বৃহস্পতিবার, ১২ জানুয়ারী, ২০১২

জনগণ এখন শুধু সরকার পরিবর্তন নয় সমাজব্যবস্থার পরিবর্তন চান

বদরুদ্দীন উমর


বাংলাদেশের জনগণ আজ হাজারও সমস্যায় জর্জরিত ও বিক্ষুব্ধ। জনগণের ওপর, বিশেষত বিপুল অধিকাংশ শ্রমজীবী জনগণের ওপর শোষণ-নির্যাতন কোন নতুন ব্যাপার নয়। এমন কোন সময় এ অঞ্চলে দেখা যায়নি যখন এ অবস্থার কোন ব্যতিক্রম ছিল। ব্রিটিশ, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ আমলে এ দিক দিয়ে জনগণের জীবনযাত্রা ও জীবন সংগ্রামের একটা ধারাবাহিকতা আছে।

এর প্রক্রিয়ায় দীর্ঘদিন ধরে জনগণের মধ্যেও পরিবর্তনের একটা তাগিদ স্বাভাবিকভাবেই দেখা যাচ্ছে। জনগণের একটা ক্ষুদ্র অংশ সমগ্র সমাজব্যবস্থা পরিবর্তনের একটা তাগিদ অনুভব করলেও বিপুল অধিকাংশ মানুষই এই পরিবর্তন বলতে বুঝেছেন সরকার পরিবর্তন। বিদ্যমান সরকারের শোষণ-নিপীড়নের দ্বারা জর্জরিত হয়ে তারা মনে করেছেন, সেই সরকারের পরিবর্তন হলে অবস্থার কিছু পরিবর্তন হবে। কাজেই তারা নির্বাচনের মাধ্যমে এই পরিবর্তনের চেষ্টা করেছেন। এক সরকারের পরিবর্তে অন্য সরকার ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হলে তাদের ওপর শোষণ-নির্যাতনের কিছু কমতি হবে, এটা এমনভাবে তাদের বিশ্বাসের অংশে পরিণত হয়েছিল যে, বারবার নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে কোন সুফল না পাওয়া সত্ত্বেও তারা একই প্রত্যাশায় বুক বেঁধে ভোট দিয়ে এসেছেন।

সরকার পরিবর্তন সত্ত্বেও পরিস্থিতির পরিবর্তন না হওয়ায় তাদের মধ্যে এক ধরনের হতাশার সৃষ্টি হলেও তারা চিন্তাগত অভ্যাসের বশবর্তী হয়ে এর পরও নির্বাচনে ভোট দিয়ে এক দলের পরিবর্তে অন্য দলকে ক্ষমতায় বসিয়েছেন। এ অবস্থা ১৯৯৬ সাল থেকে দেখা গেছে। এর সর্বশেষ দৃষ্টান্ত হল ২০০৮ সালের ডিসেম্বরের নির্বাচন। বিএনপি ও বেনামি সামরিক সরকারের সাত বছরের শাসনকালে জনগণ যেভাবে বিপর্যস্ত জীবনযাপন করতে বাধ্য হয়েছিলেন, তার পরিবর্তনের জন্য তারা আওয়ামী লীগকে ভোট দেন। প্রতিবারের মতো এবারও নির্বাচনী দলগুলোর ভুয়া প্রতিশ্র“তির অভাব ছিল না। এর মধ্যে আওয়ামী লীগের প্রতিশ্র“তি ছিল সব থেকে রঙিন। সাত বছরের অন্য দলীয় শাসনের প্রতি বীতশ্রদ্ধ এবং আওয়ামী লীগের রঙিন প্রতিশ্র“তির দ্বারা মোহাবিষ্ট হয়ে জনগণ তাদের নির্বাচনে জিতিয়ে দেন।

এই বড় আকারের নির্বাচন বিজয়ের পর আওয়ামী লীগ শাসক শ্রেণীর কয়েকটি ছোটখাটো দলকে লেজে বেঁধে গঠন করে তাদের তথাকথিত মহাজোট সরকার। কিন্তু বিএনপি-জামায়াতের জোট সরকার এবং মইন-ফখরুদ্দীনের বেনামি সামরিক সরকারের শাসনের অবসান হলেও পরিস্থিতির কোন পরিবর্তন তো হল না, হওয়ার কথাও নয়। দেখা গেল, পূর্ববর্তী সময়ের মতো এবারও জনগণ বিভ্রান্ত ও প্রতারিত হয়েছেন। শুধু তাই নয়, এবারের মিথ্যা নির্বাচনী প্রতিশ্র“তি তাদের এমনভাবে বিভ্রান্ত ও প্রতারিত করেছে, যার পূর্ব দৃষ্টান্ত নেই। এর কারণ আওয়ামী লীগ এবার তাদের নির্বাচনী প্রতিশ্র“তি বড় আকারে এবং নানা বর্ণে রঞ্জিত করে জনগণের সামনে উপস্থিত করেছিল। এই বড় ও আকর্ষণীয় প্রতিশ্র“তি পালনের কোন লক্ষণই বর্তমান সরকারের মধ্যে না দেখে জনগণ অল্পদিনের ভেতরেই তাদের প্রতি মোহমুক্ত হয়েছেন, যা ইতিপূর্বে এত তাড়াতাড়ি কখনও দেখা যায়নি। মাত্র পনের-ষোল মাসের মধ্যেই বর্তমান সরকার নিজের লুণ্ঠনজীবী (চৎবফধঃড়ৎু) চরিত্র জনগণের সামনে এমনভাবে উšে§াচিত করেছে যা প্রতারিত হতে অভ্যস্ত বাংলাদেশের জনগণকে শুধু বিস্মিতই করেনি, তাদের চোখ খুলে দিয়েছে। এই সরকারের চুরি, দুর্নীতি, লুণ্ঠন ও তার সঙ্গে সন্ত্রাস যুক্ত হয়ে দেশে যে অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে ও যেভাবে করেছে, এটা আগে দেখা যায়নি।

এই নৈরাজ্য সৃষ্টির ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগ এক নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। নিজেদের মূল রাজনৈতিক দলের ক্ষমতার জোরে প্রথমদিকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোয় এবং পরে তার সঙ্গে সমাজের ব্যাপকতর ক্ষেত্রে চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, গুণ্ডামি, খুনখারাবি করে চারদিকে তারা এক ভয়াবহ বিশৃংখল পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে। এটা ঘটছে এমন অবস্থায়, যখন নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের অবাধ ও আকাশচুম্বী মূল্য বৃদ্ধি, কাজ ও মজুরির অভাব, কৃষি ও শিল্পক্ষেত্রে নৈরাজ্য, জীবন ও সম্পত্তির নিরাপত্তার অভাবে সাধারণ মানুষের জীবন অতিষ্ঠ রয়েছে।

সরকারের ছত্রছায়ায় ষোল মাস ছাত্রলীগ তাদের দুর্নীতি ও সন্ত্রাস চালিয়ে এখন এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে, যাতে চারদিকে এর বিরুদ্ধে জনমত প্রবল হয়েছে। এই প্রবল বিরুদ্ধ জনমত শেষ পর্যন্ত আওয়ামী সরকারকে তাদের ছাত্র সংগঠনটির বিরুদ্ধে কিছু পদক্ষেপ নেয়ার তোড়জোড় দেখাতে বাধ্য করেছে। তারা পুলিশকে এতদিনে হুকুম দিয়েছে বিশৃংখলা সৃষ্টিকারী ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিতে। কিন্তু এই হুকুম কতটুকু কার্যকর হবে, সেটা বোঝায় অসুবিধা নেই। কারণ এ ধরনের কাজ শুধু ছাত্রলীগই করছে তাই নয়, যুবলীগ, মহিলা লীগসহ তাদের রঙবেরঙের অনেক লীগই এ কাজ করছে। কাজেই এ দিক দিয়ে ছাত্রলীগের অবস্থা হয়েছে ‘সকল পক্ষী মৎস্যভক্ষী মৎস্যরাঙা কলঙ্কিনি’র মতো।

আওয়ামী লীগের দলীয় নেতাকর্মীরা তো আছেই, তার ওপর তাদের এমপি, উপজেলা চেয়ারম্যান, মেম্বর ইত্যাদি লোকরা বিভিন্ন স্তরে ‘গডফাদার’ নামক অপরাধী চক্রের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে এখন সর্বত্র সক্রিয়। বস্তুতপক্ষে ছাত্রলীগ তাদের রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের এই চক্রের পৃষ্ঠপোষকতাতেই এবং তাদের দুর্নীতি ও সন্ত্রাসের কাঠামোর মধ্য থেকেই নিজেরা দুর্নীতি ও সন্ত্রাস চালিয়ে যাচ্ছে। আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব এখন তাদের ছাত্র সংগঠন নিয়ন্ত্রণের জন্য হম্বিতম্বি করলেও ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা জানে, তাদের দলের নেতৃস্থানীয় লোকজন একই কাজ অবাধে ও বেপরোয়াভাবে চালিয়ে যাচ্ছে। শুধু চালিয়ে যাচ্ছে তাই নয়, এ কাজ থেকে তাদের বিরত রাখা কারও পক্ষে সম্ভব নয়। আওয়ামী লীগের রাজনীতি ও সংগঠন দুর্নীতি ও সন্ত্রাসের সঙ্গে এত ওতপ্রোতভাবে সম্পর্কিত যে, এই দলকে এ দুই থেকে বিযুক্ত করার চেষ্টার অর্থ হল তাকে ভেঙে ফেলা। কে চায় নিজেদের দলকে নিজেরাই ভেঙে ফেলতে?

মাত্র ক’দিন আগে বিএনপির রাজশাহী সমাবেশে বিভিন্ন এলাকা থেকে সেখানে যাওয়ার পথে কিভাবে আওয়ামী লীগের গুণ্ডাপাণ্ডারা তাদের ওপর আক্রমণ চালিয়ে খুন-জখম করছে, তার বিবরণ সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে। বিএনপি জনস্বার্থের প্রতিনিধি নয়, তাদের মধ্যেও দুর্নীতি, প্রতারণা, সন্ত্রাস ইত্যাদির অভাব নেই। তারা আওয়ামী লীগের শ্রেণী ভাই। তা সত্ত্বেও দলীয় স্বার্থে আওয়ামী লীগ তাদের ওপর যে হামলা চালাচ্ছে, তাতে তার ফ্যাসিস্ট চরিত্র স্পষ্ট। এই সরকার যে শুধু তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী শ্রেণী দলকেই আক্রমণ করছে তা নয়। তারা আরও কঠোরভাবে নানা কায়দায় তাদের হামলা পরিচালনা করছে প্রগতিশীল সংগঠনের ওপর। তাদের সভা, সমাবেশ, মিছিলের ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করে এবং পুলিশি হামলা চালিয়ে তাদের শ্বাসরুদ্ধ করছে।

কাজেই ছাত্রলীগের বর্তমান সন্ত্রাসী তৎপরতাকে আওয়ামী লীগের এই নীতি ও তৎপরতা থেকে বিচ্ছিন্নভাবে দেখার চেষ্টা অবাস্তব। ঠিক একই কারণে ছাত্রলীগ দমনের জন্য তাদের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের কঠোর হওয়ার হুমকি যে তাদের প্রতারণার আর একটি দৃষ্টান্ত, এতে সন্দেহ নেই। তাদের এখন বাধ্য হয়ে এ কাজ করতে হলেও এর দ্বারা পরিস্থিতি সামাল দেয়ার কোন সম্ভাবনা তাদের নেই। যে রোগ দ্বারা আওয়ামী লীগ সর্বস্তরে নিজেরাই আক্রান্ত, ছাত্রলীগের সেই একই রোগ তারা সারাবে কিভাবে?

বর্তমান সরকারের ক্ষমতাসীন হওয়ার ষোল মাসের মধ্যেই জনগণ এখন পরিবর্তনের বিষয়ে নতুনভাবে চিন্তা-ভাবনা করছেন। ‘যে যায় লঙ্কায় সেই হয় রাবণ’Ñ এই চলতি কথার সারমর্ম এখন তারা উপলব্ধি করছেন। এক্ষেত্রে লঙ্কায় যাওয়ার অর্থ হল নির্বাচনের মাধ্যমে সরকারের গদিতে বসা।
আওয়ামী লীগ, বিএনপিসহ শাসক শ্রেণীর সব দলের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড, শোষণ, নির্যাতন ও প্রতারক চরিত্র জনগণ এখন গভীরভাবে উপলব্ধি করছেন। এই উপলব্ধি চিন্তার ক্ষেত্রে তাদের এমন জায়গায় এনে দাঁড় করিয়েছে, যাতে তারা এখন আর শুধু সরকার পরিবর্তনের মধ্যে আশার ক্ষীণতম আলোও দেখেন না। তারা এ বিষয়ে নিশ্চিত যে, ভোট দিয়ে সরকার পরিবর্তনের মাধ্যমে তাদের জীবনের কোন সমস্যার সমাধানই সম্ভব নয়। এজন্য প্রয়োজন বিদ্যমান সমাজব্যবস্থা ও শাসন কাঠামোর আমূল পরিবর্তন। এই পরিবর্তন কিভাবে ঘটবে এবং কারা এই পরিবর্তন ঘটাবে, এ বিষয়ে তাদের স্পষ্ট ধারণা এখনও না থাকলেও এই পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তার বিষয়ে তারা নিঃসন্দেহ এবং এর তাগিদ তারা অনুভব করছেন। তাদের চেতনার এই পরিবর্তন যে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির এক বড় ধরনের ইতিবাচক দিক এ বিষয়ে কোন সংশয় নেই।
[সূত্রঃ যুগান্তর, ০৯/০৫/১০]

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন