বৃহস্পতিবার, ১২ জানুয়ারী, ২০১২

ঢাকায় ভারতের সামরিক উপস্থিতির জন্য বিস্ময়কর প্রস্তাব

বদরুদ্দীন উমর


ভারত ও বাংলাদেশ প্রতিবেশী রাষ্ট্র। শুধু তাই নয়, ১৯৪৭ সালের আগে উভয়েই ভিন্ন একটি রাষ্ট্রের অন্তর্গত ছিল। সুদূর প্রাচীনকাল থেকে ব্রিটিশ শাসনের শেষ পর্যন্ত এ দুই দেশের ইতিহাস অভিন্ন। শুধু দুই দেশ নয়, পাকিস্তানকে হিসাব করলে তিন দেশের ইতিহাসই দক্ষিণ এশীয় উপমহাদেশের অভিন্ন ইতিহাস। সাম্রাজ্যবাদী চক্রান্তে ওই উপমহাদেশ বিভক্ত হওয়ার পর থেকে ১৯৪৭-পরবর্তীকালে ভারত ও পাকিস্তান স্বতন্ত্র রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে ওঠে। পরে পাকিস্তান বিভক্ত হয়ে বাংলাদেশ রাষ্ট্র সৃষ্টির পর দক্ষিণ এশিয়া এখন ত্রিধাবিভক্ত হয়েছে। কিন্তু ১৯৪৭ সাল থেকে ৬৩ বছরের স্বাতন্ত্র্য সত্ত্বেও এ অঞ্চলের জনগণ শত শত বছরের সামাজিক আদান-প্রদান, চিন্তাধারা ও শাসনসূত্রে পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্কিত। এ সম্পর্কের ঐতিহ্য কৃত্রিম বিভাজনের কারণে বিনষ্ট হওয়ার নয়। কাজেই অনেক বিভিন্নতা সত্ত্বেও ভারতীয় উপমহাদেশ বা দক্ষিণ এশিয়া নামে পরিচিত, তিন রাষ্ট্রে বিভক্ত, এ দেশের জনগণের চিন্তাচেতনা ও সংস্কৃতির মধ্যে যে ঐক্য ও বন্ধন দেখা যায়, সেটা অন্য কারো সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে দেখা যায় না। এর ফলে এমনি ঘোরতর বিশ্বাস জনগণের মধ্যে যে সৌহার্দ্য ও সুসম্পর্ক আছে রাষ্ট্রীয় দ্বন্দ্ব ও বৈরিতা সত্ত্বেও, এটা এক সুখকর বাস্তবতা। বিশেষ বিশেষ সময়ে দ্বন্দ্ব-বৈরিতার পরিবর্তে যেকোনো দুই রাষ্ট্রের মধ্যে কিছুটা সুসম্পর্ক যখন হয়, তখন জনগণের মধ্যকার ওই সৌহার্দ্য স্পষ্টভাবেই দেখা যায়। এটা ভারত-পাকিস্তান, ভারত-বাংলাদেশ, এমনকি পাকিস্তান-বাংলাদেশের জনগণের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের মধ্যে দেখা যায়। এটিই স্বাভাবিক, কারণ যেসব স্বার্থ নিয়ে এ রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে বৈরিতা ও দ্বন্দ্ব-সংঘাত থাকে, সেসব স্বার্থ জনগণের নয়। এই রাষ্ট্রগুলোর প্রতিটিতে শাসনকাজ যে শ্রেণী বা শ্রেণীদের দ্বারা পরিচালিত হয়, তারা জনস্বার্থের প্রতিনিধিত্ব করে না, এর পরও জনগণকে শোষণ ও দমন-পীড়ন করে তারা নিজেদের শাসনব্যবস্থা বলবৎ রাখে। নিজেদের শাসনস্বার্থেই এই রাষ্ট্রগুলো পরস্পরের সঙ্গে দ্বন্দ্ব-সংঘর্ষে লিপ্ত হয়, যে দ্বন্দ্ব-সংঘর্ষের সঙ্গে এই রাষ্ট্রগুলোর জনগণের কোনো সম্পর্ক থাকে না। তবে তারা সব সময়ই চেষ্টা করে আন্তরাষ্ট্রীয় বৈরিতা ও দ্বন্দ্ব-সংঘর্ষকে জনগণের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে। তাদের এ চেষ্টা তারা কত ধরনের কৌশলের মাধ্যমে করে, তার কোনো হিসাব নেই।

ভারত বাংলাদেশের ঘনিষ্ঠতম প্রতিবেশী দেশ। এই দুই দেশের জনগণের মধ্যে দীর্ঘদিনের গভীর সম্পর্ক। ১৯৪৭ সালের দেশভাগ লাখ লাখ পরিবারকে বিভক্ত করেছিল। তারা দুই দেশেই ছড়িয়ে আছে। কাজেই দুই দেশের মধ্যে যে শুধু প্রতিবেশীসুলভ সম্পর্ক আছে তাই নয়, রক্ত ও আত্দীয়তার বন্ধনও উপেক্ষার নয়। কিন্তু এসব সত্ত্বেও দেখা যাবে যে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে অসম ও বৈরী নীতির কারণে শক্তিশালী প্রতিবেশী ভারত দুই দেশের মধ্যে তিক্ততার সম্পর্ক সৃষ্টি করছে। ১৯৭১ সালে ভারতের প্রতি বাংলাদেশের জনগণের যে বন্ধুত্ব ও সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছিল, তার মধ্যে পরিবর্তন ঘটেছে। পরবর্তী পর্যায়ে শক্তিশালী রাষ্ট্র হিসেবে ভারত বাংলাদেশের ওপর তার নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা এবং বাংলাদেশকে তার শাসকশ্রেণীর স্বার্থে ব্যবহারের যে চেষ্টা করে আসছে, তার ফলে দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কের অবনতি ঘটেছে।

এখানে লক্ষ করার বিষয়, বর্তমানে ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে যে তিক্ত সম্পর্ক অনেকাংশে সৃষ্টি হয়েছে, সে তিক্ততা রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে নেই। ভারত বাংলাদেশ সরকারের মাধ্যমেই এখন এ দেশে তার নিয়ন্ত্রণ নানাভাবে কার্যকর করতে নিযুক্ত হয়েছে। ব্যবসা-বাণিজ্য, সড়কপথ ও বন্দর, নদীর পানি ইত্যাদি ক্ষেত্রে ভারত বাংলাদেশে নিজের স্বার্থ উদ্ধার করলেও বাংলাদেশ তার বিনিময়ে প্রকৃতপক্ষে উল্লেখযোগ্য কিছুই পাচ্ছে না। এর দ্বারা জনগণ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন এবং তাঁদের ওপর এই নীতি ভারত ছড়িয়ে দিচ্ছে বাংলাদেশে সরকারের মাধ্যমেই। বাংলাদেশ সরকার এভাবে ভারত সরকারের তাঁবেদার হিসেবেই কাজ করছে।

ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের ক্ষেত্রে এই লম্বা ভূমিকার কারণ, ঠিক এ মুহূর্তে ভারত এমন এক কাজের জন্য বাংলাদেশ সরকারের ওপর প্রবল চাপ সৃষ্টি করছে, যা বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বকে সরাসরি উপেক্ষা ও পদদলিত করার শামিল। ভারত বলেছে, বাংলাদেশে যাতায়াতকারী ভারতীয় বিমানের নিরাপত্তার জন্য তারা এখানে সশস্ত্র 'স্কাই মার্শাল' পাঠাবে, যারা ঢাকার শাহজালাল বিমানবন্দরে অবস্থান নেবে। এই বিশেষ সামরিক বাহিনী বিমানবন্দরে অবস্থান করতে পারবে। এ জন্য তাদের তিন সদস্যের একটি টিম ঢাকায় এসে এখানকার কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত প্রায় চূড়ান্ত করেছে। এভাবে ভারতের স্কাই মার্শাল বাংলাদেশে মোতায়েন করার কারণ বাংলাদেশে নাকি ইসলামী জঙ্গি তৎপরতা খুব বৃদ্ধি পেয়েছে এবং তার ফলে ভারতীয় বিমানের নিরাপত্তা এখানে বিঘি্নত হওয়ার আশঙ্কা। সেটা যাতে না হয়, তার প্রতি সতর্ক দৃষ্টি রাখা এবং সে রকম কোনো আশঙ্কা রোধের জন্য ভারত ঢাকা বিমানবন্দরে তাদের নিজস্ব সামরিক ও গোয়েন্দা বাহিনী নিয়োজিত রাখার উদ্যোগ নিয়েছে।

সংবাদপত্রের রিপোর্ট থেকে দেখা যায়, এভাবে বাংলাদেশে ভারতীয় স্কাই মার্শাল নামে তাদের সামরিক বাহিনীর অবস্থান গ্রহণের ব্যাপারে এখানকার গোয়েন্দা সংস্থাগুলো আপত্তি জানিয়ে বলেছে, বিমানবন্দরের নিরাপত্তা যথেষ্ট সুরক্ষিত এবং ভারতসহ কোনো দেশের বিমানের নিরাপত্তাজনিত কোনো সমস্যা এখানে দেখা যায়নি এবং তাদের কাছে এ বিষয়ে কোনো তথ্যই নেই। কাজেই হঠাৎ ভারতীয় বিমানের নিরাপত্তার জন্য এখানে তাদের সামরিক বাহিনীর সরাসরি উপস্থিতি এবং অবস্থান গ্রহণের কোনো যৌক্তিকতা নেই। এটা সম্পূর্ণ নিষ্প্রয়োজন।

বাংলাদেশে আল-কায়েদাসহ অন্যান্য জঙ্গি সংগঠনের তৎপরতা রয়েছে বলে ভারত সরকার যে কথা বলেছে, তার কোনো বাস্তব ভিত্তি নেই। এ ধরনের কোনো তৎপরতা দ্বারা বিমানবন্দরে বিমান ওঠানামা তো নয়ই, কোনো ক্ষেত্রেই কোনো বিঘ্ন ও বিপদ সৃষ্টি হয়নি। কাজেই ভারতীয় বিমানের নিরাপত্তার জন্য তাদের এই বিশেষ ব্যবস্থা অনুমোদন করার অর্থ হলো, দেশের সার্বভৌমত্ব ভারতের কাছে সমর্পণ করা। আসলে ভারত যেভাবে তাদের সামরিক বাহিনী বিমানবন্দরে মোতায়েন করার কথা বলেছে, এটা বিশ্বের কোনো দেশের কোনো বিমানবন্দরেই নেই। একটি দেশ অন্য দেশে নিজের বিমানের নিরাপত্তার জন্য যদি নিজস্ব সামরিক বাহিনী মোতায়েন করতে চায়, তাহলে অন্য দেশও সেটা চাইতে পারে এবং এখানে এ অনুমতি দিলে অন্য ক্ষেত্রে সেটা না দেওয়ার যুক্তি থাকে না। এর অর্থ দাঁড়ায়, নিজেদের দেশের বিমানবন্দরকে নানা দেশের সামরিক বাহিনীর ঘাঁটিতে পরিণত করা। এর থেকে একটি দেশের নিজস্ব অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার ক্ষেত্রে বিপজ্জনক ব্যাপার আর কী হতে পারে? কাজেই ভারত নিজেদের বিমানের নিরাপত্তার নাম করে এখানে সামরিক বাহিনী মোতায়েন করার যে প্রস্তাব করেছে, এটার উদ্দেশ্য সম্পূর্ণ অন্য কিছু এবং একে বাংলাদেশের ওপর ভারতের সাম্রাজ্যবাদী হামলা ছাড়া অন্য কোনোভাবে আখ্যায়িত করা চলে না।

কিন্তু ভারত শুধু বিমানবন্দরে তাদের বিমানের নিরাপত্তার জন্যই নয়, তাদের দূতাবাসের নিরাপত্তার জন্যও সেখানে ভারতীয় সশস্ত্র আধাসামরিক বাহিনী মোতায়েন রাখার ব্যবস্থা করছে। এটাও এক ব্যতিক্রমী ব্যাপার। বহু দেশের দূতাবাসই ঢাকায় আছে, তাদের নিরাপত্তা বাংলাদেশের দায়িত্ব এবং সে দায়িত্ব বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনী পালন করে থাকে। কিন্তু তা সত্ত্বেও ভারত নিজেদের দূতাবাসের নিরাপত্তার জন্য নিজেদের সশস্ত্র সামরিক বাহিনী রাখার প্রস্তাব কী কারণে করতে পারে এবং বাংলাদেশ সরকার কী কারণে তাদের প্রস্তাবে সম্মত হয়_এটা স্বাভাবিক অবস্থায় কোনো বোধগম্য ব্যাপার নয়।

বাংলাদেশের প্রতি ভারতের এই আচরণ এবং এখানে সামরিক উপস্থিতির জন্য সরকারের ওপর চাপ প্রয়োগের ব্যাপারটি কোনো সুপ্রতিবেশীসুলভ ব্যাপার নয়। খুব স্পষ্টভাবেই এটা একধরনের সাম্রাজ্যবাদী আচরণ। এ ধরনের সাম্রাজ্যবাদী আচরণের অর্থ যে বাংলাদেশের ওপর নিজেদের কর্তৃত্ব স্থাপন, এতে কোনো সন্দেহ নেই। বাংলাদেশ সরকার যদি ভারতের এই চাপের কাছে নতিস্বীকার করে বিমানবন্দর, ভারতীয় দূতাবাস এবং তাদের অন্যান্য স্থাপনায় ভারতীয় সামরিক বাহিনীকে অবস্থান গ্রহণের অনুমতি দেয়, তাহলে সেটা হবে বাংলাদেশের জনগণের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা এবং দেশীয় স্বার্থ সম্পূর্ণ বিসর্জন দিয়ে ভারতের কাছে আত্দসমর্পণ। বাংলাদেশ সরকার যদি ভারতের এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান না করে ঢাকায় তাদের সামরিক উপস্থিতিতে সম্মত হয়, তাহলে তার খেসারত এ সরকারকে অবশ্যই দিতে হবে। জনস্বার্থ ও দেশীয় স্বার্থের প্রতি এই বেইমানির প্রতিশোধ জনগণ অবশ্যই নেবে।
[সূত্রঃ কালের কণ্ঠ, ২৭/০৫/১০]

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন