বৃহস্পতিবার, ১২ জানুয়ারী, ২০১২

বাংলাদেশের খনিজসম্পদ এবং লুণ্ঠনজীবীরা

বদরুদ্দীন উমর


মৌলভীবাজারের লাউয়াছড়া সংরক্ষিত বনাঞ্চলে গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য সরকার আমেরিকান তেল কোম্পানি শেভরনকে অনুমতি দেওয়ার বিরুদ্ধে অনেক প্রতিবাদ হয়েছিল। এর যুক্তিসম্মত কারণ এই ছিল যে, এ বনাঞ্চলে বহু ধরনের দুষ্প্রাপ্য প্রাণীর বাস। নানা জাতের পশুপাখি থেকে নিয়ে সরীসৃপের অস্তিত্বের জন্য এ বনাঞ্চলের জীববৈচিত্র্য সমৃদ্ধ। তেল কোম্পানি সেখানে ভারী ভারী যন্ত্রপাতি নিয়ে, আওয়াজ দিয়ে অনুসন্ধান কাজ চালিয়ে গেলে তার দ্বারা পরিবেশের ভারসাম্য বিনষ্ট হয়ে সেখানকার প্রাণিজগতের সমূহ ক্ষতির সম্ভাবনা। কিন্তু সরকার এ বিষয়ে ভ্রুক্ষেপ না করে শেভরনকে গ্যাস অনুসন্ধানের অনুমতি দিয়েছিল। ফলে লাউয়াছড়ার জীবজন্তু, পাখি, সরীসৃপ কীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল, কীভাবে তাদের অনেকে লোকালয়ে বের হয়ে দুর্বৃত্ত প্রকৃতির লোকজনের হাতে নিধন হয়েছিল তার অনেক রিপোর্ট সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছিল। এখন এদিক দিয়ে পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। বর্তমান সরকার আমেরিকান সাম্রাজ্যবাদী তেল কোম্পানি শেভরনকে লাউয়াছড়ায় গ্যাস উত্তোলনের চূড়ান্ত অনুমোদন প্রদান করেছে। বিস্ময়ের ব্যাপার, এ নিয়ে দেশে কোনো প্রতিবাদ নেই। একমাত্র জাতীয় মুক্তি কাউন্সিল ছাড়া এর বিরুদ্ধে কেউ মিছিল-সমাবেশ করেনি, বিবৃতিও দেয়নি। ৭ মে এই একমাত্র প্রতিবাদের শুধু ছবি ইংরেজি 'নিউ এজ' পত্রিকায় ৮ মে তারিখে প্রকাশিত হওয়া ছাড়া অন্য কোথাও এর রিপোর্ট প্রকাশিত হয়নি। 'জাতীয় তেল-গ্যাস, বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা কমিটি' চলমান বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সংকট নিরসনে তাদের সাত দফা দাবি বাস্তবায়নের জন্য ৯ মে ঢাকার পল্টন থেকে জাতীয় প্রেসক্লাব পর্যন্ত কয়েক মিনিটের এক পদযাত্রা করলেও তার মধ্যে লাউয়াছড়ায় শেভরনকে গ্যাস উত্তোলনের অনুমতি প্রদানের বিরুদ্ধে কোনো প্রতিবাদ দেখা যায়নি (কালের কণ্ঠ, ১০-৫-১০)। অথচ এই অনুমতির ফলে শেভরন যে লাউয়াছড়া সংরক্ষিত বনাঞ্চল ও সে সঙ্গে সেখানকার জীববৈচিত্র্য ধ্বংস করবে_ এ নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। এসব যে ওপরতলার সরকারি কর্তৃপক্ষকে সন্তুষ্ট করেই হচ্ছে এতেও বাংলাদেশের বিদ্যমান পরিস্থিতিতে সন্দেহের লেশমাত্র কারণ নেই।

আমেরিকান শেভরন কোম্পানি যে সরকারের কত পেয়ারের জিনিস তার ওপর ৮ মে দৈনিক যুগান্তরে একটি বড় রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে। রিপোর্টটির একটি অংশ এখানে উদ্ধৃত করলে আলোচনার সুবিধা হবে। এতে বলা হয়, 'আন্তর্জাতিক তেল কোম্পানি (আইওসি) শেভরনের বাংলাদেশ অফিসে ৮২ জন বিদেশিকে বছরে ১৮৫ কোটি টাকা বেতনভাতা দেওয়া হয়। অথচ ৮৮০ জন স্থানীয় স্টাফ বছরে পান মাত্র ৮৬ কোটি টাকা। প্রতি বছর শেভরন তিনটি গ্যাস ক্ষেত্রের পরিচালনা বাবদ সরকারের কাছ থেকে এ অর্থ আদায় করে। উৎপাদন-বণ্টন চুক্তির (পিএসসি) ফাঁকফোকরে শেভরন সরকারকে কোনো আয়কর শুল্কও দেয় না। স্থানীয় ও বিদেশিদের মধ্যে বিশাল বেতন বৈষম্য, অপ্রয়োজনীয় বিদেশি নিয়োগসহ নানা অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে শেভরনের বিরুদ্ধে। দেশীয় প্রকৌশলী বা বিশেষজ্ঞ থাকা সত্ত্বেও সেই পদে বিদেশি নিয়োগ এবং একই পদে নানা উপাধিতে একাধিক বিদেশির নিয়োগ নিয়ে পেট্রোবাংলা বারবার আপত্তি দিয়েছে। কিন্তু মার্কিন এ কোম্পানির স্বেচ্ছাচার কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে রহস্যজনকভাবে সরকার কোনো ব্যবস্থা নেয় না। অভিযোগ রয়েছে, পেট্রোবাংলা এবং জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের কয়েক পদস্থ কর্মকর্তাকে খুশি করে শেভরন তাদের বাজেট অনুমোদন করে নিচ্ছে।' এতে আরও বলা হচ্ছে, 'জালালাবাদ, মৌলভীবাজার এবং বিবিয়ানায় সরকারের লাভের গ্যাস সরকার কিনে তাদের এ পরিচালনা ব্যয় পরিশোধ করে।'

এ হলো লাভের গুড় পিঁপড়ায় খাওয়ার মতো ব্যাপার। রিপোর্টটিতে এ বিষয়ে আরও অনেক বিস্তারিত বিবরণ আছে, যার উল্লেখ এখানে নিষ্প্রয়োজন। ওপরের রিপোর্টে যা বলা হয়েছে তার থেকেই বেশ ভালোভাবে বোঝা যায়, আমাদের দেশের 'দেশপ্রেমিক' সরকার সাম্রাজ্যবাদের হাতে দেশের সম্পদ কীভাবে তুলে দিচ্ছে; জ্বালানি মন্ত্রণালয়ে ক্ষমতাসীন দলের শীর্ষস্থানীয় যারা বসে আছেন তারা পেট্রোবাংলাসহ বিভিন্ন সরকারি সংস্থার মাধ্যমে দেশের খনিজসম্পদ কীভাবে সাম্রাজ্যবাদী কোম্পানিকে লুটপাট করতে দিয়ে সেই লুটের একটা বখরা নিজেদের পকেটে ফেলে অর্থ-সম্পদের মালিক হচ্ছেন।

যে সাম্রাজ্যবাদী বিদেশি কোম্পানিগুলো বাংলাদেশের বিভিন্ন খনিজসম্পদের ওপর লোলুপ দৃষ্টি রেখেছে এবং বাস্তবত উত্তোলনের কাজে নিযুক্ত আছে, তাদের মধ্যে মার্কিন কোম্পানি শেভরনই সব থেকে শক্তিশালী এবং বাংলাদেশ সরকারের সব থেকে আদরের। এটা হওয়ারই কথা, কারণ এর সঙ্গে সাবেক মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট ডিক চেনির ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। উপরোক্ত গ্যাস ক্ষেত্রগুলো অন্যান্য মার্কিন কোম্পানির হাত থেকে এখন শেভরনের হাতে এসেছে এবং এরাই এখন বাংলাদেশে গ্যাসের সামগ্রিক কারবারে সর্বোচ্চ স্বেচ্ছাচারিতার দৃষ্টান্ত রাখছে।

বাংলাদেশে গ্যাস ও কয়লার সন্ধান পাওয়ার পর থেকে সাম্রাজ্যবাদী বিদেশি কোম্পানির কাছে যে কোনো শর্তে এসব উত্তোলনের কাজ দেওয়ার জন্য শাসকশ্রেণীর দালাল মুৎসুদ্দিরা এই যুক্তি দেখায়, মাটির তলায় এসব ফেলে রাখা অর্থহীন। কাজেই এগুলো যথাশিগগির তুলে ফেলে যা পাওয়া যায় তাই সংগ্রহ করা দরকার! এর থেকে মূঢ় এবং সে সঙ্গে দুর্নীতিবাজ বক্তব্য আর কী হতে পারে? মাটির তলায় খনিজসম্পদ থাকা মানে চিরতরে পড়ে থাকা নয়। সেটা অবশ্যই তোলা দরকার। কিন্তু কখন ও কী শর্তে সেটা তোলা যাবে এ বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তেল-গ্যাসের যে মজুদ আছে তার একটি বড় অংশ তারা নিজেরা না তুলে মাটির নিচেই রেখে দিয়েছে প্রয়োজন অনুযায়ী, বিশেষত আপৎকালে, জরুরি অবস্থায় ব্যবহারের জন্য। নিজেদের তেল-গ্যাস এভাবে মাটির নিচে রেখে তারা মরিয়া হয়ে বিশ্বজুড়ে তেল-গ্যাস লুণ্ঠনের জন্য যুদ্ধ পর্যন্ত করছে। আর আমাদের দেশের দুর্নীতিবাজ ও দেশীয় স্বার্থবিরোধী শাসকচক্র দেশের সম্পদ চরম ক্ষতিকর শর্তে ও হীন স্বার্থে বিদেশি সাম্রাজ্যবাদী কোম্পানিগুলোর হাতে তুলে দিচ্ছে।

এশিয়া এনার্জি নামে যে ব্রিটিশ কোম্পানিকে তারা ফুলবাড়ীর কয়লা উত্তোলনের ইজারা দিতে চেয়েছিল এবং এখনও তার জন্য নতুনভাবে চক্রান্ত ও পাঁয়তারা করছে, সেখানে ফুলবাড়ীর কয়লার মাত্র ৬ শতাংশ ছিল বাংলাদেশ সরকারের প্রাপ্য। বাকি ৯৪ শতাংশ পাওনা হতো এশিয়া এনার্জির। অর্থাৎ এর অর্থ হলো আমাদের দেশের মাটির তলায় আমাদের সম্পদ ফেলে না রেখে এগুলো যত তাড়াতাড়ি সম্ভব যে কোনো শর্তে সাম্রাজ্যবাদীদের হাতে তুলে দেওয়া, তাদের দ্বারা লুণ্ঠিত হতে দেওয়াই হলো দেশপ্রেমমূলক কর্তব্য!! এই হলো বাংলাদেশের শাসকশ্রেণীর চরিত্র। সাম্রাজ্যবাদী লুণ্ঠনজীবীদের (ঢ়ৎবফধঃড়ৎ) সেবাদাস হিসেবে এখানকার লুণ্ঠনজীবীদের অধীনতার সম্পর্কের মাধ্যমেই দেশীয় সম্পদ এভাবে বিদেশিদের কাছে পাচার হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে যারা দুর্নীতি করছে তারা শাসকশ্রেণী ও সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ের লোক। তারা বিদেশিদের সঙ্গে এই সম্পর্কের মাধ্যমে বিদেশে নিজেদের লুণ্ঠনের বখরা পাচার করছে। তারা এতই ধূর্ত যে, দেশের সাধারণ আইন-কানুন দিয়ে এদের দুর্নীতি ও দেশীয় স্বার্থবিরোধী কাজের জন্য শাস্তি দেওয়ার উপায় নেই।
(সুত্র, সমকাল, ১১/০৫/২০১০)

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন