বৃহস্পতিবার, ১২ জানুয়ারী, ২০১২

পাবনায় ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের চরিত্র যাচাইয়ের জন্য রক্ত পরীক্ষার কর্মসূচি

বদরুদ্দীন উমর


ফুলের মতো চরিত্রসম্পন্ন ছাত্র ছাড়া অন্য কেউ যাতে ছাত্রলীগের নেতৃত্বে না আসতে পারে তার জন্য ছাত্রলীগের জেলা ও নিম্নপর্যায়ের কমিটি নির্বাচনের আগে পাবনাবাসী স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী তার জেলা সদর পাবনা শহরের নির্বাচন পদপ্রার্থী ছাত্রলীগের কর্মীদের রক্ত পরীক্ষার ব্যবস্থা করেছেন। পত্রিকার রিপোর্টে দেখা গেল প্রতিমন্ত্রীর এই শুদ্ধি কর্মসূচিকে অভিনন্দন জানিয়ে স্থানীয় রাজনৈতিক নেতারা উল্লাস প্রকাশ করেছেন (উধরষু ঝঃধত্ ২১.৪.১০)। বর্তমানে ছাত্রলীগের দুর্বৃত্ত নেতা ও নেতৃস্থানীয় কর্মীদের নির্যাতনে ও খুন-খারাবিতে অতিষ্ঠ লোকজন ভবিষ্যতে এদের হাত থেকে পরিত্রাণ পাবেন, এই চিন্তা থেকে যদি আওয়ামী মন্ত্রীর এ কর্মসূচিকে অভিনন্দন জানিয়ে তারা কেউ কেউ উল্লাস প্রকাশ করেন তাতে তাদের দোষ দেয়া যায় না। কিন্তু ভালো একটা কিছু হবে এ চিন্তা এবং কোনো কাজের দ্বারা সত্যি সত্যি ভালো কিছু হওয়া এক জিনিস নয়। কাজেই আওয়ামী মন্ত্রীর এই শুদ্ধি অভিযান নিয়ে উল্লসিত হওয়ার কারণ আছে কিনা সেটা দেখা দরকার।

নির্বাচন পদপ্রার্থীদের মধ্যে কোনো মাদকাসক্ত যাতে না থাকে এ কারণেই নাকি মন্ত্রী এই শুদ্ধি অভিযান চালিয়েছেন। মনে হয় তার ধারণা, একমাত্র মাদকাসক্তরাই অপরাধ করে। এ ধারণার যে কোনো ভিত্তি নেই, এটা বলাই বাহুল্য। অপরাধী হলেই যে মাদকাসক্ত হতে হবে, এমন কোনো কথা নেই। তার পরও দেখা যাবে যে যারা আসল অপরাধী, তাদের মধ্যে কিন্তু অধিকাংশই মাদকাসক্ত নয়। তা ছাড়া অপরাধ যে শুধু ছাত্ররাই করে, তা নয়। ছাত্রদের যারা রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করে নিজেদের ব্যক্তিগত ও পারিবারিক স্বার্থ হাসিল করে তাদের মধ্যেই অপরাধীর অভাব নেই। শুধু তাই নয়, সাধারণভাবে অপরাধীরাই রাজনীতির এই ব্যবস্থা করে থাকে। এর জন্য তাদের মাদকাসক্ত হওয়ার প্রয়োজন হয় না।

আওয়ামী লীগের মন্ত্রী মহোদয় এবং অন্য নেতারাও যে এটা জানেন না, এমন নয়। এটা খুব সাধারণ ব্যাপার। কাজেই জেনেশুনে খুব উদ্দেশ্যমূলকভাবেই ছাত্রলীগকে পুতপবিত্র হিসেবে উপস্থিত করার জন্যই যে এই তথাকথিত শুদ্ধি অভিযান শুরু করা হয়েছে, এতে সন্দেহ নেই। আওয়ামী লীগকে দোষ দেওয়া যায় না, কারণ তাদের অঙ্গ সংগঠন ছাত্রলীগের দুর্নীতি ও সন্ত্রাস এখন এমনভাবে ছড়িয়ে গেছে, শুধু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ক্যাম্পাস নয়, তার বাইরেও এত ব্যাপকভাবে বিস্তার লাভ করে দেশজুড়ে এক আতঙ্কের রাজত্ব কায়েম করেছে, যাতে তাদের ভাবমূর্তি পরিবর্তনের প্রয়োজন আওয়ামী লীগের জন্য জরুরি হয়েছে। কিন্তু এ প্রয়োজন জরুরি হওয়া সত্ত্বেও ছাত্রলীগের ওপর আওয়ামী লীগের নেতানেত্রীদের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। না থাকারই কথা। কারণ ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা তাদের মূল রাজনৈতিক দলের নেতানেত্রীর চরিত্রও ভালোভাবে জানে, তাদের দুর্নীতিবাজ ও অপরাধী চরিত্র এখন শুধু তারাই নন, দেশের জনগণও ভালোভাবেই জানেন। কাজেই যারা নিজেরা দুর্নীতিবাজ, সন্ত্রাসীদের গডফাদার অথবা খোদ সন্ত্রাসী, তাদের আদেশ, নির্দেশ হিতোপদেশ শুনে যে তারা নিজেদের পকেট ভর্তির জন্য চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, গাড়িবাড়িতে অগ্নিসংযোগ, খুন খারাবি ইত্যাদি বাদ দেবে, এটা বর্তমান পর্যায়ে সম্ভবই নয়, এমনকি এ চিন্তাও এক অসম্ভব ব্যাপার।

মিথ্যা প্রতিশ্রুতি, ধাপ্পাবাজি, প্রতারণা ইত্যাদি ব্যাপারে শাসকশ্রেণীর বিভিন্ন দলের নেতানেত্রীরা যে কত সিদ্ধহস্ত, এটা জনগণ জানেন। তা সত্ত্বেও নিজেদের ভাবমূর্তি উন্নত করার জন্য তাদের মিথ্যা প্রতিশ্রুতি ও প্রতারণামূলক কাজের শেষ নেই। ছাত্রলীগের মধ্যে মাদকাসক্তদের নেতৃত্ব থেকে বাইরে রাখার জন্য তাদের রক্ত পরীক্ষার যে মহড়া মন্ত্রী মহোদয়ের পৌরহিত্যে পাবনায় হচ্ছে, এটা তারই এক দৃষ্টান্ত।

একদিকে এ দৃষ্টান্তের সংবাদ যখন আজকের পত্রিকায় ছাপা হয়েছে তখন একই দিনে (২১.৪.২০১০) ছাপা হয়েছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের দ্বারা শিক্ষকদের বাসে আগুন দিয়ে তাকে ভস্মীভূত করার সংবাদ। চট্টগ্রামে এই ছাত্রলীগ কর্মীরা যে মাদকাসক্ত হওয়ার কারণে এ কাজ করেছে এটা ভাবা এক মূঢ়তা এবং এ কথা বলার চেষ্টা প্রতারণা ছাড়া কিছু নয়। যারা এ ধরনের অপরাধমূলক কাজ করছে তারা মাদক আসক্ত হয়ে নয়, বেশ ঠাণ্ডা মাথাতেই অপরাধের জন্য গরম হয়ে এ কাজ করছে। এই সত্য উপলব্ধি যাদের মধ্যে নেই তারা কাণ্ডজ্ঞানশূন্য। এ দেশের বর্তমান বাস্তবতার সঙ্গেও তাদের পরিচয় নেই।

আওয়ামী লীগের নেতানেত্রীরা এখন তাদের ছাত্র নেতাদের উদ্দেশে প্রায়ই বলেন, তারা কোনো খারাপ কাজের সঙ্গে জড়িত থাকুক এটা তারা দেখতে চান না। এই শুভ প্রত্যাশার ঘোষণা দ্বারা যে কোনো কাজ হয় না, এটা এখন বাংলাদেশে কাউকে বুঝিয়ে বলার প্রয়োজন হয় না। তারা জানেন যে এসব কথাবার্তা আওয়ামী নেত্রানেত্রীদের মামুলি ও পরিচিত ভাওতাপূর্ণ কথা ছাড়া আর কিছুই নয়। তারা আরও জানেন যে, সরকারি ক্ষমতার বলে বলিয়ান হয়েই ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা পুলিশের ছত্রছায়াতে থেকেই এসব দুর্বৃত্তমূলক কাজ করছে।

আওয়ামী লীগের মন্ত্রী পাবনায় ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের মাদকাসক্তি পরীক্ষার জন্য তাদের রক্ত পরীক্ষার ব্যবস্থা করেছেন। কিন্তু বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আশার পর শুধু কি ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরাই দুর্নীতি ও সন্ত্রাস করছে? আওয়ামী লীগের শীর্ষতম-পর্যায়ের নেতানেত্রী থেকে নিয়ে নিম্নতর স্তরের নেতানেত্রীরা কি ধোয়া তুলসী পাতা? সেটা যে নয়, এই সত্য কার না জানা? তাহলে পাবনার ছাত্রলীগ কর্মীদের রক্ত পরীক্ষার পর কি পাবনা জেলার আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের রক্ত পরীক্ষা হবে, না তাদের পুতপবিত্র ধরে নিয়েই রেয়াত দেওয়া হবে এই পরীক্ষা থেকে? শুধু পাবনা কেন, তাদের দলের শীর্ষতম নেতৃত্বকেও কি এর বাইরে রাখা হবে? অপরাধের সঙ্গে মাদকাসক্তির যোগ স্থাপন করে যারা অপরাধীদের দলের বাইরে রাখার কর্মসূচি ঘোষণা করেছেন তাদের সে কর্মসূচি কি সারা দেশে ছাত্রলীগের বিভিন্ন শাখায় চালু করার দরকার নেই? আওয়ামী লীগের অন্যান্য অঙ্গসংগঠন যুবলীগ, মহিলা লীগ, তরুণ লীগ ইত্যাদির নেতৃত্বও যাতে মাদকাসক্তদের হাতে না যায় তার জন্য কি এসব সংগঠনের মধ্যেও রক্ত পরীক্ষা চালু হবে?

এসব প্রশ্ন খুব স্বাভাবিক। এসব প্রশ্নের মাধ্যমেই এ ধরনের কোনো কর্মসূচির আসল লক্ষ্য-উদ্দেশ্য ও চরিত্র নির্ধারণ সম্ভব। এ প্রসঙ্গে এখানে উল্লেখ করা দরকার যে, আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব এখন মাদকাসক্ত নয়। তারা হলো ক্ষমতা মদমত্ত। মাদকাসক্তি প্রমাণ করা রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে যেভাবে সম্ভব ক্ষমতার মদমত্ততা প্রমাণ, সেভাবে কোনো শারীরিক পরীক্ষার দ্বারা সম্ভব নয়। তার অন্য উপায় আছে এবং জনগণ সে উপায়ে এ পরীক্ষা নিজেদের মতো করে করছেন। তারা জানেন যে, ক্ষমতার মদমত্ততার সঙ্গে মাদকাসক্তির কোনো সম্পর্ক নেই। এর সঙ্গে সম্পর্ক চরিত্রের, অভ্যাসের, দুর্নীতি ও সন্ত্রাস-প্রবণতার। কাজেই আওয়ামী লীগ বা শাসক শ্রেণীর অন্য কোনো দলের নেতানেত্রীদের ক্ষমতার মদমত্ততা ও তার সঙ্গে সম্পর্কিত দুর্নীতি এবং সন্ত্রাস দমন রক্ত পরীক্ষার মতো সম্পূর্ণ নিপ্রয়োজনীয় কোনো কর্মসূচির মাধ্যমে সম্ভব নয়। এ অবস্থার পরিবর্তন আজকের বাংলাদেশে কোনো সংস্কার বা সংস্কার আন্দোলনের মাধ্যমেও সম্ভব নয়। এটা একমাত্র সম্ভব বিদ্যমান সমাজ ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তনের মাধ্যমে। এ কারণে মাদকাসক্তির জন্য রক্ত পরীক্ষা নয়, সমাজ পরিবর্তনের জন্য প্রয়োজনীয় রাজনৈতিক আন্দোলন সংগঠিত করাই জনগণের সামনে এ মুহূর্তের সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ কর্তব্য।
সূত্রঃ আমার দেশ, ২২/০৪/১০]

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন