বৃহস্পতিবার, ১২ জানুয়ারী, ২০১২

জনগণকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলনের চক্রান্ত

বদরুদ্দীন উমর


বর্তমান সরকারের কাছে যা প্রত্যাশিত অবশেষে তা-ই হয়েছে। জনগণের স্বার্থ, তাদের ভিটেমাটি, আবাদি জমি সবকিছুকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে তারা ঠিক করেছে বড়পুকুরিয়া ও ফুলবাড়ীতে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলন করবে। ফুলবাড়ী থেকে এশিয়া এনার্জিকে জনগণ আন্দোলনের মাধ্যমে বিতাড়িত করার পর তারা এ দেশ থেকে চলে যায়নি। তারা ঢাকায় বসেই নানা চক্রান্তে লিপ্ত ছিল। কারণ তারা বাংলাদেশের শাসকশ্রেণীর এবং তাদের ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল ও আমলাদের চরিত্র ভালোভাবেই জানে। তারা জানে কিভাবে এসব সরকারি দলের নেতা-নেত্রীকে এবং আমলাদের বশ করে নিজেদের স্বার্থ উদ্ধার করতে হয়। তাদের এই জানাশোনার ভিত্তিতে তারা এটা ধরে রেখেছিল যে তাদের বিরুদ্ধে যতই আন্দোলন হোক, সরকার তাদের পক্ষে, সে সরকার বিএনপির হোক অথবা হোক আওয়ামী লীগের। এদিক দিয়ে তাদের কোনো অসুবিধা নেই। তাদের অসুবিধা শুধু জনগণের প্রতিরোধ নিয়ে। মনে হয় এখন তারা কিছুটা নিশ্চিন্ত হয়েছে যে তারা আবার ফুলবাড়ীতে ফিরতে পারবে বিশেষ কোনো প্রতিরোধ ছাড়াই।

কিন্তু শুধু ফুলবাড়ীতেই নয়, বড়পুকুরিয়ায়ও তারা উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। এই সিদ্ধান্ত যেভাবে ঘোষিত হয়েছে সেটা আকস্মিক মনে হলেও এর জন্য এক বছর ধরে সরকার এবং সংশ্লিষ্ট মহলের মধ্যে অনেক চক্রান্তমূলক আলাপ-আলোচনা হয়েছে, অনেক লেনদেন, ভাগবাটোয়ারার হিসাব কষা হয়েছে। এসব চক্রান্তমূলক আলোচনা ও হিসাব-নিকাশ শেষে এখন সরকার ঘোষণা করেছে যে তারা বড়পুকুরিয়া ও ফুলবাড়ী উভয় জায়গায়ই উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলন করবে।

এ প্রসঙ্গে ঠিক বছরখানেক আগের এক গোলটেবিল বৈঠকের কথা বলা দরকার। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর কয়েকজন অনাবাসী জ্বালানিবিশেষজ্ঞ ও সরকারি কর্মকর্তারা যমুনা রিসোর্টে এ বৈঠক করেন। তাতে যোগদানকারীদের মধ্যে একজন হলেন মহম্মদ খলিকুজ্জামান। তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের লক হাভেন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন। The Quarry Quardary নামে তাঁর একটি প্রবন্ধ আজ (১.৬.২০১০) Daily Star পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। তাতে তিনি বলেছেন, ১৫-১৮ জুন, ২০০৯ সালে অনুষ্ঠিত সেই গোলটেবিল বৈঠকে তিনিসহ আটজন অনাবাসী বিশেষজ্ঞ উপস্থিত ছিলেন। এ ছাড়া তাতে উপস্থিত ছিলেন জ্বালানি উপদেষ্টা তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী, দুজন প্রতিমন্ত্রী শামসুল হক টুকু ও মুস্তাফিজুর রহমান, জ্বালানি সেক্রেটারি মহম্মদ মহসীন, পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান হোসেন মনসুর এবং উত্তরবঙ্গের কয়েকজন সংসদ সদস্য।
সরকার কর্তৃক আয়োজিত এই বৈঠকে প্রস্তাবিত কয়লানীতি এবং কয়লা উত্তোলন বিষয়ে আলোচনা হয়। প্রকাশিত কয়লানীতি এবং কয়লা উত্তোলন পদ্ধতি নিয়ে অনাবাসী জ্বালানিবিশেষজ্ঞদের মধ্যে মতানৈক্য হলেও কতগুলো সুপারিশের ব্যাপারে সব অংশগ্রহণকারীই একমত হন। গোলটেবিল বৈঠক শেষে যমুনা রিসোর্টে ১৮ জুন, ২০০৯ এক সংবাদ সম্মেলনে এই সুপারিশগুলোর বিবরণ প্রকাশ করা হয়। মহম্মদ খলিকুজ্জামান তাঁর উলি্লখিত প্রবন্ধে বলেন, সে সময় মনে হয়েছিল অনাবাসী বিশেষজ্ঞ গ্রুপ যেসব সুপারিশ করেছে সেগুলো সরকার কর্তৃক বিবেচিত হবে। কিন্তু পরে দেখা গেল তা হয়নি। এ বছর ২৬ মে Energy Bangla নামে পত্রিকায় খবর প্রকাশিত হয়েছে, সরকার বড়পুকুরিয়া ও ফুলবাড়ীতে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। এই পত্রিকাটি হলো এশিয়া এনার্জির কয়লা উত্তোলন সম্পর্কিত প্রস্তাবের সমর্থক। এদের কাছে সরকারের এই সিদ্ধান্তের খবর আগেভাগেই কিভাবে পেঁৗছাল সেটা এক বড় প্রশ্ন।

এখানে উল্লেখ করা দরকার যে কিছুদিন আগে কয়েকজন উচ্চপর্যায়ের সরকারি কর্মকর্তা জার্মানি সফর করেন সেখানে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলন দেখার জন্য। পত্রিকার রিপোর্ট অনুযায়ী এই সফরের ব্যবস্থা ও ব্যয় বহন করে এশিয়া এনার্জি করপোরেশন (AEC, এখন নাম পরিবর্তন করে হয়েছে GCM)। যাদের উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলনের প্রস্তাব ও প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে ফুলবাড়ীতে এলাকার জনগণ প্রবল আন্দোলন করল, যাদের এই প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে অন্যত্রও আন্দোলন হলো, অনেক লেখালেখি হলো এবং এসবের পরিণতিতে ফুলবাড়ী থেকে এশিয়া এনার্জি কম্পানি বিতাড়িত হলো, তাদেরই টাকায় সরকারি কর্মকর্তারা উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলনের জন্য জার্মানি সফর কিভাবে করলেন? এটা কী ধরনের নৈতিক বিবেচনা এবং গণতান্ত্রিক রীতি অনুযায়ী সম্ভব এটা বোঝার উপায় নেই। শুধু তাই নয়, এর মতো ন্যক্কারজনক ব্যাপার এ ধরনের নীতিনির্ধারণের ক্ষেত্রে আর কী হতে পারে? কিন্তু বাংলাদেশ এক বিচিত্র ভূমি। এখানে দুর্নীতিবাজরা করতে পারে না এমন কাজ নেই।

যে সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ কম্পানি নিজেরা আমাদের দেশে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলনের প্রস্তাবক ও চক্রান্তকারী এবং ঘোষিতভাবে এই পদ্ধতির পক্ষে, তারা যখন সরকারি কর্মকর্তাদের অন্য দেশে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলন দেখে আসার জন্য নিজেদের ব্যয়ে সফরের ব্যবস্থা করে, তখন তার অর্থ বোঝার অসুবিধা কার হতে পারে? যেখানে কয়লা উত্তোলন পদ্ধতি নিয়ে দেশজুড়ে বিতর্ক তো চলছেই, উপরন্তু এ নিয়ে এশিয়া এনার্জির বিরোধিতা হচ্ছে রাজনৈতিভাবে, সেখানে এই বিতর্কের এক পক্ষের পয়সায় সরকারি কর্মকর্তাদের সফর করার অর্থ হলো সেই পক্ষের নুন খেয়ে নিমক হারামি করা ছাড়া আর কি? এই নিমক হারামিই তাঁরা করেছেন। শুধু তাঁরাই নয়, বাংলাদেশের মন্ত্রিসভাও এখন এশিয়া এনার্জি এবং উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলনের পক্ষে। গত বছর জুন মাসে অনাবাসী জ্বালানি বিশেষজ্ঞরাসহ সরকারি কর্মকর্তারা মিলে কয়লা উত্তোলনের ব্যাপারে যেসব বিষয়ে একমত হয়েছিলেন, তাতে কোনো বিশেষ পদ্ধতিকে অগ্রাধিকার না দিয়ে এমন পদ্ধতি অনুসরণের কথা ছিল, যাতে নির্দিষ্ট কোনো কয়লাক্ষেত্রে ভূতাত্তি্বক, পানি-ভূতাত্তি্বক, পরিবেশ ও আর্থসামাজিক অবস্থার হিসাব করে পদ্ধতি নির্ধারণের কথা ছিল। কিন্তু এক বছর ধরে এসব নিয়ে কোনো আলোচনা ও কথাবার্তার মধ্যে না গিয়ে হঠাৎ বড়পুকুরিয়া ও ফুলবাড়ী দুই ক্ষেত্রেই উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলনের সরকারি সিদ্ধান্ত আপাতদৃষ্টিতে এক রহস্যজনক ব্যাপার। কিন্তু বাংলাদেশে যেভাবে এসব কাজ হয় তা অজানা নয়। এর মধ্যে প্রকৃতপক্ষে কোনো রহস্য নেই। যেভাবে এশিয়া এনার্জি সরকারি কর্মকর্তাদের উন্মুক্ত কয়লা উত্তোলন দেখে আশার জন্য খরচার জোগান দিয়েছে তার মধ্যেই এই রহস্যের ঠিকানা আছে।

সরকারের এটা মনে রাখা অবশ্য কর্তব্য যে জনগণ তাদের ভোট দিয়ে দেশের সম্পদের মালিক করেনি, তারা তাঁদের ওপর দায়িত্ব অর্পণ করেছেন জনগণের সম্পদের রক্ষণাবেক্ষণ, সমৃদ্ধি ও সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার জন্য। কিন্তু ক্ষমতার গদিতে বসে সরকার ও তাদের আমলারা যে এর উল্টো কাজই সর্বত্র করে চলেছেন, এটা এক খোলাখুলি ব্যাপার। জ্বালানি মন্ত্রণালয়ে কিছু দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা ও সরকারের নিজস্ব লোকজন কয়লা উত্তোলন নিয়ে চক্রান্তমূলকভাবে যা শুরু করতে যাচ্ছে তার গণবিরোধী, দেশবিরোধী ও সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থ তোষণকারী চরিত্র বিষয়ে কোনো সংশয় নেই। তাদের এটা মনে রাখা দরকার যে দেশের সব সম্পদ, মাটির ওপরের ও নিচের সব সম্পদের মালিক জনগণ। সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থের সঙ্গে যোগসাজশ ও চক্রান্ত করে দেশি-বিদেশি গণবিরোধী স্বার্থ কর্তৃক এই সম্পদ লুটপাট বন্ধ আবেদন-নিবেদনের মাধ্যমে সম্ভব নয়। সরকার যেমন নিজেদের ক্ষমতার মোহে জনগণের সম্পদ এভাবে লুটপাট করতে এবং এ কাজ করতে গিয়ে এলাকার জনগণের জীবনে বিপর্যয় সৃষ্টি করতে উদ্যত হয়েছে, তেমনি জনগণ এই শত্রুতা প্রতিরোধের জন্য নিজেদের শক্তিকে সংগঠিত এবং ঐক্যবদ্ধ করবে। এর থেকে প্রমাণ হচ্ছে যে নির্বাচনে ভোট দিয়ে যাদের জনপ্রতিনিধি হিসেবে পাঠানো হয় তাঁরা প্রকৃত জনপ্রতিনিধি নন, জনগণের স্বার্থ তাঁরা দেখেন না। উপরন্তু ক্ষমতায় বসে জনগণের সঙ্গে শত্রুতা করাই হলো তাদের কাজ। এ শত্রুতার মোকাবিলা জনগণ সব সময়ই নিজেদের আন্দোলনের মাধ্যমে করেছে। বড়পুকুরিয়া ও ফুলবাড়ীতে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলনের উদ্যোগের মাধ্যমে সরকার জনগণের সম্পত্তি অপহরণ ও জীবনে বিপর্যয় সৃষ্টির জন্য যে নীতির ঘোষণা দিয়েছে, জনগণ নিজেদের ঐক্যবদ্ধ ও সংগঠিত আন্দোলনের মাধ্যমেই তাকে পরাজিত করবে। এ ছাড়া বড়পুকুরিয়া ও ফুলবাড়ীর জনগণের সামনে দ্বিতীয় পথ আর কোনো খোলা নেই।
[সূত্রঃ কালের কণ্ঠ, ০৩/০৬/১০]

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন