বৃহস্পতিবার, ১২ জানুয়ারী, ২০১২

দুর্বৃত্ত ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্র ইসরায়েলের নতুন হামলা

বদরুদ্দীন উমর


ইসরায়েল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেরই সমতুল্য একটি দুর্বৃত্ত রাষ্ট্র (rogue state), যদিও তার আকার তুলনায় অনেক ছোট। ১৯৪৮ সালে জন্মের পর থেকেই এই রাষ্ট্রটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, ফ্রান্সসহ পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদীদের ছত্রচ্ছায়ায় থেকে মধ্যপ্রাচ্যে অনেক ধরনের দুর্বৃত্তমূলক কর্মকাণ্ড করে এসেছে, কিন্তু তার জন্য আজ পর্যন্ত তারা সংশ্লিষ্ট কারো কাছে কোনো জবাবদিহিতা করেনি। তার প্রয়োজনও তারা বোধ করেনি। কারণ সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রগুলো, বিশেষত পরবর্তী সময়ে বিগত ৬০ বছর ধরে আমেরিকা তাকে চরম দায়িত্বহীনভাবে সব দুর্বৃত্তগিরি থেকে দায়মুক্ত রেখে আশ্রয় দিয়ে এসেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এখনো নাকি প্রবল পরাক্রান্ত শক্তি হলেও তার অবস্থা আর আগের মতো নেই। এ কারণে বাধ্য হয়ে তাকে ইসরায়েলের চরম বেপরোয়া কার্যকলাপের ভণ্ডামিপূর্ণ সমালোচনা মাঝেমধ্যে করতে হলেও তাদের পারস্পরিক সম্পর্কের মধ্যে কোনো পরিবর্তন এখনো হয়নি। এবং দুর্বৃত্ত রাষ্ট্র হিসেবে ইসরায়েল তাদের যেকোনো সময়ের মতোই কাজ করছে, এমনকি গোত্র বিশেষে তার এই দুর্বৃত্তগিরি সব মাত্রা অতিক্রম করছে। সম্প্রতি গাজায় যা ঘটেছে এটা হলো তার রাষ্ট্রীয় দুর্বৃত্তগিরির সাম্প্রতিকতম দৃষ্টান্ত।

২০০৯ সালের প্রথম দিকে ইসরায়েল গাজা আক্রমণ করে তিন সপ্তাহ ধরে প্রায় একতরফা সেখানে ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে ছিল। এর ফলে শত শত গাজাবাসী নারী, শিশু, বৃদ্ধ হতাহত হয়েছিলেন এবং বাড়িঘর ব্যাপক আকারে ধ্বংস হয়ে অর্থনৈতিক বিপর্যয় ঘটিয়েছিল।

২০০৭ সাল থেকে ইসরায়েল হামাস নিয়ন্ত্রিত গাজায় অবরোধ আরোপ করার পর থেকে সেখানকার রাজনৈতিক অবস্থা বিপর্যস্ত। পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদীদের বশীভূত আরব রাষ্ট্রগুলোর নিয়ন্ত্রণাধীন আরব লীগ এবং বিশেষ করে মিসর এ অবস্থায় গাজাবাসীকে সাহায্য করার পরিবর্তে নানা ধরনের প্রতিবন্ধকতাই সৃষ্টি করে এসেছে। তার মধ্যে একটি দিক রাফায় গাজার সঙ্গে তাদের সীমান্ত বন্ধ করে রাখা।

ইসরায়েল গাজায় তিন বছর ধরে অবরোধ সৃষ্টি করে রেখে সেখানকার অর্থনীতি ও জীবনযাত্রায় নিদারুণ সংকট সৃষ্টি করেছে। এই সংকটজনক সময়ে গাজায় ত্রাণ সাহায্যের জন্য 'ফ্রি গাজা মুভমেন্ট'-এর উদ্যোগে ছয়টি ত্রাণবাহী জাহাজের একটি আন্তর্জাতিক বহর ১০ হাজার টন খাদ্যসামগ্রী নিয়ে সাইপ্রাসের উপকূলীয় সাগর থেকে যাত্রা করে বিগত ৩০ মে। এই জাহাজ বহরে ছিল মার্কিন, ইতালি, সুইডেন, আয়ারল্যান্ড, গ্রিস ও তুরস্কের একটি করে জাহাজ। জাহাজের এই বহরটি আন্তর্জাতিক জলসীমায় থাকার সময়ই ৩১ মে সকালে কোনো উসকানি ছাড়াই ইসরায়েলি কমান্ডো বাহিনীর সদস্যরা হেলিকপ্টার থেকে জাহাজে অবতরণ করে নির্বিচারে গুলি চালিয়ে ত্রাণকর্মীদের ১৯ জনকে হত্যা এবং আরো অনেক বেশিসংখ্যককে আহত করেছে। এই ছয়টি জাহাজে বিশ্বের কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তিসহ ৭০০ যাত্রী ছিলেন। এই জাহাজ বহরের যাত্রার খবর শুনে ইসরায়েল ঘোষণা করেছিল যে তারা জাহাজগুলোকে গাজায় যেতে দেবে না। কিন্তু তারা যে আন্তর্জাতিক জলসীমায় তাদের ওপর এভাবে অতর্কিত ও মারাত্দক সামরিক হামলা চালাবে_এটা কেউ চিন্তা করেনি। এই আক্রমণে যাঁরা হতাহত হয়েছেন তাঁদের ১৯ জনের একজন তুরস্কের নাগরিক। ইসরায়েলি কমান্ডোরা তুরস্কের মাভি মারমারা নামক যাত্রীবাহী জাহাজটিতে হেলিকপ্টার থেকে নেমে বেপরোয়াভাবে গুলি চালিয়ে এ হত্যাকাণ্ড চালায়।

ইতালি এ ঘটনার নিন্দা করেছে এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন এ ঘটনার সরকারি তদন্তের নির্দেশ দিয়েছে। কিন্তু এ ঘটনায় সব থেকে তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে তুরস্ক। তারা এ ব্যাপারে জাতিসংঘের জরুরি বৈঠক আহ্বানের কথা জানিয়েছে। তা ছাড়া তারা ঘোষণা করেছে যে ইসরায়েল যদি এ ঘটনার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা না করে, তাহলে তারা ইসরায়েলের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করবে। তাদের সঙ্গে আপাতত সব রকম বাণিজ্য ও সামরিক সম্পর্ক শিথিল করার ঘোষণা তারা প্রদান করছে। প্রসঙ্গত, উল্লেখযোগ্য যে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর মধ্যে তুর্কির সঙ্গেই ইসরায়েলের প্রথম কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপিত হয় এবং এ সম্পর্ক দীর্ঘদিন আছে; যদিও গত বছর গাজায় ইসরায়েলের সামরিক হামলার পর প্রথমবারের মতো এ সম্পর্ক কিছুটা খারাপ হয়। মার্কিন তল্পিবাহক রাষ্ট্র মিসর তিন বছর ধরে গাজার সঙ্গে দুশমনি করে রাফা সীমান্ত বন্ধ রেখেছিল, কিন্তু ৩১ মের ঘটনার পর তারা এখন তা উন্মুক্ত করেছে।

৩১ মের ঘটনা ইসরায়েল ও তুরস্কের সম্পর্কের ক্ষেত্রে সংকট সৃষ্টি করেছে। মধ্যপ্রাচ্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিকটতম মিত্র হিসেবে তাদের উভয়ের সম্পর্ক দীর্ঘদিন অটুট থাকলেও এখন এ সম্পর্কের নিদারুণ অবনতি হয়েছে। জাতিসংঘের সেক্রেটারি জেনারেল বান কি মুন এ ঘটনার তদন্তের প্রস্তাব করেছেন। তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আহমেত দাভুতোগসু বলেছেন যে ইসরায়েলকে এই তদন্তে সম্মত হতে হবে। অন্যথায় বুঝতে হবে যে এ বিষয়ে তাদের গোপন করার মতো ব্যাপার আছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ইসরায়েলের রাষ্ট্রদূত বলেছেন, তাঁরা তদন্তের এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। তুরস্কের প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করেছেন, 'যারা গাজার জনগণকে খোলা আকাশের বন্দিশালায় জীবন যাপন করতে বাধ্য করছে, আমরা তার বিরোধী। গাজার বিরুদ্ধে অবরোধ উঠিয়ে না নেওয়া পর্যন্ত এ ব্যাপারে আমাদের অবস্থান খুব দৃঢ়।' তুরস্কের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে যে ইসরায়েলকে তার কাজের ফলাফল স্বীকার করতে এবং এর জন্য জবাবদিহিতা করতে হবে। তারা সব কিছুর মূল্যায়ন করছে এবং দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক আগের মতো অব্যাহত থাকবে কি না সেটা নির্ভর করবে ইসরায়েলের ওপর। তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আরো বলেন, তুরস্ক-ইসরায়েল সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণ সম্ভব নয়, যতক্ষণ পর্যন্ত না ইসরায়েল আন্তর্জাতিক আইন মান্য করে চলতে সম্মত হয়। একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনে এই চিত্র দেখার সময় পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা এ ব্যাপারে তুরস্কের সঙ্গে একাত্দতা ঘোষণা করেন। (Daily Star 8.6.2010) ইসরায়েল যে একটি দুর্বৃত্ত রাষ্ট্র এটা নতুন কথা নয়। কিন্তু তারা কত বড় দুর্বৃত্ত এর নতুন প্রমাণ এখন পাওয়া গেল বর্ণবাদী দক্ষিণ আফ্রিকার সঙ্গে তাদের গোপন পারমাণবিক সম্পর্ক ও লেনদেনের তথ্য প্রকাশিত হওয়ার পর। সব থেকে শক্তিশালী দুবর্ৃৃত্ত রাষ্ট্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তুরস্ক, কোরিয়া, ইরান, ইতালির পারমাণবিক কর্মসূচির বিরোধিতা করে, তাকে বিশ্বশান্তির জন্য হুমকি বলে অ্যাখ্যায়িত করে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধংদেহী ভাব ধারণ করে প্রায় প্রতিদিনই উসকানিমূলক কথাবার্তা বলছে ও হুংকার ছাড়ছে। কিন্তু তাদের প্রবল সহায়তায় মধ্যপ্রাচ্যে দীর্ঘদিন আগে ইসরায়েল পারমাণবিক বোমা তৈরি করে ইতিমধ্যেই শত শত বোমার মালিক হলেও সেখানে কোনো আন্তর্জাতিক পারমাণবিক তদন্ত কমিশন আজও যায়নি এবং তারা যে পারমাণবিক বোমার মালিক_এ কথা তারা স্বীকার করেনি। যদিও তাদের হাতে পারমাণবিক বোমা থাকার কথা সবারই জানা, এ বিষয়ে কারো কোনো সন্দেহ নেই।

সাশা পুলাকউ-সুরানস্কি নামক এক আমেরিকান টিভি গবেষকের `The unspoken Aliance : Israils secret Relationship with Apartheid South Africa` নামক একটি বই সদ্য প্রকাশিত হয়েছে। এই বইটির ওপর ভারতীয় সাংবাদিক প্রফুল বিদাই Daily Star-এ `Secret No More` নামক এক প্রবন্ধে (৬.৬.২০১০) বিস্তারিতভাবে বলেছেন, দক্ষিণ আফ্রিকায় বর্ণবাদ উচ্ছেদের আগে সেখানকার শ্বেতাঙ্গ শাসকদের সঙ্গে ইসরায়েলের পারমাণবিক লেনদেন ছিল এবং তারা দক্ষিণ আফ্রিকাকে পারমাণবিক বোমা তৈরির জন্য সব রকম প্রযুক্তিতিগত সহায়তা করেছিল। ইসরায়েলের নিজের ইউরেনিয়াম ঘাটতি ছিল, যা দক্ষিণ আফ্রিকা পূরণ করেছিল। এ ছাড়া এ ক্ষেত্রে দুই বর্ণবাদী ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রের মধ্যে অনেক ধরনের লেনদেন হয়েছিল, যার বিবরণ বইটির মধ্যে আছে। এর থেকেই প্রমাণিত হয়, ইসরায়েল ও দক্ষিণ আফ্রিকা উভয়েই আন্তর্জাতিকভাবে শাস্তিযোগ্য। দক্ষিণ আফ্রিকায় শ্বেতাঙ্গদের হাত থেকে ক্ষমতা চলে যাওয়ার ঠিক আগে অন্যদের হাতে যাতে পারমাণবিক বোমা না পড়ে এ জন্য তারা যে কয়টি বোমা তৈরি করেছিল সেগুলোর সবই নষ্ট করে দেয়। কিন্তু ইসরায়েল এখন ৩০০ বোমার মালিক! মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এ ব্যাপারে পরিপূর্ণভাবে অবহিত থাকায় এবং এই ক্রাইমের সঙ্গে জড়িত থাকায় তাদের দুর্বৃত্ত চরিত্রও এর মাধ্যমে নতুনভাবে প্রমাণিত হলো।
গাজার সব ঘটনা আলোচনা করতে গিয়ে প্রসঙ্গত ইসরায়েলের পারমাণবিক বোমার কথা উল্লেখ করা হলো তাদের ক্রিমিনাল চরিত্র কত গভীর ও বিপজ্জনক এটা আরো ভালোভাবে বোঝার জন্য। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তাদের ইউরোপিয়ান মিত্ররা ইসরায়েলকে ১৯৪৮ সাল থেকে মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে ব্যবহার করে নিজেদের সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থ নানাভাবে উদ্ধার করে এসেছে। কিন্তু এই দুর্বৃত্ত রাষ্ট্র এখন এমন পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে, যাতে খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকেও অদূর ভবিষ্যতে এর জন্য ভালো খেসারত দিতে হবে। কিন্তু যে পর্যন্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রবল প্রভাবশালী সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্র হিসেবে ক্রিয়াশীল থাকবে, সে পর্যন্ত তার জোরেই ইসরায়েল তার সব রকম দুর্বৃত্তমূলক কার্যকলাপ মধ্যপ্রাচ্য ও সেই সঙ্গে বিশ্বের বিভিন্ন ক্ষেত্রে চালিয়ে যাবে। এ কারণে তাদের কার্যকলাপকে সাধারণভাবে সাম্রাজ্যবাদের বিশ্বব্যবস্থা থেকে আলাদা করে দেখার উপায় নেই। ইসরায়েলের উৎখাত ও প্যালেস্টাইনের জনগণের মুক্তি বিশ্ব পরিসরে সাম্রাজ্যবাদের ধসের সঙ্গে একসূত্রেই গাঁথা।
[সূত্রঃ কালের কণ্ঠ, ১০/০৬/১০]

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন