বৃহস্পতিবার, ১২ জানুয়ারী, ২০১২

বাংলাদেশে দুর্নীতিই সার্বভৌম

বদরুদ্দীন উমর


দুর্নীতি দমন কমিশনকে দমন করার ব্যবস্থা হচ্ছে। এই দমন কর্ম করছে ২০০৮ সালের সাধারণ নির্বাচনে জাতীয় সংসদে বিশাল সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনকারী আওয়ামী লীগ। এর মাধ্যমে আবার প্রমাণিত হলো যে, বাংলাদেশের রাজনীতি, অর্থনীতি, শিক্ষা, সংস্কৃতি, চিকিত্সাসহ সর্বক্ষেত্রে দুর্নীতি সার্বভৌম। দুর্নীতির সার্বভৌমত্ব তার পদচিহ্ন সর্বত্র রাখছে। এই মুহূর্তে তার দ্বারা পদদলিত হতে যাচ্ছে দুর্নীতি দমন কমিশন।

২৬ এপ্রিল মন্ত্রিসভার বৈঠকের পর প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব সাংবাদিকদের বলেন, �দুর্নীতি দমন কমিশন আইন-২০০৪ এর সংশোধনী নীতিগত অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রিসভা। এতে কিছু বিষয়ে সংশোধনী আনা হয়েছে। এর মধ্যে কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে দুর্নীতির মিথ্যা অভিযোগ আনলে অভিযোগকারীর বিরুদ্ধে পাঁচ বছরের জেল ও আর্থিক জরিমানার বিধান রয়েছে। (যুগান্তর ২৭-৪-২০১০) উপরোক্ত সংশোধনীর অন্যদিক বাদ দিয়ে এখানে যা বলা হয়েছে তা যে কোনো তদন্ত ও বিচার ব্যবস্থার ক্ষেত্রে এক বিরাট প্রতিবন্ধক, এ নিয়ে কোনো সত্ ও যুক্তিনিষ্ঠ ব্যক্তির দ্বিমত থাকার কথা নয়। শুধু তাই নয়, এটা বাস্তবত তদন্ত ও বিচার ব্যবস্থা অকার্যকর করে রাখারই এক স্বচ্ছ কৌশল। দুদকের মামলার বিষয়ে যা বলা হয়েছে সেটা যদি সাধারণ মামলার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য করার ব্যবস্থা হয়, তাহলে নিম্ন থেকে উচ্চতম আদালত পর্যন্ত যে কোনো মামলা দায়ের করে পরাজিত হওয়ার পর পরাজিত ব্যক্তির জেল-জরিমানা হওয়ার কথা। বিচার ব্যবস্থার ক্ষেত্রে এর থেকে অদ্ভুত ও হাস্যকর ব্যাপার আর কী হতে পারে? শুধু তাই নয়, এ এক মহাবিপজ্জনক ব্যাপার। কারণ এর অর্থ হবে কার্যত দেশের বিচার ব্যবস্থার উচ্ছেদ।

আদালতে শুধু দুর্নীতির বিরুদ্ধে নয়, যে কোনো বিষয়ে একজন নাগরিক অন্য একজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ এনে মামলা দায়ের করতে পারেন। এই মামলায় অভিযুক্ত ব্যক্তির বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ প্রমাণিত হলে তার শাস্তি আইন অনুযায়ী হয়। কিন্তু মামলায় হেরে গেলে একজনের শাস্তির বিধান আইনের কোন্ খাতায় লেখা আছে? কেউ যদি ইচ্ছাকৃতভাবে কোনো মিথ্যা বলে তার জন্য আইনে (চবহধষ ঈড়ফব) ব্যবস্থা আছে। কাজেই এ নিয়ে দুদকের ক্ষেত্রে কোনো বিশেষ ব্যবস্থার প্রয়োজনই নেই। মন্ত্রিপরিষদ প্রস্তাবিত সংশোধনীতে মামলায় মিথ্যা অভিযোগ সংক্রান্ত ব্যাপারে বিশেষভাবে শাস্তি বিধানের যে কথা বলা হয়েছে বাস্তবত তা হলো, দুর্নীতির বিরুদ্ধে দুদকে মামলা দায়েরকারীর বিরুদ্ধে হুমকিস্বরূপ। কারণ দুদক নিজে কোনো বিচার করে না। তদন্তে ও প্রসিকিউটরের কাজ করে। দুর্নীতি বা অন্য কোনো বিষয় নিয়ে মামলায় জয়-পরাজয় অনেক কিছুর ওপর নির্ভর করে। কাজেই পরাজিত পক্ষকে শাস্তি দেয়ার কোনো প্রশ্ন নেই। শাস্তির প্রশ্ন তখনই উঠতে পারে যখন মামলার নিষ্পত্তির মাধ্যমে প্রমাণিত হয় যে, অভিযোগকারী একেবারে ইচ্ছাকৃতভাবে মানহানি ও হয়রানির উদ্দেশ্যে কোনো মিথ্যা অভিযোগ একজনের বিরুদ্ধে এনে মামলা দায়ের করেছে। আগেই বলা হয়েছে, এর জন্য চবহধষ ঈড়ফব-এ সুনির্দিষ্ট বিধান আছে, যার অধীনে শাস্তি হতে পারে। তবে এই শাস্তি ঢালাওভাবে পাঁচ বছর জেল বা সেই সঙ্গে জরিমানা নয়। কী শাস্তি হবে সেটা মিথ্যার অভিযোগ ওজন করে আদালতেরই নির্ধারণ করার কথা। তার জন্য মন্ত্রিপরিষদের হুকুমজারির কোনো প্রয়োজন নেই।

এসব অতি সাধারণ জ্ঞানের ব্যাপার। কিন্তু যে কারণে মন্ত্রিপরিষদ এই সংশোধনী প্রস্তাব করেছে ও কার্যকর করতে যাচ্ছে তার একটিই উদ্দেশ্য�যারা দুর্নীতিবাজ তাদের দুর্নীতির বিরুদ্ধে দেশের নাগরিকদের অভিযোগ উত্থাপন করা থেকে বিরত রাখা। দুর্নীতির অভিযোগ অনেক কারণেই মিথ্যা প্রমাণিত হতে পারে। এমনকি এটা হতে পারে খোদ আদালতের দুর্নীতি ও ভ্রান্ত বিচারের কারণেও। এটা হতে পারে সরকারি কর্তাব্যক্তিদের হুমকির কারণে। এই পরিস্থিতিতে দুর্নীতির অভিযোগ এনে একজনের পক্ষে সেটা প্রমাণ করার অসুবিধা অনেক। তাছাড়া যেভাবে শীর্ষতম থেকে নিম্নপর্যায়ের সরকারি লোকদের মামলার পর মামলা আদালত বিচার না করে সরকারি চাপ ও নির্দেশের মুখে খারিজ করে চলেছে তার থেকে ভালোভাবেই বোঝা যায় যে, সরকারি লোকদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণ করা একটা মহাদুরূহ, এমনকি অসম্ভব ব্যাপার।

দুর্নীতি দমনের ক্ষেত্রে দুদক যে প্রকৃতপক্ষে ঠুঁটো জগন্নাথের ভূমিকাই পালন করবে এর আর এক ব্যবস্থা হচ্ছে দুদকে মামলা করার জন্য সরকারি অনুমতির প্রয়োজনীয়তা। দুদকে দায়েরকৃত মামলার অধিকাংশ বা একটা বড় অংশ হলো, সরকারি ও বিরোধী দলের রাজনৈতিক ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে। এই অবস্থায় দুদক কর্তৃক যে কোনো মামলা দায়েরের ক্ষেত্রে যদি সরকারের অনুমতি নিতে হয় তাহলে সরকারি লোকদের দুর্নীতির বিরুদ্ধে মামলা হবে কীভাবে? এটা কি ভাবা যায় যে, সরকার তার নিজের লোকদের বিরুদ্ধে দুদককে মামলা করার অনুমতি দেবে? বিশেষ করে শক্তিধর সরকারি নেতা-নেত্রীদের বিরুদ্ধে বর্তমান পরিস্থিতিতে দুদকের মামলা দায়ের করা কি সম্ভব, যেখানে সরকারি লোকদের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত মামলার বিচার না হয়ে আদালত কর্তৃক সেসব খারিজ হয়ে যাচ্ছে?

বাংলাদেশে সমাজের একটা বড় অংশ এখন অপরাধীকরণকৃত (Criminalised) হয়েছে। এই অপরাধীকরণকৃত অংশের মধ্যে শাসকশ্রেণীর উচ্চতম শিখরে অধিষ্ঠিত লোকজনেরই প্রাধান্য। তাদের এই প্রাধান্যের প্রভাব চুঁইয়ে চুঁইয়ে নিচের দিকে নেমে এসে নিম্নতর বিভিন্ন পর্যায়ে অবস্থিত লোকদের চরিত্র দুর্নীতির রসে সিক্ত করছে। এই দুর্নীতির কারণে সব সমাজে কীভাবে আজ চুরি-ডাকাতি, সন্ত্রাস ও খুনখারাবি ছড়িয়ে পড়ে এক বিভীষিকার রাজত্ব এখানে কায়েম হয়েছে তার চিত্র প্রতিদিনই সংবাদপত্রের পাতায় দেখা যায়। একটি দেশে যখন এই অবস্থা বিরাজ করে তখন তার নিয়ন্ত্রণে বিচার ব্যবস্থার একটা ভূমিকা থাকার কথা। কিন্তু বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থাও আজ হয়ে দাঁড়িয়েছে উপরে বর্ণিত সাধারণ অবস্থার অধীন। বিগত ২৪ এপ্রিল একটি সেমিনারে সাবেক প্রধান বিচারপতি মাহমুদুল আমিন চৌধুরী যেভাবে বিচার বিভাগকে কাচের ঘর হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন তার থেকে বিচার ব্যবস্থার ভঙ্গুর চরিত্র সহজেই বোঝা যায়।

বিচার ব্যবস্থায় এখন যেভাবে সরকার হস্তক্ষেপ করছে এদিক থেকেই সাবেক প্রধান বিচারপতি মাহমুদুল আমিন চৌধুরী তার উপরোক্ত বক্তব্য প্রদান করেছেন। এদেশে নির্বাচনী এবং আইন বিভাগের প্রতি জনগণ অনেক আগেই আস্থা হারিয়েছেন। এই পরিস্থিতিতে বিচার বিভাগকেই তারা দুর্নীতি, সন্ত্রাস ও সবরকম অবিচারের বিরুদ্ধে প্রতিকারের এক ভরসাস্থল মনে করে এসেছেন, যদিও এ ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতাও তাদের অজানা নয়। কিন্তু বর্তমানে যেভাবে বিচার বিভাগ �কাচের ঘরে� পরিণত হয়েছে এবং সরকারি হস্তক্ষেপের কারণে এটা হয়েছে তার থেকে বিপজ্জনক পরিস্থিতি একটা দেশের জন্য আর কী হতে পারে?

আসলে পরিস্থিতি এ ক্ষেত্রে কী ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে তারই এক দৃষ্টান্ত হলো, ২৬ এপ্রিল মন্ত্রিসভার বৈঠকে দুদক সম্পর্কিত সংশোধনী। দুদকে দুর্নীতির অভিযোগ দায়ের করে কেউ মামলা করে পরাজিত হলে তার পাঁচ বছর জেল ও সেই সঙ্গে জরিমানা হবে এবং সরকারি লোকদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ দায়েরের জন্য সরকারের অনুমতি লাগবে এ দুই বিধান যে ভঙ্গুর বিচার ব্যবস্থাকে একেবারে ভেঙে ফেলারই ব্যবস্থা, এতে আর সন্দেহ কী? বাংলাদেশে এখন দুর্নীতিই যে সার্বভৌম এর থেকে তার বড় প্রমাণ আর কী হতে পারে?
(সুত্র, আমার দেশ, ২৯/০৪/২০১০)

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন