মাহমুদুর রহমানের ওপর যে নির্যাতন করা হচ্ছে সেটা আলোচনার আগে বলা দরকার যে, কথায় কথায় যেকোন গ্রেফতার হওয়া লোককে রিমান্ডে নেয়ার ব্যাপার বাংলাদেশে আগে ছিল না। এটা শুরু হয়েছে ২০০৭-০৮ সালে ক্ষমতাসীন মইন-ফখরুদ্দীন সরকারের বেনামি সামরিক শাসনামলে। সে সময় নির্যাতনের মাত্রা এতই বৃদ্ধি পেয়েছিল যে, একজন রাজনৈতিক কারণে গ্রেফতার হওয়ার অর্থই দাঁড়িয়েছিল পুলিশ বা র্যাবের রিমান্ডে নিয়ে তার ওপর অকথ্য শারীরিক নির্যাতন চালানো। এসব নির্যাতন বন্ধ করার প্রতিশ্রুতি নির্বাচনের সময় আওয়ামী লীগ, বিএনপি উভয় দলই দিয়েছিল। কিন্তু নির্বাচনে জয়লাভ করে গদিনসিন হওয়ার পর অন্যান্য প্রতিশ্রুতির মতো এক্ষেত্রেও সরকার প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। এরা এখন বাস্তবত ২০০৭-০৮ সালের ফ্যাসিস্ট সরকারের যাবতীয় নীতিরই উত্তরাধিকারী হিসেবে আবির্ভূত হয়ে তাদের কীর্তিকলাপেরই পুনরাবৃত্তি ঘটাচ্ছে। এরা যদি এই পথে না হাঁটত, তাহলে পত্রিকা প্রকাশের ব্যাপারে কিছু অনিয়ম যদি হয়ে থাকত তাহলে তার জন্য প্রথম সারির একটি জাতীয় দৈনিকের সম্পাদককে এভাবে রিমান্ডে নেয়ার ঘটনা সম্ভব হতো না। পুলিশ রিমান্ডে একজন গ্রেফতার হওয়া লোককে নিয়ে যাওয়ার অর্থই হল, জিজ্ঞাসাবাদের নামে তার ওপর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন। এই নির্যাতন বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ীও করা যায় না। কিন্তু সরকার যেভাবে সংবিধান লঙ্ঘন করে এখন নানা কাজ করছে, এর দৃষ্টান্ত একমাত্র ফখরুদ্দীন সরকারের আমল ছাড়া অন্য কোন আমলে পাওয়া যায় না। এভাবে আটক ব্যক্তিদের রিমান্ডে নেয়া সরকারের ফ্যাসিবাদী চরিত্রেরই বহিঃপ্রকাশ। ফখরুদ্দীন সরকারের মতো বর্তমান সরকারও অনুরূপ ফ্যাসিবাদী চরিত্র পরিগ্রহ করার কারণেই এরকম ঘটছে। মাহমুদুর রহমানকে পুলিশ রিমান্ডে নিয়ে তার ওপর যে নির্মম শারীরিক নির্যাতন করা হয়েছে, তার বিবরণ তিনি আদালতের সামনে দিয়েছেন। এ বিবরণ দিয়ে তিনি আদালতের কাছে আবেদন করেছেন যাতে আবার তাকে রিমান্ডে না দেয়া হয়। কিন্তু তার আবেদন অগ্রাহ্য করে তাকে আবার রিমান্ডে দেয়া হয়েছে। প্রথমবার তাকে রিমান্ডে দেয়ার সময় আদালত তার ওপর নির্যাতন না করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু পুলিশ আদালতের সে নির্দেশ অমান্য করে মাহমুদুর রহমানের ওপর নির্যাতন করেছে, একথা তিনি আদালতের সামনে বলা সত্ত্বেও এজন্য পুলিশকে জবাবদিহি করতে বলা হয়নি। উপরন্তু মাহমুদুর রহমানকে আবার রিমান্ডে পাঠানো হয়েছে। শুধু মাহমুদুর রহমানই নয়, যে কোন গ্রেফতার হওয়া লোককে পুলিশ রিমান্ডে নিয়ে যেভাবে নির্যাতন করা হচ্ছে তার বিরুদ্ধে সাধারণভাবে রাজনৈতিক আন্দোলন আজ অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। এই পরিস্থিতিতে আদালত কর্তৃক পাইকারি হারে পুলিশের রিমান্ড আবেদন মঞ্জুর করার বিষয়টিও রীতিমতো বিস্ময়কর। আমার দেশ পত্রিকা তাদের প্রকাশনা পুনরায় চালু করার জন্য হাইকোর্টে যে মামলাটি করেছিল তাতে আদালত সরকারি নিষেধাজ্ঞা স্থগিত করে প্রকাশনা চালু করার এবং প্রেসের তালা খুলে দেয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন। এই রায়ের ওপর ভিত্তি করে পত্রিকা কর্তৃপক্ষ সাময়িকভাবে অন্য প্রেস থেকে পত্রিকা প্রকাশের ব্যবস্থা করে। কিন্তু সরকারের পাল্টা আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে সুপ্রিমকোর্টের চেম্বার জজ আমার দেশ প্রকাশনার ওপর নিষেধাজ্ঞা বহাল রেখেছেন। কাজেই পত্রিকাটির প্রকাশনা শুরু হয়ে আবার বন্ধ হয়েছে। হাইকোর্ট এখন এক মাসের জন্য বন্ধ। কাজেই পত্রিকাটি অন্তত আরও এক মাস বন্ধ থাকবে। বাংলাদেশে শাসন ব্যবস্থা এখন এভাবেই চলছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের মূল্যবৃদ্ধি, চুরি, চাঁদাবাজিসহ সব সম্ভাব্যরকম দুর্নীতির কবলে পড়ে সাধারণ মানুষের জীবন এখন দুর্বিষহ হয়েছে। তার ওপর পুলিশ ও র্যাবের ক্রসফায়ারে হত্যাকাণ্ড থেকে নিয়ে মত প্রকাশের স্বাধীনতার ওপর হামলা জীবনকে বিপর্যন্ত করছে। বর্তমান সরকার চিরদিন গদিনসিন থাকার স্বপ্নে বিভোর হয়ে বেপরোয়াভাবে জনগণের ওপর নিজেদের শোষণ-নির্যাতন চালিয়ে যাচ্ছে। সব ক্রিয়ারই প্রতিক্রিয়া আছে। কাজেই অদূর ভবিষ্যতে তাদের ক্রিয়ার প্রতিক্রিয়া যে তাদের দেখতে হবে এবং এ প্রতিক্রিয়া যে ক্রিয়ার মতোই প্রচণ্ড হবে এতে সন্দেহ নেই। ১৭ জুন অনুষ্ঠিত চট্টগ্রামের মেয়র নির্বাচনে মহিউদ্দিন চৌধুরীর পরাজয় এটা স্পষ্টভাবেই প্রমাণ করেছে। [সূত্রঃ যুগান্তর, ২০/০৬/১০] |
বৃহস্পতিবার, ১২ জানুয়ারী, ২০১২
আটকদের নিয়মিতভাবে রিমান্ডে নেয়া ফ্যাসিবাদেরই বহিঃপ্রকাশ
এতে সদস্যতা:
মন্তব্যগুলি পোস্ট করুন (Atom)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন