বৃহস্পতিবার, ১২ জানুয়ারী, ২০১২

নামকরণ পরিবর্তনের মহোত্সব দুর্নীতিরই দৃষ্টান্ত

বদরুদ্দীন উমর


বিভিন্ন রকম প্রতিষ্ঠান ও স্থাপনার নামকরণ নিজের পিতার নাম অনুযায়ী করার এক উদগ্র তাগিদ বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রীকে প্রায় দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য করে রেখেছে। তিনি শুধু নতুন নতুন প্রতিষ্ঠান ও স্থাপনার নাম নিজের পিতার নামে রেখেই ক্ষান্ত হচ্ছেন না। অনেক বিদ্যমান প্রতিষ্ঠান ও স্থাপনার নাম পর্যন্ত পরিবর্তন করে নিজের পিতার নাম সেখানে বসিয়ে দিচ্ছেন। এখানেই শেষ নয়, তিনি নিজের মাতা এবং ভাইদের নামেও এ ধরনের নামকরণ করছেন। এ কাজের মধ্যে রুচির দোষ যাই থাকুক, অন্যদিক দিয়ে বিচার করলে এটা এক ধরনের দুর্নীতিও বটে। কারণ শাসনক্ষমতার অধিকারী হয়ে বিভিন্ন সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের নাম এভাবে রাখার মধ্যে পারিবারিক গৌরব কীর্তন ছাড়া অন্য উদ্দেশ্য নেই। এই উদ্দেশ্য যে কোনো গৌরবজনক ব্যাপার নয়, এটা বলাই বাহুল্য। লক্ষণীয় ব্যাপার এই যে, তিনি শুধু নিজের পিতার নামে এভাবে নামকরণ করেই থেমে থাকছেন না। তার প্রতিহিংসাপরায়ণতা এমন যে, তিনি যাদেরকে তার রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করেন তাদের নামে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও স্থাপনার নাম পরিবর্তন করে যেখানে তার পিতার নামে মোটেই রাখা সম্ভব হচ্ছে না, সেখানে অন্য কারোর নামে তার নতুন নামকরণ করছেন। যেভাবে নাম পরিবর্তনের কাজ করা হচ্ছে তার থেকে মনে হতে পারে যে, ২০০৮ সালের ডিসেম্বরের নির্বাচনে জনগণ ভোটের কল্যাণে আওয়ামী লীগকে এ কাজ করার জন্য ম্যান্ডেট দিয়েছে। বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক প্রতিপক্ষরা ক্ষমতায় থেকে এই একই কাজ করলেও নাম পরিবর্তনের এই কুিসত ব্যাপার সবমাত্রা অতিক্রম করে কুরুচি ও অসভ্যতার এমন পরিচয় রাখছে, যা একটি দেশ ও জাতির জন্য কলঙ্কজনক।

ঢাকার আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নাম প্রথম থেকেই ছিল জিয়া আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। এই বিমানবন্দরের নাম পরিবর্তন করে এখন রাখা হয়েছে হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। একজন বড় মাপের পীর সাহেবের নামে এই নামকরণের কারণ এই ধারণা যে, পরে কেউ এই নাম পরিবর্তন করতে গেলে দেশের ধর্মপ্রাণ লোকদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লাগবে—এই ভয়ে কেউ আর সে চেষ্টা করবে না। এখানে প্রতিহিংসার হীন প্রকৃতি ছাড়াও ধর্মকে যেভাবে ব্যবহার করা হয়েছে তার মধ্যেও প্রশংসার কিছু নেই। এখানে বলা দরকার যে, মওলানা ভাসানীর নামও এভাবে মুছে ফেলা হচ্ছে। ঢাকার নভোথিয়েটারের নাম ভাসানী নভোথিয়েটারের পরিবর্তে রাখা হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর পিতার নামে।

বিদ্যমান আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নাম পরিবর্তন করতে গিয়ে যে বিশাল অংকের বৈদেশিক মুদ্রাসহ মোট অর্থ ব্যয় হয়েছে এটা বাংলাদেশের মতো একটি দেশের স্বার্থবিরোধী কাজ ছাড়া আর কী? শুধু নিজের ব্যক্তিগত প্রতিহিংসা চরিতার্থের জন্য দেশের মেহনতি জনগণের ঘাড়ে এই ব্যয়ভার চাপিয়ে দেয়ার কী এখতিয়ার আওয়ামী লীগের প্রধানমন্ত্রীর আছে? তিনি নিজের পিতার নামে আরও বিশাল এক আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর নির্মাণের পরিকল্পনা গ্রহণ করেছেন। কিন্তু তার জন্য বিদ্যমান আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরটির নাম পরিবর্তনের কী প্রয়োজন ছিল? প্রতিহিংসাপরায়ণতা ছাড়া এর আর কী ব্যাখ্যা থাকতে পারে? আমরা জিয়াউর রহমানের পক্ষপাতী নই, তার নামে কোনো কিছুর নামকরণ থাকুক বা না থাকুক তাতে আমাদের কিছু যায় আসে না। কিন্তু বিদ্যমান নাম পরিবর্তন করে দেশকে আর্থিক ক্ষতির মধ্যে নিক্ষেপ করার আমরা ঘোর বিরোধী।

বাংলাদেশে এখন দুর্নীতির প্রবল রাজত্ব। এই দুর্নীতি যে কত বিচিত্র পথগামী তার একটি দৃষ্টান্ত হিসেবেই নামকরণের বিষয়টি উল্লেখ করা হলো। দুর্নীতি বলতে সাধারণত অর্থনৈতিক দুর্নীতি অর্থাত্ চুরি, ঘুষ, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি ইত্যাদির কথা মনে হয়। কিন্তু দুর্নীতি আসলে হলো এক ধরনের অভ্যাসগত সংস্কৃতি। এই সংস্কৃতি মানুষের চেতনা থেকে নিয়ে কাজকর্মের পুরো জগেকই আচ্ছন্ন করে রাখে। কাজেই এর প্রতিফলন ঘটে সর্বত্র। মিথ্যা, প্রতারণা ইত্যাদি এই সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ।

বাংলাদেশে শাসকশ্রেণীর একের পর এক সরকার নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতাসীন হলেও দুুর্নীতির চর্চা তাদের মধ্যে প্রবল। এই দুর্নীতির সব থেকে উল্লিখিত দিক হলো তাদের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ। প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের এ বিষয়টি পূর্ব-নির্ধারিত। কারণ প্রতিশ্রুতির ফিরিস্তি তৈরি করার সময় তারা জানে যে, এসব প্রতিশ্রুতি তারা পূরণের জন্য দেয় না। এগুলো দেয়া হয় ভোটারদের প্রতারিত করার উদ্দেশ্যেই।

বাংলাদেশের বর্তমান সরকার ক্ষমতাসীন হওয়ার আগে ভোটারদের সামনে সাজানো-গোছানো এমনসব রঙিন প্রতিশ্রুতি হাজির করেছিল যার তুল্য আকর্ষণীয় প্রতিশ্রুতি অন্য কেউ, এমনকি তারা নিজেরাও এর আগে দেয়নি। একদিকে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার ও মইনউদ্দীন-ফখরুদ্দীন সরকারের সাত বছরের শোষণ-নির্যাতনে জর্জরিত হয়ে এবং অন্যদিকে আওয়ামী লীগ সরকারের ১৯৯৬-২০০১ সালের কীর্তিকলাপের কথা মনে না রেখে তাদের রঙিন প্রতিশ্রুতি দ্বারা বিভ্রান্ত হয়ে ভোটাররা আওয়ামী লীগকে বিগত নির্বাচনে বড় আকারে জিতিয়ে দিয়েছে। অন্যভাবে দেখলে বলা চলে যে, তাদের অন্য কিছু করারও থাকেনি। কারণ বিএনপিকে বাদ দিয়ে আওয়ামী লীগ ছাড়া তাদের সামনে কোনো বিকল্প ছিল না। বস্তুতপক্ষে বাংলাদেশের ভোটাররা যে নির্বাচনী কাঠামোর মধ্যে এখন বন্দি এবং যে শর্তে ওই নির্বাচন হয় তাতে বিএনপি এবং আওয়ামী লীগের মধ্যে একটিকে বাদ দিলে অন্যটি ছাড়া কোনো বিকল্প তাদের সামনে থাকে না। কাজেই প্রকৃতপক্ষে বিকল্পের অভাবেই ভোটাররা বিগত নির্বাচনে বাধ্য হয়ে আওয়ামী লীগকে ভোট দিয়ে জয়যুক্ত করেছে। নির্বাচনে জয়লাভ করে জাতীয় সংসদে বসে বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো জাতীয় সংসদের ঐতিহ্য রক্ষা করছে। প্রতিপক্ষকে কথাবার্তার প্রয়োজনীয় অধিকার থেকে বঞ্চিত রেখে সরকারদলীয় স্পিকার তার কর্তব্য পালন করে যাচ্ছেন। অন্যদিকে সরকারি ও বিরোধী দল দেশের গুরুত্বপূর্ণ সমস্যার পরিবর্তে দলীয় মতলববাজি এবং খিস্তিখেউর নিয়ে সংসদে বাক্যবিস্তার করে চলার ফলে কোনো গণতান্ত্রিক দায়িত্বই তাদের দ্বারা পালিত হয় না। এসবই হলো নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দুর্নীতির এক ধরন। এই দুর্নীতি তাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিরই অবিচ্ছেদ্য অংশ।

সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন লাভ করে ক্ষমতায় বসে আওয়ামী লীগ তাদের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি রক্ষা করছে, এমন কথা বলা যাবে না। নির্বাচনী প্রতিশ্রুতির ছিটেফোঁটা ছাড়া অন্য কিছু নিয়ে মাথা ঘামানোর সময় তাদের নেই। তারপরও তারা এমন সব কাজ করে যাচ্ছে যার সঙ্গে তাদের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতির কোনো সম্পর্ক নেই। দেশের জনগণের স্বার্থের কোনো সম্পর্ক নেই। অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক তার পিতা এবং অন্যান্য আত্মীয়স্বজনের নামে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও স্থাপনার নামকরণ এবং প্রতিহিংসার বশবর্তী হয়ে এসব থেকে অন্যদের নাম মুছে ফেলার যে ‘কর্মসূচি’ গ্রহণ করেছেন সেটা তাদের নানা ধরনের দুর্নীতিরই অন্যতম দৃষ্টান্ত।
[সূত্রঃ আমার দেশ, ১৩/০৫/১০]

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন